#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ২৪(প্রথম অংশ)
#আদওয়া_ইবশার
মোড়ের দোকানে বসে চায়ের কাপে ঠোঁট ছুঁয়ে অলস সময় পাড় করছে রক্তিম। নিত্যদিন যে দোকানে বসে চায়ের আড্ডায় সময় চলে যেতো চোখের পলকে। আজ যেন সেখানেও মন টিকছেনা। একেতো পাশে মেহেদী নেই। দ্বিতীয়ত কতক্ষণ পরপর বোনটা ফোন করে কেঁদে কেটে অস্থির হয়ে আবদার জানাচ্ছে ও বাড়ি যেতে।সব মিলিয়ে চারিদিকটা কেমন গুমোট মনে হচ্ছে।চারিদিক তখন ঘন কুয়াশার আস্তরণ সন্ধ্যার পূর্বেই আধার নামিয়ে দিয়েছে। চা শেষ করে সবে সিগারেট হাতে নিয়েছিল রক্তিম। এর মাঝেই পকেটে থাকা যান্ত্রিক বস্তুটা তারস্বরে বেজে ওঠে। সিগারেটটা ঠোঁটের ভাজে নিয়ে ধীরস্থির ভাবে আগুন ধরানোর কাজটুকু শেষ করে ফোন হাতে নেয়। স্ক্রিনে বোনের নাম্বার দেখে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে। ক্ষণকাল কিছু একটা ভেবে রিসিভ করে কানে ঠেকায়। কন্ঠস্বর স্বাভাবিক করে বলে,
“ইতু! কেন এমন পাগলামি করছিস? আমি বললাম তো ভাইয়া তোর বিয়েতে না থাকলেও দূর থেকেই সমস্ত দায়িত্ব পালন করে যাব। আমার বোনের সুখের জন্য যা যা করতে হয় সব করব।”
রেহানা বেগম ছেলের কথার পৃষ্ঠে তৎক্ষণাৎ কিছু বলতে পারেনা। কতক্ষণ চুপ থেকে আমতা আমতা করে বলে,
“আমি ! আমি ফোন দিয়েছি। ইতু না।”
মায়ের কন্ঠ শুনে সাথে সাথে জমে যায় রক্তিম। বরফ শীতল চোখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে। মুখ দিয়ে কোনো বাক্য উচ্চারণ হয়না। রক্তিমের অবাকের মাত্রা আরও একটু বাড়িয়ে দিতে রেহানা বেগম পূণরায় বলে,
“বোনের বিয়েতে ভাই উপস্থিত থাকবেনা এ কেমন কথা? মেয়েটা আমার সেই কাল থেকে কেঁদে যাচ্ছে।”
এটুকু বলতেই আবারও রেহানা বেগমকে জড়তা এসে আকরে ধরে। কতক্ষণ দ্বিধান্বিত হয়ে চুপ থাকে। পরপর আবারও ইতির উৎসুক মুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে দ্বিধা-জরতা সমস্ত কিছু দূরে ফেলে বলে,
“সন্ধ্যার আগে বউমাকে নিয়ে এই বাড়িতে উপস্থিত হবে তুমি। আমার মেয়ের চোখ দিয়ে যেন আর এক ফোটা অশ্রুও না ঝরে। তোমরা না আসা পযর্ন্ত কোনো অনুষ্ঠান হবেনা।”
ব্যাস! দীর্ঘদিন পর মায়ের সাথে স্বাভাবিক আলাপচারিতা এটুকুই।সেটাও একপাক্ষিক। এই অল্প সময় আর মায়ের ঐ কথা গুলোই রক্তিম শিকদারকে অস্থিরতার অতলে ডুবিয়ে দিয়েছে। সর্বক্ষণ রুক্ষ হয়ে থাকা চোখ দুটো আচমকা জ্বালা ধরে ভিজে ওঠতে চাইছে। বুকের ভিতরটা অস্বাভাবিক মাত্রায় কাঁপছে। দুটো বছর যাবৎ যে মা বারবার তাকে ঐ বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে, আজ সেই মা নিজেই তাকে বাড়িতে যেতে বলছে। যে মায়ের মুখ থেকে কখনো খু নি ছাড়া অন্য কোনো সম্বোধন রক্তিমের জন্য উচ্চারিত হয়নি সেই মা আজ এতো শান্ত ভাবে তুমি বলে সম্বোধন করেছে। বাবার স্বাভাবিক একটা কথাতেও রক্তিম সবসময় ত্যাড়া জবাব দিলেও কখনো পারেনি মায়ের কোনো কথার বা মারের প্রতিবাদ করতে। চুপচাপ সকল অভিযোগ মাথা পেতে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নিয়েছে। বিবর্ণ সেই অতীত রক্তিমকে যতটা না ক্ষতবীক্ষত করেছে, তার থেকেও বেশি হৃদয়ে আঘাত করেছে মায়ের এক একটা ধারালো কথা। পাষাণ হৃদয়টা মুখ ফোটে কারো কাছে না স্বীকার করলেও নিরবে প্রতিনিয়ত সৃষ্টিকর্তার কাছে আর্জি জানিয়েছে, মা যেন তাকে একটাবার বুকে টেনে নেয়। একটাবার যেন ঐ মমতাময়ী তার স্নেহের পরশ বুলিয়ে দেয় রক্তিমের মাথায়। তার কাছে বারবার মনে হতো মায়ের একটু পরশেই তার মনের ভিতর জ্বলতে থাকা আগুনটা নিভে যাবে। একটাবার যদি সে মায়ের কোলে মাথা রেখে চিৎকার করে কাঁদতে পারতো তবে হয়তো বুকের ভিতর জমে থাকা কষ্টটা লাঘব হতো। মা নামক জাদুর মানবীর স্পর্শে পাষাণ হৃদয়টা হয়তো নরম হতো। সৃষ্টিকর্তা বুঝি আজ অবশেষে তার দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছে! আজ কি তবে শিকদার মঞ্জিলে পা রাখলে মা তার জাদুর পরশে রক্তিমের যন্ত্রণা গুলো ঘুচিয়ে দিবে! চোখের জ্বলন, বুকের ভিতরের যন্ত্রণা পুরো শরীরেও ছটফটানি সৃষ্টি করে দিয়েছে। দেহটা চলছেনা। কিন্তু মনটা এক মুহূর্তও দেরি করতে চাচ্ছেনা। পাষাণ হৃদয়টা মায়ের একটু নরম আচরণেই কেমন বাচ্চা হৃদয়ে পরিণত হয়েছে।
হঠাৎ রক্তিমের এমন অস্থিরতায় রাকিব, জাবির, শান্ত তিনজনই অভাব। চিন্তিত হয়ে শান্ত জানতে চায়,
“ভাই কি হলো আপনার! শরীর খারাপ লাগছে?”
কোনো জবাব দেয়না রক্তিম। তবে ইচ্ছে হচ্ছে বাচ্চাদের মতো চিৎকার করে সবাইকে জানিয়ে দিতে, “শুনো তোমরা। আমার মা আজকে আমাকে ডেকেছে। এই পাষাণ, খু নি, গুন্ডা রক্তিমকে বোধহয় মা এবার কাছে টেনে নিবে। তার মমতার পরশে আমার হৃদয়ের যন্ত্রণা নিঃশেষ করে দিব।” কিন্তু পারেনা রক্তিম। অনাকাঙ্ক্ষিত খুশি, আনন্দ বোবা বানিয়ে দেয় নিষ্ঠুর রক্তিমকে। অসাঢ় করে দেয় পুরো দেহ। অদ্ভূতভাবে ভেঙ্গে পরে ইস্পাত কঠিন রক্তিম। মুখে শুধু বলে,
“আমাকে একটু তাড়াতাড়ি শিকদার মঞ্জিলে দিয়ে আসবি?”
যে রক্তিম শিকদার সর্বদা নিজের ছেলেদের উপর হুকুম চালিয়েছে। আজ সেই রক্তিম শিকদার কেমন অনুরোধের স্বরে আকুতি জানাচ্ছে তাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে। হঠাৎ রক্তিমের এমন আচরণ হজম হয়না কারো। অদ্ভূত চোখ করে তাকায় সকলেই রক্তিমের দিকে। মনের মাঝে হাজারটা প্রশ্ন থাকলেও মুখে কোনোটাই উচ্চারিত হয়না কারো। নিজেদের মতোই নিজেরা ভেবে নেয়, একটু আগের ফোনকলে হয়তো শিকদার বাড়িতে যাবার মতো কোনো জরুরী বার্তা পেয়েছে। বিয়ে বাড়িতে আবার কোন অঘটন না ঘটে গেছে! যে অঘটনের জন্য বোনের বিয়েতে থাকার জন্য ঘোর আপত্তি জানানো রক্তিম এখন এভাবে তার ছেলেদের আকুতি জানাচ্ছে তাকে ঐ বাড়ি দিয়ে আসতে। জাবির লক্ষ্য করে রক্তিমের শরীরটাও কেমন ভঙ্গুর দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে নিস্তেজ হয়ে এখনই লুটিয়ে পরবে মাটিতে। আর এক মুহূর্ত দেরি করেনা জাবির। শান্তকে ইশারায় কিছু একটা বুঝিয়ে রক্তিমের বাইকে ওঠে বসে। বলে,
“আপনার শরীর খারাপ মনে হচ্ছে ভাই। এমন অবস্থায় বাইক চালাতে পারবেন না। পিছনে বসুন আমি দিয়ে আসছি।”
অস্থির রক্তিম কন্ঠে দ্বিগুণ অস্থিরতা ঢেলে বলে ওঠে,
“আমি একা গেলে হবেনা। তোরা একটা কাজ কর। দ্রুত একটা সিএনজি নিয়ে আমার বাড়ি থেকে ঐ মেয়েটাকে নিয়ে আয়। ততক্ষণ আমি এখানে থাকি।”
“কোন মেয়ে ভাই?”
যদিও দলের সকলেই এতোদিনে জেনে গেছে রক্তিমের বিয়ের খবর। রক্তিমের কথায় এটাও আন্দাজ করে নিয়েছে সে তার স্ত্রীকেই নিয়ে আসতে বলছে। কিন্তু তবুও রাকিবের কৌতূহলী মন ফট করেই প্রশ্নটা করে ফেলে। একেতো অপেক্ষা আর সহ্য হচ্ছেনা রক্তিমের। ইচ্ছে হচ্ছে একছুটে মায়ের কাছে চলে যেতে। এদিকে অনুভূতির জাতাকলে পৃষ্ঠ হয়ে মন, শরীর দুটোই অবশ হয়ে আছে। এর মাঝে আবার রাকিবের প্রশ্নটা যেন সহ্য হয়না রক্তিমের। মনে হয় প্রশ্নটা করে তার অপেক্ষার প্রহর আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সাথে সাথেই ব্যকুল চোখ দুটোতে কাঠিন্যতা ঢেলে শক্ত কন্ঠে বলে,
“আর একটা প্রশ্ন করলে তোর জ্বিভ টেনে ছিড়ে ফেলব। আমার ঘরে কয়টা মেয়ে মানুষের বসবাস? যেটাকে পাবি ঐটাকেই নিয়ে আসবি। দ্রুত যা।”
পরিস্থিতি অনুকূলে বুঝতে পেরে রাকিব আর একটুও দেরি করেনা। তৎক্ষণাৎ ছুটে যায় মেইন রোডের কাছে। একটা সিএনজি ঠিক করে পাঁচ মিনিটের মাথায় উপস্থিত হয় রক্তিমের পরিত্যক্ত প্রায় বাড়িতে। দ্রুত পদে সিএনজি থেকে নেমে দরজায় কড়াঘাত করে। টুকটাক কাজ সেড়ে দৃষ্টি মাত্রই একটা বই নিয়ে বসেছিল। সাত কলেজের পরীক্ষার আর বেশি দিন নেই। পাবলিক ভার্সিটি হারিয়েছে। বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে রক্তিমের বউ হয়ে এসেছে। মেয়ের থেকে একের পর এক আঘাত পেয়ে মা-বাবা নিশ্চয়ই বড্ড রুষ্ঠ তার প্রতি। এই পরিস্থিতিতে তাদের মন জয় করার একটাই উপায়। বিশ্ববিদ্যালয় অধিভূক্ত যেকোন একটা কলেজে নিজের জন্য স্থান করে নিতেই হবে। এতে অন্তত একটু হলেও তার প্রতি সন্তুষ্ট হবে বাবা-মা। সেই চিন্তা মাথায় রেখেই রক্তিমের মন জয় করার পাশাপাশি নিজেকে সম্পূর্ণ রুপে প্রস্তুত করে নিচ্ছে সাত কলেজের ভর্তি যুদ্ধের জন্য।
বইয়ের মাঝে ডুবে থাকা দৃষ্টি হঠাৎ দরজায় কড়াঘাত পড়ায় চমকে ওঠে। সাথে একটু চিন্তিত হয়। এই সময় তো রক্তিম বাড়িতে ফেরার কথা না। সেই রাত বারোটা-একটার আগে এভাবে দুয়ারে কে হানা দিতে পারে! কিছুটা চিন্তিত হয়েই ওঠে দাড়ায় দৃষ্টি। গলার স্বর উঁচু করে জানতে চায়,
“কে?” সাথে সাথে অধৈর্য রাকিব জবাব দেয়।
“ভাইয়ের লোক আমি রাকিব। দরজা খুলেন ভাবি। ভাই বলেছে দ্রুত আপনি নিয়ে যেতে।”
রাকিবের গলার স্বরেই তাকে চিনে নেয় দৃষ্টি। অসময়ে চামচাটার আগমনে মেজাজটাও খিঁচিয়ে ওঠে। তপ্ত মেজাজে লাফিয়ে দরজার কাছে এগিয়ে যায়। তৎপরতার সাথে খিল খুলে বলে,
“ঐ চামচার বাচ্চা চামচা। এখানে কি চায় হ্যাঁ?”
দৃষ্টির কথা রাকিবের কর্ণগোচর হবার সুযোগ পায়না। তার আগেই দৃষ্টিকে দেখে অত্যধিক বিস্ময়ে হা হয়ে যায় রাকিবের মুখ। চোখ দুটো বড় বড় মার্বেল আকৃতি ধারণ করে কুঠোর ছেড়ে বেড়িয়ে আসার উপক্রম হয়। ভাই বিয়ে করেছে জানত। কিন্তু শেষ মেষ এই মেয়েকে! যাকে কি না প্রথম দিনই গলা চেপে ধরে দুনিয়া থেকে টাটা বাই বাই করে দিতে চেয়েছিল সেই মেয়েকে কিভাবে ভাই বিয়ে করে ঘরে তুলল? এ তো অন্যায়। ছোটখাট কোনো অন্যায় না। মহা অন্যায়। মেয়েটার প্রতি ভাইয়ের বিতৃষ্ণা দেখেই তো রাকিব মনে মনে ভেবে রেখেছিল একে তার চৌদ্দ নাম্বার গার্লফ্রেন্ড বানাবে। সেই চিন্তা বাস্তবায়ন করার জন্যই তো ঐদিন সমাবেশে আড়ালে ডেকে দৃষ্টিকে পটানোর চেষ্টাও করেছিল। আর আজ কি না ভাই তার বাড়া ভাতে ছাই ঢেলে দেবার মতো এতো বড় অন্যায়টা করল! এ অন্যায় কিভাবে মেনে নিবে রাকিব?
চলবে…….
(বহুদিন পর নানু বাড়িতে বেড়াতে এসেছি। কাজিনদের সাথে আড্ডা-কথায় গল্প লেখার কোনো সময় বের করতে পারিনি। আজকে এটুকুই বহু কষ্টে লুকিয়ে চুরিয়ে লিখেছি। কষ্ট করে আজ একটু মানিয়ে নিন। আজ রাত জেগে হলেও পরবর্তী বড়সড় একটা পর্ব লিখব ইশ না আল্লাহ।)