ছায়া মানব ২
৫৬.
‘কী হয়েছে তোমার? উদাসীন লাগছে কেন?’
মাহতিম এক নজর তাকাল অহনার দিকে। তার নিষ্পাপ মুখশ্রী দেখে কখনোই তাকে অপরাধী মনে হয় না। মাহতিমের কোনো উত্তর না পেয়ে পুনরায় প্রশ্ন করল,‘কী হলো? কথা বলছ না কেন? আমার উপর রেগে আছ নাকি? কিছু তো বলো।’
মাহতিম নিরুত্তর। তার শরীরে আগুন জ্বলে যাচ্ছে। কীভাবে কী বলবে সে? অহনা বিচলিত হয়ে আরও কিছুটা এগিয়ে আসে। কাঁধে মাথা রেখে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে,
‘বলবে না? তোমার বিষণ্ণতা আমাকেও কষ্ট দেয়। কী হয়েছে তোমার? মুখ ফুটে বলেই দেখো, সব সমাধান করে দেব।’
মাহতিম আচমকা বলল,‘আমি ছাড়া আর কোনো পুরুষ তোমাকে ছুঁয়েছিল?’
এমন প্রশ্নে মাথা সরিয়ে নেয় অহনা। বড়ো বড়ো চোখ করে মাহতিমের দিকে তাকায়। প্রশ্নের বিপরীতে বলার মতো শব্দ খুঁজে পেল না। এ কেমন প্রশ্ন? ভাবনাতুর অহনা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল।
‘সন্দেহ করছ?’
‘এ প্রাণ থাকতে কখনোই নয়।’
‘হঠাৎ এমন প্রশ্ন কেন?’
মাহতিম কিছু বলল না। প্রশ্নটা যে বোকার মতো করে বসল, বুঝতে দেরি হলো না। কিন্তু কী করার ছিল? মন আনচান করছিল তার। ক্ষনিকের জন্য জ্ঞান হারিয়ে প্রশ্ন করেছে। অহনা বিচলিত হয়ে বলল,‘আমার জীবনে প্রথম পুরুষ তুমি। প্রথম স্পর্শও তোমার। যদি কখনো তোমায় ছাড়া অন্য কাউকে ছোঁয়ার প্রশ্ন আসে; তবে তার আগেই আমার মৃত্যু হোক।’
‘আমি তোমাকে বিশ্বাস করি।’
‘তাহলে এমন প্রশ্ন করার মানে কী? কেউ তোমাকে আমার বিষয়ে কিছু বলেছে?’
মাহতিম কিছু বলল না এ বিষয়ে। পর পরই বলল,‘শোনো আহি!’
অহনা নির্লিপ্ত বদনে বলল,‘বলো।’
‘তোমার সমস্তটাই আমার। যদি কখনো দেখি, তোমার হৃদয় অপবিত্র; তখনও আমি তোমাকেই চাইব। হাজার কলঙ্কের ছোঁয়া থাকলেও আমি তোমাকেই ভালোবাসবো। এ হৃদয়ছাড়া হবে না কখনো। তুমি একান্তই আমার।’
অহনার চোখ স্থির হয়ে আসে। মানুষটা আজ এত আবেগী হয়ে পড়েছে কেন? তার ভেতর থেকে কষ্ট কেন বের হচ্ছে? সে কি দুশ্চিন্তায়?
আচমকা সে মাহতিমের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। হু হু করে কেঁদে ওঠল,
‘আমার তুমি ছাড়া আমি মূল্যহীন! তোমার ছাড়া আর কারো অধিকার নেই আমাকে কলুষিত করার। আমি শুধু তোমার, একান্তই তোমার। তোমার দেওয়া যাতনাও আমি হাসি মুখে মেনে নিতে পারব।’
মাহতিম অহনাকে আগলে নেয়। ভেতরে থাকা আগুনটা এখন শান্ত হয়ে এসেছে। কিছুক্ষণ আগেও মনের ভেতর যে খচখচানি ছিল তা-ও এখন বাইরে বের হয়ে এসেছে। হঠাৎ করেই মাহতিমের কলটা বেজে ওঠে। আশিশ কল করেছে। এমন সময় কল দেখে কিছুটা চিন্তিত হয়েই রিসিভ করল,
‘হ্যালো!’
ওপাশ থেকে আশিশ বলল,‘সময় কম, আসল কথা বলি। অহনা মোটেও খারাপ মেয়ে নয়। এগুলো অনুজের চক্রান্ত। মেয়েটার দিকে তার নজর ছিল; তাই তাকে খারাপ প্রমাণ করতে চেয়েছিল। তোর থেকে সরিয়ে নিতে চেয়েছিল। সিমটাও অনুজের ছিল। সে-ই ছবিগুলো এডিট করেছে। এখানে অহনার কোনো অস্তিত্ব নেই। মেয়েটা নির্দোষ। আশা করি ওকে ভুল বুঝবি না।’
‘আমি জানি, অহনা নির্দোষ। তবে জানতাম না এটা অনুজের কাজ। বন্ধু হয়ে সে আমার এত বড়ো ক্ষতি কী করে করতে চাইল? ছি!’
কলটা রেখে দেয় সাথে সাথেই। তার হাত-পা কাঁপছে। বন্ধু নামক মানুষটার এমন ভয়ঙ্কর রূপ দেখে তার মন বিষিয়ে ওঠল। অহনাও এতক্ষণে কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছে। বলল,‘তাই তোমার মন এত খারাপ ছিল। কেউ আমার নামে বাজে কিছু বলেছিল তোমাকে।’
‘কতটা বাজে; তুমি সেটা কল্পনাও করতে পারবে না। আমি চাই না তুমি সেটা দেখতে চাও। এসব দেখলেও ঘৃণা হয়। চাই না তোমার চোখটাই অপবিত্র হয়ে যাক।’
‘কী হয়েছে বলবে আমাকে?’
‘তুমি ঠিক বলেছিলে, অনুজের নজর ছিল তোমার দিকে। সে তোমাকে পেতে চেয়েছিল। আমার কাছে তোমাকে খারাপ প্রমাণ করতে চেয়েছিল। কিছু বিচ্ছিরি ছবি পাঠিয়েছিল তোমার বিরুদ্ধে। ছি! আমার ইচ্ছে হচ্ছে না বন্ধুর সাথে এমন বিচ্ছিরি বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করি। অথচ সে এমন অন্যায় করে বসল। ঘেন্না হচ্ছে আমার।’
অহনা মাহতিমের হাত দুটো নিজের সাথে চেপে ধরল,‘বন্ধুই সবসময় শত্রু হয়। যদি বন্ধু হয়ে না মেশে তবে ক্ষতি করবে কী করে? লোকটাকে আগেই আমার সন্দেহ হয়েছিল। তুমি তার থেকে দূরে থাকবে। বাজে মানসিকতা তার।’
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল মাহতিম। অহনাকে দু’হাতে আলিঙ্গন করে প্রশান্তিতে চোখ বন্ধ করল,
‘তুমিই আমার সর্বসুখ।’
‘আমারও।’
দুজনের প্রেম বিনিময় শান্ত হলেই মাহতিম তপ্ত হয়ে মোবাইলের দিকে তাকাল। অনুজের ফোনে কল করল না। গিয়েই দেখা করবে বলে ভেবে নেয়। অহনাকেও বলল,‘আমার সাথে চলো। তার শাস্তি তুমিই দেবে। সে আমার কাছে একটা পিঁপড়ার সমতুল্য। তুমি হয়ত একটু কম শাস্তিই দেবে।’
অহনাও সায় দেয়। দুজনেই অনুজের এপার্টমেন্টের দিকে রওনা হয়। সময় বেশি লাগল না।
অনুজের মাথা ব্যথা করছিল খুব। সে এসিটা বাড়িয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে রইল। মুহুর্তেই আশিশের কল আসে। বিচলিত না হয়েই কল ধরল। সাথে সাথেই আশিশ বলল,‘তোর চক্রান্তের কথা জেনে গেছে মাহতিম।’
অনুজ সচকিত হয়ে উঠে বসল,‘কে বলেছে?’
‘তা জানি না। এখন তোর বাড়ির দিকেই আসছে। পারলে পালিয়ে যা। মাহতিম ভয়ঙ্কর! তার সাথে প্রকাশ্যে লড়াই করা উত্তম হবে না।’
অনুজের মাথা ঘুরে গেল। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল মাহতিমের গাড়ি থেমেছে। সে তাড়াহুড়ো করে জানালা দিয়ে এক পা বের করে দেয়। পর পরই পা সরিয়ে ঘরের ভেতরেই কিছু খোঁজার চেষ্টা করে। লুকানোর জায়গা পাচ্ছে না সে। কী করবে তা-ও বুঝতে পারছে না। কোনোরকমে জানালা দিয়ে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। দেরি করল না। বের হয়ে গেল। মাহতিম ঢুকেই কাউকে দেখতে পেল না। ঘরের দরজা খোলা; অথচ অনুজ নেই। বিষয়টা ভাবালো তাকে। পুরো ঘর খুঁজেও পেল না। জানালা দিয়ে তাকাতেই দেখল গাড়ি নিয়ে চলে যাচ্ছে অনুজ। মাহতিমের আর বুঝতে বাকি রইল না, অনুজ তার ভয়েই পালাচ্ছে। অহনা হেসে ফেলল। এমন মুহুর্তেও অহনার হাসি আসছে দেখে মাহতিম কিছুটা বিরক্ত হলো।
‘হাসছ কেন?’
অহনা হাসি থামিয়ে দেয়,
‘ছেলেটা তোমাকে ভয় পেয়েছে। যেভাবে প্রাণ নিয়ে ছুটছে; মনে হলো তুমি তাকে খেয়ে নেবে।’
‘সামনে পেলে খেয়েই নিতাম।’
‘আশা করি মুখ নোংরা করতে না। এখন চলো, বাড়ি যাব। আজ তো বর্ষণ ভাইয়ের বিয়ের দ্বিতীয় দিন। আমাদের না দেখলে সবাই খুঁজবে। আসার সময় মোহনাও দেখেছে আমাদের। দূরত্ব বেশি থাকায় কথা বলতে পারেনি। আমাদের চলে যাওয়া উচিত।’
‘তুমি স্বাভাবিক ধরে নিলে বিষয়টা। ওকে সামনে পেলে মেরে ফেলব।’
‘একটু ভয় দেখিয়ে দিও। আর কিছু করার দরকার নেই। এমনিতেও ভয় পেয়েছে।’
জয়ন্ত কল করল। মাহতিম গাড়িতে উঠতে উঠতেই কল ধরল। সাথে সাথেই জয়ন্ত বলল,‘মিটিংয়ে এটেন্ড করো দশটার মধ্যেই। একটা নারী পাচারকারী দল দিনদিন আরও উন্নত হচ্ছে। শিঘ্রই তাদের ধরতে হবে। তাছাড়া নিমোকে ক্যাপ্টেন করা হয়েছে। বিষয়টা জানানো হয়নি তোমাকে। অফিসে আসো, বাকিটা জানতে পারবে।’
নিমোর প্রমোশনে মাহতিম বেশ খুশি হলো। লোকটা সবসময় তাকে সাপোর্ট করেছে। যেকোনো অবস্থাতেই সঙ্গ দিয়েছে। প্রতিবার তাকে বুদ্ধি দিয়েছে সঠিক কাজ করার। মাহতিম অহনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে নিজে অফিসে চলে গেল। অনুজ উপস্থিত ছিল। মাহতিমকে নজরে পড়তেই পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু পারল না। মাহতিম পেছন থেকেই তার কলার চেপে ধরে। কিছুটা আড়ালে নিয়ে গিয়ে সপাটে চারটা চড় দিল। তাল সামলাতে না পেরে অনুজ ছিটকে পড়ে। মাহতিম অকপটে বলল,‘তুই আমার বন্ধু বলেই ছেড়ে দিলাম। আশা করি আর কখনো এমন নোংরা খেলা খেলবি না আমার সাথে। আমি চাই না তোর নামে মামলা করে বন্ধুত্বকে অসম্মান করতে। এটা বললেও ভুল হবে। আমাদের মধ্যে আর কোনো বন্ধুত্ব নেই। যা অতীতে ছিল, তা ভুল ছিল। আমি এটাকে একটা অপ্রয়োজনীয় অধ্যায় ভেবে পেলে দিয়েছি। আশা করি তুইও ভুলে যাবি। আমাকে একটু শান্তি দে। আমি শুধু আহিকে নিয়ে একটু শান্তিতে থাকতে চাই; আর কিছুই না। এভাবে শত্রুতা করে সম্পর্ক নষ্ট করিস না।’
অনুজ আচমকা মাহতিমের পা জড়িয়ে ধরল,‘আমি ভুল করেছি। আর কখনোই এমনটা হবে না। এটা ঠিক, আমি অহনার প্রতি দুর্বল ছিলাম। জানিস তো, এসব আকর্ষণ মানুষকে খারাপ কাজ করতেও বাধা দেয় না। আমিও না বুঝে অন্যায় করে ফেললাম। আমি অহনার কাছেও ক্ষমা চাইব।’
‘ওর সামনে দাঁড়াতে পারবি? এমন চোখ আছে তোর?’
অনুজ নীরব হয়ে গেল। মাহতিম পুনরায় বলল,‘তুই ভালো হয়ে গেলে আমিও সব ভুলে যাব।’
‘আমি ভালো হয়ে গেছি। আর কখনো তোর সাথে শত্রুতা করব না। আমি সত্যিই সরি!’
মাহতিম ঈষৎ হেসে প্রস্থান করল। তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে অনুজ শয়তানি হাসি দিল। চোখের কোণে থাকা এক ফোঁটা জল আঙুলের ঢগায় নিয়ে সেটাকে টোকা মেরে ফেলে দিল। পর পরই বাঁকা হেসে উচ্চারণ করল,‘আমি অবশ্যই ভালো হয়ে গেছি। এবার আর কোনো প্রমাণ রেখে ভুল করব না। এবারেরটা হবে প্রতারণা এবং ছলনা।’
চলবে…
Sathi Islam : সাথী ইসলাম