#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_২৫
ছেলের প্লেটে খাবার সাজাতে সাজাতে অধৈর্য মাতা ফের শুধালেন,
— “হ্যাঁ রে, বাবু? বললি না তো মেয়েটা কে?”
মার কথায় লজ্জা পেল নিখিল। এভাবে মায়ের সামনে প্রেমিকার কথা বলা যায় নাকি? কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
— “আগে খাবারটা দাও, আম্মি। ছেলেকে ভুখা পেটে এসব কথা জিজ্ঞেস করো না! বিরক্ত লাগে।”
নাজিয়া শব্দ করে প্লেটটা ঠেলে দিলেন। সাপের মতো ফোঁস করে উঠে বললেন,
— “বিরক্ত লাগে, না? আমি কিছু জিজ্ঞেস করলেই খুব বিরক্ত লাগে? আর ফোনে যখন প্রেমিকার সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্যাঁচাল পারো তখন কিছু হয় না? হুঁ?”
হতাশ শ্বাস ফেলে নিখিল,
— “চারু আমার সেরকম প্রেমিকা নয়!”
— “তো কি রকম শুনি?”
— “বলছি।…”
বলেই প্লেট টেনে নিয়ে খেতে শুরু করলো। নাজিয়া রাগি মুখে ছেলের দিকে চেয়ে রইলেন। অকারণে তরকারির বাটি টানাটানি করলেন, চামচ দিয়ে ঘুঁটঘাঁট করলেন। গ্লাসে পানি ঢেলে রেখে দিলেন। কিন্তু সহিষ্ণু হতে পারলেন না। তার এই নটাংকি ছেলে যে কি করছে! কেন যে বলছে না!
খেতে খেতে একবার মুখ তুলে তাকালো নিখিল। মার অস্থিরপানা মুখখানি দেখে শীতল সুরে বললো,
— “কথাগুলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ, আম্মি। খেতে খেতে বলবার মত হাল্কা নয়। আমি খাচ্ছি, সঙ্গে তুমিও খেয়ে নাও। তারপর আমরা ঠাণ্ডা মাথায় কথা বলবো।”
নাজিয়া দিরুক্ত করতে চেয়েছিলেন। ছেলের গম্ভীর চেহারা দেখে কেন যেন কিছু বলতে ইচ্ছে করলো না। সুস্থির হয়ে খেতে বসলেন।
খাওয়ার পর্ব সেরে বসার ঘরে গিয়ে টেলিভিশন ছেড়ে বসলো নিখিল। রান্নাঘর গুছিয়ে দ্রুতই সেখানে উপস্থিত হলেন নিলুফার নাজিয়া। এসেই চঞ্চল চিত্তে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
— “তুই কি এখন বলবি? শোন, নিখিল। অনেকক্ষণ ধরে ধানাই-পানাই দেখছি তোর। আর কিন্তু সহ্য হচ্ছে না…”
— “বলছি, আম্মি। শান্ত হয়ে বসো।”
রিমোট চেপে টেলিভিশন বন্ধ করলো। মায়ের একহাত ধরে টেনে পাশে বসিয়ে দিলো। নাজিয়া বসেই ফের বললেন,
— “ঝটপট বল। কোনো কাহিনী করবি না!”
লম্বা দম নিয়ে বলা শুরু করলো নিখিল,
— “চারুলতা জাফরিন। আজমীর রাজার বড় কন্যা। আহাদ রাজা’র বড় নাতনি। তার দাদার নামটা তুমি শুনেছ, তাই উল্লেখ করলাম। আহাদ এ্যাম্পোরিয়ামকে তো চেনোই। তোমার শাড়ি কেনার দোকান। সেই বাড়ির মেয়ে চারু। ওর আরেকটা পরিচয় হলো, সৌভিকের ছোট বোন সে। গত ছুটিতে সৌভিকদের বাড়িতে গিয়ে প্রথম পরিচয় হয়।”
— “সৌভিকের বোন? সত্যিই? দেখতে কেমন? তোর ফোনে আবছা ছবি দেখলাম। বুঝি নি। তুই বল, কেমন দেখতে? ভাইয়ের মতই সুন্দর? অবশ্য তা-না হওয়ারই সম্ভবনা বেশি। যে পরিবারের ছেলেরা সুন্দর, নায়ক নায়ক হয়, সেই পরিবারের মেয়েগুলো হয় একেকটা বান্দর। পরীক্ষিত সত্য… যাইহোক, মেয়ের বয়স কেমন?”
একসঙ্গে এত কথা বলে তবেই থামলেন নাজিয়া। মায়ের উত্তেজনা টের পেল নিখিল। হেসে জানালো,
— “সব ক্ষেত্রে ‘পরীক্ষিত সত্য’ খাটে না, আম্মি। কিছুক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আছে। সৌভিকের সব ভাই-বোনরাই তামিল সিনেমার নায়ক – নায়িকার মত সুন্দর। তারমধ্যে চারু হলো বেস্ট। ওর লাবণ্য মাখা মুখ দেখলেই তোমার মন ভালো হয়ে যাবে! ট্রাস্ট মি, এত্তো মিষ্টি ও!”
— “হয়েছে, হয়েছে। এ বয়সে ডায়েবেটিস বাঁধাতে চাই না। মেয়ের বয়স বল। তোর চেয়ে ছোট তো? মিনিমাম পাঁচ বছরের ছোট না হলে কিন্তু সংসারে ভালো হবে না—”
— “আমি ওর সঠিক বয়স জানি না। তবে চব্বিশ অথবা পঁচিশ হবে।”
— “সে কি, তোরই তো আঠাশ! বয়সের ডিসটেন্স এতো কম হলে—”
— “আম্মি! আজকাল বয়সে কি হয়?”
মাঝপথে বাঁধা দিলো নিখিল। নাজিয়া দম ফেলে পুনরায় বললেন,
— “মেয়ে রান্নাবান্না, কাজকর্ম সব জানে তো? তাকে তোর ফ্যামিলী নিয়ে বলেছিস? দেখিস, বিয়ের পর যেন এসে না বলে, আমার সঙ্গে থাকবে না। সংসার আলাদা করবে! আমার একটা মাত্র ছেলে! তাকে কিন্তু আমি বৌ নিয়ে আলাদা হতে দেব না—”
তাকে আর কিছু বলতে দিলো না নিখিল। হাত ধরে কোমল গলায় আশ্বস্ত করলো,
— “তোমার ছেলে সবসময়ই তোমার থাকবে। ভয় পেয় না তুমি। চারু অমন মেয়ে নয়! তুমি ওর সঙ্গে একবার পরিচয় হলেই বুঝবে!”
— “কবে করাবি পরিচয়?”
আবদারি সুর তার। নিখিল হাসলো,
— “সরাসরি সাক্ষাৎ তো এখন হবে না; আমি বরং তোমাদের ভার্চুয়াল মিটিং সেট করে দেই, কেমন? পরশু কথা বলিয়ে দেব।”
— “পরশুই তো? মনে থাকে যেন!”
— “আচ্ছা।”
সায় দিলো বাধ্য ছেলের ন্যায়। অতঃপর আরও টুকটাক কিছু আলাপ সেরে মাকে ঘুমোতে পাঠিয়ে দিলো।
নাজিয়া চলে যেতেই হাঁফ ছাড়লো নিখিল। এতক্ষণ অদ্ভুত এক আতঙ্কে সময় কাটাচ্ছিল সে। বারেবারে মনে হচ্ছিল এই বুঝি মা ক্ষেপে যায়! এই বুঝি রেগে বলেন, ‘না, আমি চারুকে মানি না!’ তখন কি হতো? মা আর চারু কাকে বেছে নিত সে?
এ জগতে মা ছাড়া ওর কেউ কি আছে? আর চারু ছাড়া ভালোবাসা? সেও তো হয় না। কিন্তু মার প্রতিক্রিয়া দেখে সে তৃপ্ত হয়েছে। চারুকে মা ঠিক মেনেছেন। শুধু তার মুখে শুনেই। এখন পরিচয় হলেই আর দ্বিধা থাকবে না!
কিন্তু সমস্যা সেখানে নয়। নিখিলের মনে ভয় আছে অন্য কিছু নিয়ে। আর সেটা হলো, চারুর অতীত। মা যদি চারুর অতীত প্রসঙ্গে কিছু বলেন? বিয়ে কোনো ছেলেখেলা নয়। লুকোছাপা এখানে চলে না। কথা এগোলে চারুর অতীত নাজিয়া ঠিকই জানবেন। তবে তার আগে চারুর সঙ্গে তার সখ্যতা হওয়া দরকার। চারুকে একবার দেখলে নাজিয়া মা কখনোই তাকে দোষী বলবেন না, এ নিখিলের দৃঢ় বিশ্বাস। তার মাকে তো সে চেনে!
___
লিফটের দরজা খুলতেই একটু চমকে গেল সৌভিক। আনিকা দাড়িয়ে। সর্বাঙ্গ কালো রঙের পোশাকে মোড়ানো, মুখখানি রুগ্ন, ফ্যাকাশে। বেশ কিছুদিন পর এই মেয়েটার সঙ্গে দেখা হলো ওর। অসুস্থতায় লিভ নিয়েছিল সে। আজ থেকেই যে কাজে ফিরবে সৌভিক জানত না। ওকে দেখে অবাকই হলো। বললো,
— “আপনি? এতদিন পর?”
— “ছুটি নিয়েছিলাম, স্যার।”
নম্র মুখে বললো। সৌভিক মাথা নাড়ালো,
— “শুনেছি। অসুস্থ ছিলেন। তো এখন সব ঠিক হয়েছে?”
— “জ-জ্বি।”
— “আচ্ছা, ভালো। কাজে যান।”
আনিকা মাথা নাড়িয়ে এগিয়ে গেল। সৌভিক সূক্ষ্ম চোখে ওর যাওয়া দেখলো। লিফটে ওঠা ছেড়ে, পেছন ফিরে মেয়েটার দিকে চেয়ে রইল অনিমেষ। অদ্ভুত কারণে তার মনটা অশান্ত হয়েছে। কেমন একটা উচাটন লাগছে ভেতরে ভেতরে। এতক্ষণ কিন্তু ব্যাপারটা হয় নি। এখনই হঠাৎ হচ্ছে কেন বুঝলো না। কারণটা ধরতেই আনিকার দিকে চেয়ে থাকা। কোনোভাবে কি ওর সঙ্গে তার ইন্দ্রিয়ের সম্পর্ক আছে?
এরপর সারাদিন আনিকার সঙ্গেই থাকতে হলো ওকে। আনিকা অফিসে নতুন বিধায় এক মাস তার আন্ডারেই থাকবে। আজ সৌভিক অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো, মেয়েটা বদলেছে। সবসময়ের ‘বেখেয়ালি আনিকা’ যেন এ নয়। যে যা বলছে, করছে। মন দিয়ে সবার কথা শুনছে। কোনো অদ্ভুতুড়ে আচরণ নেই। উড়নচণ্ডী ভাব নেই। সব কেমন শান্ত, নির্মল। দুপুরে একটা মিটিং ছিল। সেই মিটিংয়ে প্রেজেন্টেশন দেয়ার ছিল ওর। সেখানেই আরও বিস্ময়কর ব্যাপার লক্ষ্য করলো সৌভিক। আধ ঘণ্টার লম্বা সময়টা সে সহ রুমে উপস্থিত বাকি সবাই মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো ওর দিকে। কারণ তুখোড় মেধাবী মেয়েটা তখন জাদুকরী বাচন ভঙ্গিতে মোহগ্রস্ত করে রেখে সবাইকে!
বিকেলে চারুর সঙ্গে নিখিল তার মাকে পরিচয় করিয়ে দিলো। ছেলে তার কেমন মেয়েকে পছন্দ করে, তাকে দেখতে বেশ উতলা হয়ে ছিলেন নিলুফার নাজিয়া। সাক্ষাৎ তো আর সম্ভব নয়, ভিডিও কলেই আলাপ সারা হলো। ছেলেকে তুলে দিয়ে, ঠেলেঠুলে বের করে দিয়ে, ল্যাপটপ নিয়ে নাজিয়া বসে পড়লেন গল্প করতে।
— “তুই যা তো, নিখিল। আমি চারুর সঙ্গে কথা বলি।”
— “হ্যাঁ, এখন তো যেতে বলবেই। আমি তো ফেলনা হয়ে গেলাম—”
কপট রাগ দেখালো সে। নাজিয়া হাসলেন ছেলের গাল ফুলানো দেখে,
— “হিংসে করছিস কেন? তুই যা বাইরে। আমি একটু কথা বলি?”
— “বলো। বলো। আমাকে বের করে দিয়ে একা কথা বলো!”
তেজ দেখিয়েই বেরিয়ে গেল। এবার জোরেই হেসে উঠলেন নাজিয়া। কলের ওপ্রান্তে, সাড়ে তিনশো কিলোমিটার দূরে অরুণা ম্যানশনে নিজের ছোট্ট কক্ষের বিছানায় বসে বসে মা – ছেলের অবস্থা দেখে চারুও হেসে উঠলো তাল মিলিয়ে। হাসি থামিয়ে নাজিয়ার মন্তব্য,
— “দেখেছ, তোমার বরটা কেমন হিংসুটে? শুধু কথা বলছি বলেই কি জ্বলছে!”
নিখিল ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিল। সেভাবেই জবাব দিলো,
— “কি জ্বলছে? কার জ্বলছে? আমার কোনো জ্বলন-টলন নেই! কথা বানাবে না কিন্তু—”
সেই প্রতিবাদী স্বর কানে আসতেই আরেকদফায় হাসাহাসি শুরু হলো দুই প্রান্তের দুই নারীর। তাদের মধুময় অট্টহাসি শুনে অজান্তেই মন ভালো হয়ে গেল নিখিলের। শার্ট গায়ে জড়িয়ে, কব্জির উপরে ঘড়িটা পরতে পরতে প্রশান্তির হাওয়া বয়ে গেল বুক জুড়ে! আহা, এই সুখ কবে চিরস্থায়ী হয়ে আসবে তার জীবনে?
__
ব্রেক টাইমে বহুদিন পর বন্ধুর সঙ্গে লাঞ্চ শেয়ার করলো সৌভিক। নিখিল তখন একা একা নিজের মত খাচ্ছিল। হুট করে চোখ তুলে তাকাতেই সম্মুখে সৌভিককে দেখতে পেল। খাবারের প্লেট হাতে সে হাসি হাসি মুখ করে বসে আছে। নিখিল কিছু বললো না। মুখ নামিয়ে খাওয়ায় মন দিলো। সৌভিকও ব্যস্ত হলো খাওয়ায়। সে নিজে থেকে এগিয়েছে একধাপ। নিখিলের কি উচিৎ নয় সহযোগিতা করা?
খানিক বাদে নিজের লাঞ্চ বক্সটা ঠেলে সামনে এগিয়ে দিলো নিখিল। শব্দে ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই হাসলো,
— “ধর, টেস্ট কর। মা বানিয়েছে।”
সৌভিক কয়েক পল্ ভাবলো। বক্স থেকে বিরিয়ানির সুঘ্রাণ আসছে। নাজু আন্টির রান্না!
বরাবরই তার রান্নার ফ্যান সৌভিক। প্রতি উৎসব-পর্বেই আন্টি দারুণসব রেসিপি করে পাঠান নিখিলের দ্বারা। সেসব এতোই সুস্বাদু আঙুল পর্যন্ত কামড়ে খেয়ে নিতে ইচ্ছে করে ওর। আজ তাই মিস করা যায়? জলদিই চামচ ভরে মুখে পুরলো সৌভিক। তৃপ্তি সূচক ‘উমম্ উমম্’ করতে করতে নিখিলের দিকে চোখ পড়তেই একটু থামলো। নিখিল সব মেনে নিয়েছে?
প্রশ্নটা মাথায় আসতেই বললো,
— “তুই রেগে আছিস এখনও?”
— “রাগলে বিরিয়ানির অফার দিতাম?”
হাসলো নিখিল। থমথমে মুখে চেয়ে থাকা বন্ধুর কাঁধ চাপড়ে বললো,
— “আমি তোর উপরে কখনো রাগ করি নি, দোস্ত। তোর পরিস্থিতিতে নিজেকে দাড় করিয়ে আমি বুঝেছি, সব মেনে নেয়া তোর জন্য সহজ নয়। গড়মেলে জটিল। তবে তুই সবকিছু মেনে নিয়েছিস, তাতে আমি খুশি।”
— “মেনে না নিয়ে উপায় আছে? কিছুই যে আমার অনুকূলে নয়!”
অন্যমনস্ক চোখে চেয়ে বিড়বিড় করলো সৌভিক। নিখিল সেই মৃদু গুঞ্জন শুনতে পেল না। সে নিজের খুশি জাহির করে বললো,
— “আজকে আমি অনেক খুশি, দোস্ত। ভীষণ খুশি!”
চলবে___
#মৌরিন_আহমেদ
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/