দৃষ্টির_আলাপন #পর্বঃ৪ ( প্রথমাংশ ) #আদওয়া_ইবশার

0
464

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৪ ( প্রথমাংশ )
#আদওয়া_ইবশার

“আপনাদের মাঝে রক্তিম শিকদার কে?”

প্রতিদিনের মতো আজও নিজের দলবল নিয়ে রাস্তায় বাইকে হেলাল দিয়ে দাঁড়িয়েছিল রক্তিম। টুকটাক দলের ছেলেদের সাথে কথা হচ্ছিলো লিয়াকত বিল্লাকে নিয়ে। এর মাঝেই হঠাৎ এক মেয়ে কন্ঠের রিনরিনে স্বরে রক্তিমের নাম শুনে কথা থামিয়ে ফিরে তাকায় সকলেই। দেখতে পায় ঐদিন রাস্তায় গলা ছেড়ে গান গাওয়া মেয়েটাই খোঁজ করছে রক্তিমের। এই মেয়ের রক্তিমের সাথে আবার কি কাজ! যেখানে আজ পযর্ন্ত কোনো মেয়ে রক্তিমের আশেপাশে ঘেষার সাহস পায়নি সেখানে এই মেয়ে রক্তিমের খোঁজ করার সাহস কিভাবে পেল! কথাটা ভেবেই একটু অবাক হয় সকলেই। তবে রক্তিম নিরুত্তাপ। একটা মেয়ের মুখে নিজের নাম শুনেই তার কোনো হেলদুল নেই। নির্বিকার ভাবে আয়েশী ভঙ্গিতে হাতে থাকা সিগারেট ফুঁকে যাচ্ছে। রক্তিমের দিকে এক পলক তাকিয়ে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করে মেহেদী,

“রক্তিম শিকদারের কাছে কি দরকার তোমার?”

এমন প্রশ্নে একটু বিরক্ত হয় দৃষ্টি। এমনিতেই এতোদূর দৌড়ে এসে হাপিয়ে গেছে। হাতে খুবই অল্প সময়। এই অল্প সময় টুকুর মাঝেই যা করার করে চলে যেতে হবে তাকে। এমতাবস্থায় মেহেদীর প্রশ্নটা তার কাছে মনে হচ্ছে অযথা তার সময় নষ্ট করার ফন্দি। ঘনঘন শ্বাস নিতে নিতেই দৃষ্টি জবাব দেয়,

“সেটা আপনাকে বলব কেন? যা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দিন।”

কথাটা বলে আড়চোখে এক পলক রক্তিমের দিকে তাকিয়ে তার হাবভাব বোঝার চেষ্টা করে। এইটুকু একটা মেয়ের মুখে এমন চ্যাটাং চ্যাটাং কথার জবাব শুনে একটু বুঝি থমকায় রক্তিম। রোদ চশমার আড়ালে লুকিয়ে থাকা তিক্ষ্ণ চোখ দুটো ঘুরিয়ে এক পলক দেখে নেয় মেয়েটাকে। সেটাও সকলের অগোচরে। দৃষ্টির মুখে এমন জবাব শুনে যারপরনাই অবাক উপস্থিত প্রতিটা ছেলে। চোখে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে ফের তাকায় দৃষ্টির দিকে। হাঁটুর বয়সী একটা মেয়ের কাছে এভাবে অপদস্থ হয়ে চুপচাপ বসে থাকবে রক্তিম শিকদারের দলবল। এটা কি মানা যায়! মেহেদী বিস্ময় কাটিয়ে কিছু বলার আগেই খ্যাঁকিয়ে ওঠে রাকিব,

“অ্যাই মেয়ে! কার সামনে দাঁড়িয়ে এমন বেয়াদবের মতো কথা বলছো জানো তুমি? এক রত্তি একটা মেয়ে এক আঙুলে তুলে আছাড় মারলেই চেপ্টা হয়ে যাবে। এই মেয়ের আবার এতো পাওয়ার!”

উত্তরে দৃষ্টি কিছু বলতে যাবে এর মাঝেই রক্তিম হাত উচিয়ে সকলকেই এক ইশারায় থামিয়ে দেয়। ঠোঁট থেকে সিগারেট নামিয়ে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে গম্ভীর কন্ঠে অন্যদিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,

“আমি রক্তিম শিকদার। কি দরকার?”

জবাব পেয়ে খুশিতে আত্মহারা দৃষ্টি। সে তো আগে থেকেই জানতো কোনটা রক্তিম। এতোক্ষন অহেতুক এই প্রশ্নপর্ব চালিয়ে যাবার একমাত্র উদ্দেশ্যই ছিল রক্তিমের থেকে একটা জবাব পাওয়া। অবশেষ সেটা পেয়ে হাতে চাঁদ পাওয়ার মতোই আনন্দ হচ্ছে দৃষ্টির। কিন্তু আনন্দটা বেশিক্ষণ চেহারায় ধরে রাখেনা। টুপ করে সবটুকু আনন্দ গিলে নিয়ে মুখে দুঃখি দুঃখি ভাব এনে রক্তিমের দিকে এগিয়ে যায় এক কদম। কাঁদো কাঁদো মুখ ভঙ্গিতে বলে,

“আমি খুব অসহায় হয়ে আপনার খোঁজ করতে এসেছি ভাই। সবার কাছে শুনেছি কেউ যদি কোনো মেয়েকে উত্তক্ত করে তবে আপনি না কি তার বিচার করেন! গত তিনটা দিন যাবৎ এক ছেলে আমার রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছে ভাইয়া। আমি খেতে পারিনা, ঘুমাতে পারিনা। শান্তিতে কোথাও একটু বসতেও পারিনা। সবসময় ঐ ছেলের চিন্তা মাথায় ঘুরে। আপনি দয়া করে এর একটা বিহিত করুন। নইলে এই যন্ত্রণা সইতে না পেরে আমি মরে যাব একেবারে।”

এমন এক অভিযোগে একটু থমকায় সকলেই। চোয়ালদ্বয় শক্ত হয়ে ওটা রক্তিমের। অত্যন্ত শীতল স্বরে জানতে চায়,

“ছেলেটা কে?”

“আমি তো জানিনা ভাইয়া।”

ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে জবাব দেয় দৃষ্টি।তার এহেন জবাবে বিরক্ত হয় দলের সবগুলো ছেলে। তিরিক্ষি মেজাজে রাকিব আবারও থমকে বলে ওঠে,

“এই মেয়ে ফাজলামি পাইছো? জানোনা তো এতোক্ষন কুমিরে কান্না করে কি বলেছো ঐসব? একটা ছেলে তোমাকে বিরক্ত করে, অথচ ছেলেটা কে সেটাই তুমি জানোনা! অদ্ভূত সব কথাবার্তা।”

পাশ থেকে জাবির রাকিবের কথার তালে বলে,

“আমি আগেই বুঝতে পেরেছি এই মেয়ে পাগল। না হলে ঐদিন মাঝ রাস্তায় ঐভাবে গলা ছেড়ে গান গাইতো না। আর না আজ এমন অহেতুক কথাবার্তা বলতো।”

নিজেকে পাগল বলায় দৃষ্টির রাগ হয় খুব। কিন্তু প্রকাশ করেনা তা। একবার শুধু কটমট দৃষ্টিতে রাকিব, জাবিরের দিকে তাকিয়ে মুহুর্তে মুখটা অসহায় করে রক্তিমের দিকে তাকিয়ে বলে,

“গান হলো মনের খোরাক। গান গাইলে মন ভালো থাকে। আপনিই বলুন ভাইয়া, গলা ছেড়ে গান গেয়ে নিজের মন ভালো করার ব্যক্তিস্বাধীনতা কি আমার নেই? আর যে ছেলেটা আমাকে বিরক্ত করে তার নাম জানিনা। তবে দেখলে ঠিকই চিনবো। এখন আমি কিভাবে নাম না জেনে বলব কে সেই ছেলে? এই যুক্তিসঙ্গত কারণ গুলো না বুঝেই ওনারা আমাকে পাগল বলে আখ্যায়িত করে ফেলল। এটা কি ঠিক করল? আজকে আমি অসহায় ভুক্তভোগী দেখেই তো আপনাদের কাছে সাহায্য চাইতে আসলাম। সেই আপনারাই যদি এখন আমাকে সাহায্য না করে উল্টাপাল্টা কথা বলেন তবে আমার মতো অসহায় মেয়েরা যাবে কোথায়?”

দৃষ্টির এতোগুলো কথা শুনে একটু নরম হয় সকলেই। প্রথমে কিছুটা থমথম খেলেও নিজেদের সামলে নিয়ে মেহেদী বলে,

“কষ্ট পেয়ো না ছোট আপু। আসলে আমরা বুঝতে পারিনি। আচ্ছা! ঐ ছেলেকে আবার দেখলে তো চিনতে পারবে তাই না!”

উপর নিচ মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায় দৃষ্টি। সাথে সাথেই মেহেদী চড়াও হয়ে বলে,

“ঠিক আছে। তবে চলো আমার সাথে। পুরো এলাকায় চিরুনি তল্লাশি করে হলেও আজকে দিনে দিনে ঐ ছেলেকে খোঁজে বের করব আমি। এরপর রক্তিম শিকদার নিজের হাতে ঐ স্কাউন্ড্রেল এর বিচার করবে। চলো চলো।”

সহসা আতকে ওঠে দৃষ্টি। তড়িৎ মাথা নাড়িয়ে বলতে থাকে,

“না না। আপনাদের সাথে যাওয়া যাবেনা।”

তার এমন কথায় চোখ-মুখ কুঁচকে নেয় সকলেই। নিরবতা ভেঙে আবারও রক্তিমই জানতে চায়,

“কেন?”

“ওনাদের সাথে গেলে এলাকার লোক আমার নামে বদনাম রটাবে। বলবে এক দল গুন্ডার সাথে আমি মেয়ে হয়ে দিন দুপুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আরও বিভিন্ন কথা বলবে।ঐসব আমি মুখেও আনতে চাইনা।”

ফুস একটা একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে রাকিব। হতাশ ভঙ্গিতে বলে,

“তাহলে এখন কি করবে? এই মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমাদের সাথে কথা বললেও মানুষ দেখে বদনাম রটাবে। তার থেকে বরং এক কাজ করো। বাসায় গিয়ে চোখে সরিষা তেল লাগিয়ে ইচ্ছমতো কতক্ষণ কান্নাকাটি করে ঘুমিয়ে পরো। পরে যদি আবার কখনও ঐ ছেলে বিরক্ত করতে আসে তখন তার থেকে জেনে নিয়ো এভাবে, ” ওহে আমার রাতের ঘুম হারাম করা জনাব! আপনার নামটা কি একটু জানতে পারি? অনুগ্রহ করে আপনার নামটা বললে রক্তিম শিকদারকে বলে আপনাকে সিন্নি খাওয়াতাম।”

রাকিবের কথার ধরনে হু হু করে হেসে ওঠে উপস্থিত সকলেই। ব্যতিক্রম শুধু রক্তিম আর দৃষ্টি। চোখ-মুখ শক্ত করে রাকিবকে ধমকে ওঠে দৃষ্টি,

“একদম চুপ করুন আপনি। মাথা ভর্তি গোবর নিয়ে কিভাবে রক্তিম শিকদারের দলে কাজ করেন আপনি? আপনার থেকে তো আমার আট বছরের ছোট ভাইয়ের মাথায় আরও বেশি বুদ্ধি।”

তরতজা এমন এক অপমানে থমথম খেয়ে যায় রাকিব। কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দৃষ্টির দিকে। রাকিবের এমন অবস্থা দেখে মিটিমিটি হাসে সকলেই। সেদিকে আর পাত্তা দেয়না দৃষ্টি। হঠাৎ কিছু একটা মনে হয়েছে এমন একটা ভাব করে রক্তিমের দিকে ফিরে তাকায়। জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে,

“একটা বুদ্ধি পেয়েছি।”

“কি বুদ্ধি?”

জানতে চায় জাবির। সেদিকে এক পল তাকিয়ে দৃষ্টি আবারও রক্তিমের দিকে ফিরে তাকায়। ফট করে বলে ফেলে,

“আপনার নাম্বারটা দিন।”

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here