ছায়া মানব ২
১৫.
মাহতিমকে চলে যেতে দেখে অহনা ওসমানের পেছন থেকে সরে আসে। সে এমনটা আসা করেনি। ইতস্তত করেই ডাকল,’শুনছেন?’
মাহতিম থমকে দাঁড়াল। ঢোক গিলে পুনরায় হাঁটা ধরতেই অহনা পেছন থেকে গিয়ে তার হাত টেনে ধরল। মাহতিমের সমস্ত অভিমান যেন মুহুর্তেই উবে গেল। অহনার ছোঁয়া পেতেই সব কষ্ট ভুলে গেল। তবে শিরশির ব্যথা অনুভব করল। ‘উঁহ’ সূচক শব্দ করতেই অহনা আচমকা হাত ছেঁড়ে দেয়। এতে খানিকটা নারাজ হয় মাহতিম। সে চাইছিল হাতটা অহনা ধরে রাখুক বেশ খানিকটা সময়। পুরো জীবনতো সাধ্য নেই ধরে রাখার, খানিক সময়ের জন্য হলেও ধরত। অহনা মাহতিমের হাতের দিকে চোখ দেয়। হাত চিঁড়ে গেছে অনেকটা। আ’ঘাতের স্থানে চোখে পড়তেই অহনার চোখ সজল হয়ে আসে। কান্না করে দেবে বলে হচ্ছে মুহুর্তেই। অহনা পুনরায় মাহতিমের হাত ধরল সন্তর্পণে। এবার আর সে ব্যথা পেল না। তবে ব্যথা পেলেও এবার আর শব্দ করবে না। কারণ এখনের স্পর্শ যত্নের। অহনা মাহতিমের হাত চেপে ধরে তাকে রুমে নিয়ে গেল। দ্রুত ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে এলো। যখন অহনা মাহতিমের হাত ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছিল, তখন বাঁকা নজরে কয়েকবার ওসমান অহনাকে দেখল। তবে বুঝতে পারল না তার মনের অবস্থান। দয়া দেখাচ্ছে নাকি ভালোবাসা তার বোধগম্য হয়নি। তবে দয়া বলেই ধরে নিল। অহনার থেকে বিদায় না জানিয়েই প্রস্থান নিল দ্রুত।
অহনা গভীর যত্ন সহকারেই মাহতিমের ক্ষততে ঔষধ লাগিয়ে দিল। মাহতিম চোখের পলক ফেলেনি কিছু মুহুর্তের জন্যও। অহনাকে দেখার তৃষ্ণা যেন তার মিটে না। মলিন বেশেও তাকে অপরূপা লাগে। মাহতিমের কর্ণপাত নেই কোথাও। অহনা কয়েকবার ডেকেছে। বারবার সাড়া না পেয়ে কাঁধে ধা’ক্কা দিল। এতে সম্বিৎ ফিরে এলো মাহতিমের। হকচকিয়ে ওঠে সে। অহনা মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করল,’বেশি ব্যথা করছে?’
মাহতিম শান্ত ভঙ্গিতেই বলল,’একদম না।’
‘ আর কোথাও লেগেছে? বলুন, আমি ঔষধ লাগিয়ে দিচ্ছি।’
‘লাগবে না। আমি নিজেই করে নিতে পারব। তুমি ঔষধটা দাও।’
‘ পারবেনতো? আমি সাহায্য করলে ক্ষতি কী?’
‘ বললাম তো, আমি পারব।’
অহনা ক্ষেপে যায়। এতক্ষণে যতটা শান্ত থেকেছে তাই যেন ঢের বেশি।
‘আপনি বারবার না করছেন কেন? আমি কি পারব না নাকি? কোথায় ব্যথা পেয়েছেন দেখি?’
‘পারবেনা বলেই বলেছি। তবে আমার দোষ কী? তুমিই চাইছ এটা।’
বলেই মাহতিম দরজাটা বন্ধ করে দিল এক ঝটকায়। অহনার চোখ দুটো যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে। ঢোক গিলল বার কয়েক। ভয়ে, আতঙ্কে চিৎকার করেই বসল,’দরজা খুলুন দ্রুত।’
‘এতো উতলা কেন তুমি? আমার কী কোনো সেফটি নেই? যদি তোমার পার্টনার মেয়ে দুটো চলে আসে তবে কী করব? তাই দরজা বন্ধ করলাম। কাজ শেষেই দরজা খোলা হবে।’
অহনা আঁতকে ওঠল,’কিসের কাজ?’
‘ ঔষধ লাগানোর কাজ।’
কথাটা শেষ না করতেই মাহতিম শার্টের বোতাম খুলতে লাগল। অহনার ভয়ের মাত্রা যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেল। ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে। মাহতিম বুকের কাছের তিনটা বোতাম খুলতেই অহনা তার শার্ট চেপে ধরে,’আপনি এসব কী করছেন? আর কিছুক্ষণের মাঝেই কিন্তু বড়ো আপুরা আসবে।’
‘দরজা লাগানো। আসলেই তারা নক করবে, তখন আমি পোশাক ঠিক করে নিতে পারব।’
‘আমি আপনাকে কোনো ঔষধ লাগাব না। আমি বের হতে চাই। আমার দম আঁটকে আসছে। আর একটু হলে মরেই যাব।’
‘ কিসব শুরু করলে। তুমি নিজেই জোর করেছ। আমি যেচে বলিনি।’
অহনার হাতে চিটচিটে কিছু একটা লাগল। মাহতিমের বুকেই তার হাত ছিল। হঠাৎ কিছুর স্পর্শ পেয়ে দ্রুত দেখল। হাত র’ক্ত দেখে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়ল। কী করে আসলো র’ক্ত? বুকে আ’ঘাত লাগল কী করে? রক্ত কিনা সিউর হতে অহনা গন্ধ নিল। মাহতিম শার্টের বাকি বোতাম খুলে বলল,’এবার ঔষধ লাগাও।’
অহনা অনেকটা সরে দাঁড়ায়। এতোটাই দূরে যে হাত বাড়িয়ে নাগাল পাওয়া অসম্ভব।
‘আপনার উচিত ডাক্তারে কাছে যাওয়া। খুব বেশি ব্যথা পেয়েছেন।’
মাহতিমের গলা সামান্য নরম হয়ে আসে,’এটা কোনো ব্যথাই নয়। প্রকৃত ব্যথা শরীর নয় মন ভেদ করে। তুমি দাঁড়িয়ে পড়লে কেন?’
‘আপনি নিজে লাগিয়ে নিন।’
‘তা হবে না। তুমি জোর করেছ। এখন নিজেই লাগিয়ে দাও।’
অহনা ঠোঁট টিপে এগিয়ে আসে। হাত কাঁপছে তার। মাহতিমের উন্মুক্ত বুকের দিকে চোখ দিতেও কেমন লজ্জা পাচ্ছে। এমনটা হওয়ার কারণ ব্যাখ্যাহীন। অহনা সহসাই নিজেকে কঠোর করার চেষ্টা করল। দুর্বল হয়ে যাচ্ছে বারবার। মাহতিমের বুকে হাত দিতেই যেন ছ্যাঁত করে ওঠল বুকের ভেতরটা। অহনা মুখ বন্ধ করে শ্বাস নিল। পুনরায় তাঁর বুকে ঔষধ লাগানোর চেষ্টা করল। অবশেষে সফল হলো। মাহতিম অহনার আচরণ দেখে ঠোঁট টিপে হাসল, সেটা অহনার অগোচরে। সামনে থেকে বলল,’হচ্ছে না। আর একটু জোরে চাপ দাও। অস্থিতে ব্যথা হচ্ছে।’
মাহতিমের কথা শুনল না অহনা। কোনোরকমে ঔষধ লাগিয়ে বলল,’শেষ! এবার আপনি ঠিক হয়ে যাবেন।’
মাহতিম হাত নাড়াতে গিয়ে ব্যথা প্রকাশ করে। তৎক্ষণাৎ অহনা তাকে ব্যস্ত হতে না করে। মাহতিম মৃদু হাসে,
‘তোমার সেবা পেতে হলেও দিনে কয়েকবার ব্যথা পাওয়া উচিত আমার।’
‘কিই?’
‘বললাম, হাত নাড়াতে পারছি না। শার্টের বোতামগুলো একটু লাগিয়ে দেবে।’
অহনা বিরক্তি প্রকাশ করলেও সেটা বাইরে নয়। হেসেই সবটা করল। হঠাৎ করেই দরজায় করা’ঘাত পায়। অহনা ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দরজার ফুটো দিয়ে দেখল ছোঁয়া এসেছে। মাহতিম অহনার ব্যস্ততাকে এড়িয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল। অহনা দাঁত দিয়ে নখ খুঁটছে। ছোঁয়াকে দেখে কিছুটা বিচলিত হাসলো। ছোঁয়া মাহতিম এবং অহনাকে একসাথে দেখে কিছুটা অবাক হয়। মাহতিমকে উপেক্ষা করে রুমে ঢুকেই বিছানায় বসল। মাঝে মাঝে মাহতিমকে আড়চোখে দেখছে। মাহতিম মৃদু হাসল,
,’অহনা, আমরা কি বাইরে যেতে পারি?’
সহসাই বলল,’হু! চলুন। আমি বাইরেই যাব।’
অহনা বের হতেই ছোঁয়া শয়তানি হাসি দিয়ে বলল,’ক্যারি অন বেবস্!’
অহনা তার কথা তেমন বুঝল না। তবে পালাই পালাই ভাব থাকায় কোনোরকমে বের হয়ে এলো। রাস্তার পাশে থাকা বেঞ্চে গিয়ে বসলো। মুখ ভার করে আছে। মাহতিম তাকে আনমনে কিছু বলল, তারপর কিছুটা কাছে এগিয়ে বসলো,
‘শর্তের কথা মনে আছে?’
অহনার মুখটা আরো ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে। নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। ঘাবড়ে গিয়ে বলল,’না।’
‘ এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে?’
‘ভুলিনি, মনে আছে। আমি শর্ত মেনে নিয়েছি। কিন্তু তার আগে বলুন, কী করে আপনি জিতে গেলেন? এটা অসম্ভব ছিল।’
মাহতিম হাসল,’আমি একজন আর্মি অফিসার। ট্রেইনিংয়ে কষ্টের মাত্রা তুমি অনুভব করতে পারবে না। তার তুলনায় এটা খুবই কম। তবে আড়াই ঘণ্টা দৌড়ানোটা একটু টাপ ছিল। আমি সেটা মাথায় রাখিনি, আমার লক্ষ্য ছিল তোমাকে জয় করা।’
অহনা বিচলিত হাসলো। এই হাসিতে কোনো ভালোবাসা পেল না মাহতিম। বুঝতে পারল, তার কষ্ট সার্থক হয়নি।
‘ভয় নেই, শর্ত নিয়ে আর কথা বাড়াচ্ছি না। আমি কাউকে তার মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করতে বলব না অন্তত।’
অহনা কিছুটা খুশি হলেও প্রকাশ করল না। মাহতিমের চোখের দিকে তাকাল। শ্যামবর্ণের মুখশ্রী, সুঠাম দেহ, সুদর্শন ভীষণ এসব চোখে পড়তেই কয়েক সেকেন্ডের জন্য অহনা চোখ সরিয়ে নেয়। মাহতিম তার ভাবাবেগ দেখে মিইয়ে যায়। তবে আফসোস রয়েই যায়।
‘তুমি চোখের দিকে তাকাতেই ভয় পাচ্ছ, প্রেমে পড়বে কী করে? প্রেমে পড়তে হলে চোখের মিলন চাই প্রথমে।’
মাহতিমের কথার পিঠেই অহনা তার চোখের দিকে তাকাল। বুকের ভেতর শীতল হাওয়া বয়ে গেল যেন। কারো চোখের চাওয়াতেও যে শান্তি পাওয়া যায় তা তার বোধগম্য ছিল না।
‘আজ বিদায় নিই তাহলে।’
‘সাবধানে যাবেন।’
মাহতিম যাওয়ার আগে বলল,’তুমি করে বলবে। আপনি শব্দটা কেমন পর হয়ে গেল। শর্ত বাদ পড়াতে এটা অন্তত মানতে পারো।’
‘ ঠিক আছে।’
মাহতিমের প্রতি অহনার শ্রদ্ধাটা আরো বেড়ে গেল। অন্য ছেলে হলে হয়ত এই সুযোগ কখনোই হাতছাড়া করত না। অথচ মাহতিমের চিন্তাধারা আলাদা। সে ভেবেই সবটা বলল।
অহনা আনমনে বলল,’কতো ভালো লোক ওনি।’
ম্যাচে আসতেই ছোঁয়ার মুখোমুখি।
‘কেমন চলছে?’
অহনা আরেক তরফা অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করল,’কী কেমন চলছে?’
‘ছেলেটার সাথে কেমন চলছে সেটাই বলেছি।’
‘গাড়ি নয় যে চলবে। তবে আপনার পছন্দ হলে আমি সুযোগ করে দিতে পারি।’
‘কেন? তোমার কি ভালো লাগছে না আর?’
‘ লোকটাকে আমি চিনি। আমাকে সাহায্য করেছে। এর বাইরে আর কিছুই হয়নি।’
‘ তাহলে দরজা বন্ধ করে কী করছিলে?’
‘ ওনি আহত ছিলেন, তাই ব্যান্ডেজ করে দিয়েছিলাম।’
‘সে যাই হোক। এটাও একটা ভাবার বিষয়। সো আমাদের আজ ট্রিট দেবে তুমি।’
অহনা রেগে যায়। তার কাছে টাকার পরিমাণও একদম কম। তার ওপর মেয়েগুলোর অত্যাচার আর মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। তারা কখনোই অহনার কষ্টটা বুঝতে পারছে না।
‘আমার এখনো পুরো মাসটা পড়ে রয়েছে আপু। এই মুহুর্তে আমি খরচ করতে পারিনা।’
‘ ঠিক আছে, তাহলে সবাইকে বলে দেব তুমি ঘরে ছেলে নিয়ে এসেছিলে। তখন কেমন হবে বলোতো।’
‘ যা হবার তাই হবে। নিকৃষ্ট মানসিকতা আপনাদের।’
বলেই মোহনা অহনার হাত চেপে ধরে তাকে বাইরে নিয়ে এলো,
‘এদের মাঝে থাকো তুমি? মেয়ে হয়ে অন্য একটা মেয়েকেই ব্লেকমেইল করছে কেমন। তুমি এদের সাথে আর থাকবে না।’
মোহনাকে দেখে খানিকটা চমকে গেল অহনা। তারতো আসার কথা ছিল না ছিল অসময়ে। কেন এলো?
অহনার কথা যেন বুঝতে পারল মোহনা। বলল,’দুপুরে আমার খটকা লেগেছিল। তোমার কিছু একটা হয়েছে ভেবে আমি শান্ত থাকতে পারিনি। তাই দেখতে এলাম। এখন মনে হচ্ছে এসে ভালোই করেছি। ছেলে নিয়ে অপবাদ দিচ্ছে তোমাকে। কোন ছেলে এসেছিল তোমার কাছে?’
মোহনার কথার জবাবে কী বলবে জানা নেই অহনার। এড়িয়ে যেতেও পারছে না। কী বলবে এখন? মোহনা পুনরায় বলল,’কী হলো, বলো? তোমাকে অপবাদ দিচ্ছে আর তুমি মেনেও নিলে?’
চলবে….
Sathi Islam : সাথী ইসলাম
গল্পটা সম্পর্কে জানতে এবং মতামত জানাতে সাথীর পাঠকমহল (পাঠক+পাঠিকা) – Sathi’s Readership