#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_২৪
দেখতে দেখতে মাস গড়ালো। ফেব্রুয়ারিতে পদার্পণ করলো মাস। শুষ্ক-শীতল আবহাওয়ায় দিনগুলো ভালোই কাটছিল। সৌভিক-নিখিলের মতো কর্মকরা মানুষের কর্মব্যস্ত দিন। চারুর সঙ্গে প্রণয়ের সম্পর্কটা বেশ জমেই গিয়েছে নিখিলের। রোজ রোজ ফোনকলে কথা, সকালে অফিস যেতে-যেতে, দুপুরে লাঞ্চ ব্রেকের ফাঁকে আর রাতে বাড়ি ফিরে বিছানায় শরীর এলিয়ে টুকটুক করে দু’ প্রান্তের দু’জন মানুষ গল্পে মেতে ওঠে। সারাদিন কি কি করলো তারা, লাইনের ওপাশের অপরপক্ষকে জানায়। মাঝে মাঝে ভিডিও কলেও সাক্ষাৎ হয় ওদের। কিন্তু তা মাত্র কয়েক মিনিট স্থায়ী হয়। ভিডিও কলে নিখিলের সামনে বসে কথা বলতে ভীষণ লজ্জা পায় কি-না! নিখিল অবশ্য হাসে খুব। এই নিয়ে ওকে পঁচানি দিতেও ছাড়ে না,
— “এখনই এতো লজ্জা পাচ্ছেন? বিয়ের পর কি করবেন, বলুন তো?”
ওর চোখের দুষ্টু ইশারা বুঝতে অসুবিধে হয় না চারুর। লাজে রাঙা গাল নিয়ে মন্তব্য ছুঁড়ে ওর দিকে,
— “সে তখন দেখা যাবে!”
— “তখন কিন্তু এসব লজ্জা-ফজ্জা চলবে না, ম্যাডাম! শুধুই আদর চলবে!”
চারু লজ্জায় অবনত আরক্তিম মুখখানি লুকোনোর জায়গা খুঁজে পায় না। চট করে কল কেটে অফলাইনে চলে যায়। ওপাশ থেকে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে নিখিল!
রিংকু-টিংকুর মতো ভীষণ দুষ্টু ছেলেদের জন্য মহানন্দের সময়। তারা কোনোমতে উতরে গেছে তাদের ক্লাস এইট। বছর শুরুর দিনগুলি। তাই দু’ ভাইয়ের এখন পড়ালেখা নেই। তাদের জোর দাবি তারা বড় হয়ে গেছে। ক্লাস নাইনে উঠেছে কি-না!
অনুলেখার সাংসারিক জীবন চলছে তার মতন। রোজকার একঘেঁয়ে রুটিন। আজকাল বাপের বাড়িকে খুব মনে পড়ে মেয়েটার। মাঝে মাঝে ফিরে আসতে ইচ্ছে করে এ বাড়িতে, তার আজন্ম বেড়ে ওঠা প্রিয় ‘অরুণা ম্যানশনে’! কিন্তু ফেরা হয় না। যে নারী একবার ‘কবুল’ বলে স্বামী নামক মানুষটির হাত ধরে বাড়ি ছাড়ে, তার যে বাপের বাড়ি বলে আর কিছু থাকে না!
মাঝে মাঝে দু’ একদিনের জন্য আসে বটে কিন্তু আগেকার সেই দখলদারিত্ব, দাপুটে ভাবটা আর নেই। মনে মনে অনুও জানে সেরকম অহং দেখিয়ে কোনো লাভ নেই। ক্ষণিকের অতিথি হয়ে ফিরে যায় শ্বশুরবাড়িতে; তার বর্তমান এবং ভবিষ্যতের একমাত্র ঠিকানায়।
এরমধ্যে একটা খবর এসে জীবনটাকে সুখের করে তোলে তার। অনু জানতে পারে, সে মা হতে চলেছে। দু’ বাড়িতেই মোটামুটি খুশির জোয়ার বয়ে যায়। সেই প্রথমবার, হ্যাঁ, সেই প্রথমবারের মত বড় বোনকে টেক্কা দিতে পেরে ভীষণ আনন্দিত হয় অনুলেখা। তার সারাজীবনের আফসোস, চারুর চেয়ে এগিয়ে না থাকার, প্রথম এবং শ্রেষ্ঠ হতে না পারার আক্ষেপ, মুছে যায় নিমিষেই!
মাতৃত্বের আনন্দের চেয়ে এই আনন্দটাই ওর কাছে বেশি হয়ে ওঠে তখন। চারুকে সে হারিয়ে দিয়েছে!
____
ক’দিন ধরে অফিসে আসে না আনিকা। কি যে হয়েছে আল্লাহ্ মালুম। এমডি স্যার সেদিন খোঁজ করলেন। সৌভিকের উপর দায়িত্ব পড়েছে মেয়েটার। খবর রাখা আবশ্যিক। ও কল করলো। একবার না, কয়েকবার। ধরবে তো দূর, কল তো গেলই না! সুইচ অফ্ বলছে। বিরক্ত সৌভিক আর কল করল না। এরকম ইরেস্পন্সিবল এমপ্ল্যোই নিয়ে চলা মুশকিল।
ক’ দিন কাটলো। আনিকা তখনো অনুপস্থিত অফিসে। সৌভিক এরমধ্যে যোগাযোগের চেষ্টা করে নি। লাঞ্চ ব্রেকে ওর এক কলিগ রাসেলের কাছেই শুনলো আধো আধো,
— “বুঝলেন, ভাই। অফিসের যে নতুন এমপ্ল্যোই গুলো এসেছে অধিকাংশই কেমন যেন। সব ইরেগুলার, ইরেস্পন্সিবল। এদের নিয়ে যে কি করবো—”
— “কেন? কে আবার কি করলো?”
খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলো সৌভিক। রাসেল শ্রাগ জানালো,
— “আর বলবেন না, ভাই। আমার ঘাড়ে পড়েছে এক উজবুক। এমন বেকুবের বেকুব মাস খানেক ধরে বুঝিয়েও কিছু বুঝাতে পারছি না। ইসস, জীবনডা জ্বালায় ভেজে ভেজে খাচ্ছে—”
রাসেলের আহাজারি শুনে সৌজন্য হাসলো সৌভিক। কিছু বললো না। উনি নিজেই ফের বললেন,
— “আপনার কি অবস্থা? ওই মেয়ে, কি যেন নামটা, আনিতা—আনিশা—”
— “আনিকা।”
সৌভিক শুধরে দিতেই সায় দিলেন,
— “হ্যাঁ, হ্যাঁ। আনিকা। তার কি অবস্থা? দেখতে – শুনতে তো ভালোই মেয়ে। কিন্তু বোধ হয় একটু ঢিলে। খামখেয়ালী টাইপের— না?”
সৌভিক মাথা নাড়ালো,
— “কি জানি, ভাই। অতশত বুঝি না। কিন্তু একটু উইয়ার্ড মেয়ে। কোনো কথা বললে কেমন যেন রিয়েকশন দেয়। চট করে কিছু বোঝে না। কাজে মন নেই। উদাস কিন্তু কাজ ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে খুব উৎফুল্ল। অদ্ভুৎ!”
— “অদ্ভুৎ তো বটেই। কিন্তু মেয়েটা কিন্তু খুব ব্রিলিয়ান্ট। এটা খেয়াল করেছেন? সেদিন আমার একটা প্রবলেম ফট করে সলভ করে দিলো! আ’ম ইমপ্রেসড্!”
রাসেল ভাইয়ের চোখে তৃপ্তি। সৌভিক অনিমেষ চেয়ে লক্ষ্য করলো। আনিকার গুণ শুনে একটু অবাকও হলো। সে বরাবরেই এই মেয়েকে বাতিলের খাতায় ফেলেছে। ওর ধারণা আনিকার মতো উদাস, বেখেয়ালি মেয়েকে দিয়ে আর যাই হোক, কর্পোরেট দুনিয়ায় চাকরী হবে না! এখন শখ করে হয় তো এসেছে, টিকতে পারবে না। কিন্তু সহকর্মীর কথায় অবাক হলো,
— “মেয়েটা ক্রিয়েটিভ আছে, বুঝলেন? কিন্তু কেয়ার করে না। আল্লাহ্ সবসময় অপাত্রেই ভালো জিনিস দান করেন কেন কে জানে!”
সৌভিকের বড় ইচ্ছে করলো জিজ্ঞেস করতে ‘কি এমন গুণ দেখলেন ওই উড়নচণ্ডী মেয়ের মধ্যে? এতো মুগ্ধ গিয়ে গেলেন?’ — কিন্তু জিজ্ঞেস করলো না। অজানা সংকোচ ঘিরে ধরলো। কথা পাল্টে বললো,
— “ও কদিন ধরে অফিসে আসে না কেন, জানেন?”
— “জ্বর এসেছে তো। জানেন না? কাল বসের কাছ থেকে ছুটি নিয়েছে।”
— “ওহ্। জানতাম না।”
ক্লান্ত শ্বাস বিমোচন করলো সৌভিক। সে সত্যিই জানতো না কিছু। মেয়েটা তবে অসুস্থ! সেজন্যই আসে না! সে আরো না জেনে মেয়েটাকে ‘ইরেগুলার, ইরেস্পন্সিবল’ কতকিছু বললো! কাজটা ঠিক হলো না। মেয়েটা অন্যমনস্ক কিন্তু অতটাও খারাপ নয়! ফাঁকিবাজি নেই ওর ভেতর। তারপরেই হঠাৎ মনে হলো, আচ্ছা, সবাই যেটা জানে ও সেটা জানলো না কেন? নিতান্ত আনিকা সম্বন্ধে কিছু জানতে চায় নি, আগ্রহ দেখায় নি বলেই?
___
ছেলের ঘরে যাচ্ছেন নিলুফার নাজিয়া। রাতের খাবার খেতে ডাকছেন সেই কখন থেকে। নিখিলের কোনো পাত্তা নেই। রাগ করে এলেন, ওর কান ধরে টেনে নিয়ে যেতে। ‘রাত কত হয়েছে, সে হুশ আছে? সারারাত কি ভাত নিয়ে আমি বসে থাকবো? আমার আর কাজ নেই?’ — রাগে গজগজ করতে করতে ভেতরে ঢুকলেন তিনি। ঘর ফাঁকা। লাগোয়া বাথরুম থেকে পানির তিরতির শব্দ আসছে। নিখিল ওয়াশরুমে। বিছানায় রাখা ওর ফোন বাজছে। উনি গলা উঁচিয়ে ডাকলেন,
— “এ্যাই ছেলে? বেরোবি না? তাড়াতাড়ি বেরো!”
ভেতর থেকে সাড়া নেই। হয় তো আওয়াজে শুনতে পায় নি। নাজিয়া দু’ সেকেন্ড পর ফের হাঁক দিলেন,
— “এ্যাই নিখিল! শুনছিস?”
ট্যাপ বন্ধ হলো। পানির ঝিরঝিরে শব্দটা কমে এলো। নিখিল জবাব দিলো,
— “হুম। থামো।”
— “থামো মানে? তোর ফোন বাজছে তো। কানে শুনিস না? কল রিসিভ করবে কে?”
একটু বাদেই বিখিলের জবাব,
— “রিসিভ করে দেখো তো কে! আমি গোসল সারছি…”
— “রাত-বিরেতে তোকে গোসল করতে হবে কেন? শুনি! এই শীতে— নিউমোনিয়া হলে দেখিস।”
রাগে গজগজ করতে করতে ফোনের কাছে এগোলেন। অনবরত বেজে চলেছে সেটা। কি এক রিংটোন ব্যবহার করে তার ছেলে। একটানা চ্যানচ্যানে আওয়াজ! উফ্! মাথা ধরে যায়! মুখ কুঁচকে ফোনটা হাতে তুলে নিলেন নাজিয়া। স্ক্রিনে গোল করে ভাসছে একটা মেয়ের ছবি। চমৎকার রূপবতী এক মেয়ে। নিচে ইংরেজিতে লেখা,
“Charulota Jafrin”
কে এই মেয়ে? নিখিলের সঙ্গে চাকরী করে না-কি? কলিগ? ভাবতেই ভেতর থেকে ছেলের গলা শোনা গেলো,
— “আম্মি, রিসিভ করলে? কে এলে?”
— “হুঁ, করছি।”
— “তাড়াতাড়ি করো।”
তাড়া দেয়ায় আর কিছু ভাবলেন না তিনি। স্ক্রিনের জ্বলজ্বলে সবুজ অংশে সোয়াইপ করে সেলফোনটা কানে চাপলেন। ওপাশ থেকে মেয়েলি মিষ্টি স্বর ভেসে এলো,
— “আসসালামু আলাইকুম, নিখিল সাহেব। কেমন আছেন?”
এই কোকিলা কণ্ঠি নারীর পরিচয় কি? জানতে উদগ্রীব হলেন নাজিয়া। সালামের জবাব দিয়ে বললেন,
— “ওয়ালাইকুম আসসালাম। নিখিল নেই, মামণি। আমি ওর মা বলছি।”
কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা। চারু থমকালো। নিখিলের মা বলছে? কেন? নিখিল কোথায়?
— “নিখিল নেই?”
— “ও তো শাওয়ার নিতে গেছে। তুমি কে বললে না তো? ওর কলিগ?”
চারু আবারও সময় নিলো। কি পরিচয় দেবে এখন? নিখিলের বন্ধুর ছোটবোন? ধুর, সে পরিচয়ে আবার কিছু হয়। তবে? সে কি করে বলবে ‘আপনার পুত্রের প্রণয়িনী আমি’? এ কি বলা যায়? একে তো লজ্জার কথা, তার উপরে—
একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে স্বপ্রতিভ গলায় বললো,
— “জ্বি না, আন্টি। আমি চারুলতা জাফরিন। আপনার সঙ্গে কখনো কথা হয় নি আমার। আশা করি ভালো আছেন। একটা প্রয়োজনে কল দিয়েছিলাম। ফিরলে তাকে বলবেন। পরিচয়টা নাহয় উনিই দেবেন!”
বাহ্, মেয়েটার বলবার ভঙ্গি তো দারুণ! নাজিয়ার ভীষণ পছন্দ হলো এই অচেনা মেয়েকে। কলিগ নয় তবে এ কে? নিখিল প্রেম করছে? ও-মা! ‘তুমি কি ওর প্রেমিকা?’ — প্রশ্নটা করতে গিয়েও করা হলো না, ওপাশ থেকে মেয়েটার নির্মল ঝরঝরে কণ্ঠ,
— “রাখছি, কেমন? ভালো থাকবেন আন্টি!”
কল কেটে গেল। বিস্ময়াহত নাজিয়া স্ক্রিনের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতেই ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো নিখিল। হাতের টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে মার উদ্দেশ্যে বললো,
— “কে কল দিয়েছিল, মা? বললে না?”
সেলফোনটা পূর্বের স্থানে রেখে ছেলের দিকে সরু চোখে তাকালেন,
— “চারুলতা জাফরিন কে রে? কল দিয়েছিল!”
হুট করে মায়ের কথা শুনে চমকে উঠলো নিখিল। ত্বরিত কর্মরত হাত দু’ খানি থেমে গেল। বিমূঢ় বনে নিস্পলক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো তার দিকে। নাজিয়া এগিয়ে এলেন কয়েক পা। কোমড়ে হাত রেখে বললেন,
— “তুই প্রেম করছিস, বলিস নি কেন হুঁ?”
মার বলার ধরণ দেখেই হেসে ফেললো নিখিল। যদিও হাসা উচিৎ না। কঠিন পরিস্থিতি। তবুও হাসি আটকানো গেল না।
নাজিয়া থমথমে মুখে বললেন,
— “হাসছিস কেন, বজ্জাত ছেলে!”
— “তুমি এমন অ্যাটম বোlমের মতো ফুলে আছো কেন মা? কি হাস্যকর দেখাচ্ছে জানো?”
হাসতে হাসতে বললো নিখিল। নাজিয়া রাগে ফেটে চৌচির,
— “বদমাশ! ঢং করবি না কিন্তু। আসল কথা বল আগে! কতোদিন ধরে চলছে এসব? শুধু প্রেম না বিয়েও করে রেখেছিস? হুঁ?”
হুংকার দিয়ে উঠলেন। নিখিল এসে মাকে আগলে নিল। পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
— “বলছি তো। হাইপার হচ্ছো কেন?”
— “না, আগে বল। বিয়ে করেছিস? না শুধু প্রেম— বল।”
তেঁতে উঠলেন। নিখিল হাসলো,
— “তুমি যে কি-না, আম্মু! বিয়ে করবো কেন? তাও তোমায় না জানিয়ে, একটু আধটু কথা হয়—”
— “কবে থেকে? বলিস নি কেন আমাকে?”
ক্রোধানল কমলো জননীর। বদৌলতে অভিমানি কণ্ঠে অনুযোগ করলেন। নিখিল শান্ত করবার চেষ্টা করলো তাকে,
— “বেশিদিন হয় নি। আমি জানাতাম তোমাকে। কিন্তু—”
— “জানাতি, না? মিথ্যুক!”
— “ওওও মা! শোনো তো—”
মাকে বুঝিয়ে খাবার ঘরের দিকে এগোলো নিখিল। খেতে খেতে ধীরে-সুস্থে বলবে সব।
চলবে___
#মৌরিন_আহমেদ