ছায়া মানব ২
৪০.
বাইরে খুব বাতাস বইছে। বৃষ্টির আগমন জানিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। ইমন দ্রুত জানালাটা বন্ধ করতে যায়। ইতোমধ্যে মোহনা তার ঘরে এসে খাটের ওপর বসে। জানালা লাগাতেই যেন খানিকটা সময় নষ্ট করে ফেলল ইমন। মোহনা বিরক্ত হয়ে বলল,‘জীবনের অর্ধেক সময় কি জানালা লাগাতেই শেষ করে দেবেন?’
ইমন দ্রুত এগিয়ে আসে,
‘আসলে বাতাস বইছিল তো, আমি….
‘বাতাস বলেছে, কয়েক বছর সময় লাগিয়ে জানালা বন্ধ করতে তাই তো?’
‘আপনি সারাক্ষণ এতো রেগে থাকেন কেন? একটু শান্তভাবে কথা বললেও হয়।’
মোহনা রেগে যায়,‘এখানে আসার উদ্দেশ্য ছিল না আমার। নিচে নামতে গিয়ে দেখলাম আপনি এই ঘরে। সত্যি করে বলুন, কী মতলব নিয়ে আমাদের বাড়িতে ঢুকেছেন? বারবার আসছেন কেন? এটা কিন্তু ভালো লক্ষণ নয়। আবার আজ রাতে এখানেই থেকে যাবেন না তো?’
‘হ্যাঁ! এখানেই থাকতে হবে।’
‘কিই? আমি যা ভেবেছি ঠিক তাই হলো। আপনার নিশ্চয় কোনো মতলব আছে। আমাদের বাড়ি থেকে কিছু চুরি করার আছে।’
ইমন অপমানবোধ করল। পরপরই বলল,‘চুরি করতেই এসেছি। ভালোয় ভালোয় সফল হলেই হয়।’
মোহনা তেড়ে আসে ইমনের দিকে। মুখোমুখি সংঘর্ষে দাঁড়াতেই ইমনের ফোনে মেসেজ আসে। মেয়ে পটানোর তিনটা টিপস্ পাঠিয়েছে রিয়াজ। ফোনের দিকে চোখ দিতেই প্রথম অপশনটা ছিল,‘একটা মেয়েকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করলে হলে সাজসজ্জার পাশাপাশি তার রাগ নিয়ন্ত্রণ করা শিখতে হবে। অর্থাৎ মেয়েটা রেগে গিয়ে হাজার কথা বললেও তার কথাকে ঠিক ধরে নিয়ে চুপ থাকতে হবে। তার আবেগ বোঝার জন্য বারবার ভালোলাগার কারণ জিজ্ঞেস করতে হবে।’
লেখাটা পড়ার সময় মোহনা সেদিকে চোখ দিল। সাথে সাথেই ইমন ফোন অফ করে দেয়। মোহনা রেগে গিয়ে তাকে আরো কয়টা কথা শুনিয়ে দিল। এবার সে একদম চুপ। মোহনাও থেমে নেই, বলল,‘কথা বলতে পারেন না নাকি? আমার রাগ হচ্ছে। আপনার সাথে কথা বলাই ভুল হয়েছে। ভ্যাবলা ছেলে কোথাকার।’
ইমন পরপরই বলল,‘শান্ত হোন। আমি আপনাকে হার্ট করতে চাইনি। দোষটা আমারই। আমার উচিত ছিল আপনাকে সবটা বুঝিয়ে বলা। বাবা বলেছে এই বাড়িতে থাকতে। ওনি না আসা পর্যন্ত থাকব। কিছু সমস্যার কারণে।’
মোহনা চুপ হয়ে গেল। আরো কিছু বলতে যাবে তার আগেই ইমন পুনরায় বলল,‘আমি যেহেতু অন্যায় করেছি তাই একটা শাস্তি পাওয়া দরকার। আপনার সবচেয়ে পছন্দের জিনিস কী?’
মোহনা কিছুটা অবাক হয়ে গেল।
‘তা দিয়ে আপনার কাজ কী?’
‘জানার ইচ্ছে হলো। শুনেছি মেয়েদের পছন্দে তালিকা খুব সুন্দর।’
‘কিছু্ই পছন্দ না আমার। খেতে ভালো লাগে।’
‘আমি কিন্তু রান্না করতে পারি। আপনি বললে আপনার প্রিয় খাবার রান্না করে খাওয়াব।’
‘কাজের লোক আছে বাড়িতে। আপনার রান্নার প্রয়োজন নেই। হঠাৎ এতো ভালো সাজছেন কেন?’
‘আপনি কি ফুল পছন্দ করেন?’
‘মোটেও না।’
‘তাহলে?’
মোহনা বিরক্তিতে কপাল কুঁচকালো,
‘যত্তসব আজগুবি কাজ। থাকেন আপনি, আমি গেলাম। আর শুনুন, নিজের সাথে যে ভ্যাবলা ভূতটা আছে তাকে দয়া করে সাইডে রেখে সবার সাথে কথা বলবেন। একদম ভুল করেও আর আমার চোখের সামনে পড়বেন না। না হয় কাঁচা চিবিয়ে খাব। মনে থাকে যেন।’
বলেই আর এক মুহূর্তও দেরি করল না মোহনা। বের হয়ে গেল। ইমনের আচরণ তার কাছে অদ্ভুত লেগেছে। পেছন ফিরে একবার তাকাল। পরপরই চলে গেল। ইমন মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। রিয়াজকে সাথে সাথেই কল করে বলল,‘তোর প্রথম টিপসটাই খুব বাজে ছিল। মেয়েটা আরো রেগে গেল।’
‘একটা কাজে লাগেনি তো কী হয়েছে। আরো দুইটা বাকি আছে এখনো।’
‘সেগুলো কাজে লাগবে?’
‘হান্ড্রেড পার্সেন্ট লাগবে। দেখে নিস। রাতে কোনোভাবে দেখা করার চেষ্টা করিস পরবর্তী ধাপের জন্য। আশা করি এবার কাজে দেবে।’
ইমন কলটা রেখেই চিন্তিত বদনে ওপরে আলোকিত লাইটের দিকে তাকাল। নিজেকেই নিজে হাজার প্রশ্ন করল। মনে হচ্ছে তার পৃথিবীটা থমকে গেছে। অগোছালো জীবনটা গুছে গেছে। নিজেকে তার অপার খুশিতে আত্মহারা লাগছে।
রাতের খাবার খেয়ে সবাই যথানিয়মে নিজেদের ঘরে আসে। সবাই খুবই খুশি। আগামী দিনেই নিহা আর বর্ষণের নতুন জীবনের একটি ধাপ শেষ হবে। দুজনেই বেশ খুশিতে শপিং করল। অনেক বেশিই কেনাকাটা ছিল। যদিও পুরো টাকাটাই মামুনের পকেট থেকে গেল। নিহার বাবাও পরদিন সকালে ল্যান্ড করবে। নিহা খুশিতে হৈহৈ করে নাচছে। বর্ষণ বসে বসে তার বাচ্চামো দেখছে।
মাহতিম নিজের ঘরে যাওয়ার আগে একবার ইমনের সাথে দেখা করে নিল। তারপর অহনার ঘরে গেল। অহনা মন খারাপ করে বসে আছে। মাহতিম আসতেই নিজেকে সামলে নিয়ে দাঁড়াল। তবে মাহতিম ঠিক তার অবস্থা বুঝে নিল। থুতনিটা উঁচু করে ধরে জিজ্ঞেস করল,‘মন খারাপ কেন আহির?’
অহনা থমথমে গলায় বলল,‘কিছু না। মন খারাপ হবে কেন?’
‘আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তোমার মন বিষণ্ণ। আমি কি কোনোভাবে কষ্ট দিয়ে ফেললাম?’
অহনা মাহতিমের চোখের দিকে দীর্ঘ নজরে তাকাল,
‘আমার সকল সুখের উৎস তুমি। ভালোলাগা, ভালোবাসার কারণ তুমি! তোমার দ্বারা কষ্ট পাব, সেটা কল্পনাও করতে পারি না।’
‘তাহলে মন খারাপের কারণ বলছ না কেন?’
‘বাবা-মাকে অনেকদিন দেখি না। মনটা খুব অশান্ত লাগছে। যদি একবারের জন্য দেখতে পারতাম!’
মাহতিম অহনার কপালে দীর্ঘ চুমু এঁকে দিল। অহনার পুরো শরীর শিহরিত হয়ে উঠল যেন। মাহতিমের বাহু চেপে ধরল নিমেষেই। দীর্ঘ পরশে মুহুর্তেই সব ভুলে গেল। মুখে হাসি ফুটে ওঠল। মাহতিম তার হাসিকে আরও দীর্ঘ করতে বলল,‘মনে পড়ছে আগে বললেই পারতে। আমি এক্ষুনি তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি।’
‘এতো রাতে?’
‘তো কখন যাবে? কালতো অনেক কাজ আছে, ভাইয়ের এনগেজমেন্ট। আমাদের এখনই যাওয়া উচিত। আরও একটা কথা ভেবে দেখো, যখন আমাদের বিয়ে হবে, বছর ঘুরতেই তিন-চারটা বাচ্চা হবে তারপর বাচ্চারা বড়ো হবে, স্কুলে যাবে, তখন তুমি বাপের বাড়ি যেতে পারবে? অনেক দায়িত্ব আর আমার বাচ্চাদের সামলানোর পর একটুও সময় পাবে না। তাই তোমার উচিত এখনই যাওয়া।’
অহনা হা করে তাকিয়ে আছে মাহতিমের দিকে। ছেলেটা কোথা থেকে কোথায় চলে গেল। অহনা আড়ষ্ট হয়ে বলল,‘বিয়েটাই হলো না এখনো অথচ তুমি বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলে?’
‘আগে থেকেই সব চিন্তা-ভাবনা করে নিতে হয়। না হয় পরবর্তীতে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগবো। আমি তো এটাও ভেবে রেখেছি যে বিয়ের পর….’
‘থেমে যাও, আমি শুনতে চাই না। চলো এখন।’
মাহতিম ঠোঁট টিপে হাসল। পরক্ষণেই চুপি চুপি অহনাকে নিয়ে বের হলো।
ইমন নিজের ঘরে বসে হাঁসফাঁস করছিল। সে চাইছিল কোনো বাহানা দিয়ে মোহনা তার ঘরে আসুক। কিন্তু এলো না। তাই নিজেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। রিয়াজের কথামতো শার্টের ওপরের দুটো বোতাম খোলাই রাখল। নিজেকে ফ্রেশ করেই রওনা দিল। কিন্তু মোহনার দরজার সামনে যেতেই পুনরায় ফিরে আসে। এভাবে কয়েকবার দরজায় করাঘাত করার চেষ্টা করে। পারেনি! শেষবার দরজার সামনে যেতেই দরজা খুলে যায়। মোহনা বের হওয়ার পজিশন নিতেই ইমনের বুকের সাথে বাড়ি খায়। তার উন্মুক্ত বুকের দিকে চোখ যেতেই দ্রুত বিরক্ত হয়ে সরে দাঁড়ায়,‘আপনি এখন, এখানে?’
ইমনের বুক ধড়ফড় করছে। কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। আচমকা বলে ওঠল,‘মশার স্প্রে আছে?’
‘কেন?’
‘আমার ঘরে ইঁদুরের খুব উৎপাত, তাই।’
পরপরই জিভ কাটল। ভুল বলে ফেলল যে। মোহনা আরেকবার জিজ্ঞেস করার আগেই ইমন পুনরায় বলল,‘আমার কিছু চাই না। আন্টির থেকে চেয়ে নেব।’
‘ভেতরে আসুন।’
কথাটা বলেই মোহনা ঘরের ভেতরে চলে গেল। ইমন দ্বিধায় আছে, ভেতরে যাবে কি না? পরপরই অনেকটা সাহস নিয়ে ঢুকল। মোহনা এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিল। ইমন খাটে বসে ঢকঢক করে পানি পান করল। তার পানি খাওয়া দেখে মনে হচ্ছে, কয়েকবছর সে অনাহারে ছিল। সাথে সাথেই মোহনা তার থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে বসল,
‘এবার আসল কথা বলুন। কেন এসেছেন? ইঁদুর বা মশার স্প্রে নিতে আসেননি সেটা বুঝেছি।’
ইমন আচমকা বলল,‘সেক্সুয়াল কথা বলতে এসেছি?’
‘হোয়াট? কী বললেন?’
মোহনা রেগে যায়। চট করেই উঠে দাঁড়াল। সাথে সাথেই ইমনও উঠে দাঁড়াল। কী বলতে কী বলে ফেলেছে বুঝতে পারেনি। পরপরই বলল,‘সরি! কথাটা আপনাকে নয় অন্য কাউকে বলার ছিল।’
মোহনা কিছুটা শান্ত হলো। মিনমিনে সুরে উচ্চারণ করল,‘আজব ছেলে।’
রিয়াজের দ্বিতীয় টিপসটা ছিল,‘মেয়েদেরকে নিজের দিকে আকর্ষিত করতে হলে সেক্সুয়াল কথাবার্তা বলতে হবে অর্থাৎ রোমান্টিক কথার জালে ফাঁসাতে হবে। কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। অন্য জিনিসের প্রশংসা করতে হবে। অন্য জিনিস বলতে সাধারণ যা চোখে দেখা যায় তা নয়। ভিন্ন কিছুর প্রশংসা।’
ইমন একটু আগে তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, এই টিপস সে পেল কোথা থেকে। সে বলেছিল একজন ইংরেজি লেখক স্যার এডউইন মার্কের লেখা একটি বইয়ের বঙ্গানুবাদ। বইটির নাম ছিল ‘সিডিউস অব গার্লস’।
ইমন কিছু একটা ভেবে বলল,‘তুমি কি হিন্দি সিনেমা দেখো?’
মোহনা সোজা উত্তর দিল,‘না, আমি সিনেমা দেখা পছন্দ করিনা।’
‘তোমাকে সুন্দর লাগছে। সুন্দর ঘ্রাণও আসছে। কী ব্যবহার করো?’
মোহনার ব্রু জোড়া কুঁচকে এলো,
‘কেরোসিন ব্যবহার করি। এটার স্মেল সবচেয়ে ভালো লাগে আমার।’
ইমন যেন বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পেল না। বড্ড বিপদে পড়ে গেছে। দ্রুতই সে রিয়াজকে মেসেজ দেয়,‘কাজ হচ্ছে না। একটু ভালো কিছু বল। আমি কথা বলতে পারছি না ঠিকমতো।’
মেসেজ এলো,‘শা* তোর দ্বারা কিচ্ছু হবে না। আচ্ছা দাঁড়া, আমি বলছি। তুই যদি এখন মেয়েটার কাছে থাকিস তাহলে বল,জানো, তোমার মুখটা খুব মায়াবী, তাকিয়ে থাকতেও কেমন ভালো লাগে। আমি সবসময় চাঁদ দেখে বিমুহিত হতাম, কিন্তু তোমাকে দেখার পর থেকে সেটা আর হচ্ছে না। তোমাকে দেখতেই ভালো লাগে। আমি এর আগে কখনো এমন কোনো মেয়ে দেখিনি।’
‘কিন্তু…
‘বল তুই।’
ইমন মোবাইলে চোখ রেখেই সবটা বলে গেল। চোখ উঠিয়েই দেখল মোহনা টেবিলে নিজের বই পড়ছে। তার মানে, তার কোনো কথাই শুনতে পায়নি সে। ইমন বোকার মতো মোহনাকে দেখছে।
মোহনা এক প্রকার বিরক্ত হয়েই সরে এসেছে। তার মনে হয়েছিল, ছেলেটা ভ্যাবলার মতো কথা বলতেই থাকবে। কিন্তু এই পর্যন্ত বাজে কিছু বলেনি তাই রাগ করারও প্রশ্ন আসেনা। তাই চুপচাপ নিজের কাজে লেগে পড়ল।
চলবে….
Sathi Islam : সাথী ইসলাম
সাথীর পাঠকমহল (পাঠক+পাঠিকা) – Sathi’s Readership