ছায়া মানব ২
৩১.
সকাল সকাল মাহতিম ফিরে এসেছে দেখে সবাই বেশ অবাক হলো। অহনা এখনো ঘুমাচ্ছে। রাত বললে ভুল হবে, আজ সকাল সাড়ে চারটার সময় মাহতিম ওকে পৌঁছে দিল। ঠিক দুই ঘণ্টা পরেই আবার বাড়ি ফিরে এলো। রাত জাগার কারণে চোখের কিছুটা অবনতি হয়েছে। আনিফাকে বলল,‘আম্মা, আমি ঘরে গেলাম। রাতে ঘুম হয়নি। ডিস্টার্ভ যেন না করে কেউ।’
মোহনা অহনাকে ডাকতে গেল। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই মাহতিম জিজ্ঞেস করল,‘কোথায় যাচ্ছিস ওদিকে?’
‘অহনাকে ডেকে আনি। এখনো ওঠেনি।’
মাহতিম দ্রুত বলল,‘ওকে ডাকার কী আছে? নিজের ইচ্ছে হলেই ওঠবে। বিরক্ত করিস না।’
‘ও তো সকালেই ওঠে। বিরক্ত করব কেন? আমি উঠিয়ে দিলে ওর জন্য সহজ হবে।’
মাহতিম মোহনার পথ আঁটকে দাঁড়ায়,‘কথা কানে যায় না? বড়োদের কথা শুনতে হয়। যা, গিয়ে পড়তে বোস। অন্যকাউকে বিরক্ত করিস না।’
‘তোমাদেরতো ব্রেক আপ হয়ে গেছে। তাও এত দরদ দেখাচ্ছ কেন?’
‘এসব তোকে কে বলল? বাজে কথা সব। সর এখান থেকে। আর শোন, ভুল করেও আহিকে ডাকবি না। কাল রাতে ঘুমায়নি সে।’
বলেই মাহতিম চলে গেল। এদিকে মোহনা বোকা বনে গেল। আহি কে? কেন ঘুমায়নি সে? না ঘুমালে ওর কী? সবটা ভেবেই মোহনা হাত নাড়তে নাড়তে অহনার ঘরে গেল। দেখল সাদা গাউনে আবৃত অহনা। ঘরের দরজাটাও খোলা। বেশ অবাক হয়েই অহনাকে ডাকল। অহনা গায়ের অর্ধেকে লেপ মুড়ি দিয়ে শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। মোহনা বেশ কয়েকবার ডাকতেই অহনা ঘুম কাতুরে মুখে বলল,‘বিরক্ত করো না। রাতে ঘুমাতে পারিনি।’
মোহনা যেন আকাশ থেকে পড়ল। একটু আগে মাহতিমও বলে গেছে সে রাতে ঘুমায়নি এবং আহি নামের কেউ ঘুমায়নি। এদিকে অহনাও একই কথা বলছে। মোহনা তৎক্ষণাৎ আহি এবং অহনা নামটা কয়েকবার উচ্চারণ করল। নাম দুটোতে মিল পেতেই বলল,‘আহি আর অহনা কি একই ব্যক্তি? হবে হয়ত। কিন্তু ভাই কী করে জানে, অহনা রাতে ঘুমায়নি?’
প্রশ্ন রয়েই গেল। তবে অহনাকে জাগালো না। ঘুম থেকে উঠলেই সবটা জিজ্ঞেস করবে।
বেলা দশটা বাজতেই অহনা আড়মোড়া ভেঙে ওঠল। সামনেই দেখল মোহনা দাঁড়িয়ে আছে। অহনা কিছুটা হকচকিয়ে জিজ্ঞেস করল,‘আমাকে পাহারা দিচ্ছিলে নাকি?’
‘না, তবে অপেক্ষা করছিলাম। রাতে কোথায় ছিলে?’
আচমকা প্রশ্নে অহনা মুখ ঘুরিয়ে বলল,‘ঘরেই ছিলাম।’
‘দরজা খোলা কেন?’
অহনা আমতাআমতা করে বলল,‘বাতাসে হয়ত।’
‘গায়ে গাউন কেন? মনে তো হচ্ছে কোনো রাজকুমারী। না হয় চাইনিজ বিয়ের ড্রেস। কাকে বিয়ে করেছ তুমি?’
‘তেমন কিছুই না। এই ড্রেসটা আমি কিনেছি।’
‘রাতে ঘুমাওনি কেন?’
অহনা পুনরায় মিথ্যে বলল,‘কে বলল ঘুমাইনি। অনেক ঘুমিয়েছি। আমি একটু বেশি ঘুমাই তাই।’
মোহনা অহনাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,‘এতো লুকোচুরি কেন? আমি কি তোমার বন্ধু না? কী লুকাচ্ছ আমার থেকে? একটা প্রশ্নেরও সঠিক উত্তর দিলে না। মাহতিম ভাই কী করে জানলো তুমি রাতে ঘুমাওনি? আর আহিটা কে? তোমার কী হয়?’
অহনা হকচকিয়ে ওঠে,
‘মাহতিম এসেছে?’
‘ভাই বলল, কাল রাতে তোমরা একসাথে ছিলে। এটা কি সত্যি?’
অহনা বিচলিত হয়ে পড়ে। পালানোর পথ খুঁজছে। কিন্তু মোহনা যেহেতু সব জেনে গেছে তাই লুকানোর কিছুই নেই। কোনরকমে বলল,
‘আমি কিছু করিনি। ও আমাকে কিডন্যাপ করেছিল। তারপর প্রপোজ করেছে।’
মোহনা এতক্ষণে যেন সবটা বুঝল। ভান ধরে বলল,‘ভাই আমাকে কিছুই বলেনি। আমি নিজেই প্রশ্ন করেছি। অথচ তুমি ধরা খেয়ে গেলে। আমার ভাই হয়েছেতো কী হয়েছে? তুমি আমার বন্ধু। তাই ভাইয়ের সাথে রোমান্স করলেও সেটা আমাকে জানাতে পারো। কোনো সমস্যা নেই।’
‘আসলে.’
‘আর বলতে হবে না। পরেরটা তোমার মনে থাকলেই হয়। বেশ বুঝতে পেরেছে, দুজনে ভালোই সময় কাটিয়েছ। আশা করি এভাবেই তোমাদের ভালোবাসার স্বার্থকতা আসবে।’
পরপরই বলল,‘যাই বলো! ড্রেসটা অসাধারণ।’
অহনা ফ্রেশ হয়ে কলেজের জন্য তৈরি হয়। কিন্তু কলেজ করতে ভালো লাগে না। ইচ্ছে করে না যেতে। মোহনাকে বলল,‘আজ না গেলে হয়না?’
‘কেন বলোতো? বাড়িতে কোনো কাজ আছে নাকি শরীর খারাপ?’
‘ভালো লাগছে না।’
‘সেটা কি ভাইয়ের জন্য, আহি?’
আহি শব্দটা শুনতেই অহনা কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে,
‘মজা করো না একদম।’
‘বলোতো আহি কেন রাখল?’
‘আমার নামকে ছোট করে হয়ত।’
‘শুধু নাম ছোট করে রাখার জন্য ভাই এই নাম দেয়নি। এর মিনিং অন্য। ভাই অত সহজে নামটা দেয়নি। অনেক ভেবে, বর্ণের সঠিক ব্যবহার করে দিয়েছে। তোমার কাছে এটা একটা নাম মাত্র। কিন্তু ভাইয়ের সংজ্ঞা আলাদা হবে। এই নামের পেছনে অন্য কাহিনী আছে। সময় পেলে জিজ্ঞেস করে নিও। ছোট থেকেই দেখছি তো তাই বলতে পারি। ভাইয়া একটা সিদ্ধান্তও না ভেবে নেয় না।’
‘আমিও ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম।’
‘কী?’
‘কলেজে যাব।’
অনুজ কল করল মাহতিমকে। সে এখনো ঘুমাচ্ছে জেনে বেশ রেগে গেল। সবাই মিটিং-এ অপেক্ষা করছে। আর সে নাকি ডেকে ঘুমাচ্ছে।
মাহতিম দ্রুত উঠেই কোনোরকমে ওয়াশরুমে গেল। আবারো ঢুলতে ঢুলতে ঘরে এলো। তৈরি হয়ে নিল দ্রুত। কাজের চাপ খুব বেশি। আজকাল আর ইচ্ছে করেনা এতো দায়িত্ব নিতে। কেমন যেন হাঁফিয়ে ওঠেছে। কিন্তু যখনই মনে হয়, তার জীবন আর অন্য পাঁচটা ছেলের জীবন এক নয়, তাকে দেশ চায়, তখনই তার মনে আবার জেদ চেপে বসে। যত কষ্টই হোক, এই দেশের জন্য নিজের প্রাণ দিতেও দ্বিধা করবে না। ঘর থেকে বের হতেই অহনার সাথে সাক্ষাৎ। মোহনা অহনাকে বলল,‘আমি যাচ্ছি, তুমি আসো।’
মোহনা চলে যেতেই মাহতিম চারিদিকে তাকাল। কাউকে তেমন নজরে পড়ল না বলে অহনার দিকে এগিয়ে এলো। অহনা কিছুটা দূরে সরে গিয়ে বলল,‘আমার থেকে দূরে থাকো। আর নিজের কাজে যাও।’
‘শুনেছি কাজে যাওয়ার আগে বউয়ের আদর পেলে স্বামীর কল্যাণ হয়! কাজে মন বসে! প্রমোশন হয়! আরো কত কী!’
‘তাহলে বউ খুঁজে নাও। বিয়ে করছ না কেন?’
‘বউয়ের কাজ গার্লফ্রেন্ডও করতে পারে। তুমি চাইলে বউয়ের অভাব পূরণ করে দিতে পারো। দেখবে, তোমার টানে কেমন দ্রুত চলে আসব।’
‘আসতে হবে না দ্রুত। দেরী করলেও আমার সমস্যা নেই।’
মাহতিম শুকনো কন্ঠে বলল,‘মিস করবে না?’
‘করতেও পারি। যদি তোমার থেকে সুন্দর ছেলে কলেজে দেখি তাহলে বলতে পারছি না।’
মাহতিম রেগে যায়,
‘এখন কেউ নেই। একটা চুমু দিয়েই চলে যাও। আমারো অনেক কাজ রয়েছে, যেতে হবে।’
‘পারব না।’
‘ঠিক আছে।’
বলেই মাহতিম পুনরায় দুপাশে দেখল। কেউ নেই এখন। সুযোগ বুঝে সে অহনাকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে চুমু খেল। পরপরই দৌড়ে চলে গেল। অহনা আহাম্মকের মতো তাকিয়ে রইল। আকস্মিক ঘটনা বুঝে উঠতে পারেনি। ঠোঁটে অনামিকা আঙুল দিয়ে স্পর্শ করতেই দেখল বর্ষণ সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অহনা দ্রুত গতিতে প্রস্থান করতে নিলেই সে এগিয়ে আসে। অহনা পালানোর পথ পায় না। বর্ষণ কোনোরকমে শ্বাস নিয়ে বলল,‘সম্পর্কটা ভালোই চলছে তাহলে।’
অহনা কোনো উত্তর দিল না। বর্ষণ পুনরায় বলল,‘এতো ভয় পাচ্ছ কেন? মনে রাখবে, বিয়ের পর তোমাকে সারাজীবন এই বাড়িতেই কাটাতে হবে। এখন থেকেই যদি আমাকে এড়িয়ে চলো তাহলে কী করে হবে? আমি চাই বিষয়টাকে সহজ করে নাও, আমাকে স্বাভাবিক মনে করে। কেননা এই বাড়িতে আছি যেহেতু, প্রতি মুহূর্তেই তোমার নজরে পড়ব। কয়দিন এড়িয়ে চলবে? আশা করি আমি কী বোঝাতে চেয়েছি, তুমি বুঝেছ।’
অহনা মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যাঁ’ সূচক শব্দ করল,
‘আমি চেষ্টা করব। মাফ করবেন আমাকে, আমি স্বাভাবিক হতে পারিনি।’
‘ছোট ভাইয়ের বউ হবে তুমি কিছুদিন পর, আমি তোমাকে ক্ষমা নয় স্নেহ করতে পারি।’
অহনার বিশ্বাস হচ্ছে না বর্ষণের কথা। ছেলেটা কত সহজেই পরিবর্তন হয়ে গেল। অহনা এবং বর্ষণ পাশাপাশিই নিচে গেল। যেতেই কিছুটা অবাক হলো। সবাই কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে। অহনা এবং বর্ষণকে দেখে কিছুটা বিচলিত হয়ে আনিফা এগিয়ে এলো। মোহনা সাথে সাথেই তাকে টেনে নিয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,‘কেউ ভাইকে কিছু জানাবে না এখন। আগে আমাকে টাকা দেবে তারপরেই সবটা বলব।’
বর্ষণ কিছুটা নাকোচ করে বলল,
‘আমার জানার ইচ্ছে নেই। তার ওপর ফকির-মিসকিনের আবদার রাখি না আমি। আমার থেকে সরে দাঁড়া।’
রাগে মোহনার চোখ লাল হয়ে আসে,
‘ঠিক আছে। দেখি তোমাকে কে জানায়।’
বর্ষণ আনিফাকে বলল,‘আম্মা বলো, কী হয়েছে?’
আনিফা কিছু বলতে গেলেই মোহনা আরো রেগে গেল। মনে হচ্ছে কান্না করে দেবে। আনিফা আর কিছু বলল না। বর্ষণ কোনো উপায় না পেয়ে মোহনাকে বলল,’কত চাই বল?’
মোহনা খুশিতে গদোগদো হয়ে বলল,‘বেশি না। ফ্রেন্ডদের নিয়ে একটা পার্টি দেব। সেখানে যা খরচ হয় তুমি পে করে দেবে।’
বর্ষণ সাথে সাথেই মেনে নিল। মোহনা পরপরই বলল,‘আর মাত্র চারদিন পর তোমার আর নিহা আপুর এনগেজমেন্ট। বাবাই সব সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
বর্ষণের মুখে হাসি ফুটে ওঠল। নিহার চোখে চোখ পড়তেই দেখল। তার চোখে-মুখে তৃপ্তির চাওয়া। অবশেষে তারা এক হতে চলল।
মাহতিমকে তিনদিনের জন্য সিলেট ট্রান্সপার করা হলো। যে মিথ্যে বলেছিল, সেটা এবার সত্যি হচ্ছে। তার চোখে-মুখে হাসি নয় বরং শত মন খারাপ ভীড় করল। সে চায়নি এই মুহূর্তে কোথাও যেতে। কিন্তু কী করবে? যেতেই হবে। কিছুই করার নেই। আশিশ ওর পাশে এসে দাঁড়াল। তার মুখোবয়ব সাধারণ রেখেই বলল,‘বেষ্ট অফ লাক!’
চলবে….
Sathi Islam : সাথী ইসলাম
পাঠকমহলের জন্য সাথীর পাঠকমহল (পাঠক+পাঠিকা) – Sathi’s Readership