ছায়া মানব ২
১৪.
অহনা ভেবেছিল মাহতিম হয়ত পারবে না। অথচ তাকে চমকে দিয়ে মাহতিম প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে। অহনা তার গতি দেখে মুগ্ধ। বুঝতে পারেনি এতটাও সাহস রয়েছে মাহতিমের মাঝে। সাহস নয় এটাকে বলা যায় তেজ। অহনা বেশ খানিকটা চিন্তিত। অবশেষে ট্রাক থামল একটি কনট্রাক্টের সামনে। মাহতিম তাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। বেশ খানিকটা আঘাতও লেগেছে। তবে মনটা অনেকটাই শান্ত, সে পেরেছে শর্ত রাখতে। অবশেষে ধরতে পেরেছে ট্রাকটাকে। তার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। টানা আড়াই ঘন্টা দৌড়ানো সাধারণ কথা নয়। মাহতিম সেটা করে দেখিয়েছে।
অহনা চিন্তায় পড়ে গেল। প্রচন্ড ভয় কাজ করছে এই মুহুর্তে এসে। কাজটা ঠিক করল নাকি ভুল, সেটাই এখন ভাবার বিষয়। নিজেই নিজেকে কয়েকবার বকলো। চিন্তায় কপালের ভাঁজ স্পষ্ট। তমা পেছন থেকে এসেই তার ঘাড় স্পর্শ করতেই কেঁপে ওঠে। বুকের ভেতরটা আঁকুপাঁকু করছে। তমা জিজ্ঞেস করার পরেও সঠিক কথাটা বলল না অহনা। তার থেকে সমস্তটা এড়িয়ে গেল। এদিকে ক্লাসও প্রায় শেষদিকে। তবে ওসমান, রাবি, ফারাহ ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বাইরে বের হলো। তাদের উদ্দেশ্য আড্ডা দেবে পার্কে বসে। সাধারণত এই কলেজ ফাঁকি দেওয়াটা তাদের কাছে তুচ্ছ বিষয় বলেই মনে হয়। বাইক থেকে গিটারটা তুলেই টুংটাং শব্দ করল ওসমান। আশেপাশের কয়েকটা মেয়ে তার সুরের টানে তাকে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছিল। কেউ কেউ ভাব জমানোর জন্য এগিয়েও এলো। ওসমান গানের সুর তুলল,
মন আজও পথ চেয়ে রয়,
তুমি আসবে বলেছে হৃদয়!
কেন অভিমান করে, চলে গেলে তুমি
এ ব্যথা প্রাণে নাহি সয়!_
অহনার বিষন্ন মন গানের দিকে মনোযোগ দিতেই কিছুটা হালকা হলো যেন। গান থেমে যেতেই আবার বিষন্ন হয়ে যায়। নিজের প্রতি খুব রাগ হয়। ওসমান দূর থেকে সেটা খেয়াল করল। ওঠে অহনার কাছে আসতে চাইলেই ফার্স্ট ইয়ারের একটি মেয়ে যেচে কাছে আসে। ওসমান তার দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলল,’পরে কথা হবে।’
মেয়েটা ওসমানের এমন আচরণের কোনো মানে না পেয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল। ওসমান অহনার কাছে এগিয়ে গেল। ফারাহ, রাবি, তমা অনেক জিজ্ঞেস করার পরেও কিছুই বলেনি। ওসমান এসেই বলল,’দেখে মনে হচ্ছে পরীক্ষায় ফেল মে’রেছিস! কিন্তু আমাদেরতো কোনো পরীক্ষা হয়নি ! কারণ কী এমন বাঁদরের মতো মুখ করে থাকার?’
অহনা রেগে গেলেও শান্ত হওয়ার চেষ্টা করে। কারণ তার এমন অদ্ভুত রাগের কারণেই সে অন্যকে বিপদে ফেলে। নাক ফুলিয়ে ওসমানের দিকে তাকাতেই সে বলল,’মন খারাপ সেটা আমি জানি। তবে কারণটা জানা জরুরী, না হয় সমাধান করতে পারব না। বলতে পারিস!’
অহনা অনেকটা কাঁদো কাঁদো হয়েই বলল,’সব আমার দোষ। আমার জন্যই আজ আবার কেউ বিপদে পড়ল। জানি না এখন কেমন আছে।’
‘যা ভাবছি তাই হলো। তুই কি আর বড়ো হবি না? কেন সবাইকে জ্বালাস? কী করছিস সেটা বল।’
‘একজনকে বলেছি চলন্ত একটা ট্রাকের পেছনে দৌড়াতে যতক্ষণ না সেটা থামছে। যদি সে পারে তবে তার সাথে রিলেশন করব।’
‘শর্ত দিয়ে ভালোবাসা? এটাই করার বাকি ছিল শেষমেশ। তোর প্রতি রাগ হচ্ছে আমার।’
‘ আমারো রাগ হচ্ছে খুব।’
ওসমান ব্রু কুঁচকে বলল,’কার ওপর?’
‘নিজের ওপর।’
বলতে বলতেই কেঁদে ফেলল অহনা। ফারাহ ওকে সান্ত্বনা দিতে বলল,’একটা ছেলে মানুষের জন্য তোর চিন্তা হচ্ছে কেন? না পারলে সে হাল ছেড়ে দেবে। হয়ত হেরে গিয়ে বাড়িতে বসে আছে।’
‘ওনি এমন ছেলে না। প্রাণ দিয়ে দেবে জেতার জন্য! সবচেয়ে বড়ো কথা, আমিতো ওনার গতি খেয়াল রেখেছি তাই না!’
‘তুই চিনিস? কে সে?’
‘মাহতিম। জঙ্গলে পথ হারানোর পর যিনি সাহায্য করেছিলেন। মনে নেই তোর? আমার উচিত হয়নি তাকে এমন শর্ত দেওয়া। এবার কী হবে?’
‘ কী হবে আর। যা হবার তাই হবে।’
ওসমান কিছুটা সরে দাঁড়ালো। হঠাৎ করেই তার খুব রাগ হলো। গিটারটাকে পাশে রেখেই কাউকে কল করল। পরপরই অহনার কাছে এসে বলল,’এখন বাড়ি যা। বাকিটা আমি দেখছি।’
‘ না! আমি বাড়ি যাব না।’
ওসমান আরো খানিকটা রেগে গেল। এক হাতের আঙুল দিয়ে অন্য হাত শক্ত করে চেপে ধরল। ফারাহ, তমা, রাবিকে বলল চলে যেতে। সে অহনাকে পৌঁছে দেবে। ইতমধ্যে মোহনাও চলে এলো। মোহনাকে দেখে ঢোক গিলল অহনা। জিজ্ঞেস করলে কী উত্তর দেবে ভেবে পেল না। মনে মনে হাজারবার চাইল, মোহনা যেন তাকে প্রশ্ন না করে। কিন্তু তাই হলো। মোহনা জিজ্ঞেস করল,’কী হয়েছে অহনা, তোমাকে এতোটা স্যাড লাগছে কেন? কোনো কিছু নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছ নাকি?’
অহনা উত্তর খুঁজে পেল না। তবে ওসমান বলল,’ওর শরীরটা একটু খারাপ, আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি।’
‘ কী হয়েছে ওর? আমিও যাব ওর সাথে।’
‘না, লাগবে না। আমি পৌঁছে দিতে পারব।’
মোহনা যেতে চাইল না। তবে অহনাও তাকে জোর করল চলে যেতে। তবুও মনে খচখচানি রয়েই গেল মোহনার। সে শান্ত হতে পারল না। বিষন্ন হয়েই পা বাড়ালো গাড়ির দিকে।
ওসমান অহনাকে ম্যাচে নিয়ে গেল। ওর মন ফুরফুরে করার জন্য নিজ হাতে কপি বানিয়ে আনলো। অহনা চুমুক দিতে পারল না। বিরক্তিতে ‘চ’ সূচক শব্দ করল। অহনার কাছে মাহতিমের নাম্বার চাইলো। নেই বলল প্রথমে। পরপরই বলল,’আছে আমার কাছে।’
ওসমান রাগী চোখে তাকাল অহনার দিকে। তার কান্নারত মুখশ্রী দেখে রাগ আর বেশিক্ষণ টিকলো না। বলেই ফেলল,’নাম্বার যদি থেকেই থাকে, তবে কল করলিনা কেন?’
‘তখন জানতাম না আমার কাছে নাম্বার ছিল। এখন মনে হলো।’
‘ অদ্ভুত একটা মেয়ে। দাঁড়া আমি কল করছি।’
মাহতিম ভীষণ খুশিতে ফেটে পড়ছে। অহনার বোকা মুখটা দেখার জন্য সে খুব দ্রুত আসার চেষ্টা করছে। কিন্তু বাসে আসায় জ্যাম ছাড়ছে না। এরই মাঝে কলটা বেজে ওঠল। অপরিচিত নাম্বার দেখে রিসিভ করবে কিনা দ্বিধায় পড়ে গেল। অবশেষে কলটা ধরল। ওসমান ফোনের ওপাশ থেকে মাহতিমের স্বর পেয়ে আর কোনো কথা বলল না। সোজা কলটা অহনার কানে ধরল,’নে, কথা বল।’
‘কার সাথে?’
‘এতক্ষণ যার জন্য মরা কান্না জুড়ে দিয়েছিলি তার সাথে।’
অহনা খুশিতে গদোগদো হয়ে কলটা ধরল। কাঁপাকাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,’আপনি ঠিক আছেন?’
মাহতিম ফোনটাকে নিজের বক্ষে স্থান দিল। ‘আপনি ঠিক আছেন’ এই শব্দটা তাকে ভেতর থেকে আরো কাবু করে দিল। যেন সে এটাই শুনতে চেয়েছিল। অবশেষে শুনতে পেয়ে আনন্দ আর বাঁধ মানছে না। অহনা কিছুটা বিচলিত হয়েই পুনরায় বলল,’কী হলো, কথা বলছেন না যে? আপনি ঠিক আছেন?’
মাহতিম ছোট করে উত্তর দিল,’হু!’
‘আমি ম্যাচে আছি। আপনি ভালোয় ভালোয় বাড়ি চলে যান। আজ আর দেখা হবে না।’
‘ আমি আসছি দ্রুত।’
‘না, আসতে হবে না। আমি কাল কথা বলে নেব।’
মাহতিম কলটা কেটে দিল। অহনা কিছুটা দুশ্চিন্তামুক্ত হলো। এতে হার জিতের ব্যাপারটা এখন মাথায় চেপে বসেছে। এতক্ষণ মাহতিমের চিন্তা থাকলেও এখন পরিবর্তন হয়ে গেল সেটা। ওসমানের দিকে করুণ চোখে তাকাল,
‘এবার আমার কী হবে?’
‘ যা হবার তাই হবে। ইচ্ছে করছে তোকে কয়েকটা চ’ড় বসিয়ে দিই। কখনোই ভেবে কথা বলতে পারিস না।’
ওসমান নিজেই চিন্তায় পড়ে যায়। মাথায় হাত তার। অহনা মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। সাড়ে তিনটা বাজতেই হাজির হলো মাহতিম। অহনা ওসমানের হাতে চেপে ধরল,’ভাই, তুই দরজা খোল আমি লুকিয়ে পড়ি। বলবি আমি হারিয়ে গেছি।’
‘তোর কী মনে হয়, ছেলেটা বাচ্চা? সে তোর চালাকি ধরতে পারবে না?’
‘ আমি ওয়াশরুমে চলে যাই। তুই কষ্ট করে ম্যানেজ করে নে।’
‘আমি পারব না। আমার হাত ছাড়। আজকে শিক্ষা হলে আর কখনো এমন কাজ করবি না।’
অহনা ওকে ছাড়ছেই না। ওসমান ওকে টপকে গিয়ে দরজা খুলে দিল। অহনা এখনো ওসমানের হাত দু’হাতে চেপে ধরে রেখেছে। মাহতিমকে চোখের সামনে দেখতেই পেছনে লুকিয়ে গেল। মাহতিমের চোখে শুধু প্রথমের বিষয়টাই ধরা দিল। অহনা ভয়ে ছিল। ওসমানকে সে ভরসার দেয়াল ভেবে ধরে রেখেছিল। মাহতিম বুঝতে পারলো, তার আসাতে খুশি হতে পারেনি অহনা। তার হৃদ গগনে যেন ভারী মেঘের পর্দা জমে গেল। মুখটা তার ভীষণ ফ্যাকাশে হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার কষ্টটা হয়ত সার্থক হয়নি, সেটাই ভেবে নিল। যার জন্য এতো বড়ো ঝুঁকি সে তার থেকে পালাতে চায়। নিজের প্রতি নিজেরই ভীষণ দয়া হচ্ছে। মাহতিম পেছন ফিরে দাঁড়াল। কোনো কারণে তার চোখের পানিটা আঁটকে গেল। পা বাড়ালো পেছনের দিকে।
চলবে….
Sathi Islam : সাথী ইসলাম
গল্পটা সম্পর্কে জানতে এবং মতামত প্রকাশ করতে জয়েন করুন সাথীর পাঠকমহল (পাঠক+পাঠিকা) – Sathi’s Readership