ফিরে_আসা২ ২৪ লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

0
435

#ফিরে_আসা২
২৪
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

শুটিং থেকে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেজে গেল রাত একটা। এই পেশার এই এক সমস্যা। কাজের কোনো নির্ধারিত সময়সীমা নেই। কর্পোরেট জীবনে অভ্যস্ত মানুষের নয়টা থেকে পাঁচটা অফিস করতে হয়। নির্দিষ্ট সময়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে আবার নির্দিষ্ট সময়েই কর্মক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে আসা। তবে মিডিয়া জগতে এই উপায় নেই।

শিডিউল অনুযায়ী শুটিং যেকোনো সময় শুরু হতে পারে, আবার যেকোনো সময়ে শেষ হতে পারে। কখনো আরশাদের কল টাইম থাকে ভোর পাঁচটায়, কখনো দুপুর দুইটায় আবার কখনো তো সন্ধ্যারও পরে। পুরোটাই নির্ভর করে আজ যে দৃশ্যগুলো ধারণ করা হবে, সেগুলোর মধ্যে দিনের দৃশ্য বেশি না-কি রাতের। দিনের দৃশ্য বেশি হলে সকাল সকাল শুটিং শুরু হবে। আবার দিনের দৃশ্য কম এবং রাতের দৃশ্য বেশি থাকলে একটু বেলা করেই শুটিং শুরু হয়।

সেই শুটিং যে কতক্ষণ চলবে তা কেউ জানে না। শিডিউলে উল্লিখিত দৃশ্যগুলো ধারণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত শুটিং চলতেই থাকে। এই নিয়ে অভিনয়শিল্পীদের অপত্তির শেষ নেই। তাদের কথা, অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত মানুষেরা দিনে আটঘন্টার বেশি কাজ করে না। তাহলে অভিনয়শিল্পীরা কেন দিনে বারো থেকে পনেরো ঘন্টা লাগাতার কাজ করবে?

ইন্ডাস্ট্রিতে অভিনয়শিল্পীর বেশ কিছু সংঘ রয়েছে। অভিনয়শিল্পীদের উন্নয়নের জন্যে তারা কাজ করে থাকে। উন্নয়ন তো করেই না, এসব সংঘে তারাই যুক্ত হয় যাদের ক্যারিয়ারের আলো প্রায় নিভে যাওয়ার পথে। নিজেদের আলোচনায় রাখার শেষ চেষ্টা হিসেবে তাদের এই সংঘকে বেছে নেওয়া।

তেমনই এক সংঘ মাস কয়েক আগে তীব্র আন্দোলন শুরু করে। তাদের দাবি আট ঘন্টার পর তাদের সেট থেকে ছেড়ে দিতে হবে। শিডিউল অনুযায়ী শুটিং শেষ হোক বা নাই হোক। কয়কেটা অনলাইন পোর্টাল ছাড়া তাদের এই আন্দোলনকে কেউ তেমন একটা পাত্তা দেয়নি। পাত্তা পাওয়ার জন্যে তারা আসে আরশাদের কাছে। দেশের সবথেকে বড় সুপারস্টার যদি এই আন্দোলনে সমর্থন দেয়, তাহলে তো নির্ঘাত চারদিকে হইচই পড়ে যাবে।

আরশাদ সমর্থন তো দেয়ইনি, উল্টো গম্ভীর গলায় তাদের এই অহেতুক আন্দোলন বন্ধ করতে বলে। আরশাদের কথা একটাই, এই পেশায় কাজের ধরন যেহেতু অন্যান্য সকল পেশার থেকে আলাদা তাই এই পেশাটাকে অন্যান্য পেশার সঙ্গে তুলনা করা উচিত নয়।

যারা দিনে আট ঘন্টা অফিস করে তাদের তো মাসে প্রত্যেকটা দিনেই অফিসে যেতে হয়। সপ্তাহে একদিন মাত্র ছুটি পায়। কিন্তু অভিনয়শিল্পীদের সেই নিয়ম নেই। তাদের সিনেমার শুটিং একনাগাড়ে চলে না। তিন-চার শুটিংয়ের পর বিরতি থাকে। তাছাড়া যখন সিনেমার শুটিং চলে, তখনই তাদের ব্যস্ততা। শুটিং শেষ হয়ে গেলে, পরবর্তী সিনেমার শুটিংয়ের আগ পর্যন্ত তো অফুরান অবসর।

আমাদের দেশের বেশির ভাগ অভিনেতারাই সিনেমাটাকে নিজের সিনেমা ভাবে না। তারা ভাবে এটা তো পরিচালকের সিনেমা, প্রযোজকের সিনেমা। আমি কেন তাদের সিনেমার জন্যে এত কষ্ট করতে যাবো? আমি কেন বারো-তেরো ঘন্টা শুটিং করতে যাবো? এই মানসিকতা থেকেই তাদের আন্দোলনে নামা। তবে আরশাদ তো এর থেকে একেবারে বিপরীত মানসিকতার অধিকারী। তার অভিনীত প্রত্যেকটা সিনেমাই তার অনেক কাছের। কাজের গুরুত্ব চিরকালই তার কাছে সবার আগে। অনেকে মনে করতে পারে, আরশাদ তো এখন প্রযোজক হয়েছে, তাই সিনেমার ভালোটা তার কাছে এত গুরুত্ব পায়।প্রযোজক তো কেবল আড়াই বছর আগে রয়েছে। তারও বহু বছর আগে তার কেবল একটাই পরিচয় ছিল – অভিনেতা।

পৃথিবীর কাছে আরশাদ সুপারস্টার হতে পারে। তবে নিজের কাছে আরশাদ কেবলই একজন অভিনেতা। যে প্রতিনিয়ত নিজের দক্ষতা বৃদ্ধির চেষ্টা করছে। যে অভিনেতা কাজের ক্ষেত্রে কোনো হেলাফেলা সহ্য করতে নারাজ।

কোনমতে ফ্রেশ হয়ে ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দিলো আরশাদ। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে। মাঝেমধ্যে এই এক সমস্যা কাজে ডুবে থাকার। কখন যে ক্লান্তি এসে গ্রাস করে নেয় টেরই পাওয়া যায় না। তবুও কাজের মাঝে ক্লান্ত হতেই ভালোবাসে আরশাদ। বেশির ভাগ মানুষ কাজটাকে দায়িত্ব মনে করে। ভালোবাসা মনে করে না। কাজটা তো আরশাদের ভালোবাসা, তাই কাজের মাঝেই তার আনন্দ।

কাজের মাঝে যতটা সময় ডুবে ছিল, নিজের ভেতরের পোকাটাকে দমিয়ে রাখা সম্ভব ছিল। কিন্তু ঘরে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে আবারও মাথা চারা দিয়ে উঠেছে সেই পোকা। অরাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় ডুবে থাকা পোকা।

বাড়ি ফেরার পথে গাড়িতে কথা হলো অরার সঙ্গে। শুটিং সেটের ওই ঝামেলা না-কি সে আধঘন্টার মধ্যে সমাধান করে ফেলেছে। অনশনকারীরা অনশন ভেঙেছে। শুটিংও শুরু হতে যাচ্ছে কাল থেকে। সবাই অনেক খুশি, খুশি অরাও। তবে খুশি হতে পারছে না আরশাদ। তার মনে কেবল উদ্বিগ্নতার ছড়াছড়ি। অরাকে নিয়ে এদিকে যে সে খুব দুশ্চিন্তা করছে, এটা অবশ্য তাকে বুঝতে দেয়নি আরশাদ। কাল শুটিং শুরু হবে, আরও কীসব হিসাব-নিকাশের ঝামেলা মিটিয়ে পরশু সকালে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেবে অরা।

একটা দিনের ব্যাপার। এমন তো নয় বিয়ের পর একটা দিনও অরাকে ছাড়া থাকেনি আরশাদ। তাকে প্রায়ই শুটিংয়ের কারণে ঢাকার বাইরে বা দেশের বাইরে থাকতে হয়। অরাকেও মাঝেমধ্যে কাজের কারণে ঢাকার বাইরে যেতে হয়েছে। তখন তো এমন অনুভূতি অনুভূত হয়নি।

মনের ভেতরে অদ্ভুত এক অস্বস্তি অনুভূত হচ্ছে আরশাদের। বাড়িটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার কারণ বাড়িটা আসলেই ফাঁকা। স্টাফরা সব সন্ধার পর পরই চলে যায়। কথাও আজ বাড়িতে নেই। অরা ঢাকার বাইরে, ওদিকে আরশাদও শুটিংয়ে ব্যস্ত। কথা তাই অরা না ফেরা পর্যন্ত আশফিয়ার কাছে বেড়াতে গেছে।

এই সময়ে বাড়িতে অরার থাকার কথা ছিল। আচ্ছা, এই মুহূর্তে অরা আরশাদের পাশে থাকলে ঠিক কী কী করতো? হাত নাড়িয়ে উৎফুল্ল ভঙ্গিতে পুরো দিন কী করেছে তার বর্ণনা দিতো। নিজে কোনো একটা গন্ডগোল করে বাবুর নামে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতো। আচ্ছা আরশাদ হঠাৎ অরাকে এত মিস করছে কেন?

দুয়েকদিনের জন্যে কিংবা তারও বেশি সময়ের জন্যে আলাদ থাকার অভ্যাস তার আছে। তবুও এই স্বল্প সময়ের দূরত্ব তাকে এত ভোগাচ্ছে কেন? শুধুমাত্র মেয়েটা প্রেগন্যান্ট বলে। না-কি আরশাদের অবচেতন মনে রাশেদের ওই প্রশ্নটা গভীরভাবে ছাপ ফেলেছে?

“আবারও মেয়েমানুষকে বিশ্বাস করতে পারবি তো?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল আরশাদ। না, না অবিশ্বাস করছে না সে অরাকে। অরাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে কেবল। না-কি অবিশ্বাস করছে? আর নিজেকে বুঝ দেওয়ার জন্যে দুশ্চিন্তা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে? আর বেশি কিছু ভাবতে পারলো না আরশাদ। মাথাটা ভনভন করে উঠছে তার। সবথেকে ভালো হতো সার্বক্ষণিক মেয়েটা কী করছে না করছে তা জানা গেলে।

তড়িৎ গতিতে কী যেন একটা খেলে গেল আরশাদের মস্তিষ্কে। ইজিচেয়ার থেকে উঠে বসে মোবাইলটা হাতে নিলো আরশাদ। এই দুশ্চিন্তা থেকে পরিত্রাণের একটা উপায় সম্ভব পাওয়া গেছে।

আয়নার সামনে বসে চুলগুলো আঁচড়াচ্ছে অরা। আজ রাতে বোধ হয় আর ঘুম-টুম আসবে না। ঘুমের ঘট ইতোমধ্যেই পূরণ হয়ে গেছে। গাড়িতে প্রায় পুরোটা সময়েই সে ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। অনশনকারীদের ওই ঝামেলা মিটিয়ে হোটেলে ফিরে আবারও ঘুম দিয়েছে। সেই ঘুম এতটাই গাঢ় ছিল যে ভেঙেছে সন্ধ্যারও পরে।

শরীরটা আজ বেশ হালকা লাগছে। বাবুর তার মাঝে আসার পর থেকে প্রায় রাতই ঘুমহীন কেটেছে। দিনে অফিস থাকার কারণে ঘুমের সুযোগও হয়ে ওঠে না। দিনভর মাথাটা কেমন ভার হয়ে থাকে। এই যে ঘুম কম হওয়া, এটা কি বাবুর মধ্যে খারাপ প্রভাব ফেলবে? নির্ঘাত ফেলবে। অরার বুঝি এবার মেটার্নিটি লিভ নেওয়ার সময় হলো।

চিরুনিটা ড্রেসিং টেবিলে নামিয়ে রাখতে রাখতে আয়নায় ফুটে ওঠা নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে চোখ আটকে গেল অরার। প্রেগন্যান্সির সবে তিন মাস চলছে। বাইরে থেকে তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই একটু একটু করে তার মাঝে বেড়ে উঠছে আরেকজন মানুষ। অত্যন্ত সাধারণ তার চেহারা। তাকে দেখে তো এও বোঝার উপায় নেই যে এই বিশাল কোম্পানির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তার নেওয়া প্রতিটি সিদ্ধান্তের ওপর।

নাহ্! মেটার্নিটি লিভের সময় এখনো হয়নি। আরশাদের মতো সেও তো কাজের মাঝে বিচিত্র এক আনন্দ খুঁজে পায়। কাজটাকে অবহেলা করে কী করে? বাবুর ওপর যাতে খারাপ প্রভাব না পড়ে তাই রাতে ভালো ঘুমের ব্যবস্থা করতে হবে। ডক্টরের সঙ্গে যাত্রাপথে আজ এই নিয়েই কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, ঘুমের আগে ইয়গা করলে না-কি ভালো ঘুম আসতে পারে। এছাড়া বিছানার কাছে সুগন্ধিযুক্ত মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখলেও ফল পাওয়া যেতে পারে।

অবশ্য ঘুমিয়ে তলিয়ে পড়ার জন্যে অরার নিজস্ব একটা পদ্ধতি আছে। গল্প শুনতে শুনতে সে সহজেই ঘুমিয়ে পড়ে। ছোটবেলায় মা এই বদভ্যাস তার মাঝে তৈরি করে দিয়ে গেছেন। অরা যখন ঘুমাতে চাইতো না, তিনি তখন শুরু করতেন গল্প। রাজকন্যা আর রাক্ষসীর গল্প। রোজ রোজ একই গল্প বললেও, কখনোই একঘেঁয়েমি লাগেনি অরার কাছে। প্রতিদিন নতুন আগ্রহ নিয়ে গল্প শুনতো সে। আগ্রহের একটা কারণ অবশ্য ছিল। গল্পের শেষটা তার জানা ছিল না। রোজ রাতে গল্প শেষ হওয়ার আগেই ঘুমে তলিয়ে যেত সে। পরের রাতে আবারও আগ্রহ নিয়ে গল্প শুনতো, শেষটা জানার আশায়। সেই গল্পের শেষ তার আজও জানা হলো না।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল অরা। মায়ের কথা ভাবলেই মনটা আর্দ্র হয়ে ওঠে। কদিন পর সেও মা হবে। অরা ঠিক তার মায়ের মতো হতে চায়। সন্তানের জন্যে যে সব পারে, সন্তানকে যে মমতার চাদরে মুড়িয়ে রাখতে জানে।

ঢাকায় ফিরে আরশাদের কাছে আবদার ধরতে হবে তাকে গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়ানোর। রাতে অরার ঘুম হচ্ছে এই দুশ্চিন্তায় তারও ঘুম হারাম। এই ছেলেটা দুশ্চিন্তা ছাড়া কী আর কিছুই পারে না? আরশাদের কথা ভাবতেই মলিনতা কেটে গিয়ে তার ঠোঁটে ফুটে উঠলো হাসির রেখা।

পাগল একটা ছেলে আরশাদ! বউকে নিয়ে কেউ এত দুশ্চিন্তা করে? সকাল থেকে ফোন করে খোঁজখবর নিয়ে নিয়ে সে যেন অরাকেই ক্লান্ত করে তুলেছে। পাগল হোক আর যাই হোক। একান্তই তার নিজের। অরার পৃথিবীর যেখানেই চলে যাক, কেউ তাকে আরশাদের মতো করে ভালোবাসবে না।

মোবাইলটা হাতে নিয়েই অরা দেখলো, আশফিয়া অনলাইনে।

অরা তার উদ্দেশ্যে ম্যাসেজ লিখলো, “আপা, কথা ঘুমিয়েছে?”

আশফিয়া ম্যাসেজের রিপ্লাই দিলো না। সোজা কল করলো। অরা কল রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গে আশফিয়া জোর গলায় বলল, “তোমার মেয়ে আবার ঘুমাবে! সে এখন কী করছে জানো? ইউটিউবে মিল্কশেকের রেসিপি দেখছে। এই রাতদুপুরে না-কি সে মিল্কশেক বানাবে!”

অরা খানিক হেসে বলল, “খুব জ্বালাচ্ছে না আপা?”

আশফিয়া স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, “তা জ্বালাচ্ছে। অবশ্য কথা কমই জ্বালায়। জ্বালানোর ওস্তাদ ছিল ওর বাবা। আমার অবশ্য জ্বলতেই ভালো লাগে।”

আশফিয়ার এই মজা করে কথা বলার ভঙ্গিতে অরা হেসে ফেলল।

ওদিকে ফোনের অপরপ্রান্তে অরার আওয়াজ পেয়ে ছুটে এসেছে কথা।

কথা উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বলল, “অরা জানো! আমি আর ফুপি অনেক মজা করছি।”

অরা অবাক গলায় বলল, “তাই না-কি? তা কীভাবে মজা করছিস?”

“আজ সারাদিন আমি আর ফুপি ক্রাফটিং করেছি। কাগজ দিয়ে অনেক খেলনা বানিয়েছি। এখন আমরা রান্না করবো। প্রথমে বানাবো মিল্কশেক।”

অরা মিষ্টি গলায় বলল, “এখন তো অনেক রাত হয়ে গেছে সোনা। এত রাতে কেউ রান্না করে?”

কথা দৃঢ় ভঙ্গিতে বলল, “হোক! আমাকে তো কাল সকালে উঠে স্কুলে যেতে হবে না।”

ফুপির কাছে বেড়াতে আসার আগে কথা বলে দিয়েছিল বেড়ানোর মাঝে সে স্কুল করতে পারবে না। একদিনের যেহেতু ব্যাপার, তাই অরার মেনে নিয়েছে কথার জুড়ে দেওয়া এই শর্ত।

অরা সুন্দর করে বলল, “স্কুলে যেতে হবে না ঠিকই, কিন্তু দেরি করে ঘুমালে তো কাল সকাল সকাল উঠতে পারবি না। দেরি করে উঠলে ফুপির সাথে মজাও কম করতে পারবি।”

কথা হতবাক হয়ে বলল, “তাই তো! তাহলে এখন ঘুমিয়ে পড়বো?”

“হ্যাঁ সোনা। এখন ঘুমিয়ে পড়, কাল সকাল উঠে মিল্কশেক বানাবি।”

কথা বাধ্য মেয়ের মতো বলল, “ঠিক আছে। অরা? তুমি কবে আসবে? তুমি এলে আমি তোমার জন্যেও মিল্কশেক বানাবো।”

অরা মেয়েকে আশ্বস্ত করে বলল, “এই তো! পরশুই চলে আসবো।”

“পরশু মানে কী? আরেকটা কালকে?”

কথার শব্দের জগতে পরশু বলে কোনো শব্দ নেই। তার কাছে পরশু মানেই ‘আরেকটা কালকে’।

অরা বলল, “হ্যাঁ বাবা, আরেকটা কালকে।”

আশফিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফোন রেখে দিলো অরা। যদিও রাত একটার বেশি বাজছে, তবুও কর্মচাঞ্চল্য খেলে বেড়াচ্ছে শুটিং ইউনিটের সকলের মাঝে। টানা চারদিন অবরুদ্ধ থাকার পর অবশেষে কাল সকালে শুটিং শুরু হচ্ছে।

নতুন করে শিডিউল তৈরি করা হচ্ছে, নতুন করে বাজেট তৈরি করা হচ্ছে। ডিরেক্টর এবং ডিওপি নতুন করে শট ডিভিশনে ব্যস্ত। একটি দৃশ্যকে আমরা ক্যামেরার বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে দেখি। একটি দৃশ্যে ক্যামেরার কতগুলো অ্যাঙ্গেল থাকবেই, সেই ছক দৃশ্য ধারণের আগেই কষা হয়। আর সেই ছকটাই হলো শট ডিভিশন। ওদিকে অভিনয়শিল্পীরা শেষ মুহূর্তের রিহার্সেল করছে। সব কাজই হচ্ছে হোটেলের লবিতে।

অরা ভাবলো, সে যেহেতু জেগেই আছে তাদের কাজ পর্যবেক্ষণ করে এলে মন্দ হয় না। হালকা তৈরি হয়ে গায়ের ওপর একটা কার্ডিগান জড়িয়ে ঘর থেকে বের হলো সে। ঘরের বাইরে কিছুটা দূরেই ছিল হোটেলের দুজন ক্লিনিং স্টাফ।

অরাকে বের হতে দেখেই তাদের একজন ছুটে এসে বিনয়ী ভঙ্গিতে বলল, “ম্যাম, আপনার রুমের চাবিটা আমাদের দেওয়া যাবে প্লিজ?”

অরা কিছুটা অবাক হয়ে বলল, “কেন?”

“আপনার রুমটার ক্লিনিং করা হবে ম্যাম।”

অরা বিভ্রান্ত গলায় বলল, “এত রাতে ক্লিনিং?”

ক্লিনিং স্টাফ দুর্বলভাবে জোর দিয়ে বলল, “আমাদের প্রটোকল ম্যাম। গেস্ট যতক্ষণ জেগে থাকবে, ততক্ষণ প্রতি ছয় ঘন্টা পর পর রুম ক্লিন করা হবে।”

এ আবার কেমন প্রটোকল? অন্যান্য হোটেলে তো বারো ঘন্টা পর পর ক্লিনিং করা হয়। বিষয়টা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামালো না অরা। চাবিটা তার কাছে দিয়ে পা বাড়ালো হোটেলের লবির দিকে।

লবির দৃশ্য ঠিক যেমনটা সে কল্পনা করেছিল, তেমনই। যে যার কাজে ব্যস্ত। সকলের মুখেই হাসি। ঝামেলাটা মিটে যাওয়ার পর থেকেই ফুরফুরে মেজাজে আছে শুটিং সেটের সকলে।

অরা এগিয়ে যেতেই তার দিকে ছুটে এলো পরিচালক সাইদ সাহেব এবং এই সিনেমার ডিওপি।

অরা সহজ গলায় বলল, “আপনারা কাজ করুন প্লিজ। আমি আপনাদের ডিস্টার্ব করতে চাই না, আমি তো ঘুরতে এলাম কেবল।”

সাইদ সাহেব বিগলিত গলায় বলল, “কী যে বলেন আপু! আমরা মোটেও ডিস্টার্বড হচ্ছি না।”

অরা হঠাৎ কী যেন মনে করে বলল, “আচ্ছা সাইদ ভাই? তখন কী যেন বলছিলেন, আর্টিস্টরা ডেট নিয়ে ঝামেলা করছে?”

“সব আর্টিস্ট না, আমাদের ফিল্মের নায়িকা মোহনা। তার না-কি ঢাকায় অন্য ফিল্মের ডেট দেওয়া আছে। এখানে যে চারদিন নষ্ট হয়েছে, ওই চারদিন কভার করার জন্যে একট্রা ডেট দিতে পারবে না।”

সিনেমার শুটিংয়ের দিন চূড়ান্ত হওয়ার আগে সেই তারিখে অভিনয়শিল্পীরা ফ্রি আছে কিনা জানতে চাওয়া হয়। তারা ফ্রি থাকলে তবেই ওই ডেট লক করা হয়। মোহনা দশ দিন দিয়েছে এই লটের শুটিংয়ের জন্যে।

অভিনয়শিল্পীরা এক্সট্রা ডেট দিতে চায় না। তাদের মনোভাবটা এমন, “আমি তো ডেট দিয়েই রেখেছিলাম। অনশনের কারণে শুটিং বন্ধ ছিল এটা তো আমার দোষ নয়।” এরা পরিস্থিতি বুঝতে চায় না। এ ধরনের মানুষেরাই আবার পান থেকে চুন খসলে সংঘে গিয়ে আন্দোলনে যোগ দেয়।

অরা বলল, “আমি দেখছি ব্যাপারটা।”

লবির কোণার দিকে একটা টেবিলে মোহনা অন্যান্য অভিনয়শিল্পীদের সঙ্গে রিহার্সেল করছিল। অরা এগিয়ে যেতেই তারা উঠে দাঁড়ালো।

অরা ব্যস্ত হয়ে বললেন, “দাঁড়াচ্ছেন কেন? আপনারা বসুন প্লিজ!”

এই সিনেমার নায়ক আবির ভদ্রভাবে বলল, “আপু আপনিও বসুন আমাদের সঙ্গে।”

“আমি বসবো না। আমার আসলে মোহনা আপুর সঙ্গে একটু কথা ছিল।”

মোহনা সঙ্গে সঙ্গে উঠে এসে অরার সঙ্গে একটু আলাদা হয়ে গিয়ে দাঁড়ালো।

অরা হাসিমুখে বলল, “আপু আপনার কাছে তো দশ দিনের ডেট নেওয়া হয়েছিল। চারদিন তো চলেই গেল। আপনি কি প্লিজ আমাদের এক্সট্রা চারদিনের ডেট দিতে পারেন?”

মোহনা ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “অবশ্যই আপু! ডেটের জন্যে আপনাকে আসতে হয় না-কি? কোনো এডিকে পাঠিয়ে দিলেই তো হয়ে যেত!”

কোম্পানির ভালোর জন্যে ছোট-বড় সকল কাজ অরাকে একা হাতেই করতে হয়। এটাই তো কাজের মাঝে লুকিয়ে থাকা প্রকৃত আনন্দ!

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here