ছায়া মানব ২ ৪৭.

0
207

ছায়া মানব ২

৪৭.
বর্ষণ পরিত্যক্ত জায়গাটায় অনেকক্ষণ খুঁজল অহনাকে। অবশেষে কারো ফুঁপিয়ে কাঁদার শব্দ কানে আসে। হালকা শব্দকে অনুসরণ করে সে এগিয়ে যায়। ভাঙাচোরা একটা ফ্যাক্টরি, ছোটোখাটো। বর্ষণ বুকে সাহস নিয়ে প্রবেশ করে সেটায়। অনেকগুলো ড্রাম ছাড়া কিছুই নজরে পড়েনি। আরও কিছুটা এগিয়ে যেতেই শব্দের প্রতিধ্বনি শুনতে পায়। শব্দের গতি অনুসরণ করেই বর্ষণ পা বাড়ায়। এক পর্যায়ে অহনার দেখা পায় তবে দেখতে পায়নি। বিদঘুটে অন্ধকার সব জায়গায়। ফুঁপানোর শব্দ পেয়েই বর্ষণ ডাকল,‘এখানে কেউ আছে?’

মুহুর্তেই তার শব্দের প্রতিধ্বনি হলো। অহনা আঁতকে ওঠে। ভয়ঙ্কর এক শব্দ শোনা যাচ্ছে। ভয়ে আত্মা শুকিয়ে আসে। বর্ষণ মোবাইলের ফ্লাশ জ্বালিয়ে চারিদিকে দেখতে থাকে। একদম কোণায় কিছু ড্রামের আড়ালে অহনা। তাকে একদম দেখতে পাচ্ছে না।
‘অহনা, তুমি কি এখানে?’

ভরসা পায় অহনা। মুহুর্তেই বলল,‘হ্যাঁ!’
লাইট জ্বলে উঠে সাথে সাথেই। বর্ষণের হাত থেকে মোবাইলটা পড়ে যায়। চার-পাঁচজন লোক তাকে ঘিরে ধরে। বর্ষণ একা তাদের সাথে পারবে না। সে মোবাইল খুঁজতে থাকে। নিচ থেকে মোবাইলটা হাতে নিতে চাইলেই শক্তপোক্ত দেহের একজন তার নাকে সজোরে আ’ঘাত করে। নাক ফেটে রক্ত বের হয়। নিজেকে সামলে নিয়ে বর্ষণ‌ও আ’ঘাত করে। সাথে সাথেই ফোনটা কুড়িয়ে নেয়। এতজনের সাথে সে পেরে উঠছে না।

মাহতিম রিসাইন করার জন্য তৈরি। ইমন আরেকবার বলল,‘বিষয়টা আবার ভেবে দেখুন। আপনি কিন্তু নিজের ভবিষ্যৎ হারাচ্ছেন।’

‘ভবিষ্যৎ যার সাথে কাটাবো তাকে হারিয়ে ফেললে?’

জয়ন্ত পেপার রেডি করে আনে। মাহতিম কোনোদিকে না ভেবেই কলমটা হাতে নেয়। জয়ন্ত আবার বলল,‘আরেকবার ভেবে দেখা উচিত তোমার।’

মাহতিম কোনো কথা বলল না। তার ধ্যান এখন একটাই, অহনাকে বাঁচাতে হবে। আচমকা তার কল বেজে ওঠে। মাহতিম সেদিকে নজর দিল না। জয়ন্ত বলল,‘কলটা ধরে দেখো।’

জয়ন্তের কথাতেই মাহতিম রিসিভ করে। কিন্তু সাথে সাথেই আর্তনাদ ভেসে আসে। কেউ সজোরে লাথি মেরে ফোনটা ফেলে দিয়েছে। মাহতিম কয়েকবার ‘হ্যালো! হ্যালো’ করল। কোনো উত্তর এলো না। কলটা ছিল বর্ষণের। মাহতিম স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখল বর্ষণের একটা মেসেজ। মাহতিম সাথে সাথেই ইমনকে বলল,‘এক্ষুনি যেতে হবে।’

জয়ন্ত বেশ অবাক হলো। বলল,‘কোথায় যাচ্ছ?’

‘স্যার, আপনার গাড়িটা নিয়ে যাই? আমারটা এক্সি’ডেন্ট করেছে।’

‘ঠিক আছে।’

কথাটা বলতে দেরি মাহতিমের বের হতে দেরি হলো না। কিন্তু পেছনে দ্রুত এলো জয়ন্ত,‘চাবিটা নিয়ে যাও।’

‘ধন্যবাদ স্যার!’

‘শিঘ্র‌ই ফিরে এসো।’

ইমন আর মাহতিম চলে গেল বর্ষণের পাঠানো ঠিকানায়। বর্ষণ কিছুতেই নিজেকে রক্ষা করতে পারছে না। অবশেষে মাথায় আঘাত পেল। তার চিৎকার কানে যেতেই অহনা বিচলিত হয়ে পড়ে। তাকে বাঁচাতে এসে অন্যকারো ক্ষতি হোক সে চায় না। কিন্তু বন্দি থেকে কী করে সে সাহায্য করবে? নিজেকে ছাড়ানোর হাজার চেষ্টা করেও অসফল হয়।

মাহতিম আর ইমন লোকেশন দেখেই বর্ষণের স্থান শনাক্ত করে। ফ্যাক্টরিতে ঢুকতেই লোকগুলো পালানোর চেষ্টা করে কিন্তু মাহতিম দুজনকে ধরে নেয়। ইমন একজনকে ঘু’ষি মারার সাথে সাথেই সে অজ্ঞান হয়ে যায়। অন্য দুজন পালিয়েছে। মাহতিম সাথে সাথেই পুলিশ কল করে। মাহতিম বর্ষণকে কোনোরকমে সামলে নেয়। মাথায় বেশ খানিকটা ব্যথা পেয়েছে। পর পরই অহনাকে খুঁজে নেয়। মাহতিমকে দেখতে পেয়ে অহনা ঝাঁপিয়ে পড়ে। ইমন বর্ষণকে নিয়ে অপরাধীদের কাছে যায়। তারা অবচেতন প্রায়। তিনজনেই ঘু’ষি খেয়ে জ্ঞান হারিয়েছে। স্থানীয় পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যায় তিনজনকে। মামুন লোকেশন দেখেই পুলিশ নিয়ে এসেছে। মাহতিম বারবার বলছে অহনাকে,‘শান্ত হ‌ও, বাড়িতে সবাই চিন্তা করছে তোমার জন্য।’
অহনা কেঁদেই যাচ্ছে। থামার কোনো লক্ষণ নেই। মাহতিম গাঢ় করে চুমু এঁকে দেয় অহনার কপালে। সাথে সাথেই থেমে যায় অহনা,
‘ভেবেছিলাম এ যাত্রায় বেঁচে ফিরতে পারব না। তোমাকে আর দেখা হবে না।’

অহনা পুনরায় নাক টেনে ওঠে। মাহতিম তার কপোলদ্বয়ে দুহাত রেখে সান্ত্বনা ঘিরে দেয়,
‘আমি থাকতে কেউ কীভাবে তোমার ক্ষতি করবে? এবার থেকে আরও সাবধান হব। কখনোই ছাড়ব না তোমায়। স্বল্প সময়ের জন্য হলেও নিজের সাথে রাখব।’

অহনা মুখ গুঁজে নেয় মাহতিমের বুকে,
‘এখানেই আমার শান্তি। এভাবেই থাকব আজীবন।’

‘না, থাকতে পারবে না। এভাবে থাকলে আমি হাঁটতে পারব না। ভাই আর ইমন অপেক্ষা করছে, বাড়িও যেতে পারব না।’

অহনা ফিক করে হেসে দেয়। তারা দ্রুত হাসপাতালে র‌ওনা দেয়। বর্ষণ যেতে চায়নি। মাহতিম জোর করে নিয়ে গেছে। বর্ষণের কাছে সেটা হালকা ব্যথা হলেও মূলত বাড়ি খাওয়ার দরুণ অনেকটা কেটে গেছে। তাই ব্যান্ডেজ করেই বাড়ি ফিরতে হলো।

বাড়ি ফিরতেই সবাই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। মাহতিম সব তথ্যাদি নিতেই পুলিশ স্টেশন যেতে চাইল কিন্তু অহনা হাত ধরে রাখে,‘যেও না এখন।’

সকলের সামনে অহনার এমন কাণ্ড দেখে মাহতিম হকচকিয়ে ওঠে। চারিদিকে তাকিয়ে তারপর অহনার দিকে তাকাল। সবাই নিজ নিজ কক্ষে চলে গেল। এমন বিব্রতকর অবস্থায় কেউ থাকতে চায় না।
সবাই চলে যেতেই অহনা বলল,‘যা হয়েছে তা বাদ দাও। আমি এখন তোমার সাথে থাকতে চাই। খুব কঠিন সময় পর তোমাকে পেলাম। এভাবে চলে যেও না।’

মাহতিম গলা নরম করে বলল,‘এখন দিন নয় যে আমার সাথে থাকবে। এখন রাত! সো, ঘুমিয়ে পড়ো। অনেক ক্লান্ত তুমি।’

‘ওহ, তুমি বুঝি ক্লান্ত ন‌ও?’

‘তা বলিনি। তবে অপরাধী কে, না জানা পর্যন্ত আমি শান্তি পাব না।’

‘প্লিজ যেও না।’

অহনা মাহতিমকে টেনে নিয়ে গেল নিজের ঘরে। এক মুহূর্তো দেরি হলো পুনরায় বুকে মাথা গুঁজে নিতে।
‘আমার প্রিয় বয়ফ্রেন্ড।’

অহনার কথায় হাসল মাহতিম,
‘নতুন উপাধি!’

‘বহু পুরাতন। যুগ যুগ ধরে এ প্রেম গাঁথা হয়ে থাকুক।তোমার স্পর্শেই কেটে যাক আমার প্রতিটি সময়।’

নিহা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে দেখেও বর্ষণ এগিয়ে গেল। ঘুমন্ত মেয়েটার কপালে চুমু এঁকে দিয়ে বলল,‘পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী নারী তুমি আমার কাছে। অহনার থেকেও বেশি সুন্দরী।’

‘ততটা না। একটু কম আছে।’

বর্ষণ সরে যায়। নিহা জেগে ওঠেছে। নিহা পিটপিট করে চোখ খুলেই বর্ষণকে দেখে আঁতকে ওঠে।
‘এসব কী? কী করে হলো?’

বর্ষণ নিহার দুকাঁধে হাত রাখে,
‘তেমন কিছু নয়। চিন্তা করো না। একটু ব্যথা পেয়েছি।’

‘একটু নয় অনেকটা। আর কোথাও ব্যথা পাওনিতো? কী করে হলো এসব?’

বর্ষণ আসল ঘটনা বলল না। বলল,‘তেমন কিছু না। আঘাত লাগতেই পারে। সামান্য‌ই ছিল। এখন তুমি বলো, এভাবে জেরা করবে নাকি একটু প্রেম ভালোবাসা নিবেদন‌ও করবে?’

নিহা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে যায়,
‘তোমাকে নিয়ে ভয় পাই। তাই চিন্তা করি। এটাও বুঝি অন্যায়? চিন্তা করাও প্রেমের মাঝেই পড়ে।’

‘ওহ আচ্ছা! কোন কবি বলে গেছে, প্রেমের মাঝেই চিন্তা?’

‘কবি আলুকেন্দ্রনাথ বলেছেন।’

‘সেও হয়ত তোমার মতোই বুদ্ধিমান। তোমার থেকে অন্তত এক ইঞ্চি পরিমাণ বেশি বুদ্ধি থাকলেও এমন কথা বলতো না।’

‘ইনসাল্ট করলে নাকি?’

‘আমার ঘাড়ে কটা মাথা, তোমায় ইনসাল্ট করব?’

নিহা ভাবুক হয়ে বলল,‘একটু আগে তুমি আমাকে সুন্দরী বলেছিলে তাই না?’

‘ক‌ই নাতো! তোমাকে সুন্দরী বলা যায় না অহনার থেকে।’
রেগে যায় নিহা‌। কোনো মেয়েই প্রেমিকের মুখে অন্য নারীর প্রশংসা শুনতে চায় না। নিহাও তার ব্যতিক্রম নয়। রাগে তার নাকের পাটা লাল হয়ে আসে। কিছু একটা করে ফেলবে এমন ভাব করে ধপ করে খাটে বসে পড়ে। পর পরই এক মুহূর্তও দেরি না করে শুয়ে যায়। কাঁথা টেনে নেয় মুখের ওপর অবধি,
‘একদম কাছে আসার চেষ্টা করবে না। দূরেই থাকো।’

বর্ষণ ভেবেছিল মেয়েটা রেগে হয়ত কিছুটা সোহাগ দেবে কিন্তু এ তো ব্যতিক্রম। বর্ষণ‌ও সামলানোর জন্য পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল। জড়িয়ে ধরে বলল,‘তুমি কতটা সুন্দরী তা কি জানো? হয়ত আমার চোখে প্রথম সুন্দরী ছিল অন্যকেউ। সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়েছে। এখন তুমি ছাড়া আর কেউ নেই আমার চোখে সুন্দরের তালিকায়।’

নিহা চুপ করে র‌ইল। বর্ষণ আরও কিছুটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরতেই নড়ে ওঠে‌। বাধা দিল না আর। ভালোবাসার স্পর্শ পেতে চায় না কোন নারী? সবাই চায়। যদি রেগে যায় তবে ভালবেসে স্পর্শ করলেই রাগ চলে যায়। যদি নিজেও কঠোর হয়ে যাও, তবে সম্পর্কের সমাপ্তি এখানেই। পুরুষ হলে শক্ত হ‌ও তবে নারীর কাছে নরম হ‌ও। কোমল হৃদয়কে আগলে নিতে হলে একটুতো কোমল হতেই হবে। না হয় পরিণাম বরাবরের মতোই শোচনীয় হবে।

চলবে….

Sathi Islam : সাথী ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here