ছায়া মানব ২
২৩.
মামুনের কল আসায় সে কিছুটা বিরতি নিল। আনিফা খেয়াল করল অহনার লাগেজের দিকে,
‘চলে যাওয়ার জোগাড় করছিলে নাকি?’
অহনা মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিল। আনিফা অহনার মাথায় হাত রাখল,
‘তুমি আমাদের আপন ভাবতে পারোনি তাই না? আমরা হয়ত তোমার আপন হতে পারিনি। না হয় চলে যাওয়ার কথা চিন্তাও করতে না।’
‘না, তেমনটা নয়। কিছুদিন পর পরীক্ষা। ভাবছি হোস্টেলে থেকে পড়ব। কাছেও হবে অনেকটা।’
‘যাওয়ার কথা ভেবো না। একেবারে রেখে দেওয়ার প্ল্যান করেছি।’
অহনা চমকে ওঠল। কথাগুলো তার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল। প্রশ্নবিদ্ধ মুখে তাকিয়ে রইল। মামুন কল রেখেই শান্ত হয়ে বসলো। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকেই বলল,’জোর করে চাপিয়ে দেওয়াটা আমি পছন্দ করিনা। তাই ছেলে বলার সাথে সাথেই তোমার অনুমতি নিতে এলাম। তোমার মত থাকলে তোমার বাবার সাথে কথা বলব। ওনি আগেই বলেছেন, তোমার মতামতই ওনি মেনে নেবেন।’
অহনা মৃদু হাসল,’আপনারা কোন বিষয় নিয়ে কথা বলছেন? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। বাবার সাথে কী নিয়ে কথা হলো আপনাদের?’
‘তোমার বিয়ে নিয়ে। ছেলেটা নিজের মুখে এসে বলল, সে তোমাকে পছন্দ করে। তুমিও তাকে পছন্দ করো শুনলাম। তাই তোমাকে জানাতে এলাম। আমার ছেলেকে কি তোমার সত্যিই ভালো লাগে?’
অহনার চোখে-মুখে ভাবনা দেখা দিল। তার বাবাকে আগেই জানানো হয়েছে। তাহলে বাবা কেন আগে বলল না সবটা? কেন লুকিয়ে রেখেছে? এখন সে কী উত্তর দেবে? ছোট্ট মাথায় কিছুই এলো না। দ্বিধান্বিত হয়েই দাঁড়িয়ে রইল। মনে মনে বলল,’এই বাড়িতে আসাই তবে আমার সবচেয়ে বড়ো ভুল। জীবনে যদি খুব বড়ো ধরণের বিপদে পড়ে থাকি তবে সেটা এই বাড়িতে এসে। মুক্তি কবে পাব?’
আনিফা অহনাকে পুনরায় জিজ্ঞেস করল,’কী হলো? আমার ছেলে যা বলেছে তা কি সত্যি? তুমিও কি তাকে পছন্দ করো?’
অহনা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। সে সত্যিই মাহতিমকে পছন্দ করে ফেলেছে এই কয়দিনে। নিশ্চয় মাহতিমই আনিফাকে সবটা বলেছে আজ। অহনার চোখে-মুখে লজ্জা ভীড় জমালো। যদিও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে এখনো তবুও মনে হলো বুকের ওপর হতে খুব বড়ো একটা বোঝা নেমে গেছে। মামুন ‘আলহামদুলিল্লাহ ‘ বলে ওঠল,
‘ঠিক আছে। তোমার বাবাকে তবে আসতে বলি।’
আনিফা চট করেই বলল,’ওনাকে আর বিরক্ত করা ঠিক হবে না। তুমি নিজেই যাও বরঞ্চ। ছেলের বাড়ি থেকেই বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো নিয়ম।’
মামুন অহনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। পরপরই চলে গেল ঘর থেকে। আনিফাও বেশ খুশি। খবরটা সবাইকে জানাতে চলে গেল।
অহনা পুনরায় সব বের করল লাগেজ থেকে। কেন জানি মনটা খচখচ করছে তার। কিছুতেই নিজের সিদ্ধান্তকে ঠিক বলে মনে করল না। কিন্তু খানিক ভেবেই বিড়বিড় করে বলল,’আমারতো সত্যিই ওকে ভালো লাগে।’ তার শ্যামবর্ণীয় দেহ, মায়াবী মুখশ্রী, সুঠাম দেহ সবকিছুই কেমন মনে পড়ল অহনার। খুব বেশি ভালো লেগে গেল।
সবেমাত্র বর্ষণকে কোনোরকমে টেনে নিয়ে এলো নিহা। অনেকটাই অচেতন সে। বিছনায় শুইয়ে দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে শিয়রে বসে রইল। ঘুমন্ত বর্ষণকে দেখতেও ভালো লাগছে তার। অনুভব করল কিছু একটা। একটু আগের স্পর্শ এখনো মাথা থেকে যায়নি। এখনো আগের উষ্ণতা অনুভব করছে। দুহাতে নিজেকে আঁকড়ে ধরেই বর্ষণের দিকে নজর দিল। ঝুঁকতেই বর্ষণ নিহার একহাতের ওপর মাথা রাখল। নিহা সরানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টা করল না। আয়েশ করে ঘুমাচ্ছে ছেলেটা। বাধা দেওয়া ঠিক হবে না। তার কোমল মনে বাসনা জাগ্রত হলো। কিছুটা ঝুঁকে গালে হাত রেখে বর্ষণের চোখের পাতায় চোখ রাখল। শ্যামবর্ণের মুখশ্রী দেখে সহসাই তার বুকের ভেতর হাতু’ড়ি পে’টা শুরু হয়েছে। ভালো লাগছেও ভীষণ। বর্ষণ এবং মাহতিমের চেহারার অনেকটা মিল। কিছু একটা ভাবল। পরক্ষণেই বর্ষণের মাথাটা সরিয়ে বালিশে রাখার চেষ্টা করল। অসাবধানতায় তার বুকের ওপর পড়ে গেল। কিছুটা আ’ঘাত পেতেই বর্ষণ জেগে ওঠে। নিহাকে নিজের এতোটা কাছাকাছি দেখে ব্রুজোড়া কুঁচকে আসে,
‘তুমি এখানে?’
নিহা উঠে যায় দ্রুত। চুল ঠিক করে এদিক ওদিক তাকাল। যেন কিছু খুঁজছে সে,
‘আমি কিছু করিনি। আমিতো তোমাকে ঠিক করে রাখার চেষ্টা করছিলাম, তুমি ক্লান্ত ছিলে।’
‘কী হয়েছিল? তুমি এখানে! যাই হোক।’
বর্ষণ মাথাটা চেপে ধরল। প্রচন্ড ব্যথা হচ্ছে। যদি ঘুমটা ভালোভাবে হতো তবে এই সমস্যা আর দেখা দিত না। নিহা কোনো রকমে বাহানা দিয়েই বলল,’তুমি রেষ্ট নাও। আমি আসছি।’
পা বাড়াতেই আনিফার মুখোমুখি। পাশ কাটিয়ে চলে যায়। আনিফা জানে নিহার উদ্দেশ্য! পছন্দও করেননা তেমন। তবে আজকাল আর বিরক্ত লাগছে না তাকে। ভালোই মনে হচ্ছে। তার চলাফেরা পরিবর্তন হয়ে গেল যেন এক নিমিষেই। বর্ষণের দিকে তাকাতেই আঁতকে ওঠল।
‘কী হয়েছে বাবা? তোর কি শরীর খারাপ করছে? শরীরের এমন অবস্থা কেন?’
‘কিছু না আম্মা। মাথাটা একটু ব্যথা করছিল শুধু। তুমি হঠাৎ এখানে কেন? কিছু বলবে?’
‘বলতেই এসেছিলাম। কিন্তু এখন বিশ্রাম নে, আমি ঔষধ দিচ্ছি।’
‘, কিছু হয়নি। তুমি বলো।’
আনিফা মৃদু হাসল,
‘তর সইছে না বুঝি? আচ্ছা শোন, অহনার কথা বললি না তুই? আমি ওর সাথে কথা বলেছি।’
বর্ষণ বিরক্ত প্রকাশ করে,
‘তুমি আবার ওর সাথে কথা বলতে গেলে কেন? আমার তোমাকে কিছু বলার ছিল। তার আগেই তুমি…’
‘কী বলছিস এসব? তুই বললি তুই ওকে পছন্দ করিস। আমি ওকেও জিজ্ঞেস করলাম, মেয়েটাও তোকে পছন্দ করে বলল। তোর বাবাও খুব খুশি। কালই অহনার বাবার সাথে দেখা করতে যাবে। বিয়ের প্রস্তাব রাখবে।’
বর্ষণের চোখ কপালে। এক মুহুর্তেই যেন তার সব ব্যথা উধাও হয়ে গেল। উঠে দাঁড়াল,
‘অহনা রাজি হলো?’
‘ হ্যাঁ! ওর সম্মতি না থাকলে আমি কখনোই বলতাম না। কিন্তু তুই উঠে গেলি কেন?’
‘আমার মাথা ব্যথা নেই। এমনকি কোনো ব্যথাই নেই।’
আনিফা হাসল। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,’বোকা ছেলে। শান্ত হয়ে শুয়ে পড়।’
বর্ষণের বিশ্বাস হচ্ছে না অহনা সম্মতি দিল। আম্মাও যে মিথ্যে বলবে না, তা তার বেশ ভালো করে জানা আছে। কিন্তু বিশ্বাস করতেও যে কষ্ট হচ্ছে। নাকি মাহতিম আর অহনার মাঝে কিছুই ছিল না। সে রাতে সে ভুল দেখেছে এমনটা হয়েছে কি? হাজারো ভাবনা মনে আসে। ভাবল, একবার অহনার সাথে দেখা করা দরকার। তার মুখ থেকেই সবটা শোনা জরুরী। কিছুক্ষণের জন্য এটাও ভাবল, অহনা তার ভাইকে ঠকাচ্ছে নাতো? এতো এতো চিন্তা নিয়েই ধপাস করে খাটে বসে পড়ল।
দরজার আড়াল থেকে পুরোটাই লক্ষ্য করল নিহা। আনিফা আর বর্ষণের সব কথোপকথন শুনেছে। এমনকি বর্ষণের চঞ্চলতাও দেখল। নিহা হাসার চেষ্টা করল। চোখের কার্ণিশে বেয়ে আসা পানি বাম হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে নিল। ওপরে তাকিয়ে চোখ নিবদ্ধ করে দীর্ঘশ্বাস নিল। নিজেকে সামলে নিয়ে পুনরায় বর্ষণের ঘরে গেল। অন্যমনস্ক বর্ষণকে বলল,’বাহ্! তোমাকে খুব খুশি দেখাচ্ছে। আমিও নিশ্চিন্ত, তুমি এবার আর কষ্টে কান্না করবে না।’
‘তুমি জানো না বিষয়টা?’
‘জানি, সেজন্যই কনগ্রেটস করতে এলাম। আমার পক্ষ থেকে তোমার আর অহনার জন্য অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা রইল। আশা করি তোমরা অনেক সুখী হবে। আমার দোয়া সবসময় তোমাদের ওপর থাকবে।’
‘ধন্যবাদ!’
বর্ষণ সুক্ষ্ম নজর দিল নিহার ওপর। নিহা চলে যেতে চাইলেই বলল,’তুমিও কি কাঁদছ? কী হয়েছে তোমার?’
নিহা কোনোরকমে চোখের পানিটা আড়াল করে বলল,’কই নাতো। আমি কাঁদছি না। আমি কি তোমার মতো ছ্যাকা খেয়েছিলাম নাকি যে কাঁদব?’
মুহুর্তেই নিহা গাঢ় করে হাসার চেষ্টা করল। বর্ষণ তার সাথে যোগ দিতে পারল না। মনে হচ্ছে সত্যিই সে দুঃখী। কিন্তু কেন? সে কি খুশি হয়নি তার খুশিতে? নিহা আর কথা বাড়ালো না। চলে গেল হনহন করে। যেন পালাতে পারলেই বাঁচে। বাইরে যেতেই তার কান্নার বেগ যেন আরো বেড়ে গেল। বুক ফেটে বেরিয়ে এলো,’কেউ আমাকে ভালোবাসলো না। বারবার আমিই কষ্ট পেলাম।’
মুখ চেপে ধরে প্রস্থান করল।
চলবে….
Sathi Islam : সাথী ইসলাম
পাঠকমহলের জন্য সাথীর পাঠকমহল (পাঠক+পাঠিকা) – Sathi’s Readership