সে_আমার_সন্ধ্যাপ্রদীপ! কলমে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি (১৮)

0
819

#সে_আমার_সন্ধ্যাপ্রদীপ!
কলমে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(১৮)

কলিংবেল বাজছে। ওপাশের মানুষটা ধৈর্যবাণ! থেমে থেমে, সময় নিয়ে বেল টিপছে সে। যেন খুললে খুলবে,না খুললেও সমস্যা নেই। নূহা ওয়াশরুম থেকে মোচড়াতে মোচড়াতে বের হলো। সকাল থেকে এই অবধি তার হাফ সেঞ্চুরি শেষ।
স্যালাইন খাওয়ার পর এখন শুধু পেটে ব্য*থা। এ আরেক বি*পদ!
বেলের আওয়াজ শুনে,ও ভাবল পুষ্পিতা ফিরেছে। বলেছিল তো,একটা ক্লাস করেই চলে আসবে।
নূহা যেমন ছিল ওমন ভাবেই দরজা খুলতে এগোয়। লক টেনে ক্লান্ত কণ্ঠে বলে,
“ জানিস, আমার স্যালাইনে কাজ….”

সামনে চাইতেই বাকী কথা শেষ। চোখ দুটো বড় বড় হয়ে এলো নাহিদকে দেখে। নাহিদ হেসে বলতে যায়,
“ একটু চা পাতা…
অথচ নূহার অবস্থা দেখে,ত্রস্ত ঘুরে গেল ওদিকে। মেয়েটার গায়ে ওড়না নেই। পড়নের জামার এলোমেলো দশা। দুজনেই লজ্জায় বুঁদ। অস্বস্তিতে একাকার। নূহা সময় ব্যয় করেনা। একেবারে,ঝড়ের গতিতে দৌড়ে ঢুকে যায় রুমে।

এদিকে দ্বিধায় পড়েছে নাহিদ। চলে যাবে, না কি দাঁড়িয়ে থাকবে বুঝতে পারছে না। মিনিটের মাথায় নূহা ফিরে এলো তার রুদ্রমূর্তি নিয়ে। নাহিদের হিসাব-নিকাশের মাঝেই চিল্লিয়ে বলল,
“ এই, আপনি এখানে কী করছেন?”

নাহিদ আ*তঙ্কে লাফিয়ে ওঠে। এই মেয়ের ভাষা এত ক*র্কশ! একদম বিট্টুটার জেরক্স কপি। কিন্তু ঘুরে চাইল না। ওমন দাঁড়িয়ে,মিনমিনে জবাব দিল,
“ জি, মানে, একটু চা পাতা নিতে এসেছিলাম।”

নূহা কুণ্ঠায় একশেষ! এরকম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে জন্মে পড়েনি। কিন্তু গলার জোর বহাল রাখতে বলল,
“ কারো বাড়িতে আসতে হলে যে নক করতে হয় সেটা জানেন না ?”

নাহিদ ভীষণ ভদ্রভাবে জানাল,
“ জি,আমি তো ডোরবেল বাজিয়ে ছিলাম। আপনি হয়ত খেয়াল করেননি।”

নূহা নিম্নোষ্ঠ চে*পে মাথা নোয়াল। এখানে ছেলেটার দোষ নেই।
দোষ ওর নিজের। জ্ঞান-হীনের মতোন ওড়না ফেলে কেউ দরজা খুলতে আসে? একবার লুকিং গ্লাসে দেখে নিলেও তো পারতো। ঠিক এই জন্যই আশে-পাশে ব্যাচেলর থাকা বিপদ!

সে মাথা ঠান্ডা করল। এবার শান্ত-ভাবে শুধাল,
“ কী চাই?”
নাহিদের হাতে ছোট একটা কাচের বাটি।
সেটাকে পেছন দিকে এগিয়ে ধরে বলল,
“ একটু চা পাতা হবে? নতুন উঠেছি তো, ফ্ল্যাটে এখনও কিছু কেনা হয়নি।”

“ হবে। তার আগে এদিকে ফিরে কথা বলুন। আপনি অমন ওদিকে ঘুরে কথা বলছেন কেন? আমি কি আপনার ব্যাক সাইট দেখে চা দেব?”

নাহিদ জ্বিভ কা*টল। মেয়ে মানুষ এত টসটস করে কথা বলে! তখন ওসব দেখেই তো এরকম ঘুরে আছে।
আলগোছে ফিরে দাঁড়াল ছেলেটা। নীচের দিক চেয়ে থেকে জানাল,
“ কাল রাতে একটুও ঘুম হয়নি। মাথাটা ভীষণ ধরেছে। তাই একটু চা খেতে চাইছিলাম। এখানে ধারে-কাছে তো চায়ের দোকানও নেই, তাই…”

নূহা থামিয়ে দিয়ে বলল,
“ এত এক্সপ্লেইনেশন দিতে হবে না। দিচ্ছি, তবে কেনার পর ফেরত দিয়ে যাবেন। আমি কিন্তু আবার এত উদার নই যে ফ্রিতে দেব।”

সে শশব্যস্ত বলল,
“ হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই।”

নুহা রান্নাঘরে যায়, এবং পুরো কৌটো তুলে নিয়ে এসে বলে, “ নিন।”

নাহিদ ওর হাত পর্যন্ত চোখ ওঠাল।
গোটা কৌটো দেখে বলল,
“এত খানি তো লাগবে না।”

“ যতখানি লাগবে নিন, নিয়ে বাকিটা দিয়ে যাবেন। এখন ধরুন, আমার কাছে অতো সময় নেই।”

নাহিদ কৌতূহলী চোখে তাকাল,
“ কোথাও যাবেন বুঝি?”

নূহার আবার ওয়াশরুম যাওয়ার প্রয়োজন পড়েছে। কিন্তু ওসব কি আর একে বলা যায়? কণ্ঠ রু*ক্ষ বানিয়ে বলল,
“ সেটা আপনাকে জানতে হবে না।
যা নিতে এসেছিলেন নিয়ে ভাগুন।”

নাহিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চায়ের বৈয়াম নিলো। নিশ্চুপ মাথা নেড়ে চলে গেল ঘরে।

পনের মিনিটের মাথায় বেল বাজল আবার। নূহা বুঝল,নাহিদ এসেছে। দরজা খুলল।
এবার অনুমান সঠিক হয়েছে। ওই এসেছে,সাথে চায়ের কৌটোও। তবে মেয়েটা আশ্চর্য হয়ে গেল,তার হাতের মিনি ট্রের দিক দেখে। এক কাপ চা থেকে নিরন্তর সাদা ধোঁয়া ছুটছে। ও প্রশ্ন নিয়ে তাকাল। নাহিদ পুরু ঠোঁট দুটো দুদিকে টেনে,চমৎকার করে হাসল। ট্রে থেকে কাপ তুলে, এগিয়ে দিয়ে বলল,
“ নিন।”

নূহা তাজ্জব হয়ে বলল,
“ আমার জন্য?”
“ জি।”
“ আমিত চায়ের কথা বলিনি।”
নাহিদ নিষ্পাপ কণ্ঠে বলল,
“ বলেননি। কিন্তু আপনাকে দেখে মনে হলো,আপনিও ক্লান্ত। হয়ত আমার মতো রাতে আপনারও ঘুম হয়নি। তাই বানিয়ে এনেছি।”

নুহা বিস্মিত,চমকিত! এতটা সে আশা করেনি। মনে মনে বলল,
“ ঘুম হবে কী করে? সারারাত যে বিছানার বদলে বাথরুমে ছিলাম।”

“ ঠান্ডা হয়ে যাবে মিস নূহা। কাপটা ধরুন।”
নূহা একবার ভাবল,না বলে দেবে। দুদিনের আলাপে কেউ কিছু একটা দিলেই ও খাবে কেন? যদি এই চায়ে কিছু মিশিয়ে আনে? এই মুহুর্তে সে বাসায় একা,বিপদ হতে কতক্ষণ?
কিন্তু নাহিদের হাস্যজ্বল, সাদাসিধে মুখখানা সেই চিন্তাদের সুবিধে করতে দিলো না। এমন ভোলাভালা ছেলে, আদৌ এসব জঘন্য কাজ করতে পারে? এত আশা করে বানিয়ে এনেছে,না নিলে মন খারাপ হবে না?
সে বাড়ানো কাপ,হাতে নিলো। ছোট করে বলল,
“ ধন্যবাদ!”

নাহিদ বলল,
“ মোস্ট ওয়েলকাম! টেস্ট করে বলুন তো,কেমন হয়েছে? ফার্স্ট টাইম বানালাম।”
নূহা চুপচাপ কাপ ঠোঁট পর্যন্ত ধরল। হঠাৎ কী ভেবে থামল,তাকাল ওর দিকে। সৌজন্যতা রক্ষার্থে একবার ভেতরে আসতে বলা উচিত।
হা করতে গেল যখনই, ঘরের ভেতর থেকে তারস্বরে ফোন বেজে ওঠে নাহিদের। সে তড়িঘড়ি নূহার হাতে বৈয়াম ধরিয়ে দিয়েই, ছুটে যায় । নূহা দাঁড়িয়ে থাকল,অপেক্ষা করল ওর। কিন্তু নাহিদ ফেরত এলো সময় নিয়ে।
হাতে শপিং ব্যাগে, কিছু আছে তাতে। তাড়াহুড়ো করে কোথাও যাচ্ছে সে। নূহা বলতে গেল,
“ ইয়ে শুনুন!”

ও ফিরে চায়। ভীষণ ব্যস্ত ভাবে জানায়,
“ এসে কথা হবে মিস নূহা। আমার বন্ধু ফোন করেছে,আর্জেন্ট যেতে হবে ওর কাছে। আসি।”

ওকে কিছু বলতে না দিয়েই,নাহিদ নেমে গেল সিড়িতে। নূহার দুর্বোধ্য মন খারাপ হলো। বিড়বিড় করল,
“ চা’টা খুব ভালো হয়েছে মিস্টার ঢেঁড়স,বলা হলো না!”

***

ক্লাসে ঢুকে,সবার আগে পুষ্পিতাকে খুঁজে বেড়ায় তনুজা। একটা সময় পেলো,সেই শেষ সাড়ির বেঞ্চের কোণায় বসে।
সে এগিয়ে গেল। পিলপিলে কদমে পাশে দাঁড়িয়ে ডাকল,
“ পুষ্পিতা!”

ওদিক থেকে উত্তর এলো না কোনও। পুষ্পিতা একভাবে তাকিয়ে আছে বেঞ্চের কাঠের দিক। অক্ষিকূট স্থির রইলেও, মস্তিষ্কের সমস্ত নিউরন এখনও থরথরিয়ে কাঁপছে।

তনুজ মুখ কালো করে বলল,
“ রেগে আছো আমার সাথে?”

পুষ্পিতার জবাব নেই দেখে, মেয়েটা আহ*ত হয়। পাশে বসে উদ্বেগ নিয়ে বলে,
“ বিশ্বাস করো, আমি ওইদিন ইচ্ছে করে তোমাকে রেখে আসিনি। স্যার এমন ভাবে তাকালেন,আবার এগিয়ে আসতে নিলেন,খুব ভ*য় পেয়ে গেছিলাম। সরি,আর হবেনা!”

পুষ্পিতা ঠাঁয় বসে। তনুজা মন খারাপ করে বলল,
“ কথা বলবে না? এই পুষ্পিতা!”

গা ধরে ঝাঁকাতেই ধ্যানে মগ্ন পুষ্পিতা নড়ে ওঠে। চমকে তাকায় । তনুজা ভ্রু কপালে তুলে বলল,
“ বাব্বাহ,এভাবে কী ভাবছিলে?”

পুষ্পিতা জ্বিভে ঠোঁট ভেজাল,
“ কই, ককিছু না তো। কখন এসেছো তুমি?”

অবাক চোখে চাইল তনুজা। কণ্ঠে অনিশ্চয়তা,
“ তুমি রেগে নেই?”

পুষ্পিতা ওর থেকেও অবাক হয়ে শুধাল,
“ রাগ? কী নিয়ে?”

তনুজা বিস্ময়ে চোখ পিটপিট করল। পুষ্পিতার সঙ্গে সেদিনের পর ওর এরকম দেখা হয়নি। হলেও কথা হয়নি। সে যে মনে মনে ধরেই বসেছিল মেয়েটা ক্ষেপে বোম হয়ে থাকবে। ওকে পেলেই ব্লা*স্ট করে জ্বা*লিয়ে দেবে একদম।
মাথা নেড়ে ভাবল,
“ থাক বাবা! রাগের কারণ যেহেতু ওর মনে নেই, মনে করাতেও যাব না। এমন নরম সরম একটা বন্ধু জীবনে দরকার আছে।”

তক্ষুণি দরজায় এসে দাঁড়ালেন গফুর। সবার মধ্যে হাঁক ছুড়লেন,
“ পুষ্পিতা কে?”

পুষ্পিতা নিজের নাম শুনে মেরুদণ্ড সোজা করে ফেলল। তটস্থে দাঁড়িয়ে পড়ল বসা থেকে। গফুর বললেন,
“ তোমাকে নতুন স্যার ডাকছেন। এক্ষুণি এসো।”

ও মাথা কাত করে। তনুজা হা করে বলল,
“ নতুন স্যার মানে তো আমার তীব্র রেজা। উনি তোমাকে কেন ডাকছেন?”

“ তা তো জানি না।”
গফুর তাগাদা দেন,
“ কই মেয়ে,এসো।”

পুষ্পিতা হাঁটা ধরতেই সাথে উঠে এলো তনুজা। ওকে দেখে গফুর বললেন,
“ তুমি কোথায় যাচ্ছো? তোমাকে তো ডাকেনি।”
“ জানি। আমার স্যারের সঙ্গে দরকার আছে। আপনি আপনার মত চলুন।”

গফুরের আদলে বিরক্তি দেখা যায়। সেই কলেজ থেকে মেয়েটাকে চেনে। ভারি বেয়াদব! কোনও সম্মান দেয় না।

***
মিথিলা বহু ক*ষ্টে রান্না করেছে। ঘেমে -নেয়ে অবস্থা খারাপ। দুটো আলু সেদ্ধ করে,চটকে ভর্তা বানিয়েছে। আর রাইস কুকারে ভাত। ব্যাস! এতেই সে ক্লান্তিতে হেলে পড়ছে এখন। হাত পা ছড়িয়ে বিছানার শোয়ার জন্য ছটফট করছে শরীরটা।
খাবার বেড়ে এনে ডায়নিং টেবিলে রাখল ও। এমন রেখেই চলে যাবে। পলাশ ভেতরের ঘরে শুয়ে শুয়ে ফোন টিপছে। ডাকার কী আছে? খিদে পেলে নিয়ে খাবেই।

মিথিলার লাগেজটা তখনও বসার ঘরে। সে জামাকাপড় নিয়ে,ওয়াশরুমে ঢুকতে যায়। ওমনি ডোরবেল বাজল।
ভেতর থেকে পলাশ চেঁচিয়ে বলল,
“ দেখো তো কে!”

নাক ফোলাল মিথিলা। তাকে হুকুম করছে! তুই এসে দেখতে পারিস না? কিন্তু দাঁত চে*পে হজম করল বিষয়টা। ধুপধাপ পায়ে গিয়ে ছিটকিনি টানল দরজার। সঙ্গে সঙ্গে জেনি হেসে বলল,
“ হেই মেটিলা!”

মিথিলার শরীর উষ্ণতায় টগবগ করে ওঠে। খিটমিট করে বলে,
“ শাঁকচূন্নী, ডাইনি,আর একবার আমাকে উল্টোপাল্টা নামে ডাকলে মে*রে মুখ ভে*ঙে দেব তোর।”

জেনি ভ্রু কোঁচকাল। মিথিলার বাংলা ভাষা সে বোঝেনি। তবে চোখ-মুখের অবস্থা দেখে বলল,
“ এনিথিং রং মেটিলা?”

মিথিলা গালি দিতে গিয়েও থেমে গেল। ভাবল, এত কথার কী আছে? মুখের ওপর ধড়াম করে দরজাটা লাগিয়ে দিলেই হবে।
বিধিবাম! এর আগেই পলাশ চলে এলো ওখানে। জেনিকে দেখতেই খুশিতে বাকবাকুম করে বলল,

“ হেই জেনি,কাম কাম!”

জেনি চপল পায়ে ঘরে ঢোকে। মিথিলা ব্যর্থতায় কটমট করে দেখে গেল।

দরজা খোলা দেখে পলাশ বলল,
“কী হলো, আটকাও?”

মিথিলা জোরপূর্বক হাসল।
“ না, কেন? জেনিতো এক্ষুণি চলে যাবে তাই না?”

‘তাইনা’ সে জেনির দিক চেয়ে বলে।
মেয়েটা কিছু বলল না।
হাতের চকচকে বাটিটার ঢাকনা উঁচু করে নিজের ভাষায় বলল,
“ফালাশ, তোমার জন্য চিকেন কারি এনেছি।পছন্দ করো না অনেক?”

পলাশ উচ্ছ্বাসে ফেঁটে পড়ল যেন,
“ ওয়াও! চিকেন কারি?এসব বাঙালি রান্না কবে শিখেছো জেনি? দারূণ কালার হয়েছে তো!”

জেনি গদগদ হয়ে জানাল,
“ youtube দেখে শিখেছি।”

“ জ্বিভে জল চলে এসেছে জেনি। দাও এক্ষুনি টেস্ট করব।”
পলাশ স্বতঃস্ফূর্ত ভঙিতে প্লেট নিয়ে বসল। তরকারিতে হাত দিতে গেলেই মিথিলা ছুটে এসে বলে,
“ পলাশ, তুমি কি এখন এটা খাবে? এই জেনির আনা খাবার?”

পলাশ ভড়কে গেছে ওর আসার নমুনায়। পরপর সাবলীল হয়ে বলল,
“ হ্যাঁ, কেন?”
মিথিলা তেলে-বেগুনে জ্ব*লে উঠল,
“ কেন মানে? আমি এত ক*ষ্ট করে রান্নাবান্না করলাম,আর তুমি কী না এই ধলা চামড়া মেয়ের রান্না খাবে? এটা কি ফাজলামো হচ্ছে পলাশ?”

“ আরে আজব,খেলে সমস্যা কী? তোমার ইচ্ছে হলে তুমিও খাও।”

পলাশে তরকারিতে চামচ দিতে গেলেই মিথিলা চেঁচিয়ে উঠল,
“ না। একদম না। আমি তো খাবইনা আর তুমিও খাবেনা। এতটা পথ জার্ণি করে এসেও তোমার জন্য আমার রান্না করতে হয়েছে। কত কষ্ট হয়েছে আমার তুমি জানো? যদি এই জেনির রান্নাই খাবে তাহলে আমাকে বলেছ কেন? কেন বলেছ?”

পলাশ মহাবিরক্ত হয়ে বলল,
“ বারবার তোমার রান্না, তোমার রান্না বলছো,কী রান্না করেছ শুনি? আলু ভর্তা আর ভাত? দু ঘন্টা বসে এসব বানিয়েছ? আর তা নিয়ে আবার এত গলার জোর?”

মিথিলা স্পষ্ট বলল,
“ আমি যা পেরেছি তাই বানিয়েছি। আর তুমি এটাই খাবে। জীবনে মা- বাবা আমায় রান্নাঘরে ঢুকতে দেয়নি, আর তুমি আমাকে এনেই কাজ করিয়েছ। তাও তোমার ভাগ্য ভালো যে আমি রান্নাটা করলাম। অন্য কেউ হলে জীবনেও করত না।”

পলাশ পালটা তেঁতে বলল,
“ অন্য কেউ হলে খিদে পেটে, আলু ভর্তা দেখে এত শান্তও থাকত না। অকর্মার ঢেঁকি বলে তোমার ঘাড় ধরে বাইরে রেখে আসত।”

“ পলাশ!”
“ একদম চেঁচাবে না! ঝগড়ুটে মেয়ে কোথাকারে?”

“ আমি ঝগড়ুটে?”
“ অবশ্যই!”

জেনি বিহ্বল! গোল গোল চোখে একবার পলাশকে দেখছে, একবার মিথিলাকে। বাংলা ভাষার এই ঝগড়ার আদ্যপ্রান্ত কিছুই বুঝতে পারছে না। তবে পলাশ উঠে দাঁড়িয়ে গেছে, মিথিলার চোখ-মুখ ফুঁসছে।

পরিস্থিতি নিশ্চিত অস্বাভাবিক দেখে বলল,
“ ফালাস,কাল্ম ডাউন! হোয়াটস রং হিয়্যার?”

মিথিলা চেতে বলল,
“ এই শাঁকচূন্নি, আবার আমার স্বামীর নাম ভেঙাচ্ছিস? তোকে আমি…”

হুঙ্কার ছু*ড়ল পলাশ,
“ মিথিলা,বিহেব ইওর সেল্ফ! ও আমার বন্ধু।”

“ ছেলে -মেয়েতে আবার কীসের বন্ধু হ্যাঁ?”

পলাশ ভ্রু বাঁকাল,
“ কেন, মেয়ে বন্ধু থাকা খারাপ? অন্তত তোমার মত ছেলেদের টাকা-পয়সা হাতাতে প্রেম করার চাইতে ভালো।”

মিথিলা স্তব্ধ হয়ে বলল,
“ তুমি আমাকে খোঁটা দিচ্ছো?”

সে সাফ সাফ বলল,
“ হ্যাঁ, দিচ্ছি। আর তুমি এরকম উগ্র আচরণ করলে সারাজীবন দেব। চুপচাপ ভদ্র মেয়ের মত সংসার করো। আর নাহলে কিন্তু আমার অন্য একটা রূপ দেখাতে বাধ্য হব তোমাকে।”

তার র*ক্তচক্ষু দেখে মিইয়ে যায় মিথিলা।
“ এখন যাও এখান থেকে।”

ও তাও দাঁড়িয়ে দেখে, চোখ পাঁকাল পলাশ,
“ কী হলো, যাও?”

মিথিলার কা*ন্না পায়। ক্রন্দন স্রোতে নাক ফেঁপে ওঠে। রাগ গিলে,তেজি পায়ে, রুমে ঢুকে স্বশব্দে দরজা লাগায়। আওয়াজে জেনির মেদহীন গাত্র কেঁপে উঠল। হতভম্ব আওড়াল,
“ কী হলো এতক্ষণ? ও এত রে*গে গেল কেন?”

পলাশ জবাব দিলো না।
সে আবার বলল,
“ ও তোমার কে হয়?”

পলাশ দু আঙুলে কপাল ঘষছে। ছোট্ট উত্তরে বলল,
“ মেইড!’’

জেনি খুব বিস্ময় নিয়ে বলল,
“ মেইড হয়ে এমন ব্যবহার করে? দেখে তো মনে হচ্ছিল ঝগড়া করছে।”

উত্তরে পলাশ ঠান্ডা চোখে তাকায়। আচমকা ঠোঁট টেনে হাসে।
“ বাংলাদেশী তো, ও-দেশে সবার গায়েই একটু-আধটু তেল বেশি। যাক গে, কিছু মনে কোরো না।”

একবাক্যে মেনে নিলো জেনি। হেসে বলল,
“ আচ্ছা।”

******
করিম শাহের টং দোকানে প্রতিদিন কার ভিড়। কিন্তু আজকে সেখানে রাহাতের চেনা মুখ গুলো নেই। মিরাজ,মুশফিক,শাফিন, আরমান কাউকেই গত কয়েকদিন ধরে দেখতে পাচ্ছে না। সব চাইতে যার খোঁজে ব্যকুল তার ক্ষুদ্র মন,সেই বিট্টু অবধি নেই। বিগত কদিন যাবত, তাদের খুঁজে খুঁজে হতাশ রাহাত আজ ধৈর্য্য হারিয়ে, দোকানের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। আড্ডায় মশগুল ছেলে-পেলেদের দিক বাক্য ছুড়ল,
“ বিট্টু ভাইয়া কোথায়?”

হঠাৎ প্রশ্নে ওরা থামে। তাকায় ওর দিক। রাহাত তাদের পরিচিত। সাব্বির বলল,
“ আরে,ভাইয়ের ফ্যান যে! কী খবর তোমার? অনেকদিন পর দেখা দিলে।”

রাহাত ওসব খুচরো আলাপে গেল না। তার চিত্ত ছটফটে,অস্থির!
“ বিট্টু ভাইয়াকে ইদানীং এখানে দেখা যায় না কেন? কোথায় উনি?”

“ ভাই? ভাইতো জরুরি কাজে গেছে। আসবে মেলা-দিন পর।”

“ কোথায় গিয়েছে?”
“ সেটাত আমাদের বলেনি। মুশফিক ভাইরা জানতে পারে।”

রাহাত ব্যগ্র কণ্ঠে শুধায়,
“ ওনারা কোথায়?”
“ ওনারাও কাজে গিয়েছে। কেন বলোতো?”

রাহাতের মুখে আমাবস্যা নামল। মনের আশপাশ ছেঁয়েছে তমসায়। হুট-হাট কী কাজে গেল সবাই? সবাইকে বাদ দিয়ে হলেও, বিট্টু ভাই কে তো তার প্রয়োজন। ও যে ছোটপুকে পাওয়ার আশায় আছে,সে আশা ফলবে না?

******

পুষ্পিতা আর তনুজা গফুরের পিছু পিছু এসে তীব্রর অফিস কক্ষের সামনে দাঁড়াল। তনুজা উঁকিঝুঁকি দেয় ভেতরে। তীব্র চেয়ারে বসে। গায়ে পেস্ট রঙের শার্ট। একেবারে বিধিবৎ বসনভূষণে নজরকাড়া চেহারা। তনুজার চোখ জুড়িয়ে যায়। মুগ্ধতায় দু চারবার আওড়ে ফেলে,
“ আহা! আহা!”

গফুর ডাকলেন,
“ স্যার?”
তীব্রর সামনে অন্য একজন পুরুষ বসে। দরজার দিকে পিঠ ফেরানো তার। কথা বলছিল দুজনে। ডাক শুনে তাকাল।
গফুর, পুষ্পিতাকে দেখিয়ে চলে গেলেন। অথচ তীব্র প্রথমেই, তনুজাকে বলল,
“ আপনি? আপনাকে তো ডাকা হয়নি।”

মেয়েটা ঠোঁট ফাঁকা করে চেয়েছিল এতক্ষণ। তীব্রর হঠাৎ বাক্যবাণে নড়ে ওঠে।
“ জি,না মানে…”

তীব্রর পুরু কণ্ঠ,
“ আপনি ক্লাসে যান।”

তনুজার মুখটা ছোট হয়ে এলো। পুষ্পিতার দিক একবার অন্ধকার আননে চেয়ে,চলে গেল চুপচাপ।
পুষ্পিতা মায়া মায়া নেত্রে ওর প্রস্থান দেখে। আহারে,মেয়েটার স্যারকে এত পছন্দ,আর স্যারই কী না ধমকে পাঠিয়ে দিলেন?

তীব্র তখনই ডাকল,
“ ভেতরে এসো।”

পুষ্পিতা খানিক অবাক হয়। তনুজাকে তো স্যার আপনি করে বললেন। ওকে তুমি বলে কেন? পাশাপাশি বাসা দেখে?

সে কক্ষে ঢোকে ছোট ছোট কদমে। এসে দাঁড়াতেই পিঠ ফেরানো মানুষটা ফিরে চাইল। গাল ভরে হেসে শুধাল,
“ কেমন আছো ভা..পুষ্পিতা?”

পুষ্পিতা বিস্ময়াবহ! ইনি ওকে চিনলেন কী করে? ও জিজ্ঞাসু চোখে তীব্রর দিক চাইল।
সে নিজে থেকেই বলল,
“ ও নাহিদ। আমার সাথে থাকে,তোমাদের পাশের ফ্ল্যাটেই।”

তারপর একটু থেমে বলল,
“ তুমি এখনই ওর সঙ্গে বাসায় চলে যাবে। ছুটি অবধি অপেক্ষা করতে হবে না।”

পুষ্পিতা বিভ্রান্ত,বিমূর্ত! তীব্র তার চেনা,শিক্ষক মানুষ। অনেকবার দেখা হয়েছে। ওনার সঙ্গে একসাথে আসতেই তো কতটা অস্বস্তি হচ্ছিল! কিন্তু এই লোকটাকে দেখল আজ প্রথম। অচেনা লোকের সঙ্গে যাবে কেমন করে?

“ কিছু কি হয়েছে স্যার?”
চিন্তিত কণ্ঠের বিপরীতে জবাব এলো কাঠখোট্টা রূপে,
“ হ্যাঁ, ওই ছেলে-গুলো তোমার জন্যে বাইরেই অপেক্ষা করছে!”

পুষ্পিতার শীর্ণ বক্ষস্থল ছ্যাত করে ওঠে । হরিণী নয়ন বৃহৎ হয়ে এলো আ*তঙ্কে। ওকে ঢোক গিলতে দেখে মনে মনে হাসল তীব্র। আরেকটু রং ছড়িয়ে বলল,
“ এখন চলে গেলে তুমি নিরাপদ। কারণ সেই নিরাপত্তার দ্বায় আমার।
কিন্তু ছুটির পর যেতে চাইলে….”

পুষ্পিতা উদ্বেগ নিয়ে বলল,
“ কিন্তু স্যার,আমি তো চলে যাব,আপনি? ওরা যদি আপনার ক্ষতি করে?”

তীব্রর কথা মাঝপথে থামল। এই কথাটুকু সে আশা করেনি। ভীতু মেয়ে তার জন্য চিন্তা করছে? অথচ মুঁদে আসা শীতল দৃষ্টি তৎপর গায়েব করে ফেলে। স্থূল কণ্ঠ,ঠোঁট নেড়েচেড়ে জানায়,
“ আমার সমস্যা হবে না। তুমি এই ক্লাস করে চলে যেও।”

পুষ্পিতা দ্বিধাগ্রস্ত! কিন্তু স্যার নিশ্চয়ই খারাপ চাইবে না। সংখ্যাতীত সংশয় সমেত মাথা কাত করল একপাশে।
কিন্তু স্যার যে শুধু শুধু ওর জন্য ঝামেলায় জড়ালেন। এখন ওনার সমস্যা হলে?
তীব্র ওর মনঃদ্বিধা বুঝল কী না কে জানে! ঠান্ডা গলায় তর্জণ দিলো,
“ এখন যাও। নাহিদ অপেক্ষা করবে তোমার জন্য।”

পুষ্পিতা ঘাড় হেলাল। ফিরে গেল কোমল পায়ে। তীব্র তাকিয়ে থাকে গমনপথে। নাহিদ বলল,
“ কী চুপচাপ, নরম মেয়ে! তোর তো পুরো অপোজিটরে বিট্টু।”

তীব্র চাপা কণ্ঠে ধমকাল,
“ এ নামে ডাকবিনা এখানে,আর কতবার বলতে হবে?”
সে জ্বিভ কাটে,
“ সরি! সরি!”
তীব্র হঠাৎ হাসল। চেয়ারে এলিয়ে দিলো চওড়া পিঠ। দৃষ্টি স্থির রেখে বলল,
“ ইটস কলড কম্বিনেশন! প্রতিটি মানুষের তার বিপরীত চরিত্রের প্রতি আকর্ষণ থাকে। তীব্রর আকর্ষণ এতটাই তীব্র, যে এক ঝটকায় সে আজ মাস্তানি রেখে এই চেয়ারে বসে। তফাৎ, শুধু এখানেই।”

নাহিদ মাথা চুল্কাল। ঘঁটে এসব ঢোকেনি। হাতঘড়ি দেখে নিলো একবার। পুষ্পিতাকে সাথে নিতে একটু-আধটু সংকোচ হচ্ছে। শত হলেও ভাবি মানুষ! এই বিট্টুটা যে কখন কী চায় কে জানে!

****

কলেজ ছুটি হয়েছে। তিনজন হৃষ্টপুষ্ট আর একজন হ্যাংলা -পাতলা যুবক গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে। ওদের নজর ওৎ পাতা শিকারির ন্যায়। দুজনের হাতে মোটা লাঠি,বাকী দুজনের পকেটে ধাঁ*রাল ছু*রি। একে একে সবাই বের হলো গেট থেকে। শুধু যার অপেক্ষায় ওরা বসে,সেই কাঙ্ক্ষিতের দেখা নেই। ঠাঁয় প্রতীক্ষা শেষে ওরা ধৈর্য্য হারাল। একজন বিদ্বিষ্ট আওড়াল,
“ শালায় ভাগছে। ডরাইছে আমগো রে।”
অন্যজন বলল,
“ ভাইগা কূল পাইব না। আমাগো গায়ে হাত,তাও আবার মাইয়া মানুষ দিয়া?ওই মাইয়ার খবর তো আছেই,সাথে ওরে যে কী করমু!”

“ অহন কী করবি? কাইল ধরি? আইব তো এইহানেই।”
“ কিন্তু ওয় বাইর হইল কই দিয়া? খারাইলাম প্রায় আধঘন্টা হইব,দেখিতো নাই।”

“ হইতে পারে মাইয়া লইয়া পিছনের দেয়াল টপকাইছে। শালা ভীতু মার্কা পোলাপান আমাগো মতো মাস্তান গো লগে পাঙ্গা নেয়!”

চারজন হু-হা করে লুটো-পুটি খেল হাসিতে। তক্ষুণি পেছন থেকে কেউ একজন বলল,
“ আমাকে খুঁজছিস?”
নিম্নভার কণ্ঠে ওদের হাসি থামে,ফিরে চায়। মাস্ক, ক্যাপ পড়ুয়া এক কান্তিমান যুবক, হাতে লম্বা হকিস্টিকটা নিয়ে এক পা আড়াআড়ি ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে।
ওরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। দৃষ্টিতে প্রশ্ন! পুষ্পিতার প্রথম চড় খাওয়া ছেলেটি শুধাল,
“ তুই কে?”
যুবকটি বা হাতে ঘাড় ডলে। খুব ধীর অথচ হিমের ন্যায় কণ্ঠে বলল,
“ তোরা মাস্তান হলে,আমি মাস্তানের বাপ!”

নীচের নোট পড়ার অনুরোধ রইল…

চলবে।

লেখকা আপুর অবস্থাটা বুঝবেন সবাই আশা করি।
১২ দিন পর গল্প দিলাম। অনেকেই জানেন না,আমি অসুস্থ! জন্ডিস হয়েছে বলে গ্রামের বাড়ি এসেছি। কিন্তু আব্বু মারা যাওয়ার পর প্রথম এলাম। চারদিকে,প্রতিটি মোড়ে তার স্মৃতি। কিছু ভালো লাগছে না। দ্বিতীয়ত, প্রচন্ড শীতে মেয়ে নিয়ে তৎপরতায় আছি। অসাবধানতায় যেন ঠান্ডা না বাঁধে। সব মিলিয়ে লিখে উঠতে পারছিলাম না। আজ লিখলাম,জানিনা কেমন হয়েছে! জানাবেন কমেন্টে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here