(১)
❝ সুন্দরী চলেছে একা পথে।
সঙ্গী হলে দোষ কী তাতে?
রাগ কোরোনা,সুন্দরীগো,রাগলে তোমায় লাগে আরো ভালো! ও সুন্দরীইইইইই….❞
পঞ্চধিক পুরুষালী, উঁচু কণ্ঠে থমকে দাঁড়াল মেয়েটির বিবশ কদম। বুক কাঁ*পল সবেগে। কম্পিত চোখে ঘাড় ফিরিয়ে চাইল। রাস্তার পাশ ঘেঁষে একটি কড়া লাল জিপ,আর আটখানা বাইক দাঁড়ানো। প্রতিটি গাড়ির দখলদারিতে একেকজন তাগড়া,সবল যুবক। প্রত্যেকের চকচকে,জ্বলজ্বলে দৃষ্টি এদিকেই।
মেয়েটি তত্র গুটিয়ে এলো। এত গুলো ছেলের এমন চাউনীতে অস্বস্তিতে গাঁট হলো দেহ । হাত দিয়ে মুছে নিলো ঘাম। ফের হাঁটা দিতেই শাফিন লাফ দিয়ে এসে সামনে দাঁড়ায় হঠাৎ । ছ্যাত করে উঠল মেয়েটির শীর্ণ বুক। পিছিয়ে গেল এক পা। ভীত চোখে চাইল, কালো গাত্রের ছেলেটির দিকে। বেশ ক’দিন ধরে শাফিনের হয়রানির স্বীকার সে।
শাফিন পাখির মত দুদিকে দুহাত মেলে দিলো। নীরবে প্রদান করল বাঁধা। মস্তক ঝুঁকিয়ে শুধাল,
‘ কোথায় যাচ্ছো সুন্দরী, এই অধমকে রেখে?’
মেয়েটির কম্পিত স্বর,
‘ পপপথ ছাড়ুন প্লিজ!’
‘ সে কী! এখনও ঠিকঠাক কিছু ধরলামই না,আর ছাড়তে বোলছো?’
পাশ থেকে হুহা করে হাসির রোল পড়ল ওমনি। মজার কিছু শোনার আহ্লাদে লুটিয়ে পড়ল একেকজন। মেয়েটি মাথা নোয়াল লজ্জায়। শাফিন হাসে,মেকি বিনম্র কণ্ঠে বলে,
‘ ফোন নম্বরটা দাওনা বেবস,শুধু রাতে একা একা লাগলে কল করব,আর কিচ্ছু না।’
দলবল থেকে একজন চিল্লিয়ে বলে,
‘ সাথে বোন থাকলে তারটাও নে৷ আমাদেরও তো একটা অধিকার আছে তাইনা?
স্বশব্দে হাসল সকলে। সমস্বরে জানাল, ‘ হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক।’
মেয়েটি কালো মুখ,আর শঙ্কিত লোঁচনে চারপাশে চাইল। ছোট ছোট চায়ের দোকান,সব্জির ভ্যান, কত লোকজন আশেপাশে। সবাই মিলে একবার প্রতিবাদ করতে পারেনা? আর কতদিন চলবে এদের এই অসভ্যতামি?
কিন্তু না! প্রত্যেকে ব্যস্ত! যেন এদিকে আদৌ ফিরে দেখার মত কিছু ঘটছেনা। হতাশ মেয়েটির সুপ্ত হৃদয়ে দীর্ঘশ্বাস বইল। শাফিনের সাথে তর্কে না যাওয়ার বার্তা চলল স্নায়ুতে। চোখ নামিয়ে, পাশ কাটাতে চাইল চুপচাপ।
বিধিবাম,বাঁধ সাধল শাফিন। পথ আগলাল আবারও।
ভ্রু গুটিয়ে বলল,
‘ এভাবে অবজ্ঞা করে যেওনা সুন্দরী, দিল ম্যায় চোট লাগতাহে।’
মেয়েটি নিরুত্তর ভাবে, এপাশ থেকে হেঁটে যেতে নেয়, শাফিন ওমনি গলায় ঝোলানো ওড়নার এক মাথা টেনে ধরল। চমকে দাঁড়িয়ে গেল মেয়েটি। শাফিন বলল,
‘ এত ভাব দেখাচ্ছো কেন? ফোন নম্বর না দিলে আজ তো যেতে দেব না।’
এতক্ষণের শান্ত রূপী মেয়েটি ওড়নায় হাত পরায় নিমিষেই জ্ব*লে উঠল কেমন। ফিরে চেয়ে, শক্ত গলায় বলল,
‘ ওড়না ছাড়ুন।’
শাফিন শুনল, তবে মানল না। উলটে এক ঝটকায় সম্পূর্ণ ওড়নাখানা লুফে আনল মুঠোয়। মেয়েটি ভরকে ওঠে। স্তব্ধ হয়। শূন্য বুকের দিকে চোখ বুলিয়ে লজ্জায় মিশে যায় ভূপৃষ্ঠে।
পরপর কোটর ভর্তি অগ্নি নিয়ে বলে,
‘ অসভ্য,ইতর, জানোয়ার কোথাকারে! রাস্তাঘাটে মেয়েদের ওড়না ধরে টানতে লজ্জা করেনা? এত ওড়না ধরার শখ যখন বাড়ি গিয়ে নিজের বোনেরটা ধর।’
শাফিনের উজ্জল মুখবিবর নিভে গেল। মাঝরাস্তায় অপমানে থমথমে হয়ে এলো চেহারা। চাইল নিজের দলবলের দিকে। হা করে তাকিয়ে একেকটা। হাসি মুছেছে ওদের। তব্দা খেয়েছে স্পষ্ট।
শাফিন নাক ফুলিয়ে, দাঁত খিচে শুধাল,
‘ কী বললে তুমি?’
মেয়েটির রুষ্ট কণ্ঠ, ‘ যা বলেছি শুনেছিস না? ওড়না দে আমার।’
শাফিনের ভ্রুদ্বয় কপালে ওঠে। তাকে তুই তোকারি?
ফের চাইল বন্ধুদের দিকে। অভিযোগ করল,
‘ দেখলি বিট্টু? তুই থাকতে তোর সামনে এই মেয়ে আমাকে কীসব আজেবাজে গালাগালি দিলো,তুই তোকারি করল,কিছু বলবি না?’
ওপাশ থেকে উত্তর এলো না। জিপের ফ্রন্ট কাচে শুয়ে থাকা ছেলেটা তখনও নির্বিকার। মাথার নীচে আড়াআড়ি হাত,ঠোঁটের ভাঁজে উষ্ণ সিগারেট। নাক মুখ দিয়ে ছুটছে বেশামাল ধোঁয়া।
মিরাজ হাঁটু ধরে নাড়া দিলো। ডাকল,
‘ এই বিট্টু!’
আকাশ থেকে চোখ এনে চাইল তীব্র। ভ্রুর সন্ধিস্থলে ভাসল প্রগাঢ় ভাঁজ। কান থেকে হেডফোনের এক মাথা সরিয়ে মোটা গলায় শুধাল,
‘ কী?’
মিরাজ চোখ দিয়ে ইশারা করল সামনে। ঘাড় ঈষৎ বেঁকে এলো তীব্রর। সংকীর্ণ আদলের একটি মেয়ে,আর শাফিন…!
মস্তিষ্ক দুজনকে দেখে বুঝে ফেলল যা বোঝার। শোয়া থেকে উঠে বসল, ঘাড় বাঁকাল দুদিকে। মটমট করে শব্দ তুলল নাজুক হাড়। লাফ দিয়ে জিপের ওপর থেকে নামল তীব্র। মাথাভর্তি বাদামী চুল কিঞ্চিৎ দোল খেল হাওয়ায়। পো*ড়া ঠোঁট থেকে সিগারেট এনে জুতোয় পিষল তীব্র । সানগ্লাস খুলে পকেটে ভরতেই উন্মুখ হলো দুটো গভীর,ঘোলাটে অক্ষি। রবির তীক্ষ্ণ রশ্নিতে জ্বলে উঠল তা। দেখাল ঠিক হীড়কচূর্ণের পাথরসম।
তীব্রকে উঠতে দেখেই মেয়েটি ঘাবড়ে যায়। আশপাশ চায় একটু সহযোগিতার আশাতে। তীব্র এসে দাঁড়াল। চোখে-মুখে বিরক্তি। সিগারেটের কড়া গন্ধে শ্বাস আটকে এলো মেয়েটির।
তীব্র শাফিনের দিক চাইতেই, সে আপনা-আপনি উদ্বেগ নিয়ে বলল,
‘ এই মেয়ে আমাকে জা*নোয়ার বলেছে। তুই বলে সম্বোধন করেছে। আরো অনেক গালি দিয়েছে দোস্ত। একটা বিহিত কর।’
তীব্রর সরু চোখ গিয়ে মেয়েটির ওপর বর্তায়। চুইংগাম চিবোতে চিবোতে এক ঝলক দেখে নেয় ওর আপাদমস্তক। স্থূল কণ্ঠে শুধায়,
‘ গালি দিয়েছিস?’
মেয়েটি ভ্যাবাচেকা খেল। একটা ছেলে,সরাসরি একটি মেয়েকে তুই বলায় তাজ্জব হলো। চটে আসে মেজাজ। তেঁতে, নির্ভীক চিত্তে,থেমে থেমে বলে,
‘ হ্যাঁ,দি দিয়েছি। ‘
তীব্র ভ্রু উঁচু করল। মেয়েটি স্বদ্যোগে বলল,
‘ উনি কেন আমার ওড়না ধরবেন? ওনার জন্য আমি শান্তিতে কলেজ যেতে পারিনা। আচ্ছা, আপনাদের লজ্জা করেনা এভাবে রাস্তায় বসে মেয়েদের বিরক্ত করেন? শিক্ষা পাননি পরিবার থেকে?’
মেয়েটির কথায় আক্রোশ, অথচ স্বর নরম,কাঁপা। তীব্র ঘোলা চোখ বুজে নিলো। বক্ষগহ্বর ওঠানামা করল অতুষ্ণ শ্বাসে। তার নিরেট চিবুক দেখে ঢোক গিলল মেয়েটি। বসে থাকা ওর সাঙ্গপাঙ্গরা তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে।
একজন অন্যজনের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করল
‘ খেয়েছে রে! বিট্টুর সাথে বেয়াদবি? এই মেয়ের কী হবে?’
এত গুলো ছেলের মধ্যে নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত মেয়েটি। এই গ্যাং এলাকার কুখ্যাত! কে না চেনে!
তীব্রর চোখ তখনও বন্ধ।
চুলে আঙুল চালাতে চালাতেই ঝট করে চাইল। দৃষ্টিতে কী যেন মিশে! মেয়েটি ভীত হয় আশঙ্কায়। ভেতরকার প্রার্থনার মধ্যেই তীব্রর বরফ কণ্ঠ শোনা গেল,
‘ বাড়ি যা।’
প্রত্যাশিত চোখমুখ নিভে গেল শাফিনের। মেয়েটি বিস্ময়াবহ! যেই কথা শোনাল,তাতে তীব্রর এই উত্তর আশা করেনি৷ বিভ্রান্ত স্বরে শুধাল,
‘ জজি?’
তীব্র খ্যাক করে উঠল,’ কান খাটো? যেতে বলেছি।’
ধমকে কেঁপে ওঠে মেয়েটি। চোখ মোছে কোমল হাতে। শাফিনের হাতে তখনও ওড়না ওর। মেয়েটি সেদিক দেখে একবার তীব্রর দিক চাইল। তীব্র হুকুম ছুড়ল,
‘ ওড়না ছাড়।’
বিনাবাক্যে ছেড়ে দিলো শাফিন। তীব্র ওড়না নিয়ে মেয়েটির মুঠোয় ধরিয়ে দেয়। চোখ দিয়ে বোঝায়, যেতে।
মেয়েটির চাউনীতে বিস্ময় তখনও। কথা না বাড়িয়ে নিশ্চুপ হেঁটে গেল। একবার পেছন ফিরে দেখল দীর্ঘদেহী, বখাটে নামক প্রহেলিকা-রূপী তীব্রকে।
শাফিন এগিয়ে এলো কাছে। এক পল বাকীদের দেখে, অভিমানী গলায় বলল,
‘ ওই মেয়ে আমায় গালি দিলো,আর তুই কিছু না বলে ছেড়ে দিলি?’
তীব্রর চাউনী তাক হলো ওর চেহারায়৷ ঠান্ডা দুটো চোখ,কণ্ঠে শীতলতা,
‘ আগেও বলেছি,মেয়েলি ব্যাপারে আমাকে জড়াবিনা। ডিস্টার্ব করছিলি ভালো কথা ওড়না ধরলি কেন? ‘
শাফিন মুখ কালো করে বলল, ‘ উত্তেজিত হয়ে পরেছিলাম। ‘
তীব্র আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয় ওর। কাঁধে এক হাত রেখে, চাপা অথচ কড়া কণ্ঠে বলে, ‘ রাস্তা নাহলে থাপড়ে তোর দাঁত ফেলতাম এখন।’
‘ আমি কী কর…’
তীব্রর বাকিটুকু শোনার আগ্রহ হলোনা। তার নিষ্পৃহতা দেখে শাফিন থেমে গেল মাঝপথে। ও এসে আবার ডিঙিয়ে উঠল জিপের ওপর। আড় ভাঁজে এক পায়ের ওপর অন্য পা তুলল। অঞ্জলিপুটে
জ্বলে উঠল ম্যাচের কাঠি। নিপুণ ভঙিতে ধরাল সিগারেটের মাথা।
নিজের মত আওড়াল,
‘ দুনিয়ার সবথেকে দূর্বল জিনিস হচ্ছে নারী। অল্পতে কাঁদবে,ভয় পাবে। এদের বিরক্ত করে, ভয় দেখিয়ে মজা নেই। তীব্র রেজা তালুকদার হলো টর্নেডো। এই ঝড় সামলানো এদের সাধ্যের বাইরে। তাই তোদের যা ইচ্ছে কর,জাহান্নামে যা। মানা করেছি? কিন্তু এইসব লেইম বিষয়ে আমাকে টানলে খুব খারাপ হবে!’
শাফিন মাথা চুল্কাতে চুল্কাতে, শুকনো মুখে এসে আগের জায়গায় বসল। তীব্রকে বিচারের আশায় ডেকে হতাশ সে, ফেলল ব্যর্থ ব্যর্থ শ্বাস।
****
রাস্তার ওপাড়ের টঙ দোকান হতে দৃষ্টি গুলো ফেরত আসে। এতক্ষণের নাটকের প্রত্যক্ষ,নীরব দর্শক ওনারা। সবাই নিশ্চুপ,নিরুৎসাহিত। কথাবার্তা স্পষ্ট কানে না গেলেও, দৃশ্য দেখেছেন পরিষ্কার।
কিন্তু বেঞ্চে বসা খোরশেদুল হাওলাদার ফোসফোস করে উঠলেন।
উষ্ণ কণ্ঠে বললেন,
‘ কত্ত বড় বেয়াদব! রাস্তার মধ্যে একটা মেয়েকে এইভাবে হেন*স্তা করল? কেউ কিছু বললও না? আমার তো ইচ্ছে করছে ঠাস করে গিয়ে একটা চ*ড় বসিয়ে দিয়ে আসি। ‘
দোকানে বসা লোকজন ফিরে চাইল ওনার দিক। দোকানি সবুজ, কচি পানে, জর্দা ঢালতে ঢালতে শুধালেন,
‘ এলাকায় নতুন? ‘
উনি বললেন,
‘ জি। তিনদিন হলো এলাম।’
মুখোমুখি লোকটা সবেগে বললেন,
‘ এইজন্যেই তো বলি! পুরোনো হলে আর এসব বলতেন না ভাই। ব্যাপার না!কটা দিন থাকুন এ পাড়ায়। সব বুঝে যাবেন।’
খোরশেদুলের গলায় কৌতুহল,
‘ কেন বলুন তো!’
দোকানী জবাব দিলেন,
‘ কেন আর কী? নিজেই বুঝবেন। ওই ছেলেগুলোকে কারো কিছু বলাতো দূর,চোখ তুলে দেখার সাহসও নেই।’
খোরশেদুল প্রকান্ড জিজ্ঞাসু চোখমুখে চাইলেন৷
তিনি নিজেই বললেন,
‘ এই যে সাত আটজন দেখছেন? এরা হলো একটা গ্যাং। বিট্টু মাস্তানের গ্যাং। শুধু এরা নয়,আরো আছে দলে।
দিনের বেশিরভাগ এই রাস্তার এখানে বসে। মেয়েদের বিরক্ত করে। প্রতি মাসে এলাকার সব দোকান থেকে চাঁদা তোলে। দিলে ভালো,না দিলে আন্দাজ করুন। কত দোকানপাট যে ভে*ঙেছে! কতজনকে দেখলাম হাসপাতালে যেতে! তবে আমাকে চাঁদা দিতে হয়না,ওরা আমার দোকানের নিয়মিত কাস্টমার।’
খোরশেদুল আওড়ালেন, ‘ বিট্টু মাস্তান?’
‘ জি। জিপে বসা ছেলেটাই বিট্টু। পালের গোঁদা। এক ডাকে সবাই বিট্টু নামে চেনে। ওর ভ*য়ে এই এলাকা না শুধু, চারপাশের সব এলাকা কাঁ*পে। এসেছেন তো শখে,আস্তে-ধীরে বুঝবেন।’
খোরশেদুল অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বললেন,
‘ কী যে বলছেন আপনারা! আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না। বর্তমানেও এরকম হয়? একটা গ্যাং দিনের বেলায় এসব মা*রপিট করে,গুন্ডামি করে, আর কেউ কিছুই বলেনা?’
অন্যজন জানালেন,
‘ কী বলবে ভাই? কার এত সাহস? যে ধরুন আপনারর মতো ওদেরকে ভালো করে না চিনে কিছু বলতেও যায়,চোখ- মুখ ফাটিয়ে ঘরে ফেরে। প্রানের মায়া তো সবারই আছে বলুন! ‘
তিনি হতবাক হয়ে বললেন,
‘ সাধারণ মানুষ কিছু বলেনা বুঝলাম,কিন্তু দেশে কী আঈন কানুন নেই? আপনারা পুলিশে কমপ্লেইন দিচ্ছেন না কেন?’
উপস্থিত চারজন হেসে উঠলেন। আশ্চর্য হলেন খোরশেদুল৷ এমন গুরুতর কথাটায় হাসির কী হলো? দোকানি শুধালেন,
‘ আপনি জানেন বিট্টু কে?’
খোরশেদুলের চোখে-মুখে আগ্রহ। উনি বললেন,
‘ ও হলো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জামশেদ তালুকদারের ছেলে। ওর নামে পুলিশ কম্পলেইন দেবে কার সাধ্য বলুন তো! আর দিলেও,বিট্টু তো জেলে টিকবেইনা,বরং যে ওকে জেলে ভরার সাহস করবে সে শেষ! ‘
বাকরুদ্ধ খোরশেদুল। বিহ্বল চোখদুটো ঘুরে এলো ওপারের ছেলে সভা হতে। নির্জীব দৃষ্টি পড়ে রইল ফর্সা,স্বাস্থ্যবাণ, অগোছালো শার্ট পরুয়া বিলাই চোখের তীব্রর ওপর।
একজন শুধালেন, ‘ বাড়িতে মেয়ে আছে ভাই?’
বিলম্বে জবাব এলো, ‘ জি।’
‘ সাবধানে থাকতে বলবেন। ওদের খপ্পরে পড়লে কী হয়, এটাত ডেমো দেখলেন। আমরা ভাই পুরাতন, এসব জানি। ‘
খোরশেদুল ঘেমে গেছেন। সুতির পাঞ্জাবি লেপ্টে গিয়েছে পিঠে। গতিতে দুশ্চিন্তায় হাবু*ডুবু খেলেন। ঘরে দু -দুটো সেয়ানা মেয়ে। স্কুল-কলেজে যাতায়াত অহর্নিশ। এরকম পরিস্থিতি হলে কীভাবে কী করবেন? বুঝতে বাকী নেই, এই এলাকায় আসা জীবনের মস্ত বড় ভুল।
দোকানি শুধালেন,
‘ চায়ে কয় চামচ চিনি দেব ভাই?’
সম্বিৎ ফিরল ওনার। ফ্যাসফ্যাসে জবাব দিলেন,
‘ হু? না খাব না। আসি আজ।’
বাজারের ভারি ব্যাগটা হাতে তুলে টিনের ছাউনী থেকে বেরিয়ে এলেন খোরশেদুল। গন্তব্যে হাঁটা ধরলেন টাল-মাটাল কদমে। বাকীরা বলাবলি করল
” গল্প শুনেই ঘাবড়ে গেছে। দেখলে না জানি কঘন্টা অজ্ঞান হয়ে থাকত! ‘
*****
কড়াইয়ে, মুরগীর মাংসের মধ্যে দুধ ঢাললেন সালমা বেগম। রোস্টের ঘ্রাণ তখন ছোটাছুটি করছে বাড়িময়। সেকেন্ডে জলে মিশে দুধ ফুটতে শুরু করে। তুলতুলে চিকেন গুলো ঢেকে যায় আড়ালে।
সেই রান্নার দিকে সুক্ষ্ণ ভাবে চেয়ে আছে এক জোড়া সুশ্রী, মনোযোগী চোখ।
মস্তিষ্কের সবটুকু প্রণিধান খাঁটিয়ে দেখছে সে। সালমা বেগম ঢেকে দিলেন তরকারি। ফিরে চাইলেন এদিক। ভ্রু গুটিয়ে শুধালেন,
‘ গরমের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ঘরে যা।’
রিনঝিনে কণ্ঠের,নম্র আবদার এলো,
‘ বাকীটুকু আমি করব মণি?’
মৃদূ হাসলেন সালমা। তুষ্ট চোখে দেখলেন সম্মুখের মেয়েটিকে। কাঁটা কম্পাস দিয়ে অঙ্কিত নিখুঁত গোলাকার মুখটা যখনই দেখেন,ভেতরটা লুটিয়ে আসে হিমে। পুষ্পিতা! নামের মতোন স্নিগ্ধ হুবহু। টুকটুকে সজীব, গোলাপের ন্যায় ললিত,শুভ্র একখানা আদল।
‘ সকাল থেকে অনেক করেছিস,আর কিছু লাগবেনা। একটু বিশ্রাম নে যা…’
‘ বিশ্রাম লাগবেনা আমার। আমি সালাদ কে*টে দেই?’
সালমা হার মেনে বললেন, ‘ আচ্ছা দে।’
সেকেন্ডে বটি নিয়ে বসে গেল পুষ্পিতা। শসা,লেবু আর গাজর কা*টায় ব্যস্ত হলো পেল্লব হস্তযূগল।
সালমা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন। পুষ্পিতার মনোনিবেশ তখন বটির ধারে। নিপূন হাতের কাজে খুঁত পাওয়া মুশকিল!
ভদ্রমহিলার ঠোঁটে হাসি লেগে রয়। একটা সময় লম্বা,ভারী নিঃশ্বাসে বক্ষপট ওঠানামা করে। পুষ্পিতার প্রতি অলীক মায়া ছড়িয়ে আসে কোটরে। এত সুন্দরী, গুণী মেয়ে,অথচ অনাথ। মা নেই,বাপ থেকেও না। তিনি যথেষ্ট চেষ্টা করেন ওকে আদর করার,আগলে রাখার। কিন্তু মা সমতূল্য হয় কী?
তার চিন্তার মধ্যেই কলিংবেল বাজল। সালমা হাঁক ছুড়লেন,
‘ মিথিলা,দরজাটা খুলে দে তো। তোর বাবা এলেন বোধ হয়।’
অবিলম্বে জবাব এলো,
‘ পারব না আমি!’
চোখ-মুখ কুঁচকে ফেললেন সালমা। বিড়বিড় করলেন,
‘ বেয়াদব।’
পুষ্পিতা কাজ ফেলে উঠে দাঁড়াল,
‘ আমি যাচ্ছি।’
***
ছিটকিনি খুলতেই খোরশেদুলের শুষ্ক মুখের দেখা মিলল। চেহারায় অন্ধকার! পুষ্পিতাকে দেখেই প্রকট হলো তা৷ ভ্রু যূগলে ভাঁজ পড়ল অচিরে। বাজারের ব্যাগ এগিয়ে দিলেন। থমথমে গলায় বললেন,
‘ মাছ আছে,নামিয়ে রাখ।’
পুষ্পিতা ঘাড় কাঁত করল। নম্র গলায় শুধাল,
‘ পানি দেব খালুজান?’
‘ চেয়েছি তোর কাছে?’
কঠোর কণ্ঠে মাথা নামাল পুষ্পিতা। ব্যাগ হাতে চুপচাপ চলে গেল।
খোরশেদুল তিক্ত চোখমুখে এসে কাঠের সোফায় বসলেন। চিন্তিত ভঙিতে মাথা এলিয়ে দিলেন পেছনে। পেশায় একজন সরকারি কর্মচারী তিনি। সদ্য ট্রান্সফার হয়েছেন। পরশুই উঠলেন এ বাড়িতে। এর মধ্যে আবার এলাকা ছাড়বেন কী করে? বাসা-ই বা এত রাতারাতি পাবেন কোথায়?
পানি হাতে এলেন সালমা বেগম। স্বামীর ফ্যাকাশে মুখমন্ডল দেখে ভাঁজ পড়ল কপালে। উদ্বীগ্ন কণ্ঠে শুধালেন,
‘ কী হয়েছে?’
খোরশেদুল চোখ মেললেন। সোজা হয়ে বসলেন। গ্লাস ফাঁকা করে বললেন,
‘ ছেলেমেয়ে কোথায়?’
‘ ঘরেইত।
‘ ডাকো…’
‘ রাহাত? মিথিলা? বাবা ডাকছেন।’
এক ডাকেই চপল পায়ে হাজির হলো রাহাত। ঝাকড়া চুল অবিন্যস্ত ভাবে হেলেদুলে উঠল। কিশোর রাহাত সপ্তম শ্রেনীতে পা রেখেছে কেবল। আত্মীয় স্বজনের কাছে গুলটু নামে পরিচিত সে। একেবারে গাল টিপে,চুমু খাওয়ার মতোন কিউট!
অথচ মিথিলার চেহারায় বিরক্তি। এই হুটহাট ডাকাডাকি তার চূড়ান্ত অপছন্দের। এসে দাঁড়াতেই দুজনকে একবার একবার দেখলেন খোরশেদুল।
বললেন,
‘ বোসো।’
রাহাত মায়ের কোল ঘেঁষে বসলেও,মিথিলা বসল বাবার মুখোমুখি। একটু-আধটু অনুচিন্তন জেঁকে বসল মাথায়। বাবা কী কিছু জেনে ফেলল?
খোরশেদুল স্ত্রীর দিক চেয়ে বললেন,
‘ পুষ্পিতাকে ডাকো।’
ডাক শুনেই ঝড়ের বেগে উপস্থিত হলো সে। বাজার গোছানো ময়লা হাতটা ওড়নায় মুছতে মুছতে বসার ঘরের এক কোণায় দাঁড়াল। সবার উৎসুক চাউনীর মধ্যেই সালমা প্রশ্ন ছু*ড়লেন,
‘ কিছু কী হয়েছে?’
খোরশেদুল দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। উত্তরে মিথিলার দিক চেয়ে বললেন,
‘ তুমি বলেছিলে এই এলাকাটা ভালো। মেইন রোড পাশে,যাতায়াতে সুবিধা। আমিও সবকিছু দেখে পছন্দ করেছিলাম। কিন্তু এলাকা উন্নত হলেও,এখানকার মানুষ গুলো একদমই ভালো নয়। ভালো মতো খোঁজ না নিয়ে,ডিরেক্ট এখানে শিফট হওয়া চরম ভুল হয়ে গেছে।’
মিথিলা উশখুশে ভঙিতে শুধাল, ‘ কেন বাবা? বাসাটাত খুব সুন্দর! ‘
তিনি বললেন,
‘ বাসার কথা বলছি না। পাড়ার কথা বললাম। এই পাড়ায় কিছু অভদ্র ছেলেপেলের আনাগোনা আছে। বলা যায় একটা পাওয়ার ফুল গ্যাং। মাস্তানি করে বেড়ায় সারাদিন। খোলামেলা গুন্ডা*মি চলে। বিট্টু মাস্তান নামে এক ছেলে সেই গুন্ডা দলের লিডার। মন্ত্রীর ছেলে বলে সবাই ভ*য় পায়। মারপিট,চাঁদাবাজি,আর আজ তো আমার সামনেই এক মেয়েকে….’
থামলেন তিনি।
চেহারার অস্বস্তির প্রবল ছাপ। ছোট ছোট ছেলেমেয়ের সামনে ওসব বলার রুচি হলো না। সালমা আঁতকে বললেন,
‘ কী সাংঘাতিক! এরকম হলে এই এলাকায় থাকব কী করে?’
খোরশেদুল বললেন,
‘ তোমরা সাবধানে চলাফেরা করবে। নেকাব ছাড়া বাইরে কেউ যাবেনা। মিথিলা তোমাকে বলছি,আগে যেমন, যখন তখন বেরিয়েছ তাতো একবারেই করবেনা। ওদের হাত অনেক লম্বা। একবার চোখে পড়লে আমাদের মত সাধারণ মানুষের করার কিছু থাকবেনা। বুঝতে পেরেছ?’
মিথিলা নিম্নাষ্ঠ চেপে চুপ করে রইল। এই গ্যাং সম্পর্কে ওর থেকে ভালো কে জানে!
খোরশেদুল ঠান্ডা চোখে, জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ানো পুষ্পিতার দিক চাইলেন।
‘ কথাটা তোকেও বলেছি। খুব দরকার ছাড়া তুই বারান্দায়ও পা রাখবি না।’
পুষ্পিতা একটু নড়েচড়ে ওঠে। অবিলম্বে, বরাবরের ন্যায় ঘাড় কাঁত করে।
মুহুর্তে মেজাজ বিগড়াল মিথিলার। বাবার এমন হুশিয়ারির যথার্থ অর্থ সে জানে,বোঝে। পুষ্পিতা দেখতে সুন্দরী কী না! ওপর থেকে নিশ্চুপ রইলেও,ভেতর ভেতর ফুঁসে উঠল সেই সৌন্দর্যের প্রতি।
সালমা বললেন,
‘ ওতো বেরই হয়না। আর এখনতো পরীক্ষাও শেষ। অনার্সে ভর্তির আগে ওর আর বাইরে কাজ নেই।’
‘ শুধু বাইরেই নয়,রাস্তা দিয়ে পরিষ্কার সামনের বারান্দাটা দেখা যায়। তাই ওখানেও ওকে পাঠাবেনা।’
মিথিলার বিরক্ত লাগছে সবকিছু। অধৈর্য কণ্ঠে বলল,
‘ এখন রুমে যাই আব্বু?’
‘ যাও।’
পুষ্পিতাকে একবার তপ্ত আঁখিতে দেখে রুমে ঢুকল ও। এদিকে মেয়েটার মুখ আতঙ্কে ছোট হয়ে আছে। মাথায় ঘুরছে ‘বিট্টু মাস্তান’ নাম।
কাছাকাছি একটা শিশুপার্ক আছে শুনেছিল। রাহাতকে নিয়ে ইচ্ছেও ছিল যাওয়ার। কিন্তু এরকম হলে ওতো বাইরে পা-ও রাখতে পারবেনা। এমনিতেই যা ভীতু সে!
মিথিলা কক্ষে এসে কটমট করল। ফোন তুলল হাতে। ব্যস্তভাবে ডায়াল হলো নাহিদ লেখা নম্বরে। ওপাশের ব্যক্তিটা ফোন হাতেই রেখেছিল। সেকেন্ডে রিসিভ হলো কল। অনুযোগ জানাল,
‘ ফোন ধরছিলেনা কেন? আর এখন সময় হলো তোমার ফোন করার? ‘
মিথিলা চাপা কণ্ঠে ধমক ছুড়*ল,
‘ চুপ! ফোন যে করেছি এটাই বেশি। কী করেছ তুমি?’
নাহিদ বুঝতে না পেরে বলল,
‘ কী করলাম?’
‘ এলাকায় এসেছি মাত্র দুটোদিন। এর মধ্যেই বাবার কানে তোমার বন্ধুর কথা চলে গিয়েছে। দলবল মিলে নাকী একটা মেয়ের সাথে কী করেছ?’
নাহিদ উদ্বেগ নিয়ে বলল,
‘ কখন? না না আমি কিছু করিনি। আমি এলামই একটু আগে। যা করার ওরা করেছে। কিন্তু আঙ্কেল দেখলেন কখন?’
‘ ওসব আমি জানিনা। বাবা যদি জানতে পারে তুমি ওই গুন্ডা বিট্টুর বন্ধু,জীবনেও তোমার সাথে আমাকে বিয়ে দেবেনা।’
‘ মানে টা কী? বন্ধুর সাথে বিয়ের কী সম্পর্ক? ‘
‘ সম্পর্ক আছে,অবশ্যই আছে। যে ছেলে একটা গুন্ডার লেজ ধরে ঘোরে,আমিও বা তাকে বিয়ে করতে যাব কোন দুঃখে?’
নাহিদের স্বর পুরু হলো,
‘ কী বলতে চাও?’
মারিয়া কাট কাট জবাব দিল,
‘ বলতে চাই, পরবর্তীতে ঝামেলা হওয়ার আগেই আমাদের একটা সিদ্ধান্তে আসা প্রয়োজন। ‘
সে একটু দম ফেলে, ঠোঁট ভেজাল জ্বিভে। বলল,
‘ দ্যাখো,কথাটা তোমাকে বলা হয়নি। ভাবছিলাম বলব,আজ সন্ধ্যায় পাত্রপক্ষ আমাকে দেখতে আসছে।’
নাহিদ আর্তনাদ করে ওঠে,
‘ কী?’
‘ আস্তে! এত অবাক হওয়ার কী আছে? মেয়ে বড় হলে এমন পাত্রপক্ষ অনেক আসে।’
‘ ও, এইজন্যেই দুদিন ধরে আমার ফোন ধরছিলে না ঠিক করে? ব্যস্ততার অজুহাত দিচ্ছিলে মিথিলা?’
‘ তুমি যা ভাবো তাই। আমারও একটা লাইফ আছে। তুমি এখনও বেকার, তোমার সাথে আমার ভবিষ্যত কী?’
‘ বেকার হলেও তোমার কোন ইচ্ছে আমি অপূর্ণ রেখেছি? যখন যেটা আবদার করেছ দিইনি? আর তুমি ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছো? কেন,আমার ভালোবাসা কিছু না?’
‘ ভালোবাসা দিয়ে কী পানি খাব? বয়ফ্রেন্ড হিসেবে দুটো গিফট দিয়ে,ছোট লোকের মত আবার কথা শোনাচ্ছো? এতসব জানিনা নাহিদ! ছেলে দেখতে আসবে। পছন্দ হলে আমি রাজী হয়ে যাব। তুমি ভাই ছ্যাচড়ার মত আমার পেছনে পরে থেকোনা।’
‘ মিথি…
বলতে না দিয়েই, খট করে লাইন কাটল মিথিলা। ঠোঁট ফুলিয়ে ফোস করে শ্বাস ঝাড়ল। সাথে ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলল নাহিদ নামের উটকো এক আপদ।
*****
রৌদ্রজ্জল দিন,গড়িয়েছে সন্ধ্যায়। শহরজুড়ে আযানের মধুর সুর। অন্ধকার আস্তেধীরে হাত-পা মেলছে।
তিঁমিরে ঘেরা প্রকৃতির মধ্যেই, মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল একটি ভবন। প্রদীপ্ত,কান্তিমান সোনালী দেয়ালের কারুকাজ চোখ ধাঁধানোর মতন।
শা শা বেগে পরপর তিনটে গাড়ি এসে ভিড়ল সেথায়। দাঁড়িয়ে থাকা দুজন রক্ষী শশব্যস্ত ভাবে দুদিকে টেনে খুললেন, বিশাল দানবীয় গেটখানা।
প্রথমে পুলিশ ভ্যান,পেছনে কালো গাড়ির মাঝে ধবধবে সাদা গাড়ি অন্দরে ঢুকল।
ভেতরে বসা জামশেদ তালুকদার তুলে রাখা কাঁচ গলে একবার বাইরে তাকালেন। রোগা- পাতলা দুজন লোককে দেখে ভ্রু গোছালেন। তাদের কাতর নজর এদিকে। কিছু বলতে চাওয়ার প্রবণতা চেহারায়। এগিয়ে আসতে চাইছেন, দারোয়ান সরিয়ে দিচ্ছেন বারবার।
দেখতে দেখতে গাড়ি বাড়ির প্রাঙ্গনে থামল। নামলেন জামশেদ। পড়নে শুভ্র-সাদা পাঞ্জাবি। দাড়ি ভর্তি গাল,চোখে চিকণ চশমার ফ্রেম। আননে ছড়ানো অন্যরকম নূরের প্রভা।
তার চোখদুটো তখনও গেটের ওপারে। সহকারী আবুল হাসান পাশে এসে দাঁড়ালে,তর্জন দিলেন,
‘ ওসমানকে ডাকো।’
এক ডাকে ছুটে এলেন ওসমান। হাত উঁচিয়ে সালাম ঠুকলেন বিনয়ে।
‘ ওরা কারা? কী চায়?’
‘ ওনারা সাহায্য চাইছেন স্যার।’
ভ্রু বাঁকালেন জামশেদ ,
‘কীসের?’
ওসমান মস্তক নীচু করে বললেন,
‘ ওদের মধ্যে একজনের দোকান ছোট স্যার ভে*ঙে দিয়েছেন। আর অন্যজন ওনার জিপ রাখার জায়গায় আইস্ক্রিমের ভ্যান রেখেছিলেন বলে সেটাতেও আগুন লাগিয়ে দিয়েছেন।’
জামশেদের শৈলপ্রান্ত সবেগে মসৃন হয়। ছেলের কান্ডে মেজাজ চটে আসে।
তার মত দাপুটে মন্ত্রীর ছেলে রাস্তায় গুন্ডামি করে বেড়ায়! আবার লোকজন বিচার আনে বাড়িতে। ছি!
আবুল হাসান রে*গে বললেন,
‘ এত বড় সাহস? ছোট স্যারের নামে অভিযোগ দিতে আসে?’
তেড়ে যেতে নিলেই জামশেদ হাত উঁচু করলেন। রাগ-ঢাক ভেতরে চেপে,শান্ত গলায় বললেন’
‘ ওদের দুজনকে দশ হাজার করে টাকা দিয়ে দাও।’
ভ্রুযূগল তালুতে উঠল দুজনের। আবুল হাসান প্রসন্ন কণ্ঠে বললেন,
‘ স্যারের দয়ার শরীর!’
জামশেদ, তোষামোদে তোয়াক্কা দেখালেন না। প্রতাপী কদমে ঢুকে গেলেন বাড়িতে।
আবুল হাসান বগলের কালো ব্যাগ আরেকটু এঁটে নিলেন সাথে। এগোলেন গেটের দিক। ওনাকে দেখে লোক দুটো আরেকটু প্রত্যাশিত চোখে-মুখে চাইল।
কোনও একটা সাহায্য নিশ্চয়ই পাবেন, সেই আশায়। অথচ আবুল হাসান এসেই ধমকে বললেন,
‘ নালিশ দিতে এসেছিস? তাও আবার মন্ত্রীর বাড়িতে?’
তন্মধ্যে একজন উৎকণ্ঠিত হয়ে বললেন,
‘ না না স্যার। আমরা গরিব মানুষ। আমরা কেন নালিস দেব? স্যার অনেক দয়ালু, তাই শুধু সাহায্য চাইতে এসেছিলাম।’
আবুল বিরক্ত গলায় বললেন,
‘ ঠিক আছে, ঠিক আছে… এই নে ধর….’
পকেট থেকে এক হাজার টাকার কড়কড়ে নোট নিয়ে এগিয়ে দিলেন তিনি।
‘ দুজন ভাগ করে নিস।’
পেছনে দাঁড়ানো ওসমান তাজ্জব হয়ে চাইলেন। তিনি স্পষ্ট শুনেছেন দশ হাজার করে দেওয়ার কথা।
আর এই লোক কী না পাঁচশ টাকা দিচ্ছে? বাকীটা নিজের পকেটে ভরবে নিশ্চয়ই? দাঁত খিঁচে, মাথা নাড়লেন তিনি। দিন দুপুরে কী জোচ্চুরি!
টাকার অঙ্ক দেখে লোক দুটোর জীর্ণ চেহারা শুষ্ক হলো আরো।বিরস চোখে একে অপরকে দেখলেন। নিরুপায় হয়ে টাকা নিলেন হাতে। আবুল হাসান কড়া গলায় বললেন,
‘ এরপর বাড়ির ত্রীসীমানায়ও যেন না দেখি! মনে থাকবে? দেখলে কিন্তু একদম জেলে ভরে দেব। ‘
অসহায় লোক দুটো হুম*কি শুনে আত*ঙ্কিত হলো। মাথা নামিয়ে প্রস্থান নিলো বিশ্রান্ত কদমে।
আবুল হাসান চশমা ঠেলে বিজয়ী হাসলেন। পিছন ফিরে চাইতেই মুখোমুখি হলেন ওসমানের উষ্ণ দৃষ্টির। তবে, রা করার সাধ্য ওনার নেই। ক্রোধ মনে চেপেই নজর ফেরালেন তিনি। আবুল হাসানের যাওয়ার দিক চেয়ে বিড়বিড় করে বললেন,
‘ মাদা***!….
******
সালমা বেগম পুরোদমে ব্যস্ত। অতিথিরা কাছাকাছি চলে এসেছেন। রাতে খাওয়া -দাওয়ার আয়োজন হবে এখানেই। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার! মেয়ে পছন্দ হলে আজই কথা পাকাপোক্ত হবে। তিনি একবার চাইলেন টেবিলে ব্যস্ত পুষ্পিতার দিকে৷ ফল সাজাচ্ছে ও। সালমা ডাকলেন। পুষ্পিতা এগিয়ে এল,
‘ হ্যাঁ মণি?’
‘ তোর কাজ শেষ? ‘
‘ আরেকটু বাকী।’
‘ আচ্ছা, ওগুলো ওমন থাকুক। তুই গিয়ে একটু মিথিলাকে তৈরী হতে সাহায্য কর। আর নিজেও একটা ভালো জামা পর গিয়ে । সুন্দর করে চুল বাধ যা।’
‘ আমিতো ঠিকই আছি।’
চোখ পাঁকালেন সালমা।
‘ যা বলেছি চুপচাপ কর।’
পুষ্পিতা ‘আচ্ছা’ বলে ঘুরতেই স্তম্ভের ন্যায় সম্মুখে পড়লেন খোরশেদুল। চোখ-মুখ কুঁচকে, খ্যাক করে বললেন,
‘ সংয়ের মত দাঁড়িয়ে আছিস কেন? সর।’
পুষ্পিতা ভ*য় পেলো। চুপসে, সরে গেল পাশে।
খোরশেদুল রান্নাঘরে ঢুকলেন। সালমা শুধালেন,
‘ ধমকালে কেন? কী করেছে ও?’
‘ মন চেয়েছে। আচ্ছা,তোমার কি বুদ্ধি সুদ্ধি হাঁটুতে নেমেছে?’
সালমা বুঝতে না পেরে বললেন,
‘ আমি আবার কী করলাম?’
‘ কী করলে?’
পরপর দাঁত চেপে, চাপা গলায় বললেন,
‘ তুমি পুষ্পিতাকে তৈরী হতে বললে কেন? ওকেও কি পাত্রপক্ষের সামনে নিয়ে যাবে?’
‘ হ্যাঁ.. ওতো মিথিলার বো…’
খোরশেদুল পথিমধ্যেই চেতে বললেন
‘ ও মিথিলার বোন নয়। খালাতো বোন আর আপন বোনে অনেক তফাত। তোমার বোনঝি যখন পাত্রের সামনে যাবে,আমার মেয়েকে রেখে যদি ওকে পছন্দ করে ফেলে?’
সালমা হা করে বললেন,
‘ এসব কী বোলছো? ও তো এখনও ছোট!’
‘ ছোট হলেও বিয়ের বয়স হয়নি?’
সালমা বেগম ক্ষেপে গেলেন। তেজী হাতে খুন্তি নাড়তে নাড়তে বললেন,
‘ পছন্দ করলে করবে। তুমিতো এমনিতেই ওকে পড়াতে চাওনা। খাওয়ার খোঁটা দাও। এই সু্যোগে বিয়ে দিয়ে বিদেয় করব। সমস্যা কী? বেচে যাবে। বোঝা নামবে তোমার।’
খোরশেদুলের মোটা নাক ফেঁপে উঠল।
‘ খোঁটা দিলেও খাওয়াই তো। এতটা বছর ধরে অন্যের মেয়েকে পালিনি? এমন তো নয় যে ওর বাপ নেই। কোথায় সে? নিয়ে যাচ্ছেনা কেন মেয়েকে? আর শোনো,এই সমন্ধ অনেক কাঠ-খড় পু*ড়িয়ে আমি পেয়েছি। ওই মেয়ের জন্য যদি হাতছাড়া হয়!
আর অত বড় ঘরে তোমার ওই এতিম,অনাথ বোনের মেয়েকে কে নেবে? এরা যখন ভুড়ি ভুড়ি দাবি নিয়ে বসবে সেগুলো পূরন কে করবে? তুমি? ওর রুপ আছে। চাঁদ ধরার যোগ্যতা নেই। ‘
সালমা বেগম অতিষ্ঠ গলায় বললেন,
‘ তাহলে তুমি চাওটা কী?’
‘ কী চাই মানে? বোঝোনা তুমি? পুষ্পিতা যেন পাত্রপক্ষের ছায়াও না মারায়! আমার মেয়ের এই সমন্ধ যদি ভা*ঙেই সালমা,তোমাদের দুজনেরই খবর আছে,মনে রেখ।’
হম্বিতম্বি করে খোরশেদুল রান্নাঘর ছাড়লেন। সালমা আহত চোখে চেয়ে রইলেন কিয়ৎক্ষণ। কোটর ভরল সহসা।
মৃত বোনের শুষ্ক মুখটা ভেসে উঠল স্পটে। হঠাৎ কিছু একটা ভেবেই দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এলেন বাইরে। একবার উঁকি দিলেন মেয়ের ঘরে। পুষ্পিতাকে না দেখে শুধালেন,
‘ পুষ্পিতা কই?’
আয়নার সামনে দাঁড়ানো মিথিলা নিষ্প্রভ। কাঁধ উচু করে বলল,
‘ আমি কী জানি?’
রাহাত বলল,
‘ আপু ওয়াশরুমে মনে হয়। ‘
সালমা বেগম স্বস্তির শ্বাস ফেললেন। যাক! মেয়েটা কিছু শোনেনি তাহলে। এমনিতেই ওইটুকু মানুষের কপালে দূর্ভোগের অন্ত নেই। এসব শুনলে কষ্ট পাবে আরো।
*****
❝ তালুকদার ভবন❞, দোতলা,ডুপ্লেক্সের বিশাল আলিশান বাড়ি।
বাইরে থেকেও ভেতরটা অধিক বৃহত্তর আর চওড়া। চারপাশের সব কিছুতে ঝকঝকে, আভিজাত্যের ছোঁয়া। হলদে, কড়া আলোয় চতুর্মুখী দেয়াল মহিমান্বিত। ডিজাইনার আসবাবপত্র,গ্র্যান্ড প্রত্নবস্তু, প্রতিটি কোণ, ঐশ্বর্যের নিপুণ দৃশ্যে বন্দী । ঠিক যেন বিলাসিতার অনন্য এক মূর্তি!
জামশেদ তালুকদার সোফায় বসে। পড়নে এখনও বাইরের কাপড়। সেন্টার টেবিলের ধোঁয়া ওঠা কফিটা,নিরলস পড়ে আছে। উষ্ণতা কমে,রূপ নিয়েছে শরবতে।
হাতের আঙুল ঘষতে ঘষতে দেয়াল ঘড়ির দিক চাইলেন তিনি। পরপর চোখ বোলালেন সদর দরজায়।
তার থম ধরা, পাথরের মত মুখটা নিয়েই, ভ*য়ে সিটিয়ে আছেন লুৎফা বেগম।
স্বামীর ক্রো*ধান্বিত চোখমুখ দেখে ক্রমশ বিভ্রান্ত হচ্ছেন। কিছু জিজ্ঞেস করার স্পর্ধা অবধি হচ্ছে না। নির্ঘাত ছেলেটা আবার কিছু করেছে!
তার উতলা নয়ন এলোমেলো পায়চারি করছে। একবার স্বামীকে দেখছে, একবার দরজা।
ঘড়িতে ১২:০০টা বাজার সংকেত ঢং ঢং করে উঠল। ক্ষণ বাদেই বাইরে থেকে ভেসে এলো, জিপের শব্দ। জামশেদ নড়েচড়ে উঠলেন। পূত্রের আগমনী বার্তায় মুহুর্তে দৃঢ় হলো চিবুক।
দোরগোড়ায় তীব্রর পদচারণ পড়ে। অস্বাভাবিক কদম৷ ঝুলছে -দুলছে। শাফিন পৌঁছে দিয়েছে বাড়ি অবধি। কিন্তু ভেতরে আসার সাহসে কূলোয়নি।
ওসমান সহ আরো একজন ধরে ধরে নিয়ে আসছে ওকে।
মাতাল ছেলেকে দেখেই লুৎফা মিইয়ে এলেন। শঙ্কিত নয়ন ঘুরে এলো স্বামী হতে। উঠে দাঁড়ালেন জামশেদ। মটমটে চোয়াল,ক্ষুব্ধ লোঁচন সমেত গিয়ে দাঁড়ালেন তীব্রর মুখোমুখি।
‘ তুমি আজ আবার মদ খেয়েছ? ‘
তীব্রর, নীচু, ঢুলুঢুলু চক্ষুদ্বয় তাক হলো বাবার ওপর। অক্ষির শ্বেত বর্ণ টকটকে লাল নেশায়। সদর্পে জানাল,
‘ রোজই-তো খাই।’
জামশেদ ফুঁসে উঠলেন,
‘ তোমাকে আমি নিষেধ করেছিলাম তীব্র।’
মত্ততায় বুঁদ তীব্র হাসল। তুচ্ছ কণ্ঠে আওড়াল,
‘ তীব্র রেজা তালুকদার,কারো নিষেধ মানে….’
এটুকুতেই জামশেদ বুঝে ফেললেন ছেলের বাকী কথা। কর্মচারীদের সামনে সম্মানের আহুতি বাঁচাতে থামিয়ে দিলেন ওকে। বললেন,
‘ ওকে রেখে যাও।’
মাথা নাড়লেন ওনারা। সাবধানে ওকে সোফায় বসিয়ে প্রস্থান নিলেন। মদ্যক তীব্রর মাথাটা হেলে পড়ল একদিকে। চোখ বন্ধ রেখে বলল,
‘ এই, একটা হুইশকি… ‘
জামশেদ রুষ্ট চোখে চাইলেন। কটমটিয়ে স্ত্রীকে দেখলেন পরপর। লুৎফা ছোট কণ্ঠে বললেন,
‘ আমি,আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি।’
কাজের মেয়েটিকে সাথে নিয়ে, তীব্রকে ওঠালেন লুৎফা। রওনা করলেন কামড়ায়।
জামশেদ বিক্ষুব্ধ চোখে সবটা দেখলেন। রাগে গায়ের সমস্ত র*ক্ত ফুটছে তার। কফির কাপটা সামনে পেয়ে ওটাকেই আ*ছাড় মারলেন তুলে।
নরম বিছানার স্পর্শ পেতেই উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল তীব্র। তন্দ্রাচ্ছন্ন ফরসা মুখবিবর বালিশে গুঁজল।
কাজের মেয়েটি বেরিয়ে যায়।
লুৎফা এগিয়ে এলেন। অসহায় চোখে চেয়ে রইলেন ওর মুখের দিক। চোখের কোণে টলটলে অশ্রু এসে ভিড়েছে। গায়ে কাঁথা টেনে পাশে বসলেন। তীব্রর সোনালী, খাড়া চুলে বোলালেন কোমল হাত।
ভেজা গলায় বললেন,
‘ কবে মানুষ হবি রে বাপ? কবে ভালো হবি? কবে একটু শান্তি দিবি আমায়!’
#সে_আমার_সন্ধ্যাপ্রদীপ!
#কলমে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
#সূচনা পর্ব।
চলবে…..
অপেক্ষা করুন আগামী পর্বের জন্য, আর পেজে লাইক ফলো দিয়ে কমেন্ট করে রাখেন বাকি পর্ব পোস্ট করেই কমেন্ট বক্সে দিয়ে দেবো লিংক।