ছায়া মানব ২
৫১.
মাহতিমের মাথায় বন্দুক তাক করতেই সে আঁতকে ওঠে। অহনার আত্মা কেঁপে ওঠে। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেও অসফল হয়। কেঁদে উঠে মুহুর্তেই,
‘দোহাই আপনাদের। আমায় মেরে ফেলুন। ওকে ছেড়ে দিন। আমি ওর মৃত্যু সহ্য করতে পারব না।’
সাথে সাথেই মাহতিম ফেঁপে ওঠে,‘কাপুরুষের মতো বন্দুক না উঁচিয়ে লড়াই করো। দেখি কার কত সাহস?’
মুখোশধারী পুরুষালী কণ্ঠ ভেসে উঠে পুনরায়,‘কে আগে মরবে সেটাই বলো আপাতত? অনেক সহ্য করেছি। আর নয়! মাহতিম, তোকে বলছি! তোর জন্যই আমার প্রমোশন হচ্ছে না। তোর জন্যই আমি এখনো উন্নতি করতে পারিনি। তোকে মরতেই হবে।’
মাহতিম সাথে সাথেই বলল,‘শত্রুতা থাকলে আমার সাথে, ওকে ছেড়ে দাও।’
‘ওকে। ছেড়ে দিলাম!’
পর পরই একটা বিষের শিশি এগিয়ে দিয়ে বলল,‘নে, খেয়ে নে। তুই মরে গেলে মেয়েটাকে ছেড়ে দেব।’
একহাতের বাঁধন খুলে দিল। দুইজন দুই দিক দিয়ে বন্দুক তাক করে। চাইলেও কিছু করার নেই। মাহতিম সাথে সাথেই বিষের শিশিটা হাতে নেয়। অহনার দিকে এক নজর তাকাল। চিৎকার করে উঠে অহনা,‘না, তুমি এটা খেতে পারো না। আমি তোমাকে মরতে দিতে পারিনা।’
মাহতিম নিজেকে শক্ত করে নিয়ে বলল,‘আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি। মনে রেখো, এটুকু হলেই হবে। বিদায় নিলাম।’
ছদ্মবেশী লোকটা মাহতিমের থেকে শিশিটা কেড়ে নিয়ে অহনার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,‘তবে নিজে খেয়ে নাও। তোমার শোকে মাহতিম এমনিতেই মরে যাবে।’
মাহতিম বার বার না করা সত্ত্বেও অহনা শিশিটা হাতে নেয়। মাহতিম কিছুই করতে পারছে না। অহনা শিশিটা মুখের কাছে নিয়েই মাহতিমকে বলল,‘ভালোবাসি তোমায়। বিরহ সহ্য করতে পারব না কখনোই। তুমি ভালো থেকো।’
বলেই এক নিঃশ্বাসে সাবার করে নিল বোতলে থাকা তরল পদার্থ। মুহুর্তেই চোখে-মুখে অন্ধকার নেমে এলো। মাহতিমের হৃদয় কেঁপে ওঠে। নিজের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা দেখে সামলে উঠতে পারেনি। হু হু করে ওঠে। সাথে সাথেই ছদ্মবেশী লোকটাকে বলল,‘দেরি করছ কেন? মেরে ফেলো আমায়। আমি বাঁচতে চাই না। আমি আমার আহিকে ছাড়া কখনোই বাঁচতে পারব না।মেরে ফেলো বলছি।’
অহনার চোখ দুটো বুজে আসে। হাত-পা ছেড়ে দেয় দ্রুত। মাহতিমের সহ্য সীমা ছাড়িয়ে গেছে। চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। বুকে চিনচিন ব্যথা অনুভব করে। ছদ্মবেশী লোকটা এগিয়ে আসে তার দিকে। আরেকটা শিশি এগিয়ে দেয়,‘বাঁচার ইচ্ছে না থাকলে মরে যেতে পারিস।’
বলেই উচ্চস্বরে হাসল। মাহতিম দেরি করল না। শিশিটা নিয়েই ঢকঢক করে গিলে নিল সমস্তটা। কিছু সময়ের ব্যবধানে সেও চোখ বন্ধ করে নেয়।
ইতোমধ্যে মামুন এসেছে। মাহতিম আর অহনাকে দেখে তার বুক কেঁপে ওঠে। ছদ্মবেশীদের দেখে আরও অবাক হয়। উন্মাদের মতো আঘাত করতে যায়।
_
সকালের মৃদুমন্দ আলো ছড়িয়ে পড়েছে ঘর জুড়ে। নিস্তব্ধতা চারিদিকে। পিটপিট করে চোখ খুলে অহনা। সাথে সাথেই নিজেকে ঘরে আবিষ্কার করে লাফ মেরে ওঠে। কিছুই বুঝতে পারছে না। পাশেই শুয়ে আছে মাহতিম। চোখে আলো পড়তেই সে জেগে ওঠে। অহনাকে পর্যবেক্ষণ করে বিস্ময় নিয়ে। সাথে সাথেই অহনা মাহতিমকে ছুঁয়ে দেখল,
‘তুমি কি সত্যিই তুমি? আমি কোথায়? মরে যাইনি?’
মাহতিম চুপ করে আছে। অহনা আরও কিছুটা এগিয়ে আসে মাহতিমের দিকে। বুকে হাত রেখে বলে,‘কিছূ বলছ না কেন? আমরা কি এখনো বেঁচে আছি?’
মাহতিম উঠে গেল। বড়ো করে শ্বাস নিয়ে বলে ওঠল,‘বিষ খেয়ে কেউ বেঁচে থাকে?’
‘তার মানে মরে গেছি? তুমি আর আমি একসাথেই আছি। মরে গিয়েও শান্তি।’
বলেই দ্রুত এসে মাহতিমকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। মাহতিম ঠোঁটের কোণে পিছলে হাসি নিয়ে বলল,‘ঘুমের ঔষধ খেয়েছি দুজনেই, মরার কথা নয়।’
অহনা বিচলিত হয়ে মাথা তুলে। সাথে সাথেই ঘরে প্রবেশ করে বাড়ির সকল সদস্য। অহনা সরে যায় মাহতিমের থেকে। আনিফা এসেই বলল,‘আমি বার বার মানা করেছি, ওরা শুনেনি।’
মাহতিম মোহনার দিকে কটমট চোখে তাকাল,
‘এই উদ্ভট পরিকল্পনা কার ছিল?’
মোহনা কেঁপে ওঠে। সাথে সাথেই নিহাকে দেখিয়ে বলল,‘ওর ছিল। আমি কিছু জানি না।’
নিহাও সাথে সাথে বর্ষণের দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলে ওঠল,‘আমি কিছু জানি না। বর্ষণ বলেছিল এটা করতে। আমার কোনো দোষ নেই।’
বর্ষণ আমতা আমতা করে বলল,‘আমি কিছু করিনি। সব ইমন আর মোহনার কাজ।’
অহনা চারজনের দিকে তাকায়,
‘পাঁচজন ছিল। আর একজন কে?’
মোহনা সাথে সাথেই বলল,‘ইমনের এক বন্ধুকে ডেকে এনেছে। আমাদের ভয়েজ চিনে যেতে পারো তাই।’
মাহতিম ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল,
‘তোমাদের এই সামান্য রসিকতা আমাদের জন্য কেমন ছিল চিন্তা করতে পারবে?’
অহনার চোখ ছলছল করে ওঠে। সত্যিই, রাতের কথা মনে পড়তেই বুক কাঁপা শুরু হয়। ভয়ঙ্কর ছিল তখনকার অনুভুতি। এখনো সে রেশ কাটেনি।
মাহতিম দেয়ালে আঘাত করে। মুহুর্তেই অহনা এগিয়ে আসে,
‘এমন করছ কেন? রাগ নিয়ন্ত্রণ করে নাও।’
‘আমি শান্ত হতে পারছি না। ওরা কী করে এমন মজা করতে পারে? আমি সত্যিই তোমাকে হারিয়ে….
মাহতিম থেমে যায়। বর্ষণ কোনোরকমে বলল,‘বুঝতে পারিনি। আমরা শুধু চেয়েছিলাম তোদের ভালোবাসার পরীক্ষা নিতে। শুধু একটু ফান করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দুজনেই ঔষধটা খেয়ে নিবি বুঝতে পারিনি।’
‘অন্যায় করেছ তোমরা। ভালোবাসা নিয়ে কখনো পরীক্ষা হয় নাকি? এটা কেমন পরীক্ষা? কারো ইমোশন নিয়ে মোটেও মজা করা উচিত নয়।’
মাহতিম আর এক মুহূর্তও নষ্ট করল না। ঘর থেকে বের হয়ে গেল। অহনাও বিষণ্ণ মনে বসে পড়ল। মোহনা কানে ধরে বলল,‘সরি! মাফ করে দাও অহনা। বুঝতে পারিনি।’
ইমন, বর্ষণ, নিহাও সরি বলল। অহনা সাথে সাথেই আক্ষেপের সুরে উচ্চারণ করল,‘সে যাই হোক, আমি অন্তত ওকে হারাব না। আমার সত্যিই খুব কষ্ট হয়েছিল। সেটা তোমরা বুঝবে না। গত রাতের অনুভূতি কেমন ছিল একমাত্র আমি আর মাহতিমই জানে। তবে আমার রাগ নেই। বেঁচে গেলাম অন্তত! তোমরা গিয়ে মাহতিমের রাগ ভাঙাও। দ্রুত যাও।’
মাহতিম নিজের ঘরে বসে আছে মাথায় হাত দিয়ে। পা টিপে টিপে সবাই তার কাছে গেল। এক জোট হয়ে কানে ধরে সরি বলে ওঠল। মাহতিম সেদিকে তাকাল না। ভীষণ অভিমান জমা হয়েছে। মোহনা ঠোঁট উল্টে বলল,‘ভাইয়া, প্লিজ মাফ করে দাও। এতটাও ভেবে দেখিনি। তুমিও চাইলে আমার আর ইমনের সাথে এমন প্রাঙ্ক করতে পারো।’
মুহুর্তেই সবাই হকচকিয়ে ওঠে। মাহতিমও তাকাল। ইমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গলা খাঁকারি দিল। চশমাটা ঠিক করে বের হওয়ার জায়গা খুঁজছে। বর্ষণ সন্দিহান চোখে তাকায় মোহনার দিকে,
‘ইমনের কথা আসলো কেন? বিষয়টা কী?’
ইমন পালাতে গেলেই বর্ষণ পেছন থেকে তার কলার ধরে টেনে আনে,
‘বুঝলাম না। তুমি পালিয়ে যাচ্ছ কোথায়?’
মোহনা আমতা আমতা করে বলল,‘এটাও প্রাঙ্ক ছিল। ইমন তো আমার ছোট ভাই।’
মুহুর্তেই ইমনের চোখ-মুখ কুঁচকে আসে,
‘আমি তোমার ছোট ভাই?’
মাহতিমও বোকার মতো তাদের কার্যকলাপ দেখছে। মুহুর্তেই মোহনা পুনরায় বলল,‘নিহা আপু আর ভাইয়া বলেছে অহনা আর মাহতিম ভাইয়ার পছন্দেই শপিং করবে। তিনদিন পর বিয়ে, এখনো কোনো প্রিপারেশন নেওয়া হয়নি।’
মাহতিমের হাত টেনে ধরে,
‘আমরা এখন শপিংয়ে যাব। চলো বলছি। তোমাকে যেতেই হবে।’
‘না, আমি যাব না।’
মাহতিমের কঠোর উক্তি শুনতেই নিহা আর বর্ষণও বলল,‘আমরাও চাই। এখনই যেতে হবে। না হয় বিয়েই করব না।’
মাহতিম আর না করল না। তবে বলে দিল,‘ভুল করেও কারো সাথে এমন প্রাঙ্ক করবে না। এভাবে কখনো ফান করা উচিত নয়।’
সবাই একজোটে বলল,‘আর কখনো করব না। ভুল করেও না’
সবাই মিলে শপিংয়ে বের হয়। শপিং মলেই অনুজের সাথে দেখা। অহনাকে দেখে হাসল সে। তার সাথে নাজ ছিল। মাহতিমকে দেখতেই জিজ্ঞেস করে বসল,‘বাহ! বিয়ে করছিস নাকি?’
মাহতিম স্মিত হেসে বলল,‘শিঘ্রই করব। দোয়া করিস!’
অনুজ সাথে সাথেই বলল,‘অহনাকে হারিয়ে ফেললে? যদি শিঘ্রই আসতে আসতে কেউ তুলে নিয়ে যায়?’
‘অহেতুক কথা এসব!’
অনুজ আর কথা বাড়ালো না। মৃদু হেসে প্রস্থান করল। অহনা বার কয়েক দেখল পেছন ফিরে।
চলবে….
Sathi Islam : সাথী ইসলাম