ছায়া মানব ২
৫৩.
বিয়ের আমেজে চারিদিক মুখরিত! নিহাকে সাজানো হচ্ছে। পাশেই বসে আছে অহনা আর মোহনা। অহনা কল্পনার রাজ্যে আছে। মোহনা ধা’ক্কা দিয়ে বলল,‘নিজের বিয়ের কথা ভাবছ নাকি?’
অহনা বিচলিত হেসে না বলল। মোহনা তা-ও খোঁচা মারতে ছাড়ল না। অহনাও চট করে বলল,‘সে আমার কথা ছাড়ো। ইমন ভাইকে বিয়ে করছ কবে?’
মোহনা কিছুটা লজ্জা পেল। পর পরই বিষণ্ণ হয়ে বলল,‘আর একটু গভীর সম্পর্ক হোক তারপর। সে তো এখনো জড়িয়ে ধরতেও লজ্জা পায়।’
পাশাপাশি থাকা সবাই হু হু করে হেসে ওঠে। অহনা মোহনার কথার পিঠেই বলল,‘এটাই ভালো। বিয়ের পরেই না হয় রোমান্স করে নিও। এখন কম হলেও হবে।’
মাহতিম আসতেই সবাই থেমে যায়। এই তিনদিনে মোহনা একবারও মাহতিমের মুখোমুখি হয়নি। ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে নিহার সামনে গিয়ে বসে; যেন তাকে দেখতে না পায়। মাহতিম ঠিক বুঝতে পেরেছে। অহনাকে না ডেকে সে মোহনাকে ডাকে,’এই শোন, এদিকে আয়।’
মোহনা নড়ে ওঠে। পুনরায় মাহতিম তাকে ডাকে। অহনা অভয় দিয়ে বলল,‘যাও। কঠিন ধাঁচের মানুষ নয় সে। কী বলে শুনে এসো।’
মোহনা পা বাড়ায়। বারান্দায় এসে দাঁড়ায় দুজনেই। মাহতিম আগ বাড়িয়ে বলল,‘তূই আমার বোন। হয়ত একটু রেগে গেছি; তাই বলে কথা বলাই বন্ধ করে দিলি?’
মোহনা কোনোরকমে বলল,‘তুমি বকা দাও, তাই কথা বলিনি।’
‘আচ্ছা, তোর জীবনে আমি বেশি গুরুত্বপূর্ণ না কি ইমন?’
আচমকা এমন প্রশ্ন শুনে মোহনা বেশ চমকাল। মাহতিমের মুখের দিকে তাকাল এক মুহূর্তের জন্য। কী বলবে বুঝতে পারছে না। মাহতিম পুনরায় প্রশ্ন করল,‘কে বেশি গুরুত্বপূর্ণ?’
মোহনা নিজেকে সামলে নেয়,
‘নিঃসন্দেহে তুমি আমার লাইফে গুরুত্বপূর্ণ; তুমি আমার ভাই। অপরদিকে ইমনও আমার জন্য ততটাই গুরুত্বপূর্ণ। বলতে গেলে সে হতে পারে আমার সারাজীবনের সঙ্গী। যদি সঠিক সিদ্ধান্ত নিই তবে তার সাথেই আমাকে বাকি জীবন কাটাতে হবে।’
মাহতিম হাসল। মোহনা বাঁকা চোখে তাকে অবলোকন করল। মাহতিম হাসি আরও দীর্ঘায়িত করে বলল,‘বাহ! আমার বোনটা কত বড়ো হয়ে গেল। আমি অযথাই চিন্তা করছিলাম। যে এত সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারে; সে জীবনের সিদ্ধান্তে ভুল হতে পারে না। আমার দেখা মতে খুব ভালো ছেলে ইমন। তাকে পার্সোনালি চিনি আমি। তবে প্রেমিক হিসেবে ঠিক কি-না সেটা জানা ছিল না। অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির ছিল সে। তাই ভেবেছিলাম… যা-ই হোক, আশা করি তোদের জীবনটা সুখেই কাটবে।’
মোহনা খুশিতে গদোগদো হয়ে বলল,‘পৃথিবীর সেরা ভাই তুমি।’
বর্ষণ ঘর থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই মোহনার কথা শুনে এগিয়ে এলো,‘আমি বুঝি সেরা নই? সবসময় মাহতিমই কেন সেরা হবে?’
‘তুমিও সেরা। তবে মাহতিম ভাই থেকে একটু কম।’
বলেই মোহনা দৌড়ে চলে গেল। কোনোদিকে না তাকিয়ে যাওয়ার ফলে জোরেসোরে ধাক্কা খেয়ে কারো বুকের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। ফুলগুলো ঠিক দুজনের গায়ের উপর। খেয়াল করতেই দেখল ইমন। মোহনা হাঁফ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,‘যাক, অন্য কোনো ছেলে ছিল না।’
এমন দৃশ্য মাহতিম আর বর্ষণের নজরে যেতেই তারা প্রস্থান করল। বোনকে এমন পরিস্থিতিতে লজ্জা দেওয়ার মতো পুরুষ তারা ছিল না।
ইমন মোহনার দিকে ভালো করে তাকিয়ে বলল,‘অন্য ছেলে হলে কী হতো?’
‘ভ্যাবলাকান্তের মতো কথা বলেন কেন? সরুন এখন, আমি ওঠব।’
‘তুমি আমার গায়ের উপর; আমি নই। তোমার উঠার কথা।’
মোহনা সাথে সাথেই উঠে যায়। গাঢ় নিঃশ্বাস ফেলে ফুলগুলো তুলতে সাহায্য করে ইমনকে। ইমন অপলকে দেখছে মোহনাকে। মোহনা তাড়া দিয়ে বলল,‘তাড়াতাড়ি করুন। দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
ইমন চঞ্চল দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকিয়ে বলল,‘তোমাকে দেখার সময়ও চলে যাচ্ছে।’
থেমে যায় মোহনা। বুকের ভেতর হাতু’ড়ি পেটা শুরু হয়েছে। প্রেমিকের যে-কোনো বচন প্রেমিকার হৃদয়ে ঝড় তুলতে সক্ষম। মোহনাও তার ব্যতিক্রম নয়। বিচলিত হয়ে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নেয়। পর পরই দৌড়ে চলে যায়।
বর্ষণ মাহতিমকে প্রশ্ন করেই বসল,‘মোহনা আর ইমনের মাঝে কি কিছু… আমি বলতে চেয়েছি, ওরা কি একে অপরকে পছন্দ করে নাকি? বেশ কিছুদিন ধরে অস্বাভাবিক লক্ষ্য করছি।’
মাহতিম হেসে বলল,‘রাগ করো না ভাই। ওরা একে অপরকে পছন্দ করে। আমি প্রথম জানার পর রেগে গিয়েছিলাম কিন্তু ইমন সত্যিই ভালো ছেলে; তাই আর বাধা দিতে পারিনি। তাছাড়া মোহনাও বড়ো হয়েছে। জীবনের সিদ্ধান্ত নিতে সেও শিখে গেছে। এই মুহূর্তে এসে অন্তত তুমি বাধা দিও না।’
বর্ষণ সাথে সাথেই বলল,‘আমি বাধা দেব কেন? আমি প্রেমকে শ্রদ্ধা করি! এই প্রেমই আমাকে অনেক কিছু শিখিয়ে দিল।’
পর পরই বলল,‘একটা সাহায্য করবি?’
‘অবশ্যই! বলে দেখো শুধু।’
‘একবার দেখা করতে চাই নিহার সাথে। একটু ব্যবস্থা করে দিবি?’
‘অবশ্যই করে দেব। তুমি চিন্তা করো না, শুধু রাতটা হতে দাও; দেখবে এরপর থেকে নিহা তোমার সাথেই থাকবে আজীবন। আমি ব্যবস্থা করে দেব।’
‘রসিকতা হচ্ছে? তখন তো এমনিতেই পেয়ে যাব। তাছাড়া নিহা কী? ভাবী বলবি।’
‘সে না হয় বললাম। কিন্তু এখন দেখা করতে পারবে না। একটু পরেই বিয়ে শুরু হবে। আশা করি অপেক্ষা করতে কোনো অসুবিধা হবে না। আমি যাই, আমার হবু বউয়ের সাথে দেখা করে আসি।’
‘তোর হবু বউ কে?’
‘অহনা।’
বলেই ঠোঁট টিপে হাসল মাহতিম। চলে গেল অহনার কাছে। ডাকতেই উঠে আসলো সে। বিচলিত হয়ে অহনা বলল,‘আমাকে কেমন লাগছে?’
মাহতিম বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,‘পৃথিবীতে আমি হাজার রূপের নারী দেখেছি। তার মধ্যে সবচেয়ে নান্দনিক সৌন্দর্যের অধিকারী একমাত্র তুমি। যতবার দেখি, নতুন করে প্রেমে পড়ি।’
‘পৃথিবীতে আমার চেয়ে কোটি গুন সুন্দরী নারী আছে। মন রাখতে এসব বলছ তুমি।’
‘থাকুক, তাতে আমার কী? তোমাকে পেয়ে গিয়েই আমার পূর্ণতার ঝুলি সাঙ্গ হলো। যদি মিথ্যে বলেই তোমার মনে প্রশান্তি দিতে পারি তবে ক্ষতি কী? সবার মাঝে তুমিই সবসময় সেরা।’
‘ঠিক ভেবেছি, তুমি সকাল থেকে একবারও আমার দিকে ভালো করে তাকাওনি। কারণ আমি এখনো তৈরিই হইনি তা-ও তুমি সুন্দর বলছ। আমি বুঝে গেছি, তোমার প্রেম কমে গেছে।’
মাহতিম অহনার কপোলদ্বয়ে দু’হাত রেখে আবেশে জর্জরিত হয়ে বলল,‘শুধু একটাই বাধা; বিয়ে। এই একটা কাজ করে ফেললেই তুমি বুঝে যাবে আমার প
অনুভূতির গভীরতা কতটুকু। আর রইল প্রেমের কথা, প্রেম সবসময় কমই থাকে। বেশি প্রেম বলে কোনো শব্দ নেই। প্রেম গভীরে চলে গেলেই সেটাকে ভালোবাসা বলে। তুমি নিশ্চয় অতিরিক্ত ভালোবাসা পেতে চাইছ?’
অহনা আড়ষ্ট মুখে তাকাল মাহতিমের দিকে। তাদের এমন মুহুর্তের কিছু ছবি তুলে নিল মোহনা আর ইমন। টেরও পেল না তারা। মাহতিম অহনার আরও কিছুটা কাছাকাছি চলে গেল,
‘আজ ভাইয়ার বিয়ে। ঠিক দশ দিন না যেতেই আমাদের হবে।’
‘এত তাড়াতাড়ি কেউ মেনে নেবে?’
‘আমি মানিয়ে নেব। তারা জানে না বউ ছাড়া কষ্টটা কেমন হয়। পারলে শীতে জ্বর বাঁধিয়ে নেব। তারপর বলব বউয়ের অভাবে এমন হলো।’
অহনা দীর্ঘ হাসল। মাহতিম হাঁফ নিঃশ্বাস ছাড়ল। আচমকা তার ভেতরটা কেমন নড়ে ওঠল। যে অজানা ভয়ে অহনা সবসময় শিহরিত হতো, আজ তা নিজের সাথে হচ্ছে। হঠাৎ করেই বলে ওঠল,‘আমাকে ভুলে থাকতে পারবে কখনো?’
এমন অদ্ভুত প্রশ্নে অহনা রেগে যায়,‘এমন কথা বলবে না।এমনিতেও ভয়ে থাকি, তার মাঝে এসব কথা আরও কষ্ট দেয়।’
মাহতিম ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। অশান্ত মনে বলল,‘তৈরি হয়ে আসো। আমিও আসি।’
দুজনেই বিষণ্ণ মন নিয়ে পা বাড়ালো। মনের খচখচানি আর গেল না। তবুও অহনা নিজেকে শান্ত করে নেয়। আবেগে নিজেকেই নিজে বলে,‘আর দশদিনের অপেক্ষা শুধু।’
‘তারপরই আমি মাহতিম ভাইকে বিয়ে করব।’
আচমকা কথাটা শুনেই অহনা নিচে তাকাল। নূর দাঁড়িয়ে আছে। অহনা মৃদু হেসে বলল,‘তুমি এখনো ছোটো।’
‘মাহতিম ভাই অনেক বড়ো। ওর থেকে দশ বছর আমার কাছে নিয়ে আসব। সমান সমান হয়ে যাবে।’
এমন কড়া হিসেব শুনে অবাক হলো না অহনা। এতদিনে যা কাণ্ড দেখেছে তা থেকে বুঝাই যায় নুরের অবস্থা। বলল,‘মাহতিম তোমাকে বিয়ে করবে?’
‘এখন যাচ্ছি, বিয়ের কথা বলে আসব। তুমি মাহতিমের থেকে দূরে থাকো। তোমাকে আমার হিংসে হয়।’
নূর সাথে সাথেই মাহতিমের ঘরের দিকে দৌড়ে চলে গেল। অহনা অবাক হয়ে তার গতি লক্ষ্য করল। বাচ্চা মেয়েটার শত্রুতে পরিণত হয়ে বেশ মজাই লাগল।
চলবে…
Sathi Islam : সাথী ইসলাম