ল্যাম্পপোস্টের ঘোলাটে বাতি। পর্বঃ-০১

0
739

– আমার কলেজের শিক্ষক আমাকে জিজ্ঞেস করলো , ” তোমার ফোনের গ্যালারিতে নীল শাড়ি পরা মেয়েটা কে ? তোমার কাছের কোন মানুষ নাকি ? ”

– আমি বৈদ্যুতিক শট খাবার মত আতঙ্কিত হয়ে আমতা আমতা করে বললাম , জ্বি স্যার সামান্য পরিচিত ।

– কিরকম ?

– পাঁচ বছর আগে তার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে । তারপর থেকে তার সাথে আর দেখা হয়নি আমার , আমি তাকে অনেক খুঁজেছি কিন্তু পাইনি ।

– তারমানে পলিটেকনিক এ ভর্তি হবার আগে থেকে তুমি তাকে দেখেছো , আর সেই থেকে তার ছবি নিয়ে ঘুরে বেড়াও ? আচ্ছা ঘটনাটা খুলে বলতো সজীব !

– জ্বি স্যার , তখন আমি প্রথম স্যামসাং গ্যালাক্সি মোবাইল কিনেছিলাম । চট্টগ্রামে ছোট খালার কাছে ২০১১ সালের ডিসেম্বরে বেড়াতে গেছিলাম । তখন সেখান থেকে একদিন বিকেলে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে ঘুরতে যাই ৷ তখন অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করার পরে হঠাৎ করে একটা মেয়ে আমাকে বললো, ভাইয়া আপনার মোবাইল থেকে আমাদের কিছু ছবি তুলে দেবেন ? আসলে আমাদের কাছে বাটন ফোন তাই ভালো ছবি উঠবে না । আপনি ছবি তুলে সেই ছবি আমাদের মেমোরি কার্ডে ট্রান্সফার করে দিবেন আমরা বাসায় গিয়ে স্টুডিও থেকে বের করবো ।
আমি প্রথমে অবাক হলাম কিন্তু নিজের কৌতূহল নিজের কাছে রেখে তাদের অনেক গুলো ছবি তুলে দিলাম । এরপর তাদের সবগুলো ছবি ডিলিট করে দিছি কিন্তু এই পাঁচটা ছবি বিগত পাঁচ বছরে অনেক চেষ্টা করেও ডিলিট করতে পারিনি ।

– আহারে বেচারা সুপ্ত ভালবাসা ?

– জ্বি স্যার ।

– তার নাম কি ?

– নাম জানিনা ।

– এখন যদি হঠাৎ করে তার সাথে দেখা হয়ে যায় তাহলে তুমি কি করবে ?

– আমি তার নাম জিজ্ঞেস করবো ।

– আর কিছু না ?

– নাহহহ ।

– প্রথমে কি তার নাম জিজ্ঞেস করবে ? এরপরে তাকে প্রপোজ করবে না তুমি ?

– স্যার আপনি বছর খানিক আগে একদিন ক্লাসে বলেছিলেন , যদি কাউকে প্রপোজ করতে হয় তবে প্রথমে তাকে মানসিক ভাবে প্রস্তুত করে নিতে হবে । নাহলে আমি যে তাকে প্রপোজ করবো সেটা যদি সে আগে থেকে বুঝতে না পারে তাহলে হঠাৎ করে অপ্রস্তুত হয়ে যাবে । কিন্তু আগে থেকে যদি কিছুদিন তার ভাবনার মাঝে ঢুকতে পারি তাহলে ফলাফল ভালো আসার সম্ভবনা আছে ।

– বাহহ মনে আছে এখনো ?

– জ্বি স্যার ।

– মেয়েটার নাম নাজমা আক্তার বৃষ্টি ।

– আপনার পরিচিত ?

– হ্যাঁ ।

– বলেন কি ? কিভাবে চিনেন আপনি স্যার ?

– বৃষ্টির জন্মের পর থেকে চিনি , আর তাকে খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করছি ।

– মানে ?

– “নাজমা আক্তার বৃষ্টি” আমার বড় মেয়ে !

– লে হালুয়া , বলেন কি স্যার ?

– হ্যাঁ ।

– সরি স্যার , আমি জানতাম না ।

– যদি জানতে তাহলে কি তোমার মোবাইল আমার কাছে দিতে না ? নাকি তার ছবি ডিলিট করে দিতে ?

– জানিনা । স্যার একটা প্রশ্ন ছিল ।

– বলো !

– আপনি মাঝে মাঝে বলতেন আপনার মেয়ে বৃষ্টির জন্য আপনি বছর খানিক ধরে চিন্তিত । বৃষ্টির কি হইছে ?

– এক কাজ করো , কলেজ তো ছুটি হয়ে গেছে তাই চলো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বলছি ।

– ঠিক আছে চলুন স্যার ।

★★

যার সাথে কথা বললাম তিনি আমাদের ডিপার্টমেন্ট এর সবচেয়ে মজার স্যার । সিটি পলিটেকনিক এ এসে দেখতে দেখতে চার বছর পেরিয়ে গেছে আর এই চার বছরের মধ্যে যতগুলো বন্ধু পেয়েছি তার মধ্যে স্যারের নামও আছে । কিন্তু স্যারের বাসায় কখনো যাওয়া হয়নি বলে বৃষ্টির সাথে দেখা হয়নি আমার । বৃষ্টিকে চট্টগ্রামে দেখার পরে এতটা ভালো লেগেছিল যেটা বোঝান সম্ভব না । কিন্তু তাকে যে আর খুঁজে পাব না সেটা কখনো বুঝতে পারিনি । স্যার বছর খানিক ধরে বলতেন তিনি নাকি তার মেয়েকে নিয়ে খুব টেনশনে আছেন । কিন্তু কখনো সেই বিষয় জানার আগ্রহ ছিল না আমার , তবে এখন যখন জানলাম যে এই সেই বৃষ্টি যার জন্য আমি আজও মাঝে মাঝে মোবাইলের দিকে অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকি । তখন স্যারের মেয়ে মানে আমার অপেক্ষার বৃষ্টির জন্য হলেও জানা দরকার ।

– স্যার আর আমি পাশাপাশি হাঁটছি তখন স্যার বলতে শুরু করলেন , “” বৃষ্টি তোমাদের চেয়ে এক বছরের ছোট বৃষ্টি ২০১৩ সালে এসএসসি পাস করেছে । ওর বড় খালার বাসা চট্টগ্রামে তাই সে মাঝে মাঝে চট্টগ্রাম বড় খালার বাসায় বেড়াতে যায়। ২০১১ সালে হয়তো সেভাবেই তোমার সাথে দেখা হয়েছিল । বৃষ্টির বড় খালার বড় ছেলের নাম হচ্ছে , মোঃ রাফসান আহমেদ । রাফসান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেছিল ২০১৪ সালের মাঝামাঝি । বৃষ্টি আর রাফসান দুজন দুজনকে পছন্দ করতো । বৃষ্টি যখন ক্লাস নাইনে পড়ে তখন থেকেই নাকি তাদের প্রেমের সম্পর্ক শুরু হয় । কিন্তু আমরা জানতে পারি রাফসানের চাকরি হবার কিছুদিন আগে । আমরা সবাই রাজি ছিলাম তাই বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করা হলো । কিন্তু রাফসান নতুন সেনাবাহিনীতে যোগদান করেছে তাই শুধু এনগেজমেন্ট সম্পন্ন করে রেখেছিলাম । চাকরির এক বছর পরে রাফসানের ডিউটি পরে রাঙামাটি পার্বত্য জেলায় । ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে পাহাড়ি কিছু দস্যুদের দমন করার জন্য রাফসান সহ আরো কিছু সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয় । সেখানে একদিন গোলাগুলি হয় অনেক, আর সেদিন থেকে রাফসানকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না । বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে কেউ জানিনা তবে সবার ধারণা সে মারা গেছে । নাহলে দস্যু দল যদি আটক করতো তবে এক বছরের মধ্যে অবশ্যই মুক্তিপণ দাবি করতো । আর সেদিন থেকে বৃষ্টি পাগলের মতো হয়ে গেল । আমি অনেক চেষ্টা করছি বোঝাতে কিন্তু পারতেছি না । তাই বিগত এক বছর ধরে আমি ওকে নিয়ে টেনশনে থাকি সবসময় । মনে হয় না জানি কখন কি ভুল সিদ্ধান্ত নেবে ?

– আমি বললাম , এই এক বছরের মধ্যে বৃষ্টি কি একটুও পরিবর্তন হয়নি ?

– হ্যাঁ হয়েছে , আগে সবসময় রুম অন্ধকার করে বসে থাকতো তবে মাস তিনেক ধরে রুম থেকে বেরিয়ে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকে । প্রতি শুক্রবার বিকেলে আমার ছোট মেয়েকে নিয়ে চরেরহাট নদীর তীরে ঘুরতে যায় । আমার বিশ্বাস বৃষ্টি এখন সব কিছু ভুলে গিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বাঁচতে চেষ্টা করে । কিন্তু হোঁচট খেয়ে পরার সময় হাত টা ধরার মতো কেউ নেই বলে ইচ্ছে থাকলেও পারছে না । আমি চেয়েছিলাম বিয়ে দিয়ে দেবো কিন্তু এতবড় ধাক্কা হয়তো সহ্য করতে পারবে না । তাই আগে ওকে স্বাভাবিক করতে হবে তারপর ভালো একটা ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দেবো ।

– বললাম , আমি কি বৃষ্টির সাথে দেখা করতে পারি?

– হুম পারো তোমাকে দেখলে ও চিনতে পারবে কিনা জানিনা তবে তোমার সাথে দীর্ঘ চার বছরের চেনা পরিচিতির দ্বারা জানি যে , তুমি ওকে স্বাভাবিক করতে পারবে । তবে আমি চাই তুমি তোমার সেই পুরনো পরিচয় দিয়ে কথা বলো । তুমি যে আমার ছাত্র সে বিষয়টা প্রথমে যেন সামনে না আসে ।

– ধন্যবাদ স্যার আমি চেষ্টা করবো , আর আপনার বিশ্বাস টা যেন রাখতে পারি দোয়া করবেন ।

– অবশ্যই দোয়া করি , আগামীকাল শুক্রবার তাই বিকেলে যখন বৃষ্টি আর আমার ছোট মেয়ে ঘুরতে যাবে তখন তুমি সেখানেই তার সাথে দেখা করো । এমন ভাবে দেখা করবে যে তুমি জানোইনি বৃষ্টি এ শহরে থাকে ।

– ঠিক আছে স্যার ।

– আমি এখন তার নাম্বারটা দিয়ে দিচ্ছি তুমি রেখে দাও তোমার কাছে । অবস্থা বুঝে তারপর যদি ভালো মনে করো তাহলে ফোনে যোগাযোগ করিও ।

– আচ্ছা ঠিক আছে স্যার তাই হবে ।

★★

নাম্বার নিয়ে নাচতে নাচতে দুলতে দুলতে মেসের মধ্যে চলে আসলাম । রুমের দরজা বন্ধ করে প্যান্টের উপর লুঙ্গি পরে লাফিয়ে লাফিয়ে লুঙ্গি ড্যান্স করছি । আমার রুমমেট দুজন , শফিক আর রকি এরা দুজনেই কলিজার হারামি বন্ধু । তাদের মত বন্ধুর জন্য পৃথিবীতে আমার কোনো শত্রুর দরকার নেই ।

মেসের মধ্যে যিনি রান্না করে তাকে সবাই খালা বলে ডাকি , তিনিও আমার বিষয় জানতো । আমাকে এসে বললো , ” মামা এ খুশিতে মেসের মধ্যে আপনি নিজের খরচে বিরিয়ানি রান্না ব্যবস্থা করে দিবেন । সবাই মিলে খেয়ে আপনার জন্য দোয়া করা হবে ”

বললাম , সবকিছু হবে আগে তো কাজটা হোক , সবে মাত্র খুঁজে পেলাম এখনো কত কাজ বাকি ?

– আচ্ছা ঠিক আছে মামা তাই করেন ।

দুপুরের খাবার খেয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে নাম্বার টা বারবার দেখছি । কিছুক্ষণ ধরে মনের মধ্যে পরিস্থিতি অনুযায়ী গান আসছে , যেমন এখন মনে আসছে ” অনেক সাধনার পরে আমি পেলাম মোবাইল নাম্বার । ” নাহহহহ মিললো না , পরবর্তীতে মোবাইল নাম্বার পাওয়ার বিষয় আমাকে একটা গান লিখতে হবে ।

ঘুমানোর চেষ্টা করছি কিন্তু ঘুম আসছে না , আবার মনের মধ্যে গান আসছে , ” ঘুম কেন আসেনা কিছু ভালো লাগে না , একবার আসুক ঘুম তবে মজা দেখাবো ”

মোবাইল হাতে নিয়ে নাম্বারটা বের করে ডায়াল করলাম , কল বেজে ওঠার সাথে সাথে কেটে দিয়ে মোবাইল বুকের মধ্যে লুকিয়ে নিলাম । মনে হয় যেন কল দেবার অপরাধে মোবাইল থেকে বেরিয়ে আমাকে শাস্তি দেবে ।

মেসেজ অপশনে গিয়ে একটা মেসেজ লিখলাম ;-

ওহে বালিকা ,
তোমার বোনকে বানাবো শালিকা ।
যদি হও রাজি ,
ডেকে আনবো কাজি ।

কিনে দেবো নীল চুড়ি ,
সাথে দেবো লাল শাড়ি ।
ব্লাউজটা তুমি কিনে নিও ,
টাকাটা নাহয় তুমিই দিও ।

কথাটা শুনে হেসে দিলে ?
জানোনা আমি বেকার ছেলে ?
চাকরি করে সব কিনে দেবো ,
ছুটির দিনে ঘুরতে নেবো ।

মেসেজটা তার নাম্বারে পাঠিয়ে দিলাম , একটু পরে ডেলিভারি মেসেজ আসলো । আমি মিটমিট করে হাসছি আর বারবার রিপ্লাই আসে কিনা চেক করে দেখতেছি ।

টুং টুং…. টুং টুং…

বাহহহহ ৫ মিনিট পর মেসেজ এসেছে , মেসেজ পরে শালা আমি তো অবাক !

মেসেজ ছিল ;-

ওরে বাটপার ,
ছন্দ গুলো চমৎকার ।
কে তুমি বৎস ?
কি তোমার উৎস ?

লাইন মেরে লাভ নেই ,
মনের আসন ফাঁকা নেই ।
বিরক্ত আর করিও না ,
ফলাফল কিন্তু ভালো না ।

★★★

ল্যাম্পপোস্টের ঘোলাটে বাতি।
পর্বঃ-০১

চলবে …….?

( যারা এত কষ্টে করে আমার টাইমলাইনে গল্প পড়তে এসেছেন , তারা পড়া শেষ করে ফিরে যান । আর বাড়ি পৌঁছে একটা কল দিয়ে জানিয়ে দিও ।

লেখাঃ-
মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here