কাননে_এত_ফুল (পর্ব-১৫) লেখক– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

0
152

#কাননে_এত_ফুল (পর্ব-১৫)
লেখক– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

২৭.
চোখে কড়া রোদ পড়তেই চোখের চামড়াটা ছ্যাঁত করে উঠল। পিট পিট করে চোখ খুলে অনুভব করলাম সারা শরীরে মৃদু ব্যাথা। শাড়িটা বিছানার এই মাথা ঐ মাথা ছড়িয়ে পড়ে আছে। সেদিকে তাঁকিয়ে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ বসে রইলাম। গতরাতটি জীবনের চিরস্মরণীয় রাত। একটা গান আছে না, “কাল সারারাত ছিল স্বপনের রাত” ঐ গানটাই মাথায় আসছে তবে একটু ভিন্ন ভাবে। আমার বেলায় এটা শুধু স্বপ্ন না দুঃস্বপ্নের মত। যাই হোক! পরিস্থিতি যে এত কঠিন বদল আনে ভাবতেই পারিনি। এখন আর আমার নিজ ইচ্ছার কোনো মূল্য নেই। মা তো মুখ ফিরিয়েই নিল। ভাবতেই চোখটা ছলছল করে উঠল। আমার মা! আমাকে কোথাও বেড়াতে যেতে দিত না একা। সেই মা কীভাবে আমাকে এখন একটা অচেনা পুরুষের কাছে ছেড়ে দিতে পারল? জানি আমার ভুল। তবুও সে মুখ ফিরিয়ে নিল? বোন আর বোনের ছেলে সবসময় তার কাছে অনেক বড় ছিল। তাতে আমার কখনোই হিং’সে হতো না। তবে এখন মনে হচ্ছে ভালোবাসাটা এতটাই বেশি যে মেয়ের প্রয়োজনে সে ফিরেও তাঁকাচ্ছেনা। এতে অবশ্য খালামণিদের কাউকে দোষ দিচ্ছিনা। এটা একান্তই আমার মায়ের ইচ্ছা। সে নিজ মর্জিতেই বোনের প্রতি বেশি সেনসিটিভ। তার চেয়েও বেশি সে মিফতা ভাই আর মৃদুল ভাইকে ভালোবাসেন। বরাবরই তার পুত্র সন্তানের শখ ছিল। সেই শখটা অপূর্ণ বলেই তো তাদের প্রতি বেশি মায়া কাজ করে তার। তাই বলে তার তীব্রতা এতটাই যে নিজের মেয়েকেই কোণঠাসা করবে? এটা কেমন বিচার! এই প্রথম! হ্যাঁ, এই প্রথম! মিফতা ভাই আর মৃদুল ভাই কে আমি হিংসে করছি। তারা আমার মা’কে আমার থেকে ছিনিয়ে তো নেয়নি তবে তাদের দিকেই আটকে রেখেছে।

শাড়ি গায়ে জড়িয়ে যখন বিছানা ছাড়ব তখন চোখ গিয়ে পড়ে বারান্দার গ্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আয়ানের দিকে। হাতে কফি মগ, কিছুক্ষণ পর পরই চুমুক দিচ্ছে। এলোমেলো অবস্থায় ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেলাম। সে এদিকে তাঁকিয়ে নেই। সেই সুযোগে আমি কাবার্ডের দিকে এগিয়ে গেলাম। কাল অবন্তী আপু আমার জামা কাপড় সব এখানেই রেখেছিল। কিন্তু মাঝ পথেই থেমে গেলাম। বড় আয়নায় আমাকে দেখে। অগোছালো শাড়ি, শরীরের বিভিন্ন স্থানে কিছুটা রক্তিম আভা দেখা যায়, চুলগুলোও এলোমেলো গলার কাছটা কালছে নীল হয়ে আছে। নিজেকে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে ভুলেই গিয়েছিলাম যে রুমে বদমাইশ আর্মিম্যানটাও আছে। সে পেছন থেকে হঠাৎ গুরুগম্ভীর গলায় বলে ওঠে,
-‘কী এত দেখছ? লাভ বাইটস?’
আকস্মিক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম তার কথায়। লজ্জা শরমে আমার চোখ ঝকঝকা টাইলসে নিবদ্ধ হলো। নিজের কানের লতিতে তখনই ছোট একটা কামড়ের আভাস পেলাম। চোখ তুলে তাকানোর সাহসটাও নেই। আমার রাগ হওয়ার কথা কিন্তু লজ্জার প্রকটে রাগ ধামাচাপা পড়ে গেছে। লোকটা ফিসফিস করে যা বলল তা শুনে আমার বুকের ভেতর ধরাম করে শব্দ হলো। কান থেকে লাল লাল ধোঁয়া বের হলো বোধ হয়। তিনি যখন সরে গেল তখন এদিক ওদিক তাঁকিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলাম। কাবার্ড থেকে জামা নিব তখনই উনি বললেন,
-‘এই শাড়িটা পড়বে এখন। অবন্তী দিয়ে গেছে’
আমি তাঁকালাম তার দিকে তিনি হাতের ইশারায় সোফায় পড়ে থাকা একটা বক্সকে উদ্দেশ্য করে বললেন। আমি এখন শাড়ি পড়ব কীভাবে? তখন অবন্তী আপুই পড়িয়ে দিয়েছিল। তাছাড়া আর শাড়ি পড়তে মন চায়না। আমি কিছু বলব তার আগেই উনি বললেন,
-‘তোমার সাইজের ব্লাউজ থেকে শুরু করে সবটাই আছে। তারপরেও চেক করে নিতে পারো।’

আজব! আমার সাইজের মানে কী? আমার সাইজ কী জনে জনে সকলে জানে? এটা তো দেখেই বোঝা যাচ্ছে নতুন। বাহ! তাদের চোখ এতটাই পাওয়ারফুল যে আমার সাইজ এক্সাক্ট কী সব জানে। এতসব করতে তোদের কে বলেছে রে? আমি জামা পড়ব এসব শাড়ি ফাড়ি পড়ে কাল সারা দিন এমনকি রাতটাও আমাকে ভূগতে হয়েছে। আর পারছিনা এসব নিতে! বিরক্তির সাথে রাগটাও চড়াও হয়ে উঠেছে। আয়ান হয়তো খেয়াল করেছে। তাই বলল,
-‘কোনো সমস্যা?’
-‘শাড়ি না পড়লে হয়না?’ – থমথমে গলায় বললাম

-‘না হয়না। নতুন বউ শাড়িই পড়বে।’
নতুন বউ শব্দটায় কী ছিল কে জানে? এক ভিন্ন অনুভূতি ঘিরে ধরল আমায়। বক্সটা নিয়েই বাথরুমে ঢুকে পড়লাম। তবে দরজা দেওয়ার আগে হালকা ফাঁক করে বললাম,
-‘আপুকে একটু ডেকে দিবেন। আমার সাহায্যের প্রয়োজন।’

২৮.
গোসল সেরে রুমে এলাম যখন তখন দেখি অবন্তী আপু বিছানার চাদর বদলে ফেলেছে। কফি কালার আর সাদার মিশ্রণ দিয়ে সারা রুম টা যেমন সাজানো তেমনিই বিছানাটাও সাজানো। গতরাতে ছিল শুধুই সাদা চাদর। আমার লজ্জা লাগল খুব। আপু বলল,
-‘আরে অর্নি উফ স্যরি ভাবি। এসো এসো। শাড়িটা এমন পেচিয়ে রেখেছো কেন? আসো ঠিক করে দেই।’
-‘প্রথম ডাকটাই তো ঠিক ছিল আপু। পরেরটা বলার দরকার নেই।’
-‘আছে দরকার। বয়সে কী হও সেটা ম্যাটার করেনা, সম্পর্কে তুমি আমার বড় ভাইয়ের বউ। তোমাকে নাম ধরে যদি ডাকি তবে তারই অসম্মান। ভাইয়া আমার কত বড়!’
-‘কত বড়?
-‘আমার সাত বছরের বড়। ইশ! তবে তোমার থেকে তো আরো বড়। এই আঠারো হয়েছে তোমার?’
-‘হয়েছে তিন চার মাস আগেই।’
-‘মাত্র আঠারো হয়েছে? জানো ভাইয়ার বয়স কত?’
-‘কত?’
-‘এইবার ভাইয়ার ঊনত্রিশ শেষ হতে চলল।’

নিজের থেকে এগারো বছর বড় একটা মানুষকে বিয়ে করলাম শুনে আমার খুব খারাপ লাগল। বয়সের এত তফাৎ! তবে দেখে তো আরো কম ভেবেছিলাম। এইখানেও ঠকলাম? কিছুক্ষণ ভাবতে ভাবতেই উপলদ্ধি করলাম বয়স যেমনই হোক লোকটা দেখতে অতিরিক্ত সুন্দর। অবশ্য আমার কম বোঝাটাও বোকামি। তার বয়স অনুযায়ী তো সে পার্ফেক্ট। আমার বয়স অনুযায়ী আমি হলাম আরেকটু বুড়ি। তার শরীরে কোনো বাড়তি মেদ নেই। অথচ আমার সারা শরীরেই কম করে হলেও মেদের দেখা মিলে। আমিই পার্ফেক্ট না। ভাবতেই কষ্ট লাগল। আজ যদি সবকিছু অন্যরকম হতো তবে গর্বে বুক ভরে যেত। মুখ করে বলতাম,
-‘দেখো সবাই। আমার স্বামী কত সুন্দর।’
তবে তার বদমাইশি দেখার পর তাকে চাইলেও সুন্দর বলতে পারি না। লোকটা ভালো হলেও পারতো! তাকে যে আমার অপছন্দ এমন টা নয়, আবার পছন্দ খুব সেটাও নয়। তার বাহ্যিক সৌন্দর্য তো আমাকে প্রথম দেখাতেই আকৃষ্ট করেছে তবে পরবর্তীতে তাকে ভয় পেয়েছিলাম অনেক। এরপর সে আমাকে যেভাবে বিয়ে করল সেই কারণেই তার প্রতি আমার অনীহা।

শাড়ি পড়ানো শেষে অবন্তী আপু বলল,
-‘আমি কখনোই ভাবতে পারিনি আমার ভাই নিজের চেয়ে এত ছোট মেয়েকে বিয়ে করবে। অবশ্য তোমরা একসাথে দাঁড়ালে একটুও মিসম্যাচ লাগেনা। তোমার হাইট ওয়েট সব কিছুই ভাইয়ার জন্য পার্ফেক্ট। এই তোমার হাইট কত?’
-‘৫’৭।’
-‘হোয়াট! কী বলছ? এইটা সুপার হাইট। ভাইয়ার তো ৬’৩। আমাদের বাবাও এমন লম্বা ছিলেন। আমার দুই ভাই বাবার মত লম্বা। আমি আমার মায়ের মত মিডিয়াম।’

বাহ! লোকটার হাইট একদম আমার মন মতো। সবকিছুই তো ঠিক আছে তবে ঐ ভেতরকার মানুষটাই তো ঠিক নেই। ঐ মানুষটা কেন ভালো হতে পারল না আরেকটু? তাহলে তো তার সাথে সুখের সংসার করতে আমার কোনো আপত্তিই ছিল না।

টুকটাক কাজ শেষ করে অবন্তী আপু আমাকে বিছানায় বসিয়ে নিজেও পাশে বসলেন। বললেন,
-‘বাড়ির কথা মনে পড়ছে?’
-‘পড়ে তো। বিশেষ করে মা’য়ের কথা। আপু মা কল করেনি?’
-‘আন্টি করেনি তবে আঙ্কেল, বহ্নি আপু করেছিলেন।মা সবাইকে দাওয়াত দিয়েছেন। দুপুরে সবাই এখানে খাওয়া দাওয়া করবেন। বড় অনুষ্ঠান করতে চেয়েছিল তবে তোমার বাবা এবং আমার ভাইয়া কেউ আপাতত সেই ব্যাপারে রাজি হচ্ছেনা। তোমার মা, মৃদুল ভাইয়ের পরিবারের সবাই আগে ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিবে তারপরই অনুষ্ঠান হবে। তাছাড়া ভাইয়া চলে যাবে। আর চার পাঁচদিন আছে।’
লোকটা চলে যাবে শুনে আমার কী যে কষ্ট লাগল। কেন লাগল জানিনা তবে খুব করে কষ্ট লাগল। এক রাতেই এত মায়া জন্মেছে? মিথ্যে বলব না। কাল রাতে যখন তার বুকে আমি মাথা রেখেছিলাম, তার বাহুডোরে আবদ্ধ ছিলাম একটা বিশুদ্ধ ভালো লাগা ছাড়া আর কিছুই অনুভব হয়নি। না কষ্ট, না দুঃখ, না রাগ আর নাইবা বিরক্তি ও কান্না। আমি কাল তার কাছে প্রশান্তি অনুভব করেছিলাম। এই কথা অস্বীকার যেতে পারিনা আমি।

অবন্তী আপু বললেন,
-‘কাল একটা বড় সত্যির মুখোমুখি হয়েছি জানো?’
আমি খেয়াল করলাম অবন্তী আপুর মুখটা মলিন হয়ে গেছে কথাটা বলতে গিয়ে।
-‘কী সত্যি আপু?’
-‘কাল যখন তুমি মিফতা ভাইদের বাড়িতে ছিলেনা তখন অনেককিছুই ঘটেছে।’
-‘কী ঘটেছে?’
-‘তোমার খালামণি ভরা সভাতেই তোমার বাবার কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলেন তোমার আর মিফতা ভাইয়ের বিয়ের জন্য।’
এই কথা শুনে অস্বস্তি লাগল। শত হোক, ননদের মুখে এসব শুনতে ভালো লাগবেনা। তাছাড়া মানুষটাও আর কেউ নয় আমার অতি প্রিয় মিফতা ভাই।
অবন্তী আপু বললেন,
-‘তারপরই তো আসল ধামাকা টা হলো। মৃদুল ভাই ক্ষিপ্ত হয়ে পড়লেন হঠাৎ করেই। জোর গলায় বললেন এটা অসম্ভব। ভাইয়ার সাথে অর্নির বিয়ে অসম্ভব। তোমার খালামণি বললেন অসম্ভব কেন। মৃদুল ভাই তখন বললেন সে তোমাকে পছন্দ করেন বলতে গেলে ভালোবাসেন। বিয়ে করতে চায় তোমায়। তোমার খালু চুপ থাকলেও তোমার খালামণি রেগে গেলেন। বড় ভাইয়ের সাথে যার বিয়ের কথা চলছে ছোট ভাই তাকে বিয়ে করতে চায় ব্যাপারটা কেমন না? কথা কাটাকাটি হচ্ছিল একপ্রকার। তখন মিফতা ভাইকেও জিজ্ঞেস করা হলো তার কী মত। সে চুপ ছিল কিছুক্ষণ। পরে বলল যে তোমাকে তার বিয়ে করতে কোনো আপত্তি নেই। বরং তোমাকে বিয়ে করতে সে নিজেই প্রস্তাব দিয়েছিল। তোমার খালামণি বড় ছেলের বিয়ের কথাই আগে ভেবেছেন স্বাভাবিক। তার এক ছেলের বউ হিসেবে তুমি গেলেই সে খুশি। তারওপর মিফতা ভাইয়ের সাথে দিবে বলে খুশিটা আরো বহুগুণ ছিল। তারা কখনোই ভাবে নি যে মৃদুল ভাই তোমাকে পছন্দ করেন। কারণ তো সবাই জানে। তোমাদের মধ্যকার সম্পর্কটা তো সাপে নেউলের সম্পর্কের মতোন। তাই কখনো কারো চিন্তাতেই আসেনি। হয়তো তুমিও ভাবো নি।’

হ্যাঁ! আমি কখনোই ভাবিনি। বরং এখন এসব শুনে আমি হতবাক। মিফতা ভাই আর মৃদুল ভাই? এতদিন জানতাম মা খালাদের পাগলামি এসব। এখন শুনছি কিনা পরোক্ষ ভাবে তারা দুইভাইও এসবই ভেবেছে। আমার গা গুলিয়ে উঠল। তাদের সম্পর্কে এসব ভাবতে শুরুতেই আমি অপ্রস্তুত বোধ করতাম। আর এখন তো আমি বিবাহিত। আমার স্বামীও আছে। এই মুহূর্তে এসব শুনে আমি অস্বস্তি আর জড়তাতে আটকে গেলাম। অবন্তী আপু বললেন,
-‘জানো ভাবি? মৃদুল ভাই তোমাকে যে এতটা ভালোবাসে তা দেখে আমি এবং অনেকেই বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। মৃদুল ভাইয়ের চেঁচামেচি, রাগ সবকিছুতেই স্পষ্ট জানান দিচ্ছিল সে তোমাকে কতটা চায়। মিফতা ভাই এক পর্যায়ে রেগেই গিয়েছিল। কালকের পরিস্থিতি তো ভয়ঙ্কল ছিল তবে আরো ভয়ঙ্কর তখন হলো যখন তোমার আর বড় ভাইয়ার বিয়ের কথা সকলে জানতে পারে। মৃদুল ভাই আর মিফতা ভাই কাল যে খুব হার্ট হয়েছিল তা তাদের চোখে মুখেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। তুমি খুব লাকী। কেননা, রগচটা মৃদুল ভাই তোমাকে ভালোবাসে।’

এই শেষ কথাটা কতটা বেদনার সুরে আপু বলল তা আমি বেশ ভালোই টের পেলাম। আমি জানি অবন্তী আপু মৃদুল ভাইকে পছন্দ করে। বোঝাই যেত। নিতুন আপুরটাও বুঝেছিলাম। তবে মিফতা ভাই আর মৃদুল ভাইয়ের টা কখনো বুঝিনি। কারণ আমি কখনো তাদের ব্যাপারটা সেইভাবে ভাবিনি। তারা এমন একটা টপিকের উপর আমার চিন্তায় কখনো আসেনি। মা আর খালামণির কথা শুনেই যা একটু ভাবতাম আর ভেবে বিরক্ত হতাম।

আপু আমাকে আর কিছু বলতে দিলেন না। নিচে নিয়ে এলেন। সকলে নাস্তার টেবিলে। নেই শুধু আয়ান আর অভ্র। আচ্চা? অভ্রর কী অবস্থা? আমার বিয়েতে সে কষ্ট পেয়েছে? তার মনে কখনো কী আমি প্রভাবে ফেলেছিলাম? সে নিজেও কী মিফতা ভাই আর মৃদুল ভাইয়ের মত কষ্ট পাচ্ছে? না পাচ্ছে না হয়তো। পাওয়ার কোনো বিশেষ কারণ খুঁজেও পাচ্ছিনা।

২৯.
আয়ানদের বাড়ির দাওয়াতে আমার মা আর খালামণি ছাড়া সবাই এসেছে। তবে মৈত্রী আপু এলেও কথা বললেন না। বিথী রা ছাড়া বাকি সবাই নাকি নিজ নিজ বাড়ি চলে গেছে। মামারা অবশ্য এই বিয়েতে নাকি অসন্তুষ্ট হয়নি তবে বোনদের রাগের জন্য আর তা নিয়ে উল্লাস করেনি। যে যার জায়গায় ফিরে গেছে।

অবাক হলাম তখন যখন দেখলাম মৃদুল ভাই আর মিফতা ভাইও এসেছেন। তাদের সাথে তিয়াস ভাইকেও দেখলাম। সবাই একসাথেই এক কোণায় বসে আছে। টুকটাক কথা বলছে। আমি তাদের সামনে পড়তেই বিব্রতবোধ করলাম। তিয়াস ভাই বললেন,
-‘কখনো বুঝতেও পারিনি অর্নি তোমার চক্করটা যে আয়ান ভাইয়ের সাথে চলছিল। তা কবে থেকে এসব?’
তিয়াস ভাইয়ের কথা শুনে আমার চোখ মুখ কুঁচকে এলো। কিছুটা বিরক্তি তো অনেকটাই রাগ। লোকটার কথার ধরণ টা কেমন খোঁচা মারা ছিল। এই লোকের বাড়ি থেকে আমার জন্য প্রস্তাব এসেছিল তো। নাকোচ করার কারণেই কী তবে এমন ব্যবহার? কিছুই বললাম না। তখনিই,
মিফতা ভাই এগিয়ে এলেন। হাসিমুখেই বললেন,
-‘কেমন আছিস?’
তার এই গলাতে সবসময় আমি স্নেহ খুঁজে পেতাম। তবে আজ বিরহের একটা তেঁতো স্বাদ পেলাম। শুধু কী সবটা জানতে পেরেছি বলে নাকি এমনিতেও প্রকাশ পাচ্ছে? কোনটা সেটা বলতে পারব না। বলতে পারব আমার এখন ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। মিফতা ভাইয়ের কষ্টের কথা ভেবে কষ্ট হচ্ছে। তারা কষ্ট পাক আমি কখনোই চাইনি। তবে আমি নিজেই বড় একটা কষ্ট দিয়ে দিলাম। ভাবতেই বুক ভেঙে কান্না আসছে।

-‘বললি না তো কেমন আছিস?’

কী বলব? আমি ভালোই বা থাকি কেমন করে? আমার প্রিয় মানুষগুলো কষ্টে আছে। সেখানে আমি ভালো থাকব?
কিছু বলব না বলব না করেও বললাম,
-‘ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?’
-‘দেখতেই পাচ্ছিস।’
গরম তেলে পানি ছাড়লে যেমন ছ্যাত করে ওঠে তেমনিই আমার বুকটাও ছ্যাত করে উঠল। মৃদুল ভাইয়ের দিকে একবার তাঁকালাম। সে এতক্ষণ বসা ছিল তবে এখন দাঁড়িয়েছে একেবারে আমার মুখোমুখি। তার প্রখর দৃষ্টি আমার দিকে। আমাকে দেখছে তার চোখে কেমন মুগ্ধতা দেখা যাচ্ছে। এই প্রথম মনে হয় আমি উপলদ্ধি করলাম তার আমার প্রতি অন্যরকম দৃষ্টি আছে। ভালোবাসার দৃষ্টি! আজ সব জেনেই কী আমার মনে এসব আসছে? জানিনা। এসব কিছুই জানিনা। আমার পরিধানকৃত শাড়িটি হলো একদম ‘ঘী’ রঙা। টিস্যু শাড়ির মতোই। অবন্তী আপু বলেছে খুব সুন্দর লাগছে। আমিও দেখেছিলাম আয়নায়। শাড়িটা সত্যিই ফুঁটে আছে গায়ে। সেই সৌন্দর্য টাই কী খুঁটিয়ে দেখছেন তিনি? হঠাৎ করেই তিনি আমার চোখে চোখ রাখে। পুনরায় বিব্রত হয়ে পড়ি। তবে লক্ষ্য করলাম মৃদুল ভাইয়ের রক্তিম সেই এক জোড়া চোখ। খুব কান্না করলে যেমন চোখ লাল হয় তেমন। তবে কী মৃদুল ভাই কেঁদেছিল? কথাটা ভাবতেই বুক ভারী হয়ে এলো। আমি তো চাইনি কেউ কষ্ট পাক। তবে কেন সবাই কষ্ট পাচ্ছে এত? কারণটাও আমিই কেন? খুব দুঃখে আমার চোখের কোণে অশ্রু জমাট বাঁধল। আমি এদিক ওদিকে দৃষ্টি সরিয়ে নিচ্ছি শুধুই। আপা আর মৈত্রী আপু নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন। তাদের এদিকে নজড় ছিল না। তবে যখন মিফতা ভাই বলল,
-‘অর্নি তুই ভীষণ সুন্দর হয়ে গেছিস তো। এক রাতেই অনেক পরিবর্তন।’
এই কথা শুনে উপস্থিত সবাই আড়চোখে দৃষ্টিপাত করল আমাদের দিকে। আমি তো কেবল মৃদুল ভাইয়ের চোখের দিকেই তাঁকিয়ে ছিলাম। যখন দেখলাম তার চোখ ছলছল করছে তখন আর দাঁড়ালাম না সেখানে। এলোমেলো কদম ফেলে ছুটে এলাম সেখান থেকে। পেছন ফিরলাম একবার দেখলাম মৃদুল ভাই মূল দরজা পার করে চলে যাচ্ছেন। ব্যাপারটা এতটা হৃদয়বিদারক ছিল। এতটা আঘাত প্রাপ্ত হলাম যে হু হু করে কেঁদে উঠলাম। এই এতগুলো মানুষকে পেরিয়ে যখন দোতালার আয়ানের রুমটায় ঢুকলাম তখন দেখলাম তিনি তৈরি হচ্ছেন বাহিরে যাওয়ার জন্য। আমার কী হলো জানিনা। আমি ছুটে গিয়ে তাঁকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম আর গলা ছেড়ে কাঁদতে লাগলাম। তিনি একটা প্রশ্নও করল না। আলতো ভাবে আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিল। বুঝলাম, বাবা মায়ের পরে হয়তো আমার সবচেয়ে বিশ্বস্ত স্থান এই জায়গাটা। এই বুকটা। এই গোটা মানুষটাই।

#চলবে।
(কেমন লাগছে জানাবেন। রি-চেইক করা হয়নি তাই ভুল ত্রুটি ধরিয়ে দিবেন। লেখাটাও অগুছালো লাগছে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here