ফিরে_আসা২ ২৭ লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

0
383

#ফিরে_আসা২
২৭
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

অন্যমনস্কভাবে জানালার বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে অরা। মিনিট দশেক হলো গাড়ি প্রবেশ করেছে ঢাকায়। কালিয়াকৈরে যাওয়ার সময়ে পুরোটা পথ ঘুমিয়ে কাটিয়েছে অরা। তবে আজ ঠিক উল্টো চিত্র। ঘুমের নামগন্ধ নেই দুটো চোখে। কাল রাতেও ভালো ঘুম হয়নি। ভোর রাতে চোখদুটো লেগে এলেও ভাঙা ভাঙা স্বপ্ন দেখে উঠে যায় সে।

ঘুমটা এই মুহূর্তে মুখ্য নয়। পৃথিবীর কোনোকিছুই মুখ্য নয়। একটি প্রশ্নের উত্তর ছাড়া। কেন? আরশাদ কেন তার ঘরে স্পাই ক্যামেরা লুকিয়ে রাখতে গেল? অরার মনের একটা অংশ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করছে এই কাজ আরশাদ করেনি। হোটেলের লোকজন মিথ্যা বলেছে তাকে। হয়তো এর পেছনে অন্য কেউ আছে। তবে মনের আরেক অংশ মনে করছে, হোটেলের লোকেরা মিথ্যা বলছে না। তবে কেন? আরশাদ কেন এমন কাজ করতে যাবে? হতাশায় মাথা চেপে ধরলো অরা। বাড়িতে পৌঁছানো না পর্যন্ত তার শান্তি নেই।

“আপনি ঠিক আছেন অরা?” চিন্তিত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন ডক্টর নাসরিন।

অরা জোরপূর্বক ঠোঁটে একটা কৃত্রিম হাসি টেনে এনে বলল, “হ্যাঁ ডক্টর, আমি ঠিক আছি।”

“আপনাকে দেখে বেশ চিন্তিত বলে মনে হচ্ছে।”

অরা হালকা গলায় বলল, “তেমন কিছু না। আসলে আমি একটু টায়ার্ড, তাই হয়তো এমনটা মনে হচ্ছে।”

অজুহাত দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই অরার কাছে। যে সত্যির মুখোমুখি সে হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেই সত্যি পৃথিবীর কাউকে জানানো যায় না। অরার স্বামী, তার সবথেকে ভালোবাসার মানুষটা কেন তারই ঘরে স্পাই ক্যামেরা লুকিয়ে রাখবে?

হ্যান্ডব্যাগের মধ্যে পড়ে থাকা মোবাইলটা বেজে উঠলো। হ্যান্ডব্যাগ খুলে মোবাইল বের করার প্রয়োজন মনে করলো না অরা। খুব ভালো করেই সে জানে কে ফোন করেছে তাকে, আরশাদ। গত রাত থেকে অসংখ্যবার আরশাদ কল করেছে অরাকে। একবারও সেই কল রিসিভ করেনি অরা। অচেনা এক অভিমান আঁকড়ে ধরেছে তাকে।

মুঠোর মধ্যে থাকা জিনিসটাকে আরও শক্ত করে চেপে ধরলো অরা। যাত্রার শুরু থেকেই সেই স্পাই ক্যামেরা অরার মুঠোয় বন্দী। আরশাদ না-কি আজ শুটিংয়ে যায় নি। হুট করে সকালবেলা শুটিং প্যাকআপ করেছে সে। ভালোই হলো, বাড়ি পৌঁছেই এই ক্যামেরার বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বলা যাবে।

গাড়িটা বাড়ির সামনে এসে থামলো দুপুর নাগাদ। অন্যান্য দিনের মতোই সাধারণ একটা দিন। মাথার ওপরে মিষ্টি একটা রোদ। দুজন মালী তার বাড়ির সামনের বিশাল বাগানের যত্ন নিচ্ছে। মূল দরজার সামনে সিকিউরিটি গার্ডরা নিজেদের মধ্যে আড্ডা দিচ্ছে। সবকিছু স্বাভাবিক থাকলেও, স্বাভাবিক নেই অরা। তার সমস্ত চিন্তাভাবনা যেন এক জায়গাতেই আটকে রয়েছে।

গাড়ি থেকে নেমে এক মুহূর্তও অপেক্ষা করলো না অরা। দ্রুত পায়ে প্রবেশ করলো বাড়ির ভেতরে। দরজার সামনেই একজন স্টাফকে পাওয়া গেল।

অরা ব্যস্ত ভঙ্গিমায় তাকে জিজ্ঞেস করলো, “তোমার স্যার কোথায়?”

“লাইব্রেরিতে ম্যাম।”

লম্বা লম্বা পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেল অরা। কাল রাত থেকে যে প্রশ্নগুলো তার মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে, সেগুলোকে আর ধরে রাখতে পারছে না নিজের মাঝে। উত্তরগুলো জানা খুবই জরুরি হয়ে উঠেছে।

লাইব্রেরি ঘরের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই অরা দেখলো, সোফার ওপর পা তুলে বসে মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছে আরশাদ। দিন কয়েকের দূরত্বের পর আবার যখন তাদের দেখা হয়, অরা তখন কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে আরশাদকে। নিজেদের বন্দী করে রাখে আরশাদের বাহুডোরে। দিন কয়েকের দূরত্বের পর আজ তাদের দেখা হয়েছে ঠিকই, তবে আরশাদের বাহুডোরে নিজেকে বন্দী করার মতো পরিস্থিতি আজ নেই।

অরা থমথমে ভঙ্গিতে আরশাদের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে হাতের মুঠো থেকে সেই স্পাই ক্যামেরা বের করে এনে তার সামনে মেলে ধরলো বলল, “এসবের মানে কী আরশাদ?”

বইয়ের মাঝে আরশাদ এতটাই ডুবে গিয়েছিল যে এতটা সময় অরার উপস্থিতি টেরই পায়নি। অরার কণ্ঠে সংবিৎ ফিরে পেয়ে বই রেখে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “Finally! এত দেরি হলো কেন? রাস্তায় অনেক জ্যাম ছিল না? অনেক টেনশন করছিলাম। টেনশনে আজকের শুটিংই প্যাকআপ করে ফেলেছি।”

অবাক হয়ে আরশাদের দিকে তাকিয়ে রইলো অরা। ক্যামেরার বিষয়টা একেবারেই এড়িয়ে যাচ্ছে সে? এত বড় একটা ঘটনা অরার সামনে এলো, অথচ সে পাত্তাই দিচ্ছে না?

অরা আবারও একই প্রশ্ন করলো, “এসবের মানে কী?”

আরশাদ এবারও এড়িয়ে গেল তার প্রশ্ন। উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “কাল রাত থেকে আমার কল রিসিভ করছো না কেন তুমি? জানো কতটা টেনশনে ছিলাম?”

আরশাদ বারবার ক্যামেরার বিষয়টা এড়িয়ে যাচ্ছে কেন? তার মানে অরার ধারণা ভুল? সে তো শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বিশ্বাস করে গেছে আরশাদকে। তার ধারণা ছিল হোটেলের লোকজন মিথ্যা বলছে। কিংবা অন্য কেউ ক্যামেরা ফিট করিয়ে আরশাদের নামে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। তেমনটা হলে তো এই ক্যামেরা দেখেই তার চমকে ওঠার কথা ছিল? কিন্তু না, শান্ত ভঙ্গিতে সুকৌশলে পুরো ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে আরশাদ। তার মানে অন্য কেউ নয়, এই ক্যামেরা তার ঘরে লুকিয়ে রেখেছিল খোদ আরশাদই?

অরা সন্দেহযুক্ত গলায় বলল, “কথা ঘোরানোর চেষ্টা করবে না আরশাদ। আমার হোটেল রুমে আমি এই স্পাই ক্যামেরা খুঁজে পেয়েছি, আর আমি খুব ভালো করেই জেনে গেছি এটা তোমার কাজ। কী হচ্ছে এসব?”

আরশাদ এগিয়ে এসে ক্যামেরাটা অরার হাত থেকে নিয়ে হালকা গলায় বলল, “এটা তুমি নিয়ে আসতে গেলে কেন? শুটিংয়ে কাজে লাগতে পারতো তো!”

অরা এবার ধৈর্যহারা হয়ে উঠলো। তার ওপরে আরশাদের এই শান্ত ভঙ্গিতে তার রাগের আগুনে ঘি ঢালার কাজ করলো।

নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হয়ে অরা চিৎকার করে বলল, “Answer me damn it!”

কয়েক মুহূর্তের জন্যে নীরবতার হাওয়া কেটে গেল ঘরজুড়ে। নীরবতার মাঝে আরশাদের সঙ্গে অনেক সময় কাটিয়েছে অরা। তার সঙ্গে নীরবতায় কাটানো প্রতিটা মুহূর্তই পরম শান্তিময়। আজকের এই মুহূর্তটা বাদে। আজ এই নীরবতা যেন বড় অসহনীয় হয়ে উঠেছে। অরা উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছে কখন নীরবতা কেটে যাবে। কখন আরশাদ মুখ খুলবে আর কখন সে তার কাঙ্ক্ষিত প্রশ্নের উত্তর পাবে।

ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরশাদ বলল, “আমার তোমাকে দেখতে ইচ্ছা করছিল।”

অরা অবিশ্বাসে তাকিয়ে রইলো আরশাদের দিকে। একেবারেই অবিশ্বাস্য একটা উত্তর। এর আগেও তো তারা দূরে দূরে থেকেছে। আরও লম্বা সময়ের জন্যে দূরে থেকেছে। তখনও তাকে দেখতে ইচ্ছা হয়েছিল আরশাদের। কিন্তু কোনোবারই তো তার ঘরে স্পাই ক্যামেরা লুকিয়ে রাখার প্রয়োজন বোধ করেনি আরশাদ। তবে এবার কেন?

অরা ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, “আরশাদ আমাকে বোকা মনে করবে না। দেখতে ইচ্ছা করলে ভিডিও কল করতে পারতে। হোটেলের স্টাফ দিয়ে আমার অজান্তে আমার ঘর এই স্পাই ক্যামেরা লুকিয়ে রাখতে না।”

আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “ভিডিও কলে তো সার্বক্ষণিক দেখার সুযোগ নেই। আমার তোমাকে সবসময় দেখতে ইচ্ছা করছিল।”

অরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আচ্ছা, মানলাম সবসময় দেখতে ইচ্ছা করছিল। তাহলে ক্যামেরার ব্যাপারটা আমাকে জানালে কী হতো?”

আরশাদ গম্ভীর গলায় “এখন যা হচ্ছে তা অভয়েড করার জন্যে জানাইনি?”

অরা বিভ্রান্ত গলায় বলল, “এখন যা হচ্ছে মানে? এখন কী হচ্ছে?”

“তুমি অকারণে সিনক্রিয়েট করছো।”

অরা হতবাক গলায় বলল, “আমি অকারণে সিনক্রিয়েট করছি? আরশাদ আমার রুমে তুমি একটা স্পাই ক্যামেরা লুকিয়ে রেখেছিলে, আমার পারমিশন ছাড়া।”

আরশাদ বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, “এখানে তোমার পারমিশন নিতে হবে কেন?”

অরা জোর গলায় বলল, “তুমি খুব ভালো করেই জানো কেন পারমিশন নিতে হবে। আমার রুম আমার পার্সোনাল এরিয়া। তুমি চাইলেই পার্সোনাল এরিয়ায় আমার ভিডিও করতে পারো না। রুমের মধ্যে মানুষ ফর্মালি থাকে না। আমার জামাকাপড়ের ঠিক থাকে না, আমি কতবার চেঞ্জ করেছি! আর সেগুলো তুমি ভিডিও করেছো।”

আরশাদ আত্মপক্ষ সমর্থনের সুরে বলল, “তো সমস্যা কোথায়? সেই ভিডিও আমি ছাড়া কেউ তো দেখেনি।”

“তোমার ফোন থেকে ভিডিও অন্য কোথাও চলেও তো যেতে পারে।”

আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “অন্য কোথায় যাবে? তোমার পার্সোনাল ভিডিও আমি এখনো ফোনে রেখে দিয়েছি না-কি? সাথে সাথে ডিলিট করে দিয়েছি।”

মোবাইলে ব্যক্তিগত এমন কোনো ছবি বা ভিডিও থাকা মোটেই নিরাপদ নয়। আমরা তো ভাবি একটা ডিলিট বাটনে চাপ পড়লেই বুঝি সেই ছবি বা ভিডিও চিরতরে পৃথিবী থেকে হারিয়ে যায়। তবে বাস্তবে তেমনটা হয় না। ডিলিট হওয়ার পরও তা থেকে যায় ফোনের কোনো এক অংশে।

পৃথিবীতে কোনোকিছুই তো নিশ্চয়তা নেই। কড়া নিরাপত্তার মাঝে থাকা সত্ত্বেও আরশাদের এই ফোন তার কাছ থেকে চুরি হয়ে যেতে পারে। কিংবা তার ফোন কেউ কোনো দক্ষ হ্যাকার হ্যাকও করে ফেলতে পারে। আরশাদের ফোন চুরি বা হ্যাক হওয়ার অর্থ অন্য কারো কাছে অরার ভিডিও পৌঁছে যাওয়া। যা অরা দুঃস্বপ্নেও চায় না। তার রাগের মূল কারণ এটাই। কিন্তু আরশাদ তো বুঝতেই চাইছে না!

অরা ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “তবুও কেন রেকর্ড করবে?”

“আমি এখনো বুঝতে পারছি না এখানে সমস্যা কোথায়?”

“আমার সমস্যা আছে!”

“তুমি আমার ওয়াইফ অরা। আমি তো অন্য কারো ঘরে ক্যামেরা রাখিনি, তোমার ঘরে রেখেছি।”

অরা দৃঢ়কণ্ঠে বলল, “আমি তোমার ওয়াইফ হোই আর যেই হোই না কেন, তুমি সেটা পারো না আরশাদ। আমার প্রাইভেসি বলে তো একটা কথা আছে না-কি? রুমের মধ্যে আমি একা যেকোনো অবস্থায় থাকতে পারি!”

অনেকটা সময় নিজেকে ধরে রাখার চেষ্টা করেছে আরশাদ। আর সম্ভব হলো না তার পক্ষে। তার মনে যে অবিশ্বাসের উঁকিঝুঁকি তা আর গোপন করে রাখতে পারলো না অরার কাছ থেকে।

আরশাদ অধৈর্য হয়ে বলল, “একাই তো ছিলে। সাথে অন্য কেউ তো আর ছিল না।”

চোখ বড় বড় আরশাদের দিকে তাকিয়ে রইল অরা। বুকে বড়সর ধাক্কার মতো খেল। মনে হচ্ছে পৃথিবীটা যেন নিমিষেই থেমে গেছে। মনের মাঝে একই সাথে হাজারো অনুভূতি ঘোরাফেরা করছে। একই সঙ্গে রাগ, বিস্ময়, হতাশা ঘিরে ধরলো তাকে।

অরা কাঁপা কাঁপা স্বরে ভীত ভঙ্গিতে বলল, “আরশাদ! ডোন্ট টেল মি তুমি আমাকে সন্দেহ করো।”

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে আরশাদ শীতল গলায় বলল, “সন্দেহ করি না কিন্তু এখন তোমার কথাবার্তার সন্দেহ করতে বাধ্য হচ্ছি।”

“মানে?”

“মানে বুঝতে পারছো না?”

“না পারছি না।”

আরশাদ জিজ্ঞাসাবাদের ভঙ্গিতে বলল, “স্পাই ক্যামেরা খুঁজে পেয়ে এত রিয়্যাক্ট করছো কেন তুমি? শুধুমাত্র তোমার পার্সোনাল ভিডিও রেকর্ড করেছি বলে? আর সেই ভিডিও অন্য কোথাও চলে যেতে পারে এই ভয়ে?”

অরা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, “হ্যাঁ! আর কী কারণ থাকবে?”

আরশাদ অবিশ্বাসের সুরে বলল, “না। শুধুমাত্র এই কারণে তো কারও এত রিয়্যাক্ট করার কথা না। আমার কী মনে হচ্ছে জানো?”

“কী?”

আরশাদ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “ওই রাতে তোমার ঘরে কারোর আসার প্ল্যান ছিল। আমার স্পাই ক্যামেরা খুঁজে পাওয়ায় তুমি সতর্ক হয়ে যাও আর তোমার প্ল্যানটাও ভেস্তে যায়। সেজন্যেই এত রিয়্যাক্ট করছো, তাই না?”

অরা উচ্চ স্বরে বলল, “আরশাদ!”

এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে শরীরের সমস্ত জোর যেন হারিয়ে ফেলেছে অরা। মনের জোরটাও এই মুহূর্তে হারিয়ে ফেলল। ধপ করে বসে পড়লো সোফার ওপরে। আরশাদ তার মানে তাকে সন্দেহ করছে? শুধুমাত্র সন্দেহই নয়, আরশাদ তো রীতিমত দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করছে অরা অন্য কারোও সঙ্গে… বাকিটা আর ভাবতে পারলো না অরা। তার গা গুলিয়ে উঠছে।

চোখ তুলে অসহায় দৃষ্টিতে আরশাদের দিকে তাকালো অরা। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা কে? আসলেই তার আরশাদ? না-কি আরশাদের রূপধারী অন্য কেউ? এতকাল যে মানুষটাকে সে চিনে এসে, আজ মুহূর্তের মধ্যেই সেই মানুষটা অচেনা হয়ে উঠলো।

অরাকে দমে যেতে দেখে আরশাদ বলল, “এত গায়ে লাগলো কেন কথাটা? সত্যিই এমন প্ল্যান ছিল না-কি?”

অরা আবারও উঠে দাঁড়িয়ে তেজী ভঙ্গিতে বলল, “যে মানুষটা দুদিন পর তোমাকে বাচ্চার মা হবে তাকে এত বড় অপমান কী করে করতে পারলে তুমি?”

বিরক্তিতে গা জ্বলে গেল আরশাদের। তার মনে গেল নওশীনের কথা। নওশীন তো ঠিক এভাবেই নিজের দোষগুলো ঢাকার জন্যে ওই একটা পরিচয়কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতো। আরশাদের বাচ্চার মায়ের পরিচয়। অরাও ঠিক একই কাজ করছে। তার মানে নওশীন আর তার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।

আরশাদ বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, “কথায় কথায় বাচ্চার মায়ের কার্ড প্লে করবে না তো!”

অরা আর্তনাদ করে বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে। যে মানুষটা তোমার বিয়ে করা বউ, যাকে তুমি ভালোবাসো, যে মুখ দিয়ে ভালোবাসি বলো সেই মুখ দিয়েই ওরকম নোংরা একটা কথা কী করে বলতে পারলে? বলার পর বিন্দুমাত্র রিগ্রেটও নেই তোমার মধ্যে।”

অরা কাঁদতে চাইছে না। ভেঙে পড়তে চাইছে না। কিন্তু কথাগুলো বলতে গিয়ে তার চোখদুটো বেয়ে অঝোরে জল গড়িয়ে পড়লো।
যে আরশাদ অরার চোখে একবিন্দু জল দেখলেও ব্যস্ত হয়ে যায় সেই জল মুছে দিতে, আজ অরার কান্না সেই আরশাদের মনে বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলতে পারছে না। এই একদিনের মধ্যে কী এমন হলো, যা এতটা বদলে দিয়েছে আরশাদকে?

আরশাদ বিন্দুমাত্র সংকোচ না করে বলল, “আমার বলা নোংরা কথাগুলো মিথ্যা হলে তো তোমার এতটা গায়ে লাগতো না।”

দুহাত দিয়ে মাথা চেপে ধরলো অরা। সে প্রাণপণ বিশ্বাস করতে চাইছে, তার সঙ্গে যা ঘটছে তা বাস্তব নয়। তার দেখা আর দশটা দুঃস্বপ্নের মতো, এই মুহূর্তটাও কোনো এক দুঃস্বপ্নের অংশ।

একটা মেয়ের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা তার জন্যে সবথেকে আঘাতের, সবথেকে অপমানের। আর সেই অপমানটা যদি তারই সবথেকে কাছের মানুষটা করে! তার তো বেঁচে থাকার সকল ইচ্ছাই ফুরিয়ে যায়।

অরা বিড়বিড় করে বলল, “কার সাথে ঘর করছি আমি?”

বিড়বিড় করে বললেও কথাটা শুনতে পেলো আরশাদ। তেজী ভঙ্গিতে সে বলল, “এখন তো এ প্রশ্ন করবেই! অন্য মানুষের স্বাদ পেয়ে গেছ না!”

নিজের সম্পর্কে এমন বিশ্রী কথা আর শুনতে পারলো না অরা। আকুতির সুরে বলল, “আরশাদ প্লিজ! প্লিজ!”

চুপ করলো আরশাদ। অরা আবারও কম্পিত স্বরে বলল, “I’m sorry. আমারই ভুল হয়েছে তোমার কাছে এসে।”

আর এক মুহুর্তও অপেক্ষা না করে লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে এলো অরা। তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। পা ফেলে হাঁটাও যেন কষ্টকর কাজে পরিণত হয়েছে। আরশাদ তো কেবল তার স্বামী নয়। তার ভালোবাসার মানুষ, তার হৃদয়ে বসবাসকারী। সেই মানুষটাই কিনা তাকে নিয়ে এসব ভাবে? নিজের অস্তিত্বের ওপর ঘৃণা ধরে যাচ্ছে অরার।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here