ছায়া মানব ২
৩২.
মাহতিম বিষণ্ণ মন নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো। চোখে-মুখে ক্লান্তির ছোঁয়া। সন্ধ্যা হবে হবে ভাব। ব্যাগপত্র গুছিয়ে রাতেই ট্রেন ধরবে। তাকে সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরে আসতে দেখে অহনা কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়ল। এলোমেলো চুলগুলো হাত দিয়ে ভাঁজ করে, পোশাক ঠিক করে তার সামনে এসে দাঁড়ায়। মাহতিম এক নজর দেখল অহনাকে। পুরো হাতা শার্ট পরিধেয় সে। বুকের কাছের দুইটা বোতাম খোলাই রাখল। মাহতিম দ্রুত অহনার হাত চেপে ধরে তাকে ঘরে নিয়ে এলো। হাতে থাকা স্যুটটা একপাশে রেখেই শ্বাস নিল। এমন সময় মোহনা এলো। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,‘ভেতরে আসতে পারি?’
মাহতিম বলল,‘আসতে পারিস।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে! না আসলেও হবে। আম্মা ডাকছে। নাস্তা করতে এসো দু’জন।’
‘লাগবে না। একেবারে রাতের খাবার খাব বলে দিস।’
‘ঠিক আছে!’
মোহনা চলে যেতেই মাহতিম দরজাটা বন্ধ করে দিল। অহনার কাছে এগিয়ে আসলো তৎক্ষণাৎ। অহনা কিছুই না বুঝে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ করেই মাহতিম অহনার গলা এবং উদরের মধ্যবর্তী স্থানে তাকাল। অহনা কিছুটা হকচকিয়ে উঠে শার্টটা টেনে নেয়। মাহতিম হাত বাড়াতেই অহনা অস্বস্তিতে পড়ে যায়। তার থেকে দু’কদম পিছিয়ে যায়,
‘কী করছ? মাতাল হয়ে গেলে নাকি? কিছু খেয়েছ?’
‘একদম ঠিক আছি।’
বলেই মাহতিম পুনরায় হাত বাড়াতেই অহনা খপ করে তার হাত চেপে ধরে,
‘কী করতে চাইছ?’
মাহতিম অহনাকে অগ্রাহ্য করে তার শার্টের বোতামগুলো একে একে লাগিয়ে দেয়। অহনা বেশ অবাক। পরক্ষণেই মাহতিম বলল,‘এভাবে শরীরের অংশগুলো উন্মুক্ত করে রাখবে না। কটু লাগে খুব।’
‘এটা স্টাইল। তুমি রেগে যাচ্ছ কেন?’
মাহতিম এমনিতেও খুশি নয়। তার ওপর বেহায়াপনার মতো কথা বলায় আরো রেগে গেল,
‘স্টাইল মানেই কি শরীর দেখানো?’
‘এভাবে কথা বলছ কেন?’
‘কীভাবে বলছি? তোমার কি শরীর দেখানোর খুব সখ? তাহলে আমার সামনেই সব….’
পরবর্তীতে বলার মতো কোনো ভাষা পেল না মাহতিম। নিজেকে শান্ত করে নেয়। এক মুহুর্তের জন্য যেন বেপরোয়া হয়ে পড়েছে। একটু বেশিই হয়ত রেগে যাচ্ছে। নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে দ্রুততার সাথে। অহনা তার কপালে, গলদেশে হাত দিয়ে দেখে বলল,
‘তোমার যেহেতু পছন্দ না, তাহলে আর কখনো বোতাম খোলা রাখব না। তুমি সাধারণভাবে আমাকে কথাটা বোঝাতে পারতে। কিন্তু রেগে গেলে কেন?’
‘তুমি এসব পরবে না আর। লং কিছু পরবে।’
‘এটায় কম্পোর্ট আমি।’
‘এসব মানায় না তোমাকে। আমি বলেছি যেহেতু এসব আর পরবে না। আমার দেখতে খারাপ লাগে। জানিনা, এসবের জন্য কতজনের নজরে পড়ো?’
‘এবার কিন্তু বেশি হয়ে যাচ্ছে। ঠিক আছে, আমি আর এসব পরব না। এবার বলো, তোমার কী হয়েছে? মনে হচ্ছে কোনো কিছু নিয়ে চিন্তায় আছ।’
অহনা মাহতিমকে বিছানায় বসালো,
‘এবার বলো কী হয়েছে।’
মাহতিম হাঁসফাঁস করে বলল,‘আমাকে যেতে হবে।’
অহনা ঠোঁট উল্টে বলল,
‘কোথায়?’
‘কাজ পড়ে গেছে। সিলেট যেতেই হবে।’
মুহুর্তেই অহনার মুখটা শুকনো হয়ে যায়। মৃত চোখ দুটো নত করে ফেলে। মাহতিম চলে যাবে শুনে কষ্ট হচ্ছে তার। মাহতিম তর্জনী দিয়ে অহনার মুখমন্ডল ওপরে তুলে বলল,‘আমারো ইচ্ছে করছে না যেতে। কিন্তু কিছু করার নেই। আমি একজন দেশ সৈনিক। দেশের সেবা করাই আমার প্রধান ধর্ম। এর জন্য আমাকে প্রিয়জনকে ছাড়তে হবে। কয়টা দিনেরইতো ব্যাপার। থাকতে পারবে না?’
অহনা চুপ করে আছে। মাত্রই শুরু হওয়া সম্পর্কে যেন ফাটল ধরল। এই মুহুর্তে এসে কোনো প্রেমিক তার প্রিয়তমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করতে পারে না। হঠাৎ করেই কল আসে মাহতিমের। ফোনের শব্দে তাদের নীরবতা ভেঙ্গে যায়। জয়ন্তের কল এসেছে। কলটা ধরতেও যেন মাহতিম ভয় পাচ্ছে। না জানি আরো কী কাজ দিয়ে বসে থাকে। কাঁপাকাঁপা হাতে ধরল কলটা। জয়ন্ত বলল,
‘মাহতিম, আসা করি প্রস্তুতি নিয়েই যাবে। হয়ত একদিনও থাকতে পারো কিংবা এক মাসও। আর শোনো, কিছু স্থানের ম্যাপ দিচ্ছি। সব ঠিক আছে কিনা স্থানীয় সাব ইন্সপেক্টরের সাথে যোগাযোগ করে জেনে নেবে। আমাকে সাথে সাথেই সব ডিটেইলস্ পাঠাবে।’
কথাটা শুনতেই মাহতিমের পুনরায় খারাপ লাগা শুরু হয়। কোনোরকমে বলল,‘ইয়েস স্যার।’
আরো কিছু কথা বলেই কল ছাড়ল। অহনা নির্বাক দর্শক হয়ে দেখছে শুধু। সত্যি সত্যিই মাহতিমকে যেতে হবে। বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠল। বুঝতে দিল না মাহতিমকে। এক গাল হেসে বলল,‘এটা অনেক ভালো খবর। আমি সত্যিই গর্ভবতী, তোমার মতো বয়ফ্রেন্ড পেয়ে।’
মাহতিমের কপাল কুঁচকে আসে,
‘কী বললে তুমি? তুমি গর্ভবতী?’
‘সরি! গর্বিত হবে। তুমি একজন যোদ্ধা, আমি হব তোমার বউ। কয়জনের ভাগ্যে জুটে এমন জীবনসঙ্গী?’
মাহতিম হাসল,
‘যোদ্ধার বউ হওয়া এতো সোজা নয়। যোদ্ধার সঙ্গিকে সবসময় মৃত্যু হাতে নিয়ে থাকতে হয়। বিচ্ছেদ, ভয়, ঘাতকতা, নির্মমতা, সবশেষে মৃ’ত্যু কোনোকিছুকেই ভয় পেতে নেই! তাদের মন সাহসী থাকতে হয়, না হয় সংগ্রামে টিকে থাকতে পারে না। আমার চলে যাওয়ায় তুমি কষ্ট পেও না। শুধু আজ নয় বহুবার চলে যেতে হবে আমায়। তোমায় নিয়েতো আর যুদ্ধের ময়দানে দাঁড়াতে পারিনা। এই যে বের হচ্ছি। প্রাণটা হাতে নিয়েই বের হচ্ছি। এই প্রাণের নিশ্চয়তা নেই কোনো। তোমার মনকে কঠোর করতে হবে। তুমি যদি ভেঙ্গে পড়ো তাহলে আমিও ভেঙ্গে পড়ব। তুমি কি আমাকে জয়ী দেখতে চাও না?’
অহনা মাহতিমের হাত দুটো পরম যত্নে মুঠোবদ্ধ করে ধরল। হাত বুলিয়ে দিয়ে আবেশে চুমু খেল,
‘আমি অনেক সাহসী! আমি ভীতু নই। ইনশা আল্লাহ্ তুমি জয়ী হবেই। এবং জয়ী হয়েই আমার কাছে ফিরে আসবে। আমাদের কথা ভেবে, আমাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে। মনে রাখবে, আমাকে বিয়ে করবে তুমি, কখনোই কাজের চাপে ভুলে যেও না আমায়। আমি কিন্তু তোমার পথ চেয়ে বসে থাকব।’
‘কতক্ষণ অপেক্ষা করতে পারবে?’
‘যদি বলি, আমৃ’ত্যু! তোমার প্রতি অনুভূতিগুলো কখনোই কমবে না। তাহলে ভালবাসা কমবে কী করে? ভালোবাসা না কমলে ভুলব কী করে? তাই অপেক্ষা করব শেষ পর্যন্ত। তোমার ফেরার অপেক্ষায় থাকব আমি। কথা দাও, দ্রুত ফিরে আসবে?’
মাহতিম নিজেকে অহনার আরো কিছুটা কাছে নিয়ে আসে। কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,‘কথা দিলাম, দ্রুতই ফিরে আসব। আমাদের পথচলা এখনো অনেক বাকি।’
অহনা প্রশান্তিতে শ্বাস নিল। তরুলতার মতো তার বুকটাও যেন তাপের সন্ধান পেল। মাহতিম অহনার কপাল ছুঁইয়ে দিল ভালোবাসায়। অহনা চোখ বুজে অনুভব করল সবটা। বুকের ভেতরে তোলপাড় চলছে। এই ভালোবাসা থেকে সে অনেকদিন বঞ্চিত থাকবে। কীভাবে থাকবে সে? সহ্য হচ্ছে না আর। ইচ্ছে করছে নিজেও মাহতিমের সঙ্গ দিক। কিন্তু সম্ভব নয়।
মাহতিম অহনার চোখের দিকে তাকাল। জল চিকচিক করছে, অথচ মেয়েটা কেমন নিজেকে শক্ত করে নিল। যেন তার কষ্ট হচ্ছে না। মাহতিমও কিছুটা শান্ত হলো যেন।
অহনার ঠোঁট দুটো রুক্ষ হয়ে আছে। ঘন চোখের পাতাগুলো এক দৃষ্টিতে মাহতিমের নিঃশ্বাসে বারি খাচ্ছে। মাহতিম চোখ সরাতে পারছে না,
‘এই মায়াভরা চোখের চাহনি, ঠোঁটের হাসি কী করে ভুলে থাকব? যদি তোমাকেও নিয়ে যেতে পারতাম নিজের সাথে?’
মাহতিম দীর্ঘশ্বাস ফেলতেই অহনা বলল,‘তাহলে কাল থেকে আমাদের লং ডিসটেন্স রিলেশনশিপ শুরু হতে চলল।’
‘হুম!’
অহনা কোনো ভাবনা চিন্তা না করেই বলল,
‘একবার জড়িয়ে ধরো! কাল থেকেতো অনেকদিন বঞ্চিত থাকব। মায়া হয়না নাকি তোমার?’
মাহতিম প্রশ্রয় পেয়ে অহনাকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিল। অনুভব করল পরিচিত সেই অনুভূতি। অহনাও আষ্টেপৃষ্ঠে জাপটে ধরল মাহতিমকে।
দূরত্ব কখনো ভালোবাসায় বাধা হয়না। বাধা হয় অবহেলায়। মন যদি কাউকে সত্যিকারের অনুভব করে তাহলে কখনোই তাকে ভুলে যাওয়া যায় না। যার মন প্রতি মুহুর্তেই পরিবর্তনশীল এবং কলুষিত তাকে বেধে রাখা যায় না। সে যেকোনো উপায়েই ছেড়ে যাবে।
রাত আটটা বেজে ত্রিশ মিনিট। মাহতিম ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিতে নেমে এলো। আনিফা, মামুন, মোহনা সবার মন খারাপ। একপাশে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে অহনা। তার পাশেই বর্ষণ ও নিহা। মাহতিম একে একে সবার থেকে বিদায় নিল। আনিফা ছেলেকে সমর্পণ করলে আল্লাহর নিকট। ছেলেকে সে কখনোই ডিফেন্সে জব করতে দেবে না বলে ঠিক করেছিল। কিন্তু প্রচলিত প্রথা অনুসরণ করেই যেন মাহতিমের ঝোঁক ছিল সৈনিক জীবনে। বাবার পেশাটাকেই আপন বলে মনে করল। ছোট থেকেই তার স্বপ্ন আর্মি অফিসার হবে সে। আনিফা তাকে ভিন্ন পথে নেওয়া চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি চেয়েছিলেন ছেলেকে আইনজীবী করবেন। কিন্তু ছেলের যেখানে মর্জি নেই সেখানে আর কিছুই করতে পারেন নি। মায়ের বুক সবসময় ধুরুধুরু। কখন কী হয় বলা যায় না। সাক্ষাৎ মৃ’ত্যুর মুখেই যেন ঠেলে দেয় বারবার। এখনো কষ্ট হচ্ছে। আগামীতে কী হতে চলেছে বুঝতে পারছে না। তবুও মন না সায় দিলেও যাওয়ার পারমিশন দিল।
মাহতিম অহনার দিকে তাকাল। অহনার চোখ জলে চিকচিক। তবুও হাসার চেষ্টা করল। ঘরভর্তি মানুষ। না হয় এই মুহূর্তে দৌড়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরত। না যাওয়ার জন্য আকুতি জানাতো। পারছে না। ব্যাকুল হচ্ছে মন-প্রাণ। কিছুতেই নিজেকে শান্ত রাখতে পারল না। মাহতিমও সজল চোখে তাকিয়ে আছে। সহসাই সামনে এগোলো। কয়েক কদম এগিয়েই পুনরায় পেছনে তাকাল। হাত উঁচিয়ে সবাইকে বায় বলল। অহনার সহ্য হলো না। দ্রুত সে দৌড়ে চলে গেল। সবার সামনে কান্না করতে পারবে না সে। গোপনে একটু চোখের জল ফেলে নেবে বলেই ঠিক করল। মাহতিমের বুকের ভেতরটা ধ্বক করে ওঠল। যেন অজানা কোনো ভয় জেঁকে বসেছে মনে। অহনার জন্য তার ভয় হচ্ছে হঠাৎ করেই। বিপদের আভাস পাচ্ছে বাতাসের কম্পনে। বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা অনুভব করল।
চলবে….
Sathi Islam : সাথী ইসলাম
পাঠকমহলের জন্য সাথীর পাঠকমহল (পাঠক+পাঠিকা) – Sathi’s Readership