#কাননে_এত_ফুল (পর্ব-২)
লেখক– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
৩.
মৃদুল ভাইয়ের মেজাজ প্রচুর গরম। আমাকে পরপর তিনবার কফি বানিয়ে আনতে হয়েছে। তার নাকি কফি খেলেই মেজাজ ঠান্ডা হবে। আমি বুঝিনা! কফি তো গরম জিনিস। গরম জিনিস খেলে কী আর গরম মেজাজ ঠান্ডা হবে? মেজাজ ঠান্ডা করতে হলে তো একগ্লাস ঠান্ডা পানি বা একটা চকোলেট কোন আইসক্রীম খেলেই হয়। তবে মৃদুল ভাই সেটা তো করছেন না বরং আগুনে আরো বেশি করে কেরোসিন ঢালছেন। ওহ! আগুন বলাতে মনে পড়ে গেল আমার বড় আপার কথা। আমার বড় আপার নাম বহ্নি। তনয়া শারমিন বহ্নি। কত সুন্দর নাম না! আমার দুলাভাই আমার আপাকে রাগাতে এবং নিতান্তই ভালোবেসেই হয়তো বহ্নিশিখা ডাকেন। বহ্নি অর্থ আগুন হলেও আমার আপা পানির মত। তার মেজাজ কখনো গরম হয়না, দুলাভাই শত কিছু করেন একটু আপার রাগ দেখতে। কিন্তু আপা রাগেন না। আপা শুধু হাসেন। যখন কষ্ট পায় বা অভিমান হয় তখন আপার চোখে পানি ছলছল করে আর মুখে থাকে হাসি। আপার চোখের সেই পানি কখনো গড়িয়ে পড়েনা। কী সুন্দর চোখেই ভাসে! আমি তখন আমার সেই উজ্জ্বল শ্যামা আপাকে মুগ্ধ হয়ে দেখি। আমার আপার রং টা কেমন আমি আসলে বুঝতে পারিনা। আপা কালো তো না আবার ফর্সাও না, লোকে বলে উজ্জ্বল শ্যামা তাই আমিও বলি। তবে আমার মনে হয় আপার রঙটা দুধ চায়ের মত। কালো লিকার আর সাদা দুধে মিশে যেমন রং হয় আপা তেমন। আমার মায়ের কালো আর বাবার ফর্সা রঙের কম্বিনেশন হলেন আমার আপা! আপাকে আমি অনেক ভালোবাসি কিন্তু আমি তা প্রকাশ করিনা। আপা কী আমার সেই অপ্রকাশিত ভালোবাসা বুঝতে পারেন? আমার মনে হয় পারেন। তাই তো পাল্টা আরো অনেক গুণ ভালোবাসা আমি পাই। ডিসেম্বরের ত্রিশ তারিখ যখন এসএসসির রেজাল্ট হাতে নিয়ে বসে কাঁদছিলাম। তখন আমার আপা আমাকে কত শান্তনা দিয়েছিলেন। একটুও বকেননি। অবাক করা কান্ড কেউ কিছু বলেন নি। আমি পৌরনীতি, ইতিহাসে এ প্লাস পাই। ভূগোলেই এ মাইনাস। জেএসসির বাজে রেজাল্ট টাও তো আছে! আর তাতেই আমার সব শেষ। ৪.৪৪ উঠে কোনোরকমে। আমার সেই কী কান্না! মিফতাভাই সেদিন আমার পছন্দের মোগলাই পরোটা এনেছিলেন। ওহ হ্যাঁ! একটা মানুষ কেমন মুখ বেকিয়ে ছিলেন। তিনি হলেন আমার মৃদুল ভাই। প্রতিবার গোল্ডেন পাওয়া মৃদুল ভাইয়ের এই ক্ষেত্রে কেমন অহংকার আর বিতৃষ্ণা ছিল। তিনি আমাকে বলেছিলেন,
-“সারা বছর পড়ালেখা না করে টইটই করে ঘুরে বেড়ালে রেজাল্ট তো এমনই হবে। তাও ভালো কোনোমতে এ উঠেছে। আমি তো ভেবেছিলাম ফেইল করবি।”
আমার আবারও বিলাপ শুরু হলো। মিফতা ভাই দূরে বসে চা খাচ্ছিলেন। মৃদুল ভাইয়ের কথা শুনে হাসতে হাসতে রীতিমত গড়াগড়ি দিচ্ছিলেন। আমি জবাব করব কী? আমিও তো বলতে পারতাম যে “আপনিও তো খালুর সাথে একবার এদিক তো একবার ওদিকে যান। আমি টইটই করলেই দোষ!” কিন্তু আমার মনে কথা মনেই রইল। আমি জানতাম পাল্টা উত্তর আসবে, “আমি তো পড়ালেখাতে ঠিক ছিলাম। সব করেও সেটার কথা ভুলিনি। আমার রেজাল্ট দেখিস নি? হাই স্কুলের বোর্ডে এখনো আমার বড় ছবি আছে। আমি এসএসসি তে জেলায় ফার্স্ট হয়েছিলাম।” সেখানে আরেকদফা হাসা হাসি হতো। তাই আগেভাগেই চুপ হয়ে গিয়েছিলাম। রুমে গিয়ে দরজা দিলাম। রাতে সবাই খেতে ডাকলেও গেলাম না। মৃদুল ভাই আর মিফতাভাইও কয়েকদফা ডাকলেন। সকালে দরজা খুলে দেখি একটা ফুলের তোড়া। সাদা গোলাপের! সেখানে লেখা “কলেজ জীবনের জন্য শুভকামনা”। কে লিখেছিল আজও জানিনা। মা বাবাও নাকি খেয়াল করেননি। নাস্তা করতে বসলে মা বললেন,
-“মৃদুল টা কাল রাতে খায়নি রে। মিফতা ওকে খুব বকেছে। তুই এত বিচ্ছু কেন? ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া লাগালি।”
মায়ের কথা শুনে আমি তাজ্জব। আমি আবার কী করলাম তাদের মধ্যে? ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া লাগিয়ে আমি কী পাব? আমার লাভ কোথায়! আর তারা ঝগড়া করবে কেন? অদ্ভুত!
আমার সব ভাবনা কাটে মৃদুল ভাইয়ের ডাকে,
-“এই অর্নি! আরে এই কালা! ডাকছি যে শুনোস না?”
আমি থতমত খেয়ে গেলাম। মেকি হেসে বললাম,
-“শুনতেই তো পারছি। ষাঁড়ের মত চিল্লাচ্ছেন কেন?”
মৃদুল ভাইয়ের নাকের ডগা কেমন লাল হয়ে গেছে। চোখও লাল! অনেক বেশি রেগে ছিলেন। আমার দিকে একবার তাঁকিয়ে আমাদের সামনে বরাবর রাস্তার ঐপাশের বিল্ডিংয়ের নয়তলার বারান্দার দিকে তাকালেন। সেখানে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। ভালো করে খেয়াল করে বুঝলাম এটা তিয়াস ভাইয়া। মিফতা ভাইয়ের ভাই ব্রাদার। তিনি দেখছি এদিকেই তাঁকিয়ে আছেন। আমরা দুজন তার দিকে তাঁকাতেই কিছুটা উচ্ছাসিত হয়ে চেচিয়ে বললেন,
-“কী খবর অর্নি আর মৃদুল!”
মৃদুল ভাইয়ের চোখ মুখ কুঁচকে গেল। সে “ওহ” বলে জোরে চিৎকার করে উঠল যে আমি খানিক কেঁপে উঠে পিছু ফিরতেই বেতের সোফা তে ধপাস করে বসে গেলাম। অদ্ভুত ভাবে তার কোলেই। মৃদুল ভাইও যেন বাকহারা হয়ে গেলেন। সে হঠাৎ করেই আমাকে পেচিয়ে ধরলেন। আমি নড়তেও পারছিনা হাতের বন্ধন খুব শক্ত। ওপাশ থেকে তিয়াস ভাইয়ের দিকে তাঁকিয়ে এবার হেসে হেসে বললেন,
-“ভাই! খবর খুব ভালো। দেখতেই পারছেন।”
তিয়াস ভাই কিছু বললেন না। তিনিও কেমন চোখ মুখ শক্ত করে ভেতরে চলে গেলেন। মৃদুল ভাইয়ের বয়স পঁচিশ। লম্বা, সুন্দর এবং সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। তবে মিফতা ভাই আরো লম্বা। তার বুকশেলফের দশ তাক পর্যন্ত বই এমনিই দাঁড়িয়ে নিতে পারেন। এরপরের গুলোতে টুল লাগে। তিয়াস ভাই চলে যেতেই মৃদুল ভাই আমার কোমড়ে জোরে চাপ দিলেন। আমি আহ করে উঠলাম। চোখেই পানি এসে গেল। মৃদুল ভাই এবার আমাকে সোফাই ফেলে আমার উপর ঝুকে বলে গেলেন,
-“তিয়াস ভাইয়ের ধারে কাছেও যাবিনা। খবরদার!”
কথাটা বলেই সে ধপাধপ পা ফেলে চলে গেলেন। এদিকে কোমড়ের ব্যাথায় আর কিছুক্ষণের মধ্যে হয়ে যাওয়া ব্যাপার গুলো আমার মগজে ভালোই সাড়া ফেলেছে। আমার সারা শরীর থেকে মৃদুল ভাইয়ের গন্ধ আসছে। পৌরষ জাতির একটা অন্যরকম গন্ধ আছে। তার উপর ভাইয়ার ইতালি থেকে আনা স্পেশাল পারফিউমটা তো আছেই! আমি জীবনেও কল্পনা করিনি আমি আর মৃদুল ভাই কখনো এমন ভাবে জাপটাজাপটি করব। জাপটাজাপটি? ইয়াক! কী বাজে কথা!
৪.
আমি জামা বদলে ফেললাম। মা যদি ভাইয়ের পারফিউমের ঘ্রাণ বুঝে যান! দেখা যাবে অনেক কিছু বুঝে ফেলে খালামণিকে কল করবেন। খালামণিও নাঁচতে নাঁচতে রাতে এসে আমার আর মৃদুল ভাইয়ের বিয়ে পড়িয়ে দিবেন। তাদের তো প্ল্যানই এটা। বিয়ের কথা ভাবতেই আমার ভয় করে। তাও আবার মৃদুল ভাইকে? অসম্ভব! আমার বিয়ে হলে কী মিফতা ভাই কষ্ট পাবেন? আরে ধুর! মিফতা ভাই কেন কষ্ট পাবেন? আমিও আবার বেশিই ভাবি!
সন্ধ্যায় মায়ের সাথে খালামণির বাসায় গেলাম। মা অনেকদিন পরই এসেছেন। আমি তো সকালেও এসেছিলাম। খালামণি আর মা গল্প শুরু করলেন। খালামণির কথা শুনেই বুঝলাম যে খালু ইন্দোনেশিয়াতে গেছেন। মৃদুল ভাইকে নিয়ে সিলেট চা বাগান ঘুরেই নাকি রওনা দিয়েছেন। মৃদুল ভাই জানতেন না যে তাকেও যেতে হবে। সে শুনে খুব রাগারাগি করেছেন নাকি। এমনিতেও এখন তার ফাইনাল এক্সাম এসে গেছে তারউপর খালুর কথা রাখতেই ছয়দিনের ট্রিপে গেছেন। এখন খালু তাকে আবার বালি ঘোরাতে নিতে চান। আসলে সে ভালো করেই বুঝেছেন যে বালি ঘুরতে নয় বরং সেখানকার অফিসিয়াল কাজ কারবারে তাকে খালু ঢুকিয়ে দিতে চাইছেন। আর তিনি বারবার বলেছেন আর্কিটেক্ট হবেন আগে পরে সব দেখা যাবে। খালু মানতেই চায়না। তার এত বড় ব্যবসা দুইভাই একসাথে সামাল দিলে কত ভালো হতো বারবার এটাই বলেন। সব নিয়ে কিছুটা রাগারাগি করেই সে ফিরে এসেছেন। তার মা আর ভাইও এসব ব্যাপারে জানত। তাই রাগ করে ফিরে এসে নাকি কথাও বলেন নি। বিকেল বেলা এসে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়েছিলেন। খাবারও খেল না। কথা বলেওনি। সন্ধ্যার একটু আগেই খুশিমনে ঘরে ফিরে নাকি খালামণির সাথে গল্প করলেন। খাবার খেলেন। সিলেট থেকে আনা সব জিনিস খালামণির হাতে তুলে দিলেন। এখন মিফতা ভাইয়ের রুমে আছেন নাকি! দুইভাই গল্প করছেন। মা বললেন,
-“মৃদুল তো আমাদের বাসায় গিয়েছিল আধা ঘন্টা আগেই এসেছে সেখান থেকে।”
এইকথা শুনে আমার খালামণি আমার দিকে এমন করে তাঁকালো। আর মাও কেমন করে হাসলেন। আমি বেকায়দায় পরে গেলাম। বসা থেকে উঠে বললাম,
-“আমি মিফতা ভাইয়ের কাছে যাচ্ছি। সুমনা আপাকে বলবে দুধ চা দিয়ে আসতে।”
মা আর খালামণি সেই একই দৃষ্টি নিয়ে তাঁকিয়ে আছেন। খালামণি শুধু মাঝখান দিয়ে হাঁক ছেড়ে সুমনা আপাকে ডাকলেন। চা করে দেওয়ার জন্য।
মিফতা ভাইয়ের রুমে আসতেই হা হা করে হাসির শব্দ শুনতে পেলাম। কী ব্যাপারে তারা হাসছে? আমিও দ্রুত পায়ে রুমে ঢুকে পড়লাম। আমার হঠাৎ রুমে ঢোকা দুজনের জন্যই কেমন বিব্রতকর ছিল। আমি ওত কিছুর ধার ধারি না কি! আমি সোজা গিয়ে বিছানার উপরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা জিনিসপত্র দেখতে থাকলাম। ছেলেদের ব্যবহৃত জিনিসে ভরা। আমি পারফিউমের বোতল একটা নিয়ে নিজের হাতে স্প্রে করলাম। আহা! এই ঘ্রাণটা জাস্ট কি*লিং! এত ভালো লাগছে! আমি নিজের গলার কাছটায় হালকা একটু স্প্রে করলাম। তখনিই মৃদুল ভাই চেচিয়ে বললেন,
-“বেকুব এটা ছেলেদের!”
-“তো আমি কী বলেছি মেয়েদের? আমার তো ঘ্রাণটা দারুন লাগছে। আহ! আমি এটা নিব।”
-“কেন? তুই নিয়ে কী করবি!”
-“আমার চৌদ্দ নম্বর ক্রাশকে গিফ্ট করব। আচ্ছা মিফতা ভাই!”
মিফতা ভাইয়ের নাম নেওয়াতে সে কিছুটা চমকে বলল;
-“কী?”
-“তখন যে তোমার সাথে একজন ছিল সেটা কে? ঐ যে সকালবেলা?”
-“কেউ না।”
আমি জানি ইচ্ছা করেই বলছেনা। কারণ আমি ক্রাশ খেলে এদের সবার ভোগান্তি হয়। পকেট থেকে টাকা খসে। আমি মিফতা ভাইয়ের কাছে গিয়ে শার্টের কোণা টেনে বললাম,
-“বলবে না?”
-“না!”
মৃদুল ভাই চেচিয়ে উঠল আবারও। বললেন,
-“তোর লাজ শরম নাই? ভাইয়ের সাথে চিপকে আছিস কেন? আর পরপুরুষের উপর এত ইন্টারেস্ট কেন তোর?”
মৃদুল ভাইয়ের সামনে একটু লজ্জা লাগছে আমার। তখনকার ব্যাপারটার জন্য। তবুও নিজেকে সামলে আমি বকবক করছি। যাতে অস্বস্তি কমে। তার সাথে কম কথা বলার চেষ্টা করছি। আর সে বারবার আমার সাথে চেচাচ্ছে। আমি এবার চিৎকার করে কিছু বলতে যাব তার আগেই মৃদুল ভাইয়ের পেছন থেকে অর্থাৎ ওয়াশরুমের দরজা খুলে একজন বডিবিল্ডার না না একজন রেসলার বেরিয়ে এলো। সকাল বেলার সেই সুন্দর পুরুষটা খালি গায়ে আন্ডারওয়্যার পরেই বেরিয়ে এলো কেবল। সে এতকিছু খেয়াল করেছে কিনা জানিনা। সে তো বলছে,
-“মৃদুল! এটার সাইজ পারফেক্ট! আই আম ফিলিং কমফোর্টেবল।”
এই বলেই সামনে তাঁকিয়ে আমাকে দেখে সে শক খেয়ে গেল বোধ হয়। আমিও এমন কিছু যে এখন দেখব ভাবতেই পারিনি। মিফতা ভাই আমাকে পেছন থেকে ঘুরিয়ে দিলেন। তাতে করে আমার পিঠ তার বুকে লেগে থাকে। আমি এখনও তব্দা খেয়ে আছি। শুনতে পেলাম ওয়াশরুমের দরজাটা খুব জোরে শব্দ করে লাগানো হলো। দরজা লাগাতেই মিফতা ভাই আমাকে টানতে টানতে পাশের রুমে নিয়ে এলেন। দেখলাম তার চোখে মুখেও কেমন লজ্জা আর অস্বস্তিকর ভাব। মিফতা ভাই দরজা টেনে চলে গেলেন। আমার তো কেমন লাগছে আমি বলে বোঝাতে পারব না। একটু ভালো ভাবে খেয়াল করে বুঝলাম আমার হাত, পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। লজ্জায় আমার চোখ মুখ লাল হচ্ছে। আমি সেখানেই মানে মৃদুল ভাইয়ের রুমেই শুয়ে বালিশ দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললাম। ইশ! কী লজ্জা! ভাগ্যিস বড় ছিল আন্ডারওয়্যারটা। শর্টস টাইপ। নইলে কেমন দেখাতো? ছিঃ! সব কিছু ভাবতে ভাবতেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতে পারিনি।
#চলবে।
(কেমন লাগছে জানাবেন।)