ছায়া মানব ২
৪৫.
বিহান পুনরায় এক হাত চেপে ধরল মোহনার। মোহনা বিরক্তিতে বলল,‘এখন তোমার সাথে কথা বলার মতো সময় নেই। বাড়িতে চোর ঢুকেছে।’
ইমন অবাকের সহিত বলল,‘সিকিউরিটি রয়েছে, কেউ কিছুই চুরি করতে পারবে না।’
মোহনা শান্ত হয়। কিছুটা দ্বিধান্বিত হলেও সে বিহানের দিকে তাকায়,
‘আমার বাড়ি থেকে বের হ। আর এক মিনিটও এখানে থাকবি না। তোকে দেখলে গা ঘিনঘিন করে। বের হয়ে যা আপাতত। ল’জ্জা-সরম বিন্দুমাত্র থেকে থাকলে বের হয়ে যাবি।’
বিহান নড়ল না। ইমন মনে মনে বলল,‘তার মানে সে নির্ল’জ্জই হবে।’
কথাটা কানে গেল বিহান এবং মোহনার। ইমনের দিকে তাকাতেই সে বুঝতে পারল, মনে মনে নয়, সে উচ্চস্বরেই বলেছে কথাটা। মোহনাকে দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে গেলেও মোহনা সেটা হতে দিল না। সাথে সাথেই বলল,‘ঠিক বলেছ। নি’র্লজ্জ খুব! আমাদের ভেতরে যাওয়া উচিত। সবাই অপেক্ষা করছে।’
বলেই ইমনের আঙুলের ভাঁজে আঙুল নিয়ে অন্য হাতে তার কোমর স্পর্শ করল পেছন থেকে। যদিও কিছুটা ইতস্তত করছে। তাও ইমনের কানে কানে বলল,‘আমি ছেড়ে দিলেও আপনি ছাড়বেন না আমার হাত। আমি এক্ষুনি ছেড়ে দিতে পারি।’
ইমনের সহ্য হলো না। সে নিজে থেকেই হাত সরিয়ে নেয়। মোহনা খুব রেগে যায়। ইমন আমতাআমতা করে বিহানকে বলল,‘কাউকে দেখানোর জন্য কিছু করিনা আমি। ভদ্রভাবে বলছি, আমার গার্লফ্রেন্ড থেকে দূরে থাকুন। কিছুদিন পরেই বিয়ে করছি। আশা করি আপনার কাছে খবর যাবে। বাসর সাজানোর কাজটা আপনাকেই দেব ভাবছি। আসবেন কিন্তু। এখন ভদ্রভাবে বের হয়ে যান। আমি ভদ্র ফ্যামিলির ছেলে, গলাধা’ক্কা দেওয়া পছন্দ করিনা। আপনি হয়ত বস্তি বা মিডেল ক্লাসের। সো, নিজ দায়িত্বে বের হয়ে যান। গেট আউট ফাস্ট।’
বিহান আর কথা বাড়ালো না। এতটা অপমানের পর নিজেকে সত্যিই তার বেহায়া মনে হচ্ছে। সাদাসিধে মোহনাকে পুনরায় পটিয়ে ফেলতে পারবে, এমনটা ভেবেছে সে। অথচ পারল না। হতাশ মনেই একবার মোহনা আর ইমনকে দেখল। রাগ হলো খুব, তাও নিজেকে সামলে নিয়ে বের হয়ে গেল।
বিহান চলে যেতেই মোহনা এসে কলার চেপে ধরল ইমনের,
‘নিজেকে খুব হিরো ভাবতে ইচ্ছে হয় আপনার, তাই না?’
‘শুরু হয়ে গেল।’
মিনমিনে সুরে বলল ইমন।
‘কথা বলছেন না কেন? আমি নিজে থেকে আপনার হাত ধরলাম অথচ আপনি ছেড়ে দিলেন?’
‘আপনি কি চান আমি সর্বক্ষণ আপনার হাত ধরে থাকি?’
‘দরকার হলে তাই করবেন। আপনার সাহস কী করে হয় আমাকে ইনসাল্ট করার। এটা আমার জন্য সত্যিই অপমানজনক। কীভাবে হাত ছাড়িয়ে দিলেন বিহানের সামনে।’
কলার চেপে ধরায় মোহনা ঠিক ইমনের মুখোমুখি এসে ঠেকল। মোহনার গাঢ় নিঃশ্বাস ছড়িয়ে পড়ল ইমনের চোখেমুখে। নিজেকে দমিয়ে নিয়ে বলল,‘সরে দাঁড়ান।’
‘দাঁড়াব না। কী করবেন?’
ইমনের চক্ষু চঞ্চল হয়ে এলো। দিশেহারা ভাব পরিলক্ষিত। মৃদু কাঁপছে সে। হুট করেই কেমন ভালোলাগা অনুভব করছে সে। মোহনার মুখোমুখি সংঘর্ষে নিজেকে তার একদম কাছাকাছি মনে হচ্ছে। আচমকা মোহনার কোমরে হাত রাখল। কিছুটা অনুশোচনা হলো। পর পরই সেটা মিলিয়ে গিয়ে তার আকর্ষণ বেড়ে গেল। মোহনার চোখের দিকে তাকাল। চশমা ভেদ করে চোখদুটো দেখল। অধরজোড়া আরও কিছুটা এগিয়ে নিল। মোহনা অস্ফুট স্বরে বলল,‘এতটা কাছে আসা ঠিক না।’
ইমন বাস্তবিক জগত থেকে বিচ্যুত যেন। তার চোখের সামনে একজন অতি সুন্দরী নারী দাঁড়িয়ে। এছাড়া আর কিছুই তার গোচরে নেই। ন্যায়-অন্যায় বোধটুকুও নেই। আচমকা মোহনার একদম কাছে চলে যায়। কপোলে একহাত রেখে অধর ছুঁইয়ে দিতে গিয়ে থেমে যায়। যেন ঘোর কেটে গেছে। মুহুর্তেই দূরে সরে যায়। নিজের ঠোঁটজোড়া একহাত চেপে ধরে বলল,‘আমাকে ডাকছে। ভেতরে যেতে হবে।’
এক সেকেন্ডও দেরি করল না। চলে গেল ইমন। মোহনা বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে। ধ্যান ফিরতেই মাথা ঝাঁকি দিয়ে বলল,‘গাধা ছেলে।’
মুখ ঝামটা মেরে নিজেও চলে গেল।
অহনা আর মাহতিম একসাথে দাঁড়িয়ে। মাহতিমের নজর অহনার দিকেই সীমাবদ্ধ। গাউনের সাথে খোলা চুল আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে তাকে। বর্ষণ আর নিহার আংটি বদলের পালা এলো। অহনা মাহতিমের মুখ ঘুরিয়ে সেদিকে তাকাতে বলল। সাথে সাথেই মাহতিম মুখ ঘুরিয়ে অহনার দিকে তাকাল। এভাবে কয়েকবার করার পর অহনা পাশ থেকে একটা টিস্যু পেপার নিয়ে নিজের মুখ ঢেকে রাখল। মাহতিম বিরক্ত হয়ে যেই না কিছু বলতে যাবে তখনই তার চোখ যায় একজন লোকের দিকে। চাদরে জড়িত সে। মাহতিমের কেমন সন্দেহ হলো। সে অহনার থেকে সরে গিয়ে লোকটাকে খুঁজতে শুরু করল। হঠাৎ করেই কোথাও উধাও হয়ে গেছে। মাহতিমের ব্রুজোড়া কুঁচকে আসে। কোথাও পেল না। আচমকা কেউ তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। ভীষণ অবাক হয়েই মাহতিম দেখল নূরকে। মাহতিমের চাচা-চাচি আসতে কিছুটা দেরি হয়েছে। যেহেতু চাচা অসুস্থ তাই সব সামলে আসতেই সময় শেষ হয়ে এলো। সেদিন রেখে আসায় ঘুম থেকে উঠে খুব কেঁদেছে নূর। সারারাতও কেঁদেছে। অহনা এগিয়ে আসতেই নূর বিরক্ত হয়ে বলল,‘তুমি এখনো যাওনি?’
অহনা হাসল। কেমন বড়দের মতো কথা। যদি বড় হতো তবে একচোট ঝগড়া হয়ে যেত। মোহনা এসেই রসিকতা করে বলল,‘অহনা, তোমার সতিন এসে হাজির। এবার সামলাও।’
নূর ঠোঁট উল্টে বলল,‘মাহতিম ভাই শুধুই আমার।অহনা টানাটানি করছে। ওকে বাইরে ফেলে দিয়ে আসো।’
মাহতিম নূরের গাল টেনে দিয়ে বলল,‘আমি একটা বিয়ে করব, তারপর তুমি বড়ো হলে তোমাকেও করব।’
পর পরই অহনার দিকে তাকিয়ে বলল,‘কী! স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে মানতে পারবে?’
অহনা কিছু বলল না। নূর চটে গেল,‘বিয়ে একবার হবে। আমিই করব।’
আচমকা লাইট বন্ধ হয়ে গেল। সবাই হকচকিয়ে ওঠে। নূর ভয়ে চিৎকার করে উঠতেই মাহতিম তাকে কোলে তুলে নিল। নূর তার গলা জড়িয়ে ধরে। সাথে সাথে মোহনাকে বলল,‘নূরকে রাখ, আমি কারেন্টের কী হলো দেখে আসি।’
মোহনার কাছে নূরকে দিয়ে মাহতিম চলে গেল। অহনা হাতড়ে বেড়াচ্ছে। কিছুই নজরে পড়ল না। মোবাইলের ফ্লাশ অন করতেই চোখের সামনে একটি ছদ্মবেশী লোকের আবির্ভাব ঘটে। ভয়ে চিৎকার করার আগেই তার মুখ চেপে ধরে। মোবাইলটাও হাত থেকে পড়ে যায়। অহনা দুহাত বাড়িয়ে সবাইকে জানানোর চেষ্টা করে কিন্তু হলো না। ক্রমশ তার জ্ঞান চলে যায়।
কিছুক্ষণের মাঝেই কারেন্ট আসে। মাহতিমও ফিরে আসে। বর্ষণ আর নিহার আংটি বদল শুরু হয়। খুব খুশি দুজনেই। মাহতিমের হাসি মুহুর্তের জন্য থেমে গেল। অহনাকে দেখতে পাচ্ছে না। মোহনাকে জিজ্ঞেস করল,‘অহনা কোথায়? হঠাৎ করে কোথায় গেল? অনুষ্ঠানতো সবে শুরু হলো।’
মোহনা চারিদিকে দেখে বলল,‘কারেন্ট আসার পর আর দেখিনি। এর আগে আমার পাশেই তো দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ কোথায় গেল?’
মাহতিম আর কথা বাড়ালো না। অহনাকে চারিদিকে খুঁজতে লাগল। তার কাছে বিষয়টা খুব ঝাপসা লাগল। হঠাৎ করেই অহনার উধাও হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা হজম হলো না। দ্রুত রোস্তম আর সুমার কাছে গেল। তাদের জিজ্ঞেস করেও কিছুই হলো না। উল্টো তারাও চিন্তিত হয়ে পড়ল। মাহতিম আশ্বস্ত করতে বলল,‘কাছেই আছে। আমি খুঁজে আনছি। ব্যস্ত হবেন না।’
মাহতিম অহনার ঘরে গিয়েও দেখে এলো। পেল না! পর পরই সবার ঘর চ্যাক করল। কোথাও নেই। পুরো বাড়িতে কোথাও পাওয়া গেল না। মাহতিমের ভয় হতে লাগল। ফিরে এলো পুনরায়। উদাসীন হয়ে হাঁটার সময় তার পায়ের সাথে বাড়ি খেল অহনার ফোনটা। সেটা হাতে উঠিয়ে নিয়েই আরও ব্যস্ত হয়ে পড়ল মাহতিম। তার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠল। ফোনটার গ্লাস ফেটে গেছে। মাহতিম উন্মাদের মতো বাইরে ছুটে গেল। বাগানে খুঁজে দেখল। কোথাও না পেয়ে মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
মোহনাও এগিয়ে এলো। সেও খুঁজেছে, পেল না। মোহনার পেছনেই ইমন এসে বলল,‘কেউ আবার অপহরণ করল না তো?’
‘এসব কী বলছ? ওর সাথে কার শত্রুতা থাকবে?’
মোহনা চট করেই বলল,‘আমি বাড়িতে একজন ছদ্মবেশীকে ঢুকতে দেখেছি।’
মাহতিম একটু আগে কাউকে দেখেছিল। তার ধারণায় সে মুখটাই ভেসে ওঠল। ইমনেরও মনে হলো কিছুক্ষণ পূর্বের ঘটনা। সে বলল,‘আমাদের দেরি করা ঠিক হবে না। ভাইয়া আপনি চলুন। আশপাশটা খুঁজে দেখি।’
ইমন আর মাহতিম গাড়ি নিয়ে বের হয়ে পড়ল।
চলবে…
Sathi Islam : সাথী ইসলাম