ছায়া মানব ২ ৫২.

0
247

ছায়া মানব ২

৫২.
ইমন ব্যস্ত পায়ে মোহনার ঘরে গেল। আজ সাহসটা একটু বেশিই। ছোট ভাই পরিচয় পাওয়ার পর দুইদিন আর কথা বলেনি। মেয়েটাকে ভালোবাসার কথা বলল; কিন্তু উত্তরে সে কিছুই বলেনি। তার মনের খবর তো আর ইমনের জানা নেই। তাই জানার আগ্রহ থেকেই আজ পা বাড়ালো। মোহনা ’সে এসেছিল’ নামক একটি ব‌ই পড়ছিল। আচমকা ইমনের উপস্থিতিতে ভয় পেয়ে যায়। ব‌ইটার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর লাইন ছিল,‘ওরা তোমাকে আমার হতে দিল না। তাই ওদেরকেও মরতে হলো। ভয়ঙ্কর মৃ’ত্যু দিয়েছি আমি।’ লাইনটা পড়ার পর পরই ইমনের দিকে নজর যায়। ওড়নাটা ঠিক করেই উঠে বসে। ইমন‌ও তৎক্ষণাৎ কাছে যায়। মোহনা বিচলিত হয়েই প্রশ্ন করে,‘আপনি এখানে কেন? কোনো দরকার ছিল কি?’

ইমন নজর দিল তার পাশে থাকা ব‌ইটার দিকে। প্রচ্ছদ থেকেই বলল,‘ব‌ইটাতে সম্ভবত বিচ্ছেদ রয়েছে। না পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল খুব। পড়া হয়েছে?’

মোহনা বেশ অবাক হয়েই প্রশ্ন করল,‘আপনি ব‌ইটা পড়েছেন?’

‘না, আন্দাজ করলাম। আশা করি সত্যি হবে।’

‘একদম ঠিক। শেষটা পড়ে কেঁদেছি; তবুও আবার পড়ছি।’

‘তার মানে প্রেম বুঝো। ব‌ইটা পড়েছ অথচ প্রেমিকের ব্যাকুলতা উপলব্ধি করতে পারোনি। কেমন পাঠিকা তুমি?’

মোহনা থ হয়ে যায়। ছেলেটা এসব কী বলছে? মোহনা দ্রুত তার দিকে এগিয়ে আসে।
‘আপনি ঠিক আছেন? এমন প্রশ্ন কেন করছেন?’

‘প্রেমের ব‌ই পড়ে কাঁদছ অথচ আমাকে বুঝতে পারছ না।’

মোহনা ভয় পেয়ে যায়। না চাইতেও ইমনের দিকে হাত বাড়ায়। আচমকা ইমন নিজে থেকেই তার হাতটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে,
‘স্পন্দন শুনতে পাও? অনুভব করো?’

মোহনা ভারিক্কি নিঃশ্বাস ছাড়ে। ছেলেটার সাহস আজ এত বেড়ে গেল কী করে? অবহেলা পেলে বুঝি সাহস বেড়ে যায়? প্রশ্নগুলো মাথায় ঘোরপাক খেতেই বলল,‘আমি আপনাকে কষ্ট দিতে চাইনি। কিন্তু কোথাও যেন বারবার বাধা আমার।’

ইমন আচমকা বলে ওঠল,‘যাচ্ছি আমি।’

মোহনাও বোকার মতো তাকিয়ে রইল তার যাওয়ার পানে। হঠাৎ করেই ইমন এমন আচরণ করল কেন? বুঝে উঠতে পারছে না। ইমন নিজের ঘরে গিয়ে বুকে হাত চেপে ধরল। এতটা সাহস দেখাতে পারবে ভাবতে পারেনি। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তার সাহস কমে এলো। তাই কোনোরকমে পালিয়ে এসেছে। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে পানি পান করল। সামনে তাকাতেই দেখল মোহনা দাঁড়িয়ে আছে।

‘ঠিক ভেবেছি! অতিরিক্ত সাহস দেখাতে গিয়ে এ অবস্থা।’

ইমন কিছু বলল না। মোহনা দরজাটা বন্ধ করে দিয়েই তার দিকে এগিয়ে এলো। ইমন‌ও অশান্ত দৃষ্টিতে মোহনাকে অবলোকন করল। অনেকটা কাছাকাছি এসেই মোহনা বলল,‘দুইদিন অপেক্ষা করেছি আপনাকে অনুভব করতে। অবশেষে পারলাম।’

ইমনের দৃষ্টি চঞ্চল! চশমাটা ঠিক করেই বলল,‘তুমিও তাহলে আমাকে ভালোবাসো?’

‘তা বলতে পারব না। তবে বিয়ে করতে পারি। বিয়ের পরেই না হয় ভালোবাসাটা দেখিয়ে দেব।’
বলেই ইমনের বুকে হাত রাখল। নড়ে উঠে ইমন। নিঃশ্বাস গাঢ় করে বলল,‘এখন কী করব?’

মোহনা ব্রু কুঁচকে তাকায়,
‘আপনাকে এ জন্য‌ই আমার বিরক্ত লাগে। প্রেমিকা দাঁড়িয়ে আছে। এই মুহূর্তে আপনার কী করা উচিত?’

‘জানা নেই, গুগলে সার্চ করব?’

মোহনা ইমনের ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে দিয়ে হঠাৎ করেই জড়িয়ে ধরল। ভীষণ লজ্জায় নুইয়ে পড়ল। ইমন‌ও অধিক সাহস সঞ্চয় করে মোহনাকে আগলে নেয়। মোহনা স্মিত হেসে বলল,‘আপনার লজ্জা করছে?’

অহেতুক প্রশ্নে ইমন আড়ষ্ট হয়ে পড়ে। মেয়েটা কেমন ঠোঁটকাটা কথা বলছে। অথচ সে নিজেই অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছে। মোহনা পুনরায় বলল,‘শক্ত করে ধরুন; যেন সব বিপদে জোড়ালোভাবেই আগলে রাখতে পারেন।’

ইমন তার কথার পিঠেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। এই মুহূর্তে এসে তার উদাসীনতা আর নেই। সেও একজন সাধারণ প্রেমিকের মতো হয়ে গেছে। আপনমনে কয়েকবার ‘ভালোবাসি’ শব্দটা উচ্চারণ করল।

আচমকা দরজায় করাঘাত পড়ল। দুজন‌ই দূরে সরে যায়। মাহতিমের কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। মোহনা বিচলিত হয়ে পর্দার পেছনের লুকিয়ে পড়ে। ইমন নিজেকে শান্ত করে দরজা খুলে দেয়। মাহতিম ভেতরে এসেই তাকে কিছু পেপারস দিতে গিয়ে থেমে যায়। গন্ধ শুঁকে বলে,‘ঘরে কে আছে?’

ইমন আমতাআমতা করে বলল,‘আমি একাই। শুয়ে ছিলাম। কেউ থাকার কথাও নয়।’

মাহতিম কিছু একটা আন্দাজ করে ইমনের চারিদিকে একবার ঘুরল। পর পরই বলল,‘তোমার গায়ে মেয়েদের ঘ্রাণ কেন? ঘ্রাণটাও মনে হচ্ছে মোহনার। ও-ই এমন পারফিউম ব্যবহার করে। এসেছিল এখানে?’

‘না তো।’

ইমন ঘাবড়ে গেছে খুব। সে জানতো না মাহতিম যে কারো উপস্থিতি বুঝতে পারে ঘ্রাণ শুঁকেই‌। পর পরই মাহতিম বলল,‘সেদিন‌ও এমনটাই ছিল। তোমার ঘরে কেউ ছিল। আজ‌ও মনে হচ্ছে। আমি ভুল না হলে কেউ আছে নিশ্চয়।’

ইমন ভয় পেয়ে যায়; সাথে মোহনাও।
‘কেউ নেই। মোহনা আমার ঘরে আসেইনি।’

‘আমি তো বলিনি, মোহনা এখানেই আছে। তুমি এমনটা বললে কেন?’

সাথে সাথেই মাহতিম ঘরের আনাচে-কানাচে খুঁজতে থাকে। এক পর্যায়ে পর্দা সরাতেই মোহনা বের হয়ে আসে। ভয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে সে। মাহতিম একবার মোহনার দিকে তো আরেকবার ইমনের দিকে তাকাচ্ছে। কিছুক্ষণ নীরবতার পর মাহতিম বলল,‘আশা করি কিছু বলবে দুজনেই।’

এর‌ই মাঝে অহনা এসে হাজির হয়। অপরাধীর ভঙ্গিতে মোহনা আর ইমনকে দেখে বেশ অবাক হয়। অন্যদিকে মাহতিম তাদের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বসে আছে। অহনা আসতেই যেন কিছুটা সাহস পায় মোহনা। বলেই বসল,‘আমি ঘুরতে এসেছি ইমনের ঘরে।’

উপস্থিত তিনজন তার দিকে হকচকিয়ে তাকাল। মোহনা বুঝতে পারে, সে বোকার মতো কথা বলেছে। মাহতিম ইমনকে বলল,‘আশা করি সত্যিটা বলবে। দরজা বন্ধ ছিল এ ঘরের। তা-ও মোহনা কেন এখানে?’

ইমন চুপ করে আছে। বলার মতো কিছু পাচ্ছে না। মোহনার এত লুকোচুরি সহ্য হলো না। অকপটে বলল,‘ছেলেটাকে আমার ভালো লাগে। যাকে ভালো লাগে তার ঘরে আসা দোষের কী?’

মাহতিম সোজা উঠে দাঁড়াল। তপ্ত হয়ে কিছু বলার আগেই অহনা বলে ওঠল,‘বাহ! তোমাদের কিন্তু দারুন মানিয়েছে। যদিও আগেই কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিলাম। আজ শিওর হলাম।’

মাহতিম আরও কিছু বলার আগেই অহনা পুনরায় বলল,‘মাহতিম, তোমার প্রেমে ভুল করেও মোহনা বাধা দেয়নি। তাই তোমার‌ও দেওয়া উচিত নয়।’

‘আমি ওর বড়ো ভাই। ওর প্রতিটা বিষয় দেখার দায়িত্ব আমার।’

‘বড়ো ভাই হয়ে কি মাথা কিনে নিয়েছ? যা-ই হোক! বড়ো ভাবী কিন্তু মেনে নিয়েছি‌। তোমরা চালিয়ে যাও।’
বলেই অহনা টেনে নিয়ে চলে গেল মাহতিমকে। মাহতিমকে কিছু বলার সুযোগ‌ও দিল না। নিজের ঘরে নিয়েই শান্ত করে বসালো তাকে।

এদিকে মোহনা রেগে গেল ইমনের উপর। তার বুকে কয়েকবার কিল বসিয়ে দিয়ে বলল,‘ভীতু ছেলে! ভাইয়ার সামনে কথাই বলতে পারলেন না। ব্রেক আপ করলাম আপনার সাথে। কেউ কি করে এতটা ভয় কাতুরে হতে পারে?’

ইমন মোহনাকে আর বলতে সুযোগ না দিয়ে মুখ চেপে ধরল,
‘এবার চুপ করে যাও। সবাই জেনে যাবে। আশা করি অহনা ম্যাম সব সামলে নেবে। আপাতত আর ঝগড়া করো না।’

মোহনা কামড় বসিয়ে দেয় ইমনের হাতে,
‘আমি ঝগড়া করি?’

ইমন অবস্থা সামলে নিতে বলল,‘ছি! কী বলো? তোমার মতো মিষ্টি মেয়ে কখনোই ঝগড়া করতে পারে না। ঝগড়া তো আমি করি। পারলে শাস্তি দাও।’

‘শাস্তি পাওয়াই উচিত আপনার। এত কম সাহস হলে কী করে সারাজীবন পার করব আপনার সাথে?’

ইমন বিচলিত হয়ে বলল,‘ফিউচারের সিদ্ধান্ত যখন নিয়েই নিলে তাহলে আর ভীতু হয়ে থাকা যাবে না। আমার বন্ধু বলতো,‘নারীকে সামলাতে চালাক হতে হয়।’

‘আপনার দ্বারা হবে না। আপনি তো…

মোহনা আরও কিছু বলার আগেই ইমন তাকে বুকের সাথে চেপে ধরে। দুহাতে শক্ত করে বেঁধে নেয়,
‘রেগে গেলে এভাবেই শান্ত করে নেব।’

মাহতিমকে বোঝাতে পারল না অহনা। মাহতিম বলল,‘মোহনা এখনো ছোটো, ওর প্রেম করার বয়স হয়নি। ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।’

অহনাও বলল,‘মোহনা আমার ক্লাসমেট। সে যদি ভুল সিদ্ধান্ত নেয় তবে তোমাকে ভালোবেসেও কি আমি ভুল সিদ্ধান্ত নিলাম? আমাদের কি ব্রেক আপ করে নেওয়া উচিত?’

মাহতিম বোকার মতো তাকাল অহনার দিকে। উত্তরে কিছু পেল না। তা-ও বলল,‘আমি ওর বড়ো ভাই। তাই কথা শোনাতেই পারি।’

‘নিজে ব্রেক আপ করে তবেই বোনের সম্পর্ক ভাঙো। দেখি কেমন পারো। ভেবে দেখবে! আর শোনো, ইমন তোমার থেকেও ভালো, বিনয়ী। তার সাথেই সবচেয়ে সুখী হবে মোহনা। জীবনে সে একজন যথোপযুক্ত লোককেই বেছে নিয়েছে।’

মাহতিম রেগে গেল আরেক দফা,
‘আমার থেকেও ভালো? তুমি এটা বলতে পারলে?’

‘সত্যিটাই বললাম। যদিও ভুল করেছি। কিন্তু আমার দয়ার শরীর; তাই তোমাকে মেনে নিলাম। কষ্ট পাবে আবার। বুঝতেই পারছ আমি তোমাকে না করতে পারিনি।’

‘দয়া করে ভালোবেসেছ? তবে আমি গেলাম।’

মাহতিম রাগে ফেটে পড়ে পা বাড়ালো। অহনা সাথে সাথেই দৌড়ে গিয়ে তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল,‘এই শোনো, ওরাও ভালোবাসুক; আমরাও বাসি। ক্ষতি কী ভালোবাসায়? কোমল হয়ে সব ভালোবাসাকে মেনে নাও। দেখো কেমন সবাই সুখী হয়!’

চলবে….

Sathi Islam : সাথী ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here