কথা দিলাম 🌸❤️ ||পর্ব ~ ১৪|| @কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা

0
161

কথা দিলাম 🌸❤️
||পর্ব ~ ১৪||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা

সিয়ারা আধভিকের থেকে সরে এসে চলে যেতে নেয়। দু পা এগোতেই আধভিক বলে ওঠে….

আধভিক: তাই জন্য তুমি আবার আমাকে একা করে দেবে সিয়ু! মায়ের মতো তুমিও আমাকে ছেড়ে চলে যাবে?

সিয়ারা ভাষা হারিয়ে ফেলে আধভিকের কথা শুনে। সে স্পষ্ট দেখতে পায় আধভিকের চোখে জল। আজকে সকালেই সে বুঝতে পেরেছিলো আধভিকের মনে কষ্ট আছে কিন্তু এতটা গভীরে সেটা, এটার আন্দাজ ছিলো না।

আধভিক: আমি কখনও কাওর সাথে ঠিক ভাবে মিশে উঠতে পারিনি। কারণ আমি পারিনা সবার সাথে মিশতে। আর দেখো, যাদের সাথে আমি মিশতে চাই, যাদের আকড়ে ধরে বাঁচতে চাই তারাই আমাকে ছেড়ে চলে যায়। (তাচ্ছিল্য হেসে) মা কে হারানোর পর থেকে যেই মানুষটাকে সব থেকে পাশে পেতে চেয়েছিলাম তাঁরই আমার জন্য সময় ছিলো না। কাছে টেনে নেওয়ার বদলে দূরে ঠেলে দিয়েছে আমাকে।

সিয়ারা এগিয়ে আসে আধভিকের দিকে। আধভিক মাথা তুলে সিয়ারার দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করে,

আধভিক: সেই থেকে আমার একা পথ চলা শুরু। এতগুলো বছর পর তোমায় প্রথম যেদিন দেখেছিলাম সেদিনই তোমার একটা প্রতিচ্ছবি আমার মনে তৈরী হয়। আমি নিজেও জানি না আমি কেন তোমার দিকে সেদিন তাকিয়ে ছিলাম, তুমি চলে যাওয়ার পরে আমার শুধু তোমাকেই দেখতে ইচ্ছা হচ্ছিলো। আগে কখনও এমনটা হয়নি। পাগলের মতো খুঁজেছি তোমাকে সব জায়গায়।

আধভিক চুপ করে যায়। তাঁর কথাগুলো জড়িয়ে আসছে। সে নীচের দিকে তাকিয়ে থাকলে হঠাৎই নিজের বাহুতে সিয়ারার হাতের স্পর্শ পায়। সিয়ারার দিকে তাকালে সিয়ারা বলে,

সিয়ারা: মিশতে পারেন না কিন্তু এইসব ছাইপাশ কে সঙ্গী ঠিকই বানাতে পারেন।

আধভিক: এইগুলো কখনও ছেড়ে যায়নি আমাকে।

সিয়ারা: আপনার একাকীত্ব কাটাতে কি পেরেছে?

আধভিক: এমন কিছু এক্সিস্টই করে না পৃথিবীতে। আমার জন্য আমার মা ছাড়া না কোনোদিন কেউ ছিল, আর না কোনোদিন থাকবে।

সিয়ারা: (রেগে) তাহলে কেন এসেছেন আমার কাছে? এতক্ষণ এইসব কেন বললেন?

আধভিক: তু..তুমিই তো বললে আমাকে চলে যেতে। আর ফিরে আসতে না তোমার কাছে। (বাচ্চাদের মত করে)

আধভিককে বাচ্চাদের মত ভয় পেতে দেখে সিয়া রার হাসি পেলেও সে হাসলো না। রাগী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

সিয়ারা: অমনি আমার দোষ তাই না? আপনিই তো আমাকে বললেন যে আমি আপনার প্রায়োরিটি পাওয়ার যোগ্য নই।

আধভিক: আমি বলতে চাইনি বিশ্বাস করো। তোমার কথাগুলো শুনে মাথা ঠিক রাখতে পারিনি। অনেক চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু…

সিয়ারা: থাক! হয়েছে। আগে বলুন, এই অবস্থায় আপনি গাড়ি কেন চালাচ্ছেন? ড্রাইভারের অভাব হয়েছে আপনার?

আধভিক: (মুচকি হেসে) আমি নিজের গাড়ি নিজেই ড্রাইভ করতে পছন্দ করি।

সিয়ারা: সেই। তারপর কোনো দুর্ঘটনা ঘটে গেলে? কতোটা নেশায় রয়েছেন আপনি জানেন?

আধভিক: এইসব আমার রোজকার সিডিউল সিয়ু। বরং অন্যদিনের তুলনায় আজকে একটু বেশিই খেয়েছি। কিন্তু তারপরে তোমাকে এভাবে দেখে সব নেশা কেটে যাচ্ছে কেমন জানো। (সিয়ারার গালে আঙুল রেখে)

আধভিক হঠাৎ করে এভাবে কাছে চলে আসবে এটা বুঝতে পারেনি সিয়ারা। বুকের ধুকপুকানি এতোটাই বেড়ে গেছে যার ফলে সিয়ারার মনে হচ্ছে ওর হার্টটা বোধহয় এক্ষুনি বাইরে বেরিয়ে আসবে।

সিয়ারা: আপনি আমার বাড়ি চিনলেন কীভাবে?

আধভিক: যেখানে তোমার নাম না জেনে, ছবি না থাকা সত্বেও তোমাকে খুঁজে পেয়ে গেছি সেখানে তোমার ঠিকানা পাওয়াটা আমার কাছে বড়ো বিষয় না। এইবার তো তোমার ঠিকানা আমার মাঝে হবে, এখানে।

আধভিক হাত দিয়ে বাম পাশের বুকে রেখে ইশারা করলে সিয়ারা লাজুক হেসে মাথা নামিয়ে নেয়। তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,

সিয়ারা: এতটাও সোজা না মিস্টার আর সি কোলা। আমি এতো সহজে আপনাকে একসেপ্ট করবো ভাবলেন কীভাবে?

আধভিক: তা..তাহলে? (কাচুমাচু করে)

সিয়ারা: আপনাকে এখনও অনেক পরীক্ষা দিতে হবে। পাশ করলে তবেই আমাকে পাবেন নাহলে…

আধভিক: নাহলে আমার মুখ তুমি কখনও দেখতে পাবে না। কথা দিলাম!

সিয়ারা: বড্ড আজে বাজে কথা বলেন আপনি। আপনাকে দেখতে না পেলে শাস্তি দেব কীভাবে হ্যাঁ? পরীক্ষায় পাশ না করলে শাস্তি পেতে হবে। এতো ভালো ভালো কথা বলে পরীক্ষায় পাশ না করলে শাস্তি দেবো না ভাবছেন? দিন এবার হাতটা দিন।

আধভিকের হাতটা নিয়ে সিয়ারা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ওর হাতের দিকে। এখন ঘরে গিয়ে ফার্স্ট এইড বক্স বার করতে গেলে সময় লাগবে। তাই নিজের ওড়নাটা ছিড়ে, আধভিকের হাতে বেঁধে দিলো।

সিয়ারা: দয়া করে এবার এক হাত দিয়ে ড্রাইভ করবেন না আর বাড়ি গিয়ে ড্রেসিং করে নেবেন মনে করে। নিন, এবার যান। কেউ দেখতে পেলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।

আধভিক বাধ্য ছেলের মতো কথা শুনে গাড়িতে বসতে নিলে সিয়ারা বলে ওঠে,

সিয়ারা: আপনার নাম্বারটা দেবেন?

আধভিক অবাক চোখে সিয়ারার দিকে ফিরলে সিয়ারা একটু ইতস্তত বোধ করে। কেন জানো ওর মন চাইছে না আধভিককে কোনরকম অজুহাত দিতে। আবার সত্যিটা বলতেও ওর লজ্জা লাগছে।

আধভিক: তোমার নাম্বারে কল করো। (নিজের ফোনটা এগিয়ে)

সিয়ারা কিছু না বলে চুপচাপ নিজের নাম্বার ডায়াল করে কল করে। একবার রিং করেই ছেড়ে দেয়। আধভিককে ফোনটা ফেরত দিতে গিয়ে আধভিকের চাহুনি দেখে চোখ নামিয়ে নেয় আর বলে,

সিয়ারা: যান এবার। সাবধানে যাবেন। পৌঁছে টেক্সট করবেন।

আধভিক: এইটাই তো চাইছিলাম আমি সিয়ু!

আধভিকের মুখ থেকে নিজের নামটা নতুন রূপে শুনে বেশ ভালোই লাগছে সিয়ারার। সেই ভালো লাগা নিজের মনে মধ্যে চেপে রেখেই আধভিককে সে জোর করে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। আধভিক বেরিয়ে গেলে চারপাশটা একবার দেখে দৌঁড়ে নিজের ঘরে গিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে ফেলে সিয়ারা। কানে বাজছে, ওর জন্য আধভিকের অনুভূতির বিশ্লেষণ।

সিয়ারা: আজ যেই ঘটনাটা ঘটেছে, তাতেই তুমি পাশ করে গেছো আধভিক। আমি তোমাকে কথাটা বললাম কারণ আমি তোমার বিষয়ে সম্পূর্ণ জানতে চাই, তোমাকে পুরোপুরি চিনতে চাই। সম্পর্কে যাওয়ার পর জানতে গেলে তুমি কষ্ট পাবে। আমি তোমাকে আর কোনো কষ্ট দিতে চাই না। তোমার কষ্টগুলো জেনে, ভাগ নিতে চাই সেই কষ্টের।

সিয়ারার মনটা ভালো হয়ে যাওয়ায় সিয়ারা কাগজ পেন্সিল নিয়ে ড্র করা শুরু করে। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ মেসেজের নোটিফিকেশন আসলে দেখে আধভিক এসএমএস করেছে, সে বাড়ি পৌঁছে গেছে। আধভিককে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পরতে বলে সিয়ারা নিজের ড্রয়িং কমপ্লিট করে নেয় তারপর গিয়ে শুয়ে পরে।

পরেরদিন,

সিয়ারা এনজিও তে বাচ্চাদের টাস্ক দিয়ে ফোন হাতে নিয়ে বসে আছে। ভাবছে আধভিককে কল করবে কি না। সেই যে রাতে মেসেজ করেছিলো তারপর “হম” বলার পর আর কোনো মেসেজ আসেনি আধভিকের তরফ থেকে। সিয়ারা সকালে একবার হাতের খোঁজ নিয়ে মেসেজ করার পরেও কোনো রিপ্লাই আসেনি। তাই সে ভাবছে কল করাটা ঠিক হবে কি না। সেই সময় হঠাৎ করে একটা বাচ্চা বলে ওঠে,

“দিদি দেখো আগের দিন যে দাদাটা এসেছিলো সেই দাদাটা এসেছে।”

সিয়ারা সামনে তাকাতেই দেখে আধভিক দাঁড়িয়ে আছে ওর দিকে তাকিয়ে। আস্তে আস্তে ওর দিকে এগিয়ে এসে বলে,

আধভিক: আমাকে মিস করছিলেন নাকি ম্যাডাম?

সিয়ারা: আপনাকে আমি কেন মিস করতে যাবো? এমন, এমন কিছুই না। (অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে)

সিয়ারা অন্যদিকে ফিরে ঠোঁট চেপে নিজের হাসি আড়াল করলো। আধভিক ওর সামনে এসে দাঁড়ালে ও স্বাভাবিক হয়ে বলে,

সিয়ারা: আজকে আমি ওদের পড়িয়ে তবেই বেড়াবো।

আধভিক: হ্যাঁ, তো আমি কখন বললাম তুমি আমার সাথে বেড়াবে? (মুচকি হেসে)

সিয়ারা: (মনে মনে জিভ কেটে — উফ সিয়া তুইও না। উত্তেজনার বশে কি যে বলে ফেলিস।) আমি কখন বললাম আপনার সাথে বেড়াবো। আমি তো আমার বাড়ি যাওয়ার জন্য বেড়ানোর কথা বলছিলাম।

আধভিক: তাই বুঝি?

সিয়ারা: হ্যাঁ তাই! (জোর দিয়ে) উফ! যান তো। কাজ আছে আমার।

কোনো মতে আধভিককে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায় সিয়ারা। আধভিক সবটা বুঝেও চুপটি করে থাকে। সিয়ারার পড়ানো হয় গেলে সে সিয়ারাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে যায় কিন্তু সিয়ারার তা পছন্দ নয়, যা আধভিক জানতো। কিন্তু অনেকবার জিজ্ঞেস করার পরেও যখন সিয়ারা নিজের পছন্দের জায়গার নাম বললো না তখন আধভিক এই কায়দা বার করলো। আধভিকের প্ল্যান সফল হলে সিয়ারা আধভিককে নিয়ে চলে যায় বাগবাজার ঘাটে। সেখান সময় কাটিয়ে সিয়ারাকে বাড়ির কাছে ছেড়ে দিয়ে নিজে বাড়ি ফিরে আসে।

এক মাস পর,

এই এক মাসে সিয়ারা আর আধভিক একে অপরকে জেনেছে, চিনেছে। আধভিক যা বুঝতো না তা বুঝতে শিখেছে আর সিয়ারা আধবিকের সাথে, আধভিকের জীবনের সাথে একটু একটু করে জড়িয়ে পরেছে। এরই মাঝে একদিন হঠাৎ করেই সিয়ারার এনজিও তে আধভিকের বাবা আভাস বাবু এসে উপস্থিত হন।

সিয়ারা: স্যার আপনি? আপনি এখানে?

আভাস বাবু: হ্যাঁ। তোমার সাথে কিছু জরুরী কথা ছিলো। তোমার কি এখন সময় হবে?

সিয়ারা ঘাবড়ে গেলো আভাস বাবুর গম্ভীর গলায় স্বর শুনে। ভয় পেতে শুরু করলো ও এই ভেবে যে, হয়তো ওর আর আধভিকের সম্পর্ক নিয়ে কিছু বলবেন। হয়তো কি? উনি সেটাই বলতে এসেছেন নাহলে আর কিবা দরকার থাকতে পারে ওর সাথে আভাস বাবুর। তাহলে কি, তাহলে কি উনি আধভিকের থেকে দূরে সরে যেতে বলবে ওকে?

সিয়ারা: হ্যাঁ। আসুন আমার সাথে।

সিয়ারা বাচ্চাদের একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন আভাস বাবুকে। জলের গ্লাসটা ওনার হাতে দেওয়ার পর আঙুল কচলাতে শুরু করলো সিয়ারা। আভাস বাবু এক ঢোঁক জল গিলে নিয়ে বললেন,

আভাস বাবু: এতো ভয় পাওয়ার কিছু হয়নি সিয়া মা। আমি তোমার কাছে কিছু চাইতে এসেছি।

সিয়ারা: আ..আমি আপনাকে কি দিতে পারি? আপনাকে কিছু দেওয়ার মতো সামর্থ্য যে আমার নেই।

আভাস বাবু: নেই কি বলছো? তুমি যে আমাকে দিয়ে ফেলেছো।

সিয়ারা: ম..মানে? আমি বুঝতে পারছি না আপনার কথা।

আভাস বাবু: (কিঞ্চিৎ হেসে) তুমি আমাকে আমার ছেলে ফিরিয়ে দিয়েছো। আমার ভিকিকে ফিরিয়ে দিয়েছো।

সিয়ারা অবাক হয়ে যায় আভাস বাবুর কথা শুনে। ও ভেবেছিলো কি আর আভাস বাবু বললেন কি।

আভাস বাবু: বিশ্বাস করো, এর আগে আমি ওকে এতটা খুশি দেখিনি। যেদিন থেকে তুমি এসেছো সেদিন থেকে আমার ছেলেটার মুখে সবসময় হাসি লেগেই রয়েছে। আজ অবধি যেই কাজের ধারে কাছেও যায়নি সেই কাজ ও করছে। আবার যা ওর নিত্যদিনের অভ্যেস ছিলো। হাজার বলেও যা আমি ছাড়াতে পারিনি সেটা তুমি করে দেখিয়েছো। তুমি বুঝতে পারছো নিশ্চয় আমি কি বলছি?

সিয়ারা হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়তেই আভাস বাবু হাসি মুখে উঠে দাঁড়ালেন। সিয়ারার দিকে এগিয়ে গিয়ে ওর মাথায় হাত রেখে হাসিমুখে বললেন,

আভাস বাবু: ও যে এভাবে কখনও বদলে যাবে তার ধারণা আমার ছিলো না, বলতে পারো কল্পনা করিনি কখনও। তোমার কাছে আমার একটাই অনুরোধ, তুমি ওকে ছেড়ে যেও না কখনও। তাহলে হয়তো ও আবার আগের মত হয়ে যাবে, একা। আমার ছেলেটা বড়ো একাচোরা। এতদিনে তুমি বুঝে গেছো ওকে ভালো ভাবে তা আমি জানি। তাই তোমাকে আজকে বলতে এসেছি, ভেবোনা আমি তোমাকে জোর করছি।

সিয়ারা হাসিমুখে কিছু বলতে যাবে তার আগেই দরজার কাছ থেকে প্রশ্ন আসে,

আধভিক: তুমি এখানে কি করছ ড্যাড? (সন্দিহান দৃষ্টিতে)

[#ফিরে_আসবো_আগামী_পর্বে🥀]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here