ছায়া মানব ২
৫৪.
বর-বউ একসাথে বসে আছে। বর্ষণের পাশে মামুন আর মাহতিম। নিহার পাশে তার বাবা আর মা। ঝাঁক বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে অহনা, মোহনাসহ আত্মীয়-স্বজন। কাজী বিয়ে পড়ানো শুরু করে। অপরদিকে বর্ষণ একটু তাড়া দিয়ে বলল,‘দীর্ঘতা কম করবেন।’
হকচকিয়ে উঠে সবাই। পর পরই বর্ষণ শান্ত হয়ে হাত কচলাতে থাকে। সবশেষে কাজী বর্ষণকে উদ্দেশ্য করে বলল,‘আসলাম হকের একমাত্র কন্যাকে গ্রহণ করতে আপনার কোনো আপত্তি নেই তো? রাজি থাকলে বলুন ’আলহামদুলিল্লাহ কবুল করলাম।’
বর্ষণ এক মুহূর্তও দেরি না করে বলল,‘অবশ্যই! আমি কবুল করলাম।’
পর পরই নিহাকে বলা হলো,‘মামুন চৌধুরীর বড়ো ছেলে বর্ষণ চৌধুরীকে মেনে নিতে আপনিও বলুন ‘আলহামদুলিল্লাহ কবুল’।’
নিহা চুপ করে রইল। মোহনা পেছন থেকে বলল,‘কী হলো? বলছ না কেন? এতদিন বিয়ে করার জন্য কত লাফালে, আজ বলতে বাধা কেন?’
নিহা লজ্জায় লাল হয়ে আছে। সে উচ্চারণ করে আনতে পারছে না। কাজী আরেকবার তাড়া দিয়ে বলল,‘বলুন কবুল।’
নিহাও তাও বলল না। অহনা কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,‘আর দুই মিনিট চুপ থেকে তার পরই বলবে।’
মাহিনূর ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল,‘কিরে, বলছিস না কেন?’
নিহা চট করেই বলল,‘একটু দেরি করেই বলতে হয়। সাথে সাথে বললে লজ্জা লাগে।’
সবাই হু হু করে হেসে ওঠে। পরের বার জিজ্ঞেস করার সাথে সাথেই নিহা বলে ওঠল,‘আলহামদুলিল্লাহ! আমিও কবুল করলাম।’
বিদায়ের পর্ব বলে আর কিছু রইল না। মাহতিমের বিয়ের পরেই নিহার বাবা-মা বিদেশে চলে যাবে। তবুও মেয়েটাকে কাছ ছাড়া করবে ভেবে কেঁদে উঠে মাহিনূর। আসলাম কঠোর ভঙ্গিতে বসে ছিলেন। ভেতরের আর্তনাদ কাউকে দেখতে দিলেন না।
অহনা এবং মাহতিম দুজনে মিলে বাসর সাজানোয় মনোনিবেশ করে। একটু পর পরই মাহতিম দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। অহনা তাড়া দিয়ে বলল,‘দ্রুত করো। সময় নেই হাতে।’
মাহতিম চট করেই কিছু ফুল অহনার দিকে ছুড়ে দিল। অহনা রেগে যায়,‘তাড়াতাড়ি কাজ করতে বলেছি। তুমি কি-না মজা করছ।’
‘আমার দিনটা কবে আসবে?’
অহনা ঠোঁট উল্টে জিজ্ঞেস করে,‘তোমার আবার কীসের দিন?’
‘বিয়ে এবং পরবর্তীতে বাসরের দিন। আর কত অপেক্ষা করব?’
‘তুমিও না। তর সইছে না দেখছি।’
‘জঘন্য রকমের একটা অপেক্ষা। অন্যের বাসর দেখে আমার আফসোস হয়। আমরা কবে এক হব?’
অহনা মুখমণ্ডল লাল হয়ে আসে। ঠোঁটকাটা মাহতিমের কথাগুলো তার আর সহ্য হলো না। কিছু বলার আগেই মাহতিম তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। ঘাড়ে নাক ঘষে বলে ওঠল,‘ইচ্ছে করছে টাইম ট্রাভেল করে ভবিষ্যতে চলে যাই।’
অহনা ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল,‘গিয়ে কী করবে?’
‘বাসর করে চলে আসব। দারুণ হবে না?’
‘ছি! ছি! মুখে দেখি কিছুই আটকায় না। ছাড়ো আমাকে। কেউ দেখে ফেলবে।’
মাহতিম সাথে সাথেই বলে বসল,‘দেখুক। যদি কেউ আমাদের দেখে রোম্যান্স শিখতে পারে।’
এমন সময় মোহনার আগমন ঘটে। অহনা আর মাহতিমকে এতটা কাছাকাছি দেখে ব্রুজোড়া কুঁচকে আসে তার। চশমাটা কোনোরকমে ঠিক করেই বলল,‘অহনা আমার ফ্রেন্ড ভাইয়া। তাহলে তুমি আমার…
মোহনা আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। দ্রুত সরে গেল।
অহনা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মাহতিমের দিকে রাগী চোখে তাকাল,
‘এই তো, একজন শিখে গেল। ল’জ্জা-সরম নেই নাকি? বোনের সামনে…
‘ও তো বলেই দিল, ও তোমার ফ্রেন্ড।’
‘তোমার তো লজ্জা নেই। ও লজ্জা পেয়েই নিজেকে উদ্ধার করতে সম্পর্কের দোহাই দিয়েছে।’
মোহনা ছাদে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ করেই তার মন খারাপ করছে। কারণ তার অজানা। আচমকা বুকের ভেতর থেকে আর্তনাদ বেরিয়ে আসছে। ইমন অনেকক্ষণ খুঁজেছে তাকে। সামনে নূরকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করতেই সে ছাদের দিকে দেখিয়ে দিল। অর্থাৎ মোহনা ছাদেই আছে। ইমন দেরি করল না। দ্রুত চলে গেল। মোহনা হাত দুটো বুকের সাথে ভাঁজ করে রাতের আকাশ দেখছে। পেছন থেকে ইমন বলে ওঠল,‘আকাশ ভালো লাগে বুঝি?’
মোহনা তার দিকে তাকাল না। অকপটে বলল,‘চলে যাও।’
‘আবার কী হলো? মুহুর্তেই মনের এত পরিবর্তন হয় কেন তোমার? কিছু ভুল করেছি কি?’
‘মাহতিম ভাই আর অহনা বাসর সাজাচ্ছে।’
‘আমি কি তাদের সাহায্য করব? বলেছিলাম কিন্তু না করেছে।’
‘এই শোনেন, বেশি স্মার্টনেস দেখানোর দরকার নেই। এমনিতেও মন খারাপ।’
‘আকাশের দিকে আর তাকিয়ে থেকো না। আকাশ মানেই বিষণ্ণতা! কষ্টগুলো মনে করিয়ে দেয়। জানো, মন খারাপে আমিও প্রতি রাতে চন্দ্রবিলাস করতাম; কিন্তু তুমি জীবনে আসার পর সেটা বাদ দিয়ে দিয়েছি।’
মোহনা সাথে সাথেই তার দিকে তাকাল,
‘কেন?’
‘মাকে মনে পড়ত বলেই দেখতাম। কিন্তু তোমাকে পাওয়ার পর সে কষ্ট ভুলে গেলাম। তোমার মাঝেই চাঁদের থেকেও সুন্দরী বালিকাকে দেখতে পাই।’
মুহুর্তেই মোহনার মনটা চাঙ্গা হয়ে ওঠল। কিছুটা সরে এলো ইমনের দিকে। ইমন হাতে করে আনা গোলাপটা মোহনার দিকে বাড়িয়ে দিল,
‘তুমি আমার মানসিক শান্তি! তুমি ছাড়া অশান্ত সবই। যেদিন অনুভব করতে পারবে পুরোপুরি; সেদিন দেখবে এ অধম পুরুষের ভালোবাসার জোর কতটুকু।’
মোহনা বিভোর হয়ে তার কথা শুনল। পর পরই বলল,‘ভালো লাগছে না কিছুই। কী করব বলো?’
ইমন আরও কিছুটা কাছাকাছি এগিয়ে আসে। মোহনাকে পুরোপুরি আড়াল করে দাঁড়িয়ে গরম নিঃশ্বাস ফেলল। পর মুহূর্তেই কাঁধে দু’হাত রাখল। মোহনা কিছু বলার আগেই কপালে চুম্বন করে বসল। আচমকা স্পর্শে দিশেহারা হয়ে পড়ল মোহনা। পুরো শরীরে শিহরণ বয়ে গেল। বেসামাল কণ্ঠ তুলতে গিয়েও চুপ হয়ে গেল। শব্দ উচ্চারণ করতে পারছে না। ইমন তার চুলগুলোকে মৃদু বাতাসের নিকট ছেড়ে দিল আপনমনে,
‘এটাই চেয়েছিলে তাই না? মাহতিম ভাই আর অহনা ম্যামকে দেখে খারাপ লেগেছিল তোমার। বিষণ্ণ মনটাকে তখন তুমি আকাশের বিশালতায় ছেড়ে দিলে; আমি বুঝে নিলাম, তোমার স্পর্শ দরকার।’
আরক্ত চোখে তাকাল মোহনা। প্রেমিকার অশান্ত মনকে শান্ত করার জন্য যে একটু স্পর্শই যথেষ্ঠ, সেটা হয়ত বুঝে গেছে ইমন। মোহনা কিছু বলল না। পুরো শরীর যেন নেতিয়ে পড়েছে। বিচলিত হয়ে মুখ নত করল। ইমন তার থুতনিতে হাত দিয়ে ঈষৎ হাসল। মুহুর্তেই জড়িয়ে নিয়ে বলল,‘হয়ত প্রেমিক হতে পেরেছি আমি। কী বলো?’
মোহনা চুপ করে রইল। ইমন আরও শক্ত করে বেঁধে নেয় মোহনাকে। মৃদুমন্দ আলোয় অপরূপ দৃশ্য যেন। উপভোগ করল কেবলমাত্র দুটো প্রেমা মন আর নির্বাক প্রকৃতি।
কিছুটা সময় যেতেই মোহনা ছেড়ে দিল ইমনকে। মাথায় একহাত রেখে বলে ওঠল,‘দেরি হয়ে গেছে। এক্ষুনি যেতে হবে।’
ইমন বেশ অবাক হলো। বোকার মতো প্রশ্ন করল,‘কীসের দেরি? তোমার তো মন খারাপ ছিল।’
‘মন খারাপ কি সারাজীবন থাকবে? এখন আর নেই। যদি আবার মন খারাপ হয় তবে আরেকবার জড়িয়ে ধরবেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন যেতে হবে। বড়ো ভাইয়া বাসর ঘরে ঢোকার আগেই টাকা আদায় করতে হবে।’
‘উনি তোমার ভাই।’
‘তাতে কী? নিহা আপুও আমার বোন থেকে ভাবী হলো। চলুন তাড়াতাড়ি।’
বলেই ইমনের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল নিচে। ইমন মনে মনে বলল,‘মেয়েদের মন আর আকাশের রং; দুটোই ফাঁকি দিতে জানে। কখনোই তারা এক রূপে থাকে না।’
বাসরের আয়োজন প্রায় শেষ। অহনা ডিভানে বসে সাজানো ঘরটাকে এক নজর দেখে নিল। অপরদিকে মাহতিম কিছু ফুল অহনার গায়ে ছিটিয়ে দিয়ে বলল,‘আর মাত্র দশদিন পর ভাই আর নিহা আমাদের জন্য এমন ঘর সাজাবে। তবে আমাদের ঘরটা সাদাময় হবে। সবকিছু সাদায় রাঙাব; ওদের মতো লালে নয়।’
অহনা কিঞ্চিত হাসল। বলল,‘যেখানে বৃদ্ধ হয়ে নাতি-নাতনির সাথে খেলা করার বিষয়টাও কল্পনা করে ফেললে সেখানে এই দশদিন পরের কল্পনাটা মন্দ নয়।’
আরও কিছু বলার আগেই গলা খাঁকারি দিল ইমন। মাহতিম ভেতরে আসতে বলল। মোহনা এসেই বলল,‘এবার ভাই আর ইমন বেরিয়ে যাও। পরের কাজ মেয়েদের।’
ইমন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,‘কেন?’
‘এত বলতে পারব না। এখন যান!’
মোহনা ঠেলে বের করে দিল। পর পরই আফসোস করে বলল,‘অহনা, আমারও ইচ্ছে করছে বিয়ে করতে।’
‘কিছুদিন অপেক্ষা করো, হয়ে যাবে।’
তারা দুজন মিলে নিহাকে আনতে চলে যায়। হাজার রীতিনীতির পর নিহাকে ছাড় দিল আনিফা। প্রায় একশ মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল নিহাকে। ঠিক করে তিনজনের পরিচয় মনে রাখতে পেরেছে কি-না সন্দেহ! নিহা শুধু মাথা দুলিয়ে গেছে। মনে মনে দোয়া করেছে, কখন ছাড়া পাবে। অবশেষে পেল। মোহনা, অহনাসহ আরও কিছু মেয়ে মিলে নিহাকে বর্ষণের ঘরে নিয়ে গেল।
চলবে…
Sathi Islam : সাথী ইসলাম