ছায়া মানব ২ ৪৯.

0
202

ছায়া মানব ২

৪৯.
অহনা মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। একটাও কথা বলল না মাহতিমের সাথে। মাহতিমের‌ও অস্বস্তি হচ্ছে কথা না বলে। বার বার ডাকছে, তাও কোনো উত্তর দিচ্ছে না অহনা। এক পর্যায়ে মাঝরাস্তায় গাড়ি থামিয়ে দেয় মাহতিম। অহনা সেদিকেও নজর দিল না। কেন গাড়ি থামাল তাও জানতে চাইল না। মাহতিম গলা খাঁকারি দিল কয়েকবার। কোনো কথা বলল না অহনা। শেষমেষ বলল,‘কী হয়েছে বলো তো? কোনো কথা বলছ না কেন?’

অহনা চুপ করেই র‌ইল। এক ঠোঁটের উপর অন্য ঠোঁট উঠিয়ে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল।

মাহতিম সরে এলো অহনার দিকে। একদম মুখের কাছে এসে চিৎকার করে বলল,‘সমস্যা কী বলবে? খেয়ে নেব বলে দিলাম।’

অহনা‌ মুখ সরিয়ে নেয়। জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। সাথে সাথেই মাহতিম তার চেহারা ঘুরিয়ে এনে কপোলদ্বয় স্পর্শ করল। বড়ো বড়ো চোখ করে তাকাল,
‘এই, রাগ করেছ আমার ওপর?’

অহনা কিছু বলল না। চুপ করেই যেন সারাজীবন কাটিয়ে দেবে। মাহতিম পুনরায় বলল,‘আমি চাইনি বন্ধুদের সামনে তোমাকে আরও বেশি সুন্দরী লাগুক। ওরা সিঙ্গেল, নজর দিতে পারে।’

অহনা হকচকিয়ে ওঠে,‘মানে কী?’

‘মানে এটাই, আমি চাই না আমার আহির দিকে অন্যকারো নজর পড়ুক। ইচ্ছে তো করছে কালি মাখিয়ে নিয়ে যাই তোমায়।’

‘তোমার কি আমার প্রতি বিশ্বাস নেই? অদ্ভুত কথা! বলতে পারতে, আমি বোরকা পরেই বের হতাম। আর কেউ দেখতে পেত না।’

‘ইশশ্! বুদ্ধিটা মাথায় আসেনি। এটা করলেই তো আর কেউ দেখতে পেত না। আমি ছাড়া তোমাকে আর কেউ দেখবে, সেটা ভাবতেও ভয় হয়।’

অহনা রাগে ফেঁপে ওঠে। বাহু দ্বারা নাক ঘষে বলল,‘অত্যাচার করতে চাইছ? ঠিক আছে। প্যাকেট করে দাও আমায়। প্যাকেট হয়েই সবসময় বের হব।’

‘রেগে যাও কেন? আচ্ছা বলো, তোমার প্রিয় একটা খাবারের দিকে যদি কারো নজর যায়, তোমার খারাপ লাগবে না?’

‘কেন লাগবে? ভাগ করে খাব।’

‘আসতাগফিরুল্লাহ! এটা কী বলো? আমি তো কখনোই নিজের প্রিয় জিনিসটা কাউকে দেব না। যেমন তুমি!’

‘তুমি কি আমাকে খাবারের সাথে তুলনা করলে? আমি খাওয়ার জিনিস?’

মাহতিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অহনার হাতদুটো মুষ্টিবদ্ধ করে বুকের সাথে চেপে ধরে। পর মুহুর্তেই চুমু খেয়ে বলল,‘তুমি আমার দ্বিতীয় অস্তিত্ব। নিজের অস্তিত্বের দিকে কারো নজর পড়লে কি সহ্য হবে আমার? তোমার এই চোখ, নাক, মিষ্টি ঠোঁট, কাঁধ ছড়ানো চুল এসবের দিকে অন্যকারো নজর আমার সহ্য হবে না। কখনোই না। আমিই তোমায় প্রাণভরে দেখব। আর কারো অধিকার নেই।’

অহনার চোখে মুখে শীতলতা ভর করে। নিষ্প্রাণ ঠোঁট দুটো নড়ে উঠে কিঞ্চিত। মাহতিমের সুক্ষ্ম নজর এড়ালো না ঠোঁটের মাধুর্যতা। অহনা আচমকা বলে ওঠল,‘তোমায় রাগাতে ভালো লাগে আমার। কিন্তু রেগে যাও না বলে খারাপ লাগে। আমার সব ভুল মেনে নাও তুমি। এমন কেন তুমি? তোমার প্রতি কখনোই কোনো অভিযোগ আসে না আমার!’

‘তুমি কি আমাকে নিয়ে অভিযোগ করতে চাও?’

‘হ্যাঁ চাই।’

‘তবে ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।’

‘কীভাবে?’
অহনা অবাক চোখে তাকায়। কী করতে চাইছে মাহতিম। মাহতিম বিচলিত হাসল। সাথে সাথেই গাড়িটাকে আর একটু সাইডে নিয়ে দাঁড় করিয়ে পুনরায় তাকাল অহনার দিকে। অহনা বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে আছে। বোঝার উপায় নেই মাহতিমের অভিসন্ধি। মাহতিম অহনার সম্মুখে এগিয়ে আসে। একদম কাছাকাছি এসেই আচমকা অহনার অধরজোড়া ছুঁইয়ে দিল। কেঁপে উঠল অহনা। তবে কিছুটা বিরক্ত‌ও হয়। মাহতিমের কবল থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। বিচলিত হয়ে কয়েকটা কিল বসিয়ে দিল তার পিঠে। সাথে সাথেই মাহতিম অহনার দুহাত চেপে ধরল। শক্ত করে চেপে ধরার দরুণ অহনার অবস্থা বেহাল। মাহতিম ছাড়ছেই না। অহনা চোখ-মুখ খিঁচে রয়েছে। দীর্ঘ সময় পরেই মাহতিম ছেড়ে দেয়। অহনা সাথে সাথে চিৎকার করে ওঠে,‘এটা তুমি কী কর….
বলা শেষ করার আগেই মাহতিম পুনরায় অহনার ঠোঁট দুটো নিজের দখলে নিয়ে নেয়। কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দিতেই অহনা শান্ত হয়ে যায়। ভুল করেও কথা বলা যাবে না। মাহতিম বাঁকা হেসে অহনার দিকে তাকাল,
‘অভিযোগ করো।’
অহনা চুপ করেই র‌ইল। কথা বলার শক্তিটুকুও হারিয়ে গেছে এতক্ষণে। হাত কাঁপছে, চক্ষু চঞ্চল। বলার মতো শব্দ মনে আসছে না। লজ্জায় মুখমণ্ডল আরক্ত। চোখ সরাতে চাইলেও পারছে না। পুরো শরীর কাঁপছে যেন। মাহতিম সাথে সাথেই হাত দিয়ে অহনার মাথার এলোমেলো চুল ঠিক করে দিল। আলতো করে ঠোঁট স্পর্শ করে পর পরই বলল,‘মেরিল ব্যবহার করবে সবসময়। লিপস্টিক হালকা তেঁতো হয়।’

অহনার মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। মাহতিম সরে গিয়ে গাড়ি স্টার্ট করে। দীর্ঘ সময়ের পর তারা রেস্টুরেন্টে এসে পৌঁছায়। অহনা ঘোর লাগা চোখে মাহতিমের দিকে তাকাল। ঢোক গিলে গাড়ি থেকে বের হলো। অহনার এমন নিশ্চুপ হয়ে থাকা সহ্য হলো না মাহতিমের,
‘কথা বলছ না কেন?’

‘কথা হারিয়ে গেছে।’

মাহতিম দীর্ঘ হাসল। হাসার প্রতিধ্বনিতে অহনা আরও বিভোর হয়ে গেল। একটু আগের বিষয়টা আবার স্মরণ করল। কী হয়েছিল তখন? ভাবতেই আরও আড়ষ্টতা ঘিরে ধরে। মাহতিম হাত বাড়ালো অহনার দিকে। অহনা এক মুহূর্তও দেরি না করে মাহতিমের হাত ধরে। মৃদু হাসল এতক্ষণ পর। পর পরই বলল,‘অভিযোগ করতে পারিনি।’

মাহতিম হাসল,‘করেই দেখো, এবার আর ছাড় পাবে না।’

অহনা দমে গেল। মাথায় বার বার একটা কথাই আসছে, প্রেমিক বুঝি এমন হয়? এমন নির্লজ্জ হয়? তবে এ নির্লজ্জতা যদি সুখের কারণ হয়, তবে ক্ষতি কী! হাজারবার মেনে নিতে রাজি! আবার প্রকাশ করুক এই নির্লজ্জতা! মেনে নেব বারংবার।
ঠোঁট টিপে হাসল অহনা। মাহতিমের দিকে তাকিয়েই পা বাড়ালো। শ্যামবর্ণের মুখশ্রী ভীষণ আকর্ষণ করছে তাকে।

সবাই অনেক আগেই এসে হাজির। মাহতিম আর অহনার জন্য‌ই অপেক্ষা করছিল। দীর্ঘ অপেক্ষার পর আসতেই‌ আশিশ বলে ওঠল,‘স্বাগত বড়ো ভাই। আর একটু দেরি করে আসতে পারতে। তবে আমরাই চলে যেতাম।’

মাহতিম মৃদু হাসল। এলিনা সন্দিহান হয়ে অহনার দিকে তাকাল,‘তোমাকে চেনা মনে হচ্ছে। আমাদের আগে পরিচয় হয়েছিল?’
পর পরই মনে পড়েছে এমন ভাব করে বলল,‘ওহ অহনা তুমি। আমাদের আগেই পরিচয় ছিল। ভুলে গেলাম খুব সহজেই।’

অহনা বিচলিত হেসে সবার দিকে তাকাল। মাহতিম সবার সাথেই পরিচয় করিয়ে দিল। যদিও আগেই পরিচিত সব। সবাই মিটিমিটি হাসছে মাহতিমকে দেখে। এমন উদ্ভট কাণ্ড দেখে অবাক হলো মাহতিম। এলিনা বলেই বসল,‘মাহতিম, তুমি কি লিপস্টিক খেতে পছন্দ করো?’

এমন প্রশ্ন শুনে হকচকিয়ে উঠে সে। অহনার দিকে তাকাতেই লজ্জায় মাথা নত করল অহনা। চোখ-মুখ খিঁচে রয়েছে সে। সাথে সাথেই আশিশ বলল,‘একটু আধটু খাওয়াই যায়। আমারও একদিন সুযোগ হবে।’

মাহতিম বোকার মতো সবাইকে জিজ্ঞেস করল,‘এখানে লিপস্টিকের কথা হচ্ছে কেন? বুঝলাম না।’

নাজ অকপটে বলল,‘তেমন কিছু না। তোমার ঠোঁটের কোণে লিপস্টিক লেগে আছে। গালেও অনেকটা।’

মাহতিম চোখ তোলার আর সাহস পেল না। ঠোঁটে হাত দিতেই বুঝতে পারে। সাথে সাথেই বলল,‘আমি আসছি।’

এলিনা সাথে সাথেই অহনাকে বলল,‘এটা স্বাভাবিক! চোখ তুলো আর তোমার ব্যাপারে বলো।’

অহনাও সাহস সঞ্চয় করে নেয়। নাজের সহ্য হলো না অহনাকে। মোবাইলের দিকেই মনোযোগ তার। অনুজ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অহনার দিকে। আশিশকে ধাক্কা মেরে বলল,‘এমন মেয়ে আমাদের চোখের সামনে পড়ে না কেন?’

কথাটা শুনে ফেলল এলিনা। সহ্য হলো না তার। বলেই বসল ছোট করে,‘যাদের চোখে সমস্যা! মানুষকে পবিত্রতা দিয়ে বিচার করতে পারে না, তাদের চোখে ডায়মন্ড ধরা পড়ে না। সুন্দর দৃষ্টির লোকেরাই সৌন্দর্যকে জয় করতে পারে।’

থমথমে অবস্থা। আশিশ কলার ঠিক করে বসে। অনুজ আর কিছু বলল না। তবে তার অস্বাভাবিক চাহনি দৃষ্টি এড়ালো না অহনার। কেমন অস্বস্তি হলো। মাহতিম আসতেই সবাই খাওয়া শুরু করল। অহনা টের পেল অনুজের দৃষ্টি ঠিক নেই। তবুও কিছু বলল না। যতটা বুঝেছে মাহতিমের প্রিয় বন্ধু সে। খাওয়া শেষে সবাই মিলে অনেক ছবি তুলল। মাহতিম আর অহনার অনেকগুলো ছবি তুলে দিল এলিনা। হাজার রকমের ছবি তুলে বলল,‘এসব স্মৃতি হিসেবে রেখে দিও। স্মৃতি হারালে কাজে লাগবে।’
বলেই দীর্ঘ হাসল। বিদায়ের পালায় অনুজ আমতা আমতা করে অহনাকে বলল,‘আপনার নাম্বারটা দিন। দরকার পড়লে কথা হবে।’

অহনা সাথে সাথেই বলল,‘আমি মোবাইল ফোন ব্যবহার করিনা।’

মাহতিম কিছু বলতে গেলেই অহনা তাকে ইশারা করে চুপ থাকতে বলল। অনুজ আর কিছু বলল না। সবাই নিজ নিজ গন্তব্যে চলে যায়। গাড়িতে আসতেই মাহতিম প্রশ্ন করল,‘ফোন নেই বললে কেন?‌ নাম্বার দিতে না চাইলে অন্য কিছু বলতে পারতে।’

অহনা সাথে সাথেই প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,‘ঘুম পাচ্ছে। বাড়ি চলো।’

‘ভেবেছি অন্য কোথাও যাব। তোমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা কোনটা? কোথায় গেলে ভালো লাগবে?’

অহনা একটু ভেবে বলল,‘বান্দরবান, ইচ্ছে ছিল যাব। অনেক প্রিয় জায়গা আমার। অনেকবার গিয়েছি, তাও ইচ্ছে করে।’

‘এখন তো সম্ভব নয়। হানিমুনে গেলে কেমন হয়?’

‘বাজে কথা বন্ধ করে গাড়ি স্টার্ট করো।’
মাহতিম গাড়ি স্টার্ট করল ঠিক‌ই কিন্তু র‌ওনা দিল অন্যদিকে। অহনা চোখ বন্ধ করে ছিল। বুঝতেও পারেনি, তারা বাড়ি যাচ্ছে না।

চলবে….

Sathi Islam : সাথী ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here