_ল্যাম্পপোস্টের_ঘোলাটে_বাতি । #_পর্ব_০৯

0
148

#_ল্যাম্পপোস্টের_ঘোলাটে_বাতি ।
#_পর্ব_০৯

– বললাম , আমার ভালবাসার মধ্যে কোন স্বার্থ ছিল না , তবে হ্যাঁ একটাই স্বার্থ ছিল সেটা হচ্ছে তোমাকে আপন করে পাওয়া । পাঁচ বছর নিঃস্বার্থ ভাবে আমি চুপিচুপি ভালবেসে হঠাৎ করে তোমাকে পেয়েছি । এখন আবারও জীবনের মহা ঝড়ের আঘাতে তুমি হারিয়ে যাচ্ছ তবে আমি আমার ভালবাসার বিশ্বাস থেকে বলছি আমাদের আবার দেখা হবে । মনের মধ্যে একটা কথা সুন্দর করে গেঁথে রাখো , তোমার সাথেই আমি আমার জীবনের শেষ সূর্যাস্ত দেখে পৃথিবী থেকে বিদায় নেব । আজকের এই দেখাই আমাদের শেষ দেখা নয় , না এই জেলা কারাগারে না এই খুলনা শহরে । ভেজা মেঘের মত অদূর আকাশে উড়তে উড়তে যদি জীবনের সুতোয় তোমার টান পরে কখনো ! তবে চলে এসো আমার এই নিঃশ্ব মলিন জীবনে । বুক ভর্তি ভালবাসা দেব , নিস্তব্ধ রাতে জোৎস্না দেখতে সাথি হবো ! জীবনের শেষ দিনে তোমার ঐ কানের কাছে মুখ নিয়ে বলতে চাই ” বড্ড বেশি ভালবাসি তোমায় ” ।

– স্বপ্ন দেখা ভালো কিন্তু স্বপ্নে ভাসা ভালো না সজীব, তাই বলছি , ভালবেসে স্বপ্ন সবাই দেখে কিন্তু কিছু স্বপ্ন প্রকৃতির নিয়মে আবদ্ধ হয়ে মনের মধ্যে গলে পঁচে নষ্ট হয়ে যায় ।

– স্বপ্ন কখনো নষ্ট হয়না , অবহেলা আর অব্যবহৃত থাকে বিধায় ক্লান্ত হয়ে যায় । কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরনের লক্ষ্যে যদি মানুষ পরিশ্রম করে তাহলে অবশ্যই পূর্ণ হবে সকল স্বপ্ন আর আশা ।

– আমি গেলাম সজীব , ভালো থেকো সবসময় ।

– চেষ্টা করবো তবে নিশ্চিত না ।

– চেষ্টাই সবচেয়ে বড় কথা ।

– হুম ।

★★

যেই মানুষটি আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চায় তাহলে তাকে আর ধরে রাখবো কিভাবে ? কারণ আমাকে আর সে তার প্রয়োজন মনে করে না হয়তো , আজ হয়তো এতটা দুরত্ব হয়ে গেছে যে শত চেষ্টার পরেও আমি আর তাকে আপন করতে পারবো না ।

মাঝে মাঝে মনটাকে মিথ্যা শান্তনা দিয়ে বলি , যে ছেড়ে গেছে সমস্ত অধিকারের সম্পর্ক ছিন্ন করে সে আমার কেউ না ! কিন্তু আবার ভাবি সত্যিই কি সে আমার কেউ না ? তবে কেন তার জন্য কেঁদে ওঠে মন ? হাহাকার করে বুক , নির্ঘুম কাটে আমার রাত , মনে করে হৃদপিন্ড , গলা দিয়ে নিচে নামতে চায় না ভাত ! এর উত্তর কার কাছে চাইবো ?

শুধু আমি নই , আসলে পৃথিবীতে মানুষ নিজে ঠিক কি চায় , এইটা বুঝতে তার পুরো এ জীবন কেটে যাবে । ডিপ্রেশনের পিএইচডি ডিগ্রি কমপ্লিট করে ফেলবে কিন্তু তবুও তা অজানায় থেকে যায় । আমি কি তাদের মধ্যেই একজন ?

|
|

চার মাস পার হয়ে গেছে ! জেলা কারাগারে আসার মোট দিন হলো ৫ মাস ২৩ দিন ।

বৃষ্টি চলে গেছে সকল স্মৃতি মুছে দিয়ে আর বলে গেছে আমি যেন ভালো থাকি । সত্যি সত্যি কি তার স্মৃতি মুছতে পেরেছি আমি ?

শফিক আর রকি আর আসেনি দীর্ঘ এই পাঁচ মাস তেইশ দিনের মধ্যে । কেন আসলো না তাও জানিনা আমি , তবে আন্দাজ করতে পারি যে সামনে ডিপ্লোমার সপ্তম সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা । তাই হয়তো পরীক্ষার জন্য আর সময় করে আসতে পারে নাই । আমারও তো ইচ্ছে ছিল পরীক্ষায় পাশ করে ঢাকা গিয়ে বড় চাকরি করবো । কিন্তু শ্রাবণের আকাশে যেমন হঠাৎ করে মেঘ জমে ঝুম করে বৃষ্টি নামে । ঠিক তেমনি করে আমার জীবনের আকাশে মেঘ জমেছে যার বৃষ্টি এখনো অজস্র ঝরছে । পরীক্ষা শেষ করে ৩ মাসের ইন্টার্নি করতে হবে বিভিন্ন ইন্ড্রাস্ট্রিতে । কিন্তু সপ্তম সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলেই ডিপ্লোমা পড়াশোনা সমাপ্ত । মেস ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে হবে রাজধানীতে কিংবা বন্দর নগরী চট্টগ্রামে ।

আরো তিনদিন পরে হঠাৎ শফিক আর রকি এসে হাজির । তাদের আগমনে কিঞ্চিত আনন্দে পেয়েছি কিনা বুঝতে পারছি না । পুলিশ বললো আজকে আমার সময় ২০ মিনিট , পরে শফিকের কাছে জেনেছিলাম আজকে ১০০ টাকা বেশি দিয়ে পাঁচ মিনিট বাড়ানো হয়েছে ।

– কিরে কেমন আছো তোরা ? (আমি)

– আমরা ভালোই আছি বন্ধু, মাফ করে দিস এতদিন তোর কাছে আসতে পারিনি । তুই কেমন আছো ?

– বললাম ,

অনেক ভালো আছি আমি
সুখে সর্বক্ষণ ।
আগের মতো কষ্ট পাইনা
পাষাণ করেছি মন ।

ভাগ্যটা কে নিয়েছি মেনে
চিন্তা করিনা আর ।
বুকের মধ্যে দাফন করেছি
বেদনার পাহাড় ।

হঠাৎ করে গভীর রাতে
স্বপ্ন দেখে জাগি ।
বুকটা তখন চিনচিন করে
প্রিয়জনের লাগি ।

দুচোখ বেয়ে অশ্রু পরে
মোছার কেউ নাই ।
আপনাআপনি শুকায় অশ্রু
ইচ্ছে করে না তাই ।

হঠাৎ করে ভাবি আমি
কেন এমন হলো ?
কি দোষ করছি আল্লাহর কাছে ?
সুখ যে কেড়ে নিলো ।

— শফিক বললো , চেয়ারম্যান স্যার একদিন আমাদের দুজনকে নিজের রুমে ডেকে বললেন , তোর সাথে যেন কখনো যোগাযোগের চেষ্টা না করি । তাহলে আমাদেরকেও টিসি দিয়ে বের করে দেবে তাই ভয়ে আসতে চেয়েও পারিনি বন্ধু ।

– বললাম ,

রাগ করিনি তোদের সঙ্গে
সত্যি বলছি আমি ।
তোদের কত ভালবাসি
জানে অন্তর্যামী ।

কি লাভ হতো বলতে পারো ?
দেখা করলে তাতে !
দেখা হলেই পারতে কি ভাই
সঙ্গে আমায় নিতে ?

আফসোস করে কি আর হবে
যা হবার তা হবে ।
প্রকৃতির নিয়ম আল্লাহ করেছে
পাল্টানো কি যাবে ?

— রকি বললো , আমাদের পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে আর মেসের রুম ছেড়ে দিয়েছি । দু তিনদিনের মধ্যে আমরা খুলনা ত্যাগ করবো , খুব ইচ্ছে ছিল আমরা তিনজন ঢাকা শহর গিয়ে একসাথে আবার একই সাথে থাকবো । কিন্তু আমাদের সেই স্বপ্নটা হারিয়ে যাবে কখনো ভাবিনি সজীব ।

– আচ্ছা বাদ দে এসব , কে কোন যায়গা ইন্টার্নি ঠিক করেছিস ?

– শফিক বললো , আমি তো গাজীপুর চৌরাস্তায় ঠিক করেছি আর রকি যাবে চট্টগ্রামে তার মামার কাছে । সেখানে ওর মামা আছে কর্নফুলী ইপিজেড এর মধ্যে চাকরি করে ।

– বললাম , আচ্ছা ঠিক আছে আমার কাপড় চোপড় গুলো একটা বস্তা ভর্তি করে বাদল মামার দোকানে রেখে দিবি ।

– রকি বললো , না সজীব সমস্যা নেই । আমাদের এলাকার এক ছোট ভাই আছে না রাকিব ? তার কাছে সবকিছু রেখে দিচ্ছি , তোর মোবাইলও রাকিব এর কাছে থাকবে । যদি খুব তাড়াতাড়ি মুক্ত হতে পারিস তাহলে তো ওখান থেকে সংগ্রহ করে ঢাকা বা চট্টগ্রাম আমার কাছে চলে যাবি । আর যদি তার আগে ছাড়া না পাস তাহলে আমরা তো ভাইভা পরীক্ষা দিতে আবার আসবো তখন দেখা হবে ।

– বললাম , ঠিক আছে ।

– শফিক বললো , যখন হঠাৎ করে মনে ওঠে যে এই খুলনা শহরে আর তিনজনে একসাথে আড্ডা হবে না তখন খুব খারাপ লাগে । আর কখনো কোনদিনই দাওয়াতে কমিউনিটি সেন্টারে গিয়ে বিয়ের খাবার খাওয়া হবে না । গভীর রাতে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে একজন আরেকজনকে ধাক্কা দিয়ে কথা বলাটা বড্ড মিস করবো রে বন্ধু । জীবনতো একটাই আর সেই জীবনে কত কিছু স্মৃতি হয়ে যায় বন্ধু । কষ্ট লাগে রে বন্ধু বড্ড কষ্ট লাগে , মাঝে মাঝে চোখ বেয়ে পানি বেরিয়ে যায় । বিশ্বাস কর সজীব , বন্ধুত্বের এই কষ্ট মানুষ গার্লফ্রেন্ডের বিয়ে হয়ে গেলেও পায় কিনা জানিনা আমি ।

– বললাম , এগুলো ভেবে ভেবে মন খারাপ করে লাভ নেই বন্ধু কারণ আমাদের সবার কাছে মনের একান্ত গভীরে কিছু স্মৃতি জমে আছে । আজ সেই স্মৃতির পাতা উল্টে দেখলাম হঠাৎ করে কত মানুষ জীবন থেকে হারিয়ে গেছে । আবার কত চেনা মানুষ অচেনা হয়ে গেছে । এদের মতো করে হঠাৎ হয়তো কোন একদিন আমিও অচেনা হয়ে যাবো এই পৃথিবী থেকে ! এটাই পৃথিবী , সৃষ্টিকর্তার এটাই নিজের ইচ্ছে ।

– শফিক বললো , সময় ফুরিয়ে গেছে বন্ধু আজকের মতো বিদায় নিতে হবে । আবারও একদিন দেখা হবে কোন এক পড়ন্ত বিকেলে নদীর তীরে । আমরা তিনজন একসাথে হলে কথা ফুরাবে না সেটা তো ভালো করেই জানো ।

– বললাম , ঠিক আছে তোরা ভালো থাকিস আর একটা অনুরোধ রইল সবসময় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বি । পৃথিবীর সকল দুঃখ কষ্ট একদিন শেষ হয়ে যাবে কিন্তু নামাজ না পরলে পৃথিবীতে আসার অর্থ টা বৃথা হয়ে যাবে ।

– শফিক তার দুচোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললো , ঠিক আছে বন্ধু ভালো থেকো সবসময় ।

– বললাম , মেয়েদের মতো এমন কান্না করিস কেন শফিক ? মেয়েরা তো সামান্য ঠোঁটের লিপস্টিক হারিয়ে গেলেই কান্না করে করে চোখের কাজল নষ্ট করে ফেলে । কিন্তু মনে রাখতে হবে তুই একটা পুরুষ তাই তোকে শক্ত হতে হবে বন্ধু ।

– ঠিক আছে থাক তাহলে গেলাম আমরা ।

– আল্লাহ হাফেজ ।

★★

মা-বাবার কথা জিজ্ঞেস করা হয়নি , ইসস বড্ড ভুল হয়ে গেছে । প্রথমেই তাদের কথা জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল কিন্তু কিভাবে কি বলে যে ভুলে গেলাম বুঝতে পারছি না । শহরের মাঝে এখন একলা জীবন পার হবে প্রতিনিয়ত । আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা সোনার তরীর মাঝির মতো ফসল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি ।

৬ মাস পার হয়ে আর ৮ দিন গেল ।

দুপুরের খানিকটা আগে আমাদের কয়েদের মধ্যে একটা যুবক কে আনা হলো । বয়স আনুমানিক ২৮ থেকে ৩০ এর মধ্যে হবে , শরীর বেশি মোটা নয় কিন্তু চেহারায় হাসি হাসি ভাব । আমি এক পাশে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছি আর সেই লোকটা আমার অপর পাশে বসে আছে । দুজনেই মুখোমুখি বসে আছি কিন্তু কারো মুখে কোন কথা নেই । তবে লোক টা বারবার আমার দিকে তাকিয়ে আছে , আমি এদিক সেদিক চোখ ঘুরিয়ে যখনই তার দিকে তাকাই তখনই দেখি সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । আমি মনে মনে একটা অস্বস্তি বোধ করতে আরম্ভ শুরু করলাম । কিন্তু আগ বাড়িয়ে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছি না তাই চুপচাপ বসে আছি ।

ঘন্টা খানিক পরে লোকটা আমার কাছে উঠে এসে বসলো । আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি দুর থেকে যেমন দেখা যায় কাছ থেকেও ঠিক তেমনি । আশ্চর্য হবার মতো তেমন কোনো বস্তু আমার চোখে পরলো না । কিন্তু যখন সে মুখ ফুটে কথা শুরু করলো তখন তার কথার মধ্যে আশ্চর্যের ভাব ছিল ভরপুর ।

– লোকটা বললো , তোমার নাম সজীব তাই না ?

– বললাম , জ্বি আমার নাম সজীব । ( আবার চুপ করে রইলাম , উচিত ছিল তার নাম জিজ্ঞেস করা কিন্তু সে আমার নাম জানলো কিভাবে সেটা আমার কাছে আশ্চর্য তাই বাড়তি কথা মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না ।)

– আমাকে চিনতে পারছো ?

– না ভাইয়া ।

– আমার নাম খোকন ।

– ওহহ আচ্ছা খুব সুন্দর নাম ।

– উহু মোটেই পছন্দ না আমার নাম , সবাই আমাকে টোকন বলে ডাকে । টোকন বোঝাে তো ? যেকোনো কিছু সংগ্রহ করতে যেই কাগজ থাকে সেটাকে আমরা টোকন বলি ।

– জ্বি ভাই বুঝতে পারছি ।

– আমার নাম শুনে চিনতে পারছো ?

– না ।

– বছর খানিক আগে খুলনা ২৫০ শয্যা হাসপাতালে তুমি আমার মা’কে এক ব্যাগ ( এ নেগেটিভ ) রক্ত দিয়েছিলে । আমার মায়ের পায়ে অপারেশন করা হয়েছিল তখন রক্তের দরকার ছিল । আমার এক বন্ধু কিছু কলেজ ছাত্রদের সাথে যোগাযোগ করে তারপর তোমাকে নিয়ে আসেএবং ।

– ওহহ আচ্ছা ভাই মনে পরেছে ।

– কি মনে পরেছে ?

– মানে ?

– আমার কথা মনে পরেছে নাকি শুধু রক্ত দেবার কথা মনে পরেছে ?

– শুধু রক্তের কথা ।

– রক্ত দেবার পরে আমি তোমাকে নিয়ে হাসপাতালের সামনে ” বাগদাত ” রেস্টুরেন্টে গেছিলাম আমরা । ভেবেছিলাম তোমাকে গরুর মাংস দিয়ে লান্স করাবো কিন্তু রেস্টুরেন্টে গরুর মাংস ছিল না । কলেজ ছাত্রদের স্মৃতিশক্তি থাকবে প্রখর কিন্তু তোমার স্মৃতি খারাপ কেন ?

– জানিনা , যিনি এটা তৈরী করেছেন তাকে জিজ্ঞেস করে নিতে হবে ।

– কিভাবে ?

– মৃত্যুর পরে ।

– হাহাহা হাহাহা , আচ্ছা তুমি জেলের মধ্যে কেন ?

– সে অনেক কথা ভাই , আচ্ছা আপনার আম্মু কেমন আছেন এখন ?

– আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো । আচ্ছা বলো তো ভাই তোমার সমস্যা কি ছিল ?

– ( আমি এক এক করে সবকিছু তাকে খুলে বললাম কোনকিছুই বাকি রাখিনি ।)

– সবকিছু শুনে তিনি বললেন , তুমি চিন্তা করিও না ছোট ভাই । তুমি আমার মায়ের জীবন বাঁচিয়ে ছিলে সেই উপকারের প্রতিদান একটু হলেও আমি তোমাকে দেবো ।

– কিভাবে ?

– তোমাকে জেল থেকে বাহির করে ।

– মনে মনে ভাবলাম , যিনি নিজেই আমার পাশে জেলের মধ্যে বসে আছে তিনি আমাকে মুক্তি দেবে ।

– চুপ করে আছো কেন বিশ্বাস হয়না ?

– বিশ্বাস করেছি ভাই , আচ্ছা আপনি জেলে কেন ভাই ?

– দুই নাম্বারি ব্যাবসা করি তো তাই মাঝে মাঝে ধরে নিয়ে আসে । কিন্তু আমার উপর মহল থেকে আবার ১২ ঘন্টার মধ্যে বের করে নিয়ে যায় ।

– একটু পরিষ্কার করে বলবেন খোকন ভাই ?

– ইয়াবা চেনো তো ?

– জ্বি নাম শুনেছি ।

– ওগুলোর ব্যাবসা করি , তবে আমার উপর মহল অনেক দুর পর্যন্ত । খুলনা শহরের বড় বড় নেতাও আছে আমাদের সাথে জড়িত কিন্তু আমি তাদের সাথে কখনো যোগাযোগ করিনি । বলতে পারো আদার ব্যাপারী তবে যখন ধরা পরি তখন বাবলু ভাইয়ের কাছে খবর পৌঁছে যায় । আে উকিল এসে বেশিরভাগ সময় নিয়ে যায় আমাকে । ক্ষমতা বড় জিনিস রে ভাই ক্ষমতা বড় জিনিস ৷

– আপনি সত্যি সত্যি আমাকে বের করতে পারবেন ভাই ?

– ১০০% পারবো , তুই আমার মা’কে বাচিয়ে নতুন জীবন দান করছো তোকে এই সামান্য উপকার তো করতেই হবে । কিন্তু আগে আমি আজ সন্ধ্যার মধ্যে কিংবা আগামীকাল সকালের মধ্যে বের হবো । তারপর বাহিরে গিয়ে উকিলকে বলে ৭ দিনের মধ্যে তোর জামিন ব্যবস্থা করবো ।

– আপনি বিয়ে করেছেন ভাই ?

– হ্যাঁ একটা মেয়ে আছে তিন বছর বয়স ওর নাম ফারহানা জান্নাত । খুব সুন্দর নাম তাই না ?

– জ্বি ভাই । কিন্তু ভাই এই অনিশ্চিত বেআইনি ব্যাবসা করেন কেন ? আপনার মা আছে স্ত্রী সন্তান আছে কিন্তু হঠাৎ করে আপনার কিছু হয়ে গেলে তাদের কি হবে ? কে দেখবে তাদের ? আমি মানি যে আপনার সাথে এখন বড় বড় নেতার হাত আছে কিন্তু সময় হলে তারাই আপনাকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিতে দ্বিধা করবে না ।

– আমি জানি সজীব , কিন্তু এ ছাড়া উপায় পাইনি ছোট ভাই । আমি অনার্স পাশ করা একটা ছেলে কিন্তু বেকারত্ব আর স্বার্থপর সমাজের কাছে আমি অবহেলিত হয়ে আজ এই পথে ।

– তবুও কিন্তু সৎ পথে যারা বেচে থাকে তাদের মন ভর্তি শান্তি আছে । লাখ টাকার খাটে শুয়ে ঘুমের ঔষধ খেয়েও অনেকে ঘুমাতে পারেনা ডিপ্রেশনে ভুগে , সিগারেটের সাথে তার রাত কাটে । আর পাড়ার রিক্সাওয়ালা সারাদিন প্যাডেল ছেপে বিছানায় পিঠ লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে ।

– তুমিও শিক্ষিত ছেলে আর তোমাকে ভালো লেগেছে তাই মনের ভিতরে কথা গুলো বলি । আমি বারবার চেষ্টা করছি যে টাকা আয় করেছি সেই টাকা দিয়ে মা স্ত্রী সন্তান নিয়ে কিছু একটা করে খাই । কিন্তু দল আমাকে ছাড়ে না সজীব , আমি অনেক কিছু এখন চিনি অনেক কৌশল আমার জানা আছে বাঁচার ৷ তাই আমি চলে গেলে আমার মতো একজন ট্রেনিং করাতে তাদের অনেক পরিশ্রম হবে । তাই আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তারা আমাকে মুক্তি দেবে না ।

– আপনার মা স্ত্রী তারা কিছু বলে না ?

– আমার মা আমার সাথে কথা বলে না । তবে মাঝে মাঝে গভীর রাতে যখন বাতি বন্ধ করে হাহুতাশ করে জেগে থাকি । তখন মা আমার রুমে গিয়ে পরম স্নেহে কপালে হাত বুলিয়ে দেয় । আলতো করে একটা চুমু দিয়ে আবার ফিরে যায় নিজের রুমে । মাঝে মাঝে তার চোখের পানি আমার মুখের উপর পরে । মায়ের সেই গভীর রাতের লুকানো ভালবাসা পাবার লোভে রাতে ঘুমাইনা । রুমের দরজা বন্ধ করিনা কখনো ।

– ভাই প্রতিটি মানুষের জীবনে আলাদা আলাদা কষ্ট ভর্তি তাই না ?

– হ্যাঁ ভাই ।

★★

রাত আটটার কিছুক্ষণ পরে সত্যি সত্যি খোকন ভাইকে ছেড়ে দেওয়া হলো । তখনই বুঝতে পারছি আসলে ক্ষমতা কতবড় জিনিস ? হায়রে মানুষ আর হায়রে আমার সোনার বাংলা দেশ !

খোকন ভাই যাবার সময় আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন , ” তুই একদম চিন্তা করিসনে সজীব , আমি এই মাসের মধ্যে তোকে জামিনে বের করবো কথা দিলাম ! ” উত্তরে আমি তেমন কিছু বলিনি ।



সত্যি সত্যি আমাকে মুক্ত করা হলো , একদিন সকাল বেলা হঠাৎ করে আমাকে পুলিশ এসে বাহির করে নিয়ে গেল । ওসির সামনে গিয়ে দেখি একটা উকিল বসে আছে , তিনি কিছু কাগজে আমার সাক্ষর নিলেন তারপর আমাকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন ।

আহহ কত শান্তি , ছয় মাস ছাব্বিশ দিন পরে আজকে বাহিরের রাস্তা দেখতে পাচ্ছি গাড়ি চলাচল করছে ঠিক আগের মতো । বুঝলাম , আমি এক সজীব না থাকলে পৃথিবী থমকে যাবে না । সবকিছু চলবে তার আপন নিয়ম , কিন্তু হয়তো যে হারিয়ে যাবে তার স্মৃতি গুলো নিয়ে কেউ ভাববে মাঝে মাঝে তাও কারণে অকারণে ।

– উকিল বললো , যখনই মামলার শুনানি পরবে তখনই আমি তোমাকে ডাকবো আর তোমাকে এসে কোর্টে হাজিরা দিতে হবে । যদি মিস করো তাহলে কিন্তু তোমার বিপদ হবে বুঝতে পারছো ?

– জ্বি স্যার । খোকন ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করতে চাই আমি ।

– সেটা আপাতত নিষেধ আছে , খোকন বলেছে তোমার সাথে সে আর যোগাযোগ করতে চায় না কারণ সে চায়না তুমিও তার মতো হয়ে যাও । তবে হঠাৎ করে একদিন দেখা করবে তোমার সাথে সেটা আমার মাধ্যমে কারণ আমার সাথে তো যোগাযোগ হবে তোমার ।

– ঠিক আছে স্যার তাহলে আপনার একটা কার্ড দেন আমি মোবাইল করে পরে আমার নাম্বার দেবো ।

– আচ্ছা ঠিক আছে ।

★★

মেসের মধ্যে এসে বেশিক্ষণ দেরি করলাম না , রুম বন্ধ করে রাকিব এর কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে প্রথমেই বাড়িতে কল দিলাম । কিন্তু আমার নাম্বার ব্লক করা আছে , সবগুলো নাম্বারে কল দিয়ে চেষ্টা করছি কিন্তু সবগুলোই ব্লক করা । এরপর শফিক কে কল দিলাম কিন্তু রিসিভ করলো না । রাকিব বললো , “শফিক নাকি গ্রামের বাড়িতে আছে । ”

– রকির কাছে কল দিয়ে কথা হলো , রকি আমার মুক্তির কথা শুনে একটা চিৎকার দিল । বললো , সজীব তুই এখনই চট্টগ্রাম রওনা দিয়ে চলে আয় টাকা পাঠাচ্ছি আমি । আর তোর এসএসসি সার্টিফিকেট তো তোর কাছেই ছিল সেটা চেক করে নিয়ে আসিস ।

– বললাম , কিন্তু সেখানে গিয়ে কি করবো ?

– সে পরে দেখা যাবে , তুই কাপড় গুলো নিয়ে সোনাডাঙা বাস স্টেশন গিয়ে চট্টগ্রামের গাড়িতে উঠে পর । মিস করবি না কিন্তু আগামীকাল সকালের মধ্যে তুই চট্টগ্রাম থাকবি ।

– আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে বিকাশ নাম্বার দিচ্ছি তুই কিছু টাকা পাঠিয়ে দে ।

– আচ্ছা ঠিক আছে ।

★★

সোহাগ পরিবহনের টিকিট সংগ্রহ করে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম । বাস ছাড়লো বিকেল তিনটায় , যশোর , ঝিনাইদহ , মাগুরা , ফরিদপুর , রাজবাড়ী , দৌলতদিয়া ঘাট , মানিকগঞ্জ , ঢাকা , নারায়ণগঞ্জ , মুন্সিগঞ্জ , কুমিল্লা ও ফেনি হয়ে চট্টগ্রাম জিইসি মোড় পৌছলাম সকাল ছয়টা বাজে । এত দেরি হবার কথা ছিল না কিন্তু কাঁচপুরের ওখানে ব্রীজের কাজ চলে তাই জ্যামে আটকা ছিলাম চার ঘন্টার বেশি ।

জিইসি মোড় থেকে সিএনজি নিয়ে রওনা দিলাম ইপিজেড এলাকা ফ্রী পোর্ট পার হয়ে বন্দরটিলা । সেখানে রকি আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে কিন্তু ওর নাকি সকাল আটটায় অফিস তাই আমাকে সাড়ে সাতটার মধ্যে যেতে হবে । তবে আমি আমার দীর্ঘ বেড়াতে আসার অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে ফ্রী পোর্ট জ্যাম হবে এখন কারণ অফিসের হাজার হাজার শ্রমিকের এখন অফিসে যাবার সময় ।

সিএনজি ড্রাইভার বুদ্ধিমান ছিল তাই ভিতরের গলি পেরিয়ে পেরিয়ে সাতটা বিশ মিনিটে বন্দরটিলা এসে থামলো । রকি আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরলাে , কিন্তু কষ্টের চেয়ে সুখ মিশ্রিত ছিল বেশি ।

– রকি বললো , তাড়াতাড়ি বাসায় চল গোসল করে ফ্রেশ হয়ে আমার সাথে অফিসে যাবি ।

– কিসের অফিস ?

– গার্মেন্টসে ।

– বললাম , গতকাল জেল থেকে বের হলাম আর সারারাত বাসের ভিতরে জার্নি করে আসলাম । তুই কিনা জেলখানার মতো বাংলাদেশের দ্বিতীয় জেলখানায় নিয়ে যাবি ?

– দেখ সজীব , আমার মামা গার্মেন্টসের পিএম পোস্টে আছে । আর অফিসে এখন লোক নিয়োগ চলে তাই আজকেই তোকে যেতে হবে ।

– কিন্তু…

– কোন কিন্তু নেই চল আমার সাথে ।

★★

তড়িঘড়ি করে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে রকির সাথে এসএসসি সার্টিফিকেট আর জন্মনিবন্ধন কার্ড নিয়ে রওনা দিলাম । যেতে যেতে জানলাম , রকি নাকি দুই মাস ইন্টার্নি করেই এই অফিসে চাকরি নিয়েছে । কাজের অভিজ্ঞতা বাড়বে সাথে সাথে ট্রেনিং ও হবে । গার্মেন্টস ডিজাইনার হিসেবে ডিপ্লোমা করে গার্মেন্টস ছাড়া তো চাকরি হবে না ।

গেটের মুখে সিকিউরিটির কাছে নাম এন্ট্রি করে নতুন একটা প্রবেশ টোকন সংগ্রহ করলাম । টোকন এর কথা বলতেই আমার খোকন ভাইয়ের কথা মনে পরলো । সিড়ি বেয়ে বেয়ে পাঁচ তলায় উঠে পরলাম কিন্তু রকির নাকি ১২ মিনিট লেট হয়ে গেছে ।

রকি আমাকে ভিতরে নিয়ে গেল , চারিদিকে শুধু সেলাই মেশিনের শব্দ হচ্ছে । একটা লাইনের ভিতরে গিয়ে একটা মেশিনে বসা মেয়েকে দেখিয়ে বললো , দেখতো চিনতে পারিস কিনা ?

– আমি এই প্রথম গার্মেন্টসের ভিতরে ঢুকেছি তাই এদিক সেদিক তাকিয়ে ছিলাম । কিন্তু রকি যখন বললো , দেখতো চিনতে পারিস কিনা ! তখন সামনে তাকিয়ে দেখি বৃষ্টি চেয়ারে বসে আছে । আমার আর রকির কথা শুনে সেও সেলাই বাদ দিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আমাকে দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে ।

– অস্ফুটে তার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল , সজীব তুমি এখানে ? ( বিভিন্ন মেশিনের শব্দে বৃষ্টির প্রশ্ন আমার কানে পৌঁছাল না কিন্তু ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে সেটাই বুঝতে পারছি ।)

– আমি বিশাল একটা হাসি দিয়ে বললাম , বলেছিলাম না তোমার সাথে আবার দেখা হবে ?

চলবে….

( বিঃদ্রঃ- অনেকের মনে হয়তো দু একটা প্রশ্ন জাগতে পারে । যার যার প্রশ্ন থাকবে তারা কমেন্ট করে জানাবেন আমি রিপ্লাই করে উত্তর দেবো ।)

লেখাঃ-
মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here