ছায়া মানব ২ ৫৫.

0
311

ছায়া মানব ২

৫৫.
অনেক অপেক্ষার পর কাঙ্ক্ষিত সময়টা এলো। যার জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে ছিল বর্ষণের অশান্ত মন। কিন্তু ঘরের সামনে আসতেই বিপত্তি। হাত পেতে দাঁড়িয়ে আছে মোহনা, অহনা, তিশা এবং আরও কিছু মেয়ে। আবদার একটাই,‘টাকা দাও এবং ভেতরে যাও।’

বর্ষণের পকেট পুরো ফাঁকা। সবে চাকরি পেয়েছে। বিয়ের ভার যদিও মামুনের ঘাড়ে তা-ও অনেকটাই নিজের থেকে দিয়েছে। এখন টাকা দেওয়ার মতো পজিশনে নেই। ফোঁস করে শ্বাস ছাড়তেই মোহনা বলল,‘ছাড় নেই। টাকা দিতেই হবে। বেশি নয়, পঞ্চাশ হাজার হলেই হবে।’

বর্ষণ বেশ খানিকটা রেগে যায়,
‘বোন আমার। আমার কাছে এক কানা কড়িও নেই। পরে কখনো দিয়ে দেব। এখন যেতে দে।’

‘তা হবে না। টাকা পরে দিলে পরে ঢুকো। এখন‌ আপাতত না।’

তিন্নি বলল,‘টাকা যেহেতু পরে দেবে; বাসরটাও পরে করো।’

মাহতিমের সহ্য হলো না। সে অহনাকে চায়। কখন এ ঝামেলার পার্ট চুকাবে, কখন সে অহনাকে একটু একা পাবে। মানিব্যাগটা বের করে মোহনার হাতে দিয়ে বলল,‘এবার সরে দাঁড়া।’

‘কত আছে এখানে?’

‘ক্যাশ নেই, কার্ড আছে। ইচ্ছে মতো সংখ্যা বসিয়ে দিস।’

সাথে সাথেই জায়গা ছেড়ে দিল সবাই। বর্ষণ ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিল। আজ তার অন্যরকম লাগছে। যদিও পরিচিতি আগে থেকেই তবুও দিনটা স্পেশাল। প্রতিটি দম্পতির কাছে বিয়ের প্রথম দিন একটু অন্যরকম। বর্ষণের মনেও আলাদা ভালোলাগা। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে খাটে এসে বসে। নিহাকে দেখে তার কেমন সন্দেহ হলো। সন্দিহান চোখে তাকিয়ে পর পরই ভাবনা ত্যাগ করে বলল,‘কী বলে শুরু করব? এই মুহুর্তে এসে সব কথা ফুরিয়ে গেছে। অনেক এক্সাইটেড আমি‌। সত্যিই তোমাকে পেয়ে গেলাম। এবার থেকে প্রতিটা মুহুর্ত ভালোবাসায় কাটবে আমাদের। তোমাকে পেয়ে খুব সুখী আমি।’
বলেই লজ্জায় মাখামাখি হয়ে ঘোমটা সরালো। মুহুর্তেই লাফ মেরে খাট থেকে দূরে সরে যায়। ভূত দেখার মতো চমকে উঠে বর্ষণ। সাথে সাথেই দরজা খুলে বাইরে বের হতেই দেখে নিহা দাঁড়িয়ে আছে। পাশাপাশি মোহনারা সবাই হাসছে। বর্ষণকে নাকানিচোবানি খাওয়ালো তারা। মুহুর্তেই সবাই হু হু করে হেসে বলল,‘কী, কেমন মজা হলো?’

বর্ষণের রাগ ঝরে পড়ছিল। নিহাও হাসছে। এটা দেখে আরও ক্ষেপে গেল সে। নূর বের হয়ে এলো। তাকেই সাজিয়ে বর্ষণের ঘরে রেখে আসা হয়েছিল। আসার সাথে সাথেই তিশা জিজ্ঞেস করল,‘বর্ষণ ভাই কী কী বলেছে?’

নূর মুখ চেপে হাসল। বলল,‘কথা ফুরিয়ে গেছে। ভালোবাসা কাটবে।’

মোহনা বোকার মতো বর্ষণের দিকে তাকাল,‘ভালোবাসা কাটবে মানে?’

বর্ষণ লজ্জায় মাথা নত করে রেখেছে। মোহনা নূরকে জিজ্ঞেস করল,‘ভালোবাসা কাটা যায় না। আর কী বলেছে সেটা বল?’

‘আমার মনে নেই। মাহতিম ভাইয়ের কাছে যাব। এখানে ভালো লাগছে না।’

বলেই থপথপ করে দৌড়ে চলে গেল নূর। বর্ষণ সোজাসাপ্টা বলল,‘এবার অন্তত যাই?’
বলেই দেরি করল না। একটানে নিহাকে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। আচমকা ভয় পেয়ে যায় নিহা। বর্ষণ প্রশ্ন করেই বসল,‘অবশেষে তুমিও আমার সাথে মজা নিলে। বাচ্চা মেয়েকে কত কী বলে ফেললাম।’

নিহা ভাবুক হয়ে শুধাল,‘কী বললে?’

‘কিছু না। এখন বসো।’

নিহা সাথে সাথেই বলল,‘দাঁড়াও! আমার লজ্জা লাগছে না কেন?’

থমকে যায় বর্ষণ,
‘লজ্জা দেব?’

নিহা ঘোমটা ফেলে দিল,‘গরম লাগছে। ফ্রেশ হয়ে এসো। আমার ঘুম পাচ্ছে।’

‘কীই? বাসর হবে না?’

‘হয়েছে তো। এই দেখো, কত সাজসজ্জা। এটাকেই বাসর বলে।’

বর্ষণ হঠাৎ করেই পায়চারি শুরু করল। কী বলবে বুঝতে পারছে না। মনে মনে বলল,‘আজকের দিনেই কেন কথা ফুরিয়ে গেল? আগে তো কত কথা জমে ছিল।’

নিহা শান্ত হয়ে বসল। বর্ষণ আচমকা পাশেই বসে পড়ল। কোনো কথা না বলে হাত বাড়িয়ে নিহার হাত ধরল,
‘রাতটাকে স্মরণীয় করতে চাও না?’

নিহার হঠাৎ করেই ভালো লাগা কাজ করছে। আরক্ত হয়ে তাকাল। মাথা উপর নিচ করল। অর্থাৎ সেও চায়। বর্ষণ সন্তর্পণে নিহার মুখমণ্ডল উপরে তুলল। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,‘আমার প্রথম প্রেম হয়ত ভুল মানুষের প্রতি ছিল। সে প্রত্যাখ্যান করায় আমি তোমাকে পেলাম দ্বিতীয় প্রেম হিসেবে। প্রথম প্রেম যা-ই হোক, শেষ প্রেম তুমিই থাকবে। আমার ভালোবাসার শেষ স্বাক্ষর তোমার নামে উৎসর্গ করলাম।’
বলেই কপালে চুম্বন করল। শিহরিত হয়ে উঠল নিহার সমস্ত শরীর। উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে ভীষণ,
‘আমি সবসময় তোমাকেই চাই। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী নারী হয়ে।’
‘হবে, পৃথিবীর সর্বসুখ এনে দেব তোমায়।’
বর্ষণ নিহাকে দীর্ঘ আলিঙ্গন করল। তাদের দুটি হৃদয় সামান্য সময়ের মাঝেই মিলেমিশে একাকার।

সকাল সকাল অনুজের কল পেতেই মাহতিম চমকে ওঠে। হালকা চোখ কচলে কলটা ধরল। ওপাশ থেকে সে বলল,‘তোকে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার ছিল।’

মাহতিম বেশ অবাক হয়। জিজ্ঞেস করল,‘কী?’

‘হয়ত আমার কথা বিশ্বাস হবে না। আমি কিছু ছবি পাঠাচ্ছি তোকে।’

সাথে সাথেই কিছু ছবি পাঠালো অনুজ। সেগুলো দেখেই মাহতিমের চোখ লাল হয়ে আসে। আচমকা হাত থেকে ফোনটা পড়ে যায়। দীর্ঘ সময় তব্ধা মেরে বসে র‌ইল। অহনার সাথে কোনো একটি ছেলের অন্তরঙ্গ দৃশ্য দেখে তার চোখদ্বয় যেন অপবিত্র হয়ে গেল। পর পরই তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়িয়ে অনুজকে কল করল। ভাঙা ভাঙা গলায় বলল,‘এগুলো তুই কোথায় পেলি?’

‘অচেনা নাম্বার থেকে এসেছে। একটা ছেলে দিল।’

‘তার নাম্বার আমাকে দে। আমি বিষয়টা দেখব।’

‘তার আগে অহনার সাথে কথা বল। মেয়েটা তোকে ঠকাচ্ছে। ভালো মেয়ে নয় সে। এসব সুন্দরী মেয়েদের হাজার জন টার্গেট থাকে। এমন একটা মেয়ের সাথে তুই জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখছিস? ওকে ছেড়ে দেওয়া দরকার।’

মাহতিম সাথে সাথেই কলটা রেখে দেয়। এত প্রেম, এত ভালোবাসা কীভাবে মিথ্যে হতে পারে? মাহতিমের চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে। তার সাহস নেই এ বিষয়ে অহনার সাথে কথা বলার। সে অহনাকে বিশ্বাস করে। এসব কিছু তাকে টলাতে পারে না। স্থির হয়ে বসে র‌ইল। না! থাকতে পারল না। দ্রুত সে অনুজের এপার্টমেন্টে যায়। ধীর কণ্ঠে বলল,‘নাম্বার দে।’

‘তুই এখনো নাম্বার নিয়ে পড়ে আছিস? মেয়েটার সাথে অন্যকেউ ছিল। তোর ভাবা উচিত, অহনা একটা নষ্টা মেয়ে।’

মাহতিমের চোয়ালদ্বয় শক্ত হয়ে এলো। আচমকা অনুজের গলা চেপে ধরে,
‘তোর সাহস কী করে হয় আমার আহিকে বাজে কথা বলার? জানে মেরে দেব বলে দিলাম।’

অনুজ বেশ ভয় পেয়ে যায়। নিজেকে ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করে। এমন সময় নাজ এসে হাজির। অনুজ এবং মাহতিমের লড়াই দেখে থামানোর চেষ্টা করে। মাহতিম ছাড়ছে না।
‘আমার বিষয় আমি দেখব। ওর সাহস কী করে হয় আমার গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে কথা বলার? ওকে সে রাইট আমি দেইনি। মেরেই ফেলব আজ।’

মাহতিম অনুজের নাক বরাবর ঘুষি মারে। নাক ফেটে রক্ত ঝরে পড়ে অনুজের। মাহতিম উন্মাদ হয়ে পড়েছে। এই মুহূর্তে তাকে কেউ শান্ত করতে পারবে না। অনুজ কোনোরকমে বলল,‘আ’ম সরি। আমি বুঝতে পারিনি।’

নাজ একপাশে ঠেলে নেয় মাহতিমকে,‘শান্ত হয়ে কথা বল। মাথা ঠাণ্ডা কর।’

‘আমার আহি এমন নয়। তার অতীত-বর্তমান সব আমার জানা। সে আমাকে ঠকাতে পারে না। এসব মিথ্যে। আমি শুধু তাকে খুঁজছি, যে আমার কলিজাকে অপমান করার চেষ্টা করেছে। আমার হৃদয়ে আঘাত করার সাহস কার হতে পারে আমি সেটাই দেখতে চাই।’

মাহতিম সাথে সাথে অনুজের দিকে এগিয়ে গেল,‘আমাকে সে-ই ছেলের নাম্বার দে।’

অনুজ সাথে সাথেই তাকে একটা নাম্বার দিল। মাহতিম কল করার সাথে সাথেই সেটা বন্ধ বলছে। মাহতিম সাথে সাথেই আশিশকে নাম্বারটা দিয়ে বলল,‘এই সিম কার নামে সেটা দেখ। আমাকে শিঘ্রই জানা।’

কিছুক্ষণ পর আশিশ কল দিয়ে জানালো,‘সিমটা ডিজেবল করে দেওয়া হয়েছে কয়েক ঘণ্টা আগে। চাইলেও কিছুই করতে পারব না।’

মাহতিমের রাগ ঝরে পড়ছে। সে বিদায় নিল। অনুজ কলার ঠিক করে উঠে দাঁড়াল। একটু আগে তার প্রাণ যেতে বসেছিল। ভীষণ ভয়‌ও পেয়েছে। ঢোক গিলে নাজকে বলল,‘এই ছেলে সাংঘাতিক। আমি ওর এমন রূপ কখনো দেখিনি। একটা মেয়ের জন্য আমার গায়ে হাত তুলল।’

নাজ ব্যাঙ্গ করে বলল,‘মেয়েটার জন্য সব করতে পারে। তার আশা ছেড়ে দাও আপাতত। এই মুহুর্তে আমাদের রোম্যান্স করা দরকার।’

মাহতিমের মাথা ঘুরছে। পা দুটো চলছে না। কেমন এক কষ্ট মনের কোণে ভিড় জমালো। দ্রুতপদে বাড়ি ফিরল। অহনা মাহতিমকে চিন্তিত দেখে এগিয়ে যায়।

চলবে….

Sathi Islam : সাথী ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here