কাননে_এত_ফুল (পর্ব-১৪) লেখক– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

0
270

#কাননে_এত_ফুল (পর্ব-১৪)
লেখক– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

২৫.
চারিদিকে কোনো শব্দ নেই। কোলাহলে মুড়িয়ে থাকা শহর কী শান্ত! আহ্! চোখটা ধীরে সুস্থে মেললাম। মাথা কাজ করছেনা। সব কিছু মনে পড়তেই দেখলাম না এসব ভুল। যাক সবই স্বপ্ন ছিল। এই দুঃস্বপ্নটা যে এতটা ভয়ানক ছিল ভাবা যায়? আরে আমি তো এতক্ষণ পর্যন্ত ঘুমিয়েই ছিলাম। এইসব বিয়ে শাদি কিছুই হয়নি আমার। হা হা হা। শান্তি।

না না। শান্তি নাই তো। কারণ একটা কিছুও স্বপ্ন ছিল না। এই যে আমি মাথাটা একটু বাঁকিয়ে দেখলাম বদমাইশ আর্মিম্যান গাড়ি ড্রাইভ করছে। ইয়া আল্লাহ্! এটা স্বপ্ন হলো না কেন? এই রকম অনাচার কেন হতে গেল? আমি এবার কী করব! সমাজে মুখ দেখাব কী করে? কান্না সব গলায় এসে দলা পেকে যাচ্ছে। কী অসহনীয় বেদনা। কল্পনাও করিনি আমার এই ফ্লার্ট করার স্বভাবটার জন্য আমি এত বড় শাস্তি পাব। আচ্ছা মা আমাকে বাসায় জায়গা দিবে তো? খালামণি কথা বলবে তো আমার সাথে? আমি যে তাদের আশা ভরসা ছিলাম। সেই সবই তো আবার আমি নিজ হাতে নষ্ট করলাম। আচ্ছা বাবা কী সত্যিই জানেন এই বিয়ের কথা? আর্মিম্যানকে দেখে মনে হয়নি সে মিথ্যে বলছে। তবে আমার বাবাও তো এমন কিছু করবেন না। এসব কী হচ্ছে আমার সাথে? আমি চোখে মুখে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পারছিনা। এত অসহায় লাগছে কেন? পালিয়ে যেতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু পালানোর পথ টাই তো খোলা নেই।

-‘ক্ষুধা লাগছে? কিছু খাবে?’
রাগে আমার মাথা কিলবিল করে উঠল। এই চূড়ান্ত অসভ্য লোক তো দেখি মৃদুল ভাইয়ের চেয়েও বড় বদমাইশ। পাকস্থলী কে’টে নিয়ে বলছে খাবার খাইতে! আরে ফালতু লোক তুই আমার কয়দিনের ক্ষুধা যে কেড়ে নিলি আমি আন্দাজ করতেও পারছি না। আর খাবার জুটবে তো? আস্ত থাকব তো? মা তো আমাকে সত্যিই মে’রে বুড়িগঙ্গায় ফেলে আসবে। থমথমে মুখ আর বিতৃষ্ণা নিয়ে চুপ করে বসে রইলাম। একটু রা ও করলাম না। ফালতু লোক একটা!

-‘তোমাকে আমি কিছু বলছি? তখন জ্যামে আটকে থাকতেও বললাম খেয়ে নাও অনেক বেলা হয়েছে। খেলে তো না উল্টো রাগ দেখিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলে। এখনও খাবার আছে খেয়ে নেওয়া বেটার। আমি এসব অনিয়ম কিন্তু পছন্দ করি না একদমই।’

কি বলে? অনিয়ম পছন্দ করেনা? তার পছন্দ অপছন্দের আমি ধার ধারি! ফালতু লোক একটা! ফালতু নাম্বার ওয়ান।

এবার দেখলাম খুব দ্রুত ড্রাইভ করছেন। ওরে সাংঘাতিক। তবে কী আমাকে এখন এ’ক্সি’ডে’ন্ট করে মে’রে ফেলতে চাইছে? ছিঃ মানুষ এত নিষ্ঠুর হয়?

না শেষমেশ তো বেঁচেই ফিরলাম। গাড়ি এসে থামে একদম তাদের গেইটের সামনে। এই তো সুযোগ! লোকটা যেই না লক খুলে বের হলো ওমনি আমি নিজেও দ্রুত দরজা খুলে দৌঁড়ে মিফতা ভাইদের গেইটে ঢুকে গেলাম। লোকটা চিৎকার করে বলল,
-‘এই মেয়ে দাঁড়াও বলছি!’

কে শুনে কার কথা! আমি তো পালাতে পারলেই বাঁচি। বাহিরে ঘন কালো মেঘ আর বাতাসেরও কী তীব্রতা! আজকে জ্যামেই ছিলাম দুই আড়াই ঘন্টার মত। সন্ধ্যা নেমে আসবে হয়তো আর কিছুক্ষণ পর। ঠিক জানিনা কয়টা বাজে। আন্দাজ করছি কেবল। এমনিতেও অন্ধকার হয়ে আসছে চারিপাশ কারণ ঝড়ের পূর্বাভাস। দৌঁড়াতেও কত বাঁধা! এই বাতাসের তীব্রতা শাড়ি উল্টে পাল্টে যাচ্ছে,আঁচলেরও যাচ্ছে তা অবস্থা, দমকা হাওয়ার সাথে সে ভাসছে যেন! অবাধ্য চুল গুলোও নাজেহাল করে দিচ্ছে। মিফতা ভাইদের গার্ডেন এড়িয়াটা এত বড় কেন? পেছন ফিরে একবার দেখলাম লোকটা কী আমাকে ধাওয়া করছে নাকি! না, সে আসছেনা। বরং গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বুকের মধ্যে বলিষ্ঠ হাত দুটি গুটানো। মনে হচ্ছে আমার দৌঁড় প্রতিযোগিতা দেখছে খুবই আয়েশ করে। আরে ধুর!

বাসার গেইটে যখন ঢুকলাম ভেতরে কিছুটা শরগোল শোনা গেল। মৃদুল ভাইয়ের গলার আওয়াজটাই বেশি শোনা গেল। এ কী! তারা ঝগড়া করছেনা তো? সবার মাথা গরম? এই অবস্থায় আমার এই কেলেঙ্কারির কথা জেনে গেলে না জানি কি করবে! হায়রে! আমার একূল ও গেল ওকূল ও গেল। টিপ টিপ পা পেলে ধীরে ধীরে নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে ভেতরে ঢুকলাম। দেখলাম খালু-খালামণি, মামা-মামিরা, আর আমার বাকি খালু-খালামণিরাও সব সোফায় বসে আছে। ঐ দূরে সিঁড়ির কাছে মিফতা ভাই দাঁড়িয়ে আছে। গম্ভীর তার মুখশ্রী। আচ্ছা এরা কী আমার বিয়ের ব্যাপারে জেনে গেল? এবার কী হবে! মিফতা ভাইয়ের বাবার দিকে কাউকে দেখলাম না। তারা অবশ্য সবসময় এমন করে এসে খেয়ে কিছুক্ষণ থেকে চলে যান। থাকেন না। যাক অন্তত তাদের সামনে তো আর অপমানিত হচ্ছিনা! আমাকে কেউ খেয়াল করছে না কারণ সবাই মৃদুল ভাই আর তার মায়ের কথপকোথন এর দৃশ্যটি অবলোকন করছেন। আমার আপা আর মৈত্রী আপুকে দেখলাম এক কোণায় চিপকে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চোখ মুখ কেমন শুকিয়ে আছে। এবার মনে ভয় ঢুকে গেল অনেক। হয়েছে কী? এত সুন্দর পরিবেশ আচমকা এমন ঝড়ের মত বদলে গেল কীভাবে!

আমি এই মুহূর্তে ভরসা যোগ্য স্থান পেলাম না। ঐ সুদূরে দাঁড়িয়ে থাকা মিফতা ভাই আমার ভরসা স্থল। সবসময় তার কাছেই আমি আশ্রয় নিয়েছি। মিফতা ভাইয়ের ফিটফাট থাকা পাঞ্জাবির উপরের দুই তিনটা বোতাম খোলা, চুলটাও কেমন এলোমেলো। মিফতা ভাই কী মার খেয়েছে? ধুর!

আমি ভেবেছিলাম সবাইকে এড়িয়ে এক ফাঁকে গিয়ে মিফতা ভাইয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়াব। কিন্তু তা আর হলো কোথায়? হঠাৎ করেই শুনলাম কেউ আমার নাম ধরে চেঁচিয়ে উঠল,
-‘ঐ তো অর্নি আপু চলে আসছে।’
ব্যাস এই একটা কথা যথেষ্ট ছিল। পুরো হল রুমের দৃষ্টি আমার দিকে এখন। বিথী টাকে এখন জোরে থাপ্পড় দিতে ইচ্ছে করছে। বদমাইশ! এবার আর লুকিয়ে যেতে পারলাম না। সবার সামনে দিয়েই হাঁটা ধরলাম। মৃদুল ভাই যেহেতু মাঝখানেই দাঁড়িয়ে ছিলেন সেহেতু তার সামনে দিয়েই গেলাম। দেখি সে ফুঁসছে আর চোখ বড়বড় করে আমার দিকে চেয়ে আছে। অজানা ভয়ে আমার বুকটা ধ্বক করে উঠল। আপা উপস্থিত সবার সামনেই আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে বলল,
-‘এই অর্নি! তোকে এরকম লাগছে কেন? কই ছিলি তুই?’

কী বলব! কাজী অফিসে ছিলাম? বিয়ে করতে গিয়েছিলাম! মৃদুল ভাইদের ড্রয়িং রুমে আয়না আছে একটা দেয়াল জুড়ে। ভাগ্যক্রমে আমি সেই আয়নার সামনেই দাঁড়িয়ে। নিজেকে পরখ করে নিতেই তব্দা খেয়ে গেলাম। অগোছালো, ভাজ পড়া শাড়ি আর এলোমেলো চুলে কেমন পাগলের মত দেখা যাচ্ছে। তবে ওতটা খারাপ ও না। কোনোরকমে কাটিয়ে দেওয়া যাবে। মনে হচ্ছে বাড়ির বউ মানুষ, কাজ করে এই দশা হয়েছে।
সবাই কেমন করে তাঁকিয়ে আছে। আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে। কী বলব, কী করব কিছুই বুঝতে পারছিনা। মিফতা ভাইয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখলাম সে কেমন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। আমার দিকে তাঁকিয়ে আরেকবার মৃদুল ভাইয়ের দিকে তাঁকালো। তার চোখ মুখে যে বিষণ্ণতা প্রথমে দেখেছিলাম এখন তা কেটে গেছে। মৃদুল ভাইয়ের মুখ লাল হয়ে আছে। চোখ গুলো ভয়ঙ্কর লাগছে আমি আর তাঁকাতে পারলাম না। খালামণি বললেন,
-‘বাচ্চারা সবাই উপরে যাও। অর্নি তুইও যা।’
মৃদুল ভাই চেঁচিয়ে উঠলেন। বললেন,
-‘কারো কোথাও যাওয়ার দরকার নেই। সবাই এইখানে থাকবে। বিশেষ করে তাকে থাকতেই হবে যার ব্যাপারে কথা হচ্ছে।’

কিছু বুঝতে পারছিনা। কী ব্যাপারে! আর কাকে? আমাকে? বিয়ের কথা তবে সত্যিই জেনে গেছে! আমি যখন কিছু বলতে নিব তখনিই দেখলাম আয়ান সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করল। সে আসতেই মিফতা ভাইয়ের মেয়ে বান্ধবী কয়েকটা হা করে উঠল। ব্যাপারটা বাজেই দেখা গেল। দেখলাম কর্নিয়াও কেমন তাঁকিয়ে আছে। থাক সেটা কথা না। কথা হলো এখন আমার কী হবে? আয়ান আসতেই খালু বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। হেসে হাত মেলালেন। বললেন,
-‘আরে ইয়াং ম্যান! কখন এসেছ? দেখলাম না তো!’
অসভ্য লোকটা হেসে বললেন,
-‘এসেছি আরো কিছুদিন আগেই। কাজে ব্যস্ত থাকায় দেখা হয়ে উঠেনি। বাকি সবার সাথেই দেখা হয়েছে।’

বাবা! এই লোক হাসতেও জানে? আমার তো মনে হয় সারাক্ষণ কেবল নিজের ঈগল আই দিয়েই শুধু তাঁকিয়ে থাকতে জানে, আর জানে মানুষকে নাজেহাল করতে।

লোকটা আসতেই পরিস্থিতি একটু অন্যরকম হলো। অর্থাৎ স্বাভাবিকের দিকে আসছে। থমথমে ভাব কাটছে। কিন্তু আমি জানি এটা সাময়িক। এখন পরিস্থিতি আরো ভয়ানক হতে চলেছে। কারণ এতক্ষণে বুঝে গেছি এরা আমাদের বিয়ের ব্যাপারে কিছুই জানেনা। আমি ধুম করেই বাবার দিকে তাঁকালাম। সে আয়ানকেই বিমোহিত নজরে দেখছেন। তারপর উঠে গিয়ে সামনে দাঁড়ালেন। কিছুক্ষণ কি কথা বললেন দূর থেকে শুনলাম না। কারণ তাদের গলার স্বর অত্যন্ত নিচু ছিল। হঠাৎ বাবা আমার দিকে ফিরলেন। বললেন,
-‘অর্নি এদিকে আসো।’
এবার আমার হৃৎপিন্ডের রক্ত চলাচল বোধ হয় বন্ধ হওয়ার উপক্রম। আমি গেলাম তো না বরং মিফতা ভাইয়ের কোমরের দিকে পাঞ্জাবিটা খামচে ধরলাম। চোখ ভিজে আসছে। কী করুন পরিস্থিতির শিকার হতে চলেছি ভাবতেই গা কাটা দিচ্ছে। আকস্মিক এমন ব্যবহার মিফতা ভাইও হজম করতে পারলেন না। অবাক চোখে চেয়ে রইলেন। আমি তো নড়লাম না বরং মিনমিনে গলায় বললাম,
-‘বাঁচাও মিফতা ভাই! প্লিজ বাঁচাও!’
-‘কী হয়েছে? কাঁদিস কেন?’
-‘এই লোককে যেতে বল প্লিজ।’
-‘কাকে? আয়ান ভাইকে?’
-‘হুম।’
-‘কেন?’
-‘বল না!’
এবার আর না পেরে জোরেই কেঁদে দিলাম। মিফতা ভাই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আমার কান্না থামাতে। খালামণি বললেন,
-‘এই কী হলো? কাঁদছিস কেন!’
আমি কিছু বলতে পারলাম না। মিফতা ভাইয়ের পেছনে আড়াল হতে চাইলাম। কিন্তু সে নিজেই সরে যাচ্ছে বারবার আমার দিকে তাঁকিয়ে কথা বলার জন্য। আমি আবারও আয়ানের দিকে তাঁকালাম। সেই একই দৃষ্টি। তবে এবারের টা চরম কঠোর। আমার হাত পা কাঁপছে। বাবা বললেন,
-‘তোমাকে বলেছি এদিকে আসো।’
বাবার গলাও কী শক্ত! আমার বাবা আমাকে এভাবে কখনো বলেন না। আজ কী হলো? চেনা বাবা কেন অচেনা? আমি গেলাম না। এদিক ওদিক তাঁকাচ্ছি। দেখলাম আপা আর মৈত্রী আপু ছুটে আসছেন এদিকে। এসেই আমাকে আলগোছে পেচিয়ে ধরলেন। মৈত্রী আপু বললেন,
-‘এই কান্না করস কেন? কী হইছে রে!’
মুখে কথা আসছেনা। মৃদুল ভাই তার চেঁচানো সেই চেনা গলাতেই চিৎকার করে বললেন,
-‘এই ভ্যাবলার মত কাঁদিস কেন? কী হয়েছে বল! কে কি করেছে?’

আমি কিছু বলতে পারলাম না। বাবা বললেন,
-‘উপস্থিত সবাইকে আমি কিছু বলতে চাই।’
সবাই নড়েচড়ে বসলেন। এই এতগুলো গুরুজনের সামনে আমার মুখ দেখানোর অবস্থাটাও নেই। আমি বুঝতে পেরে গেছি বাবা কী বলতে চলেছেন। মা ও নড়েচড়ে বসলেন এতক্ষণে। বাবা বললেন,
-‘কিছুক্ষণ পূর্বেই অর্নি এবং আয়ানের বিয়ের কার্য সম্পাদন হয়েছে।
মুহূর্তেই সারা রুমে একটা ধামাকা হলো। মা বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন। খালামণিও শক্ত হয়ে গেলেন। মা চেঁচিয়ে বললেন,
-‘কী বলছ? এটা কেমন কথা!’
-‘এটা কেবল কথার কথা না। সত্যিই হয়েছে। এই জন্যই আমি এতক্ষণ তোমাদের কোনো সিদ্ধান্তে মত দিতে পারিনি।’
বাবা খালুর দিকে এগিয়ে এলেন। বললেন,
-‘ভাই! আপনি তো জানেন আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে করাতে আমার ঘোর আপত্তি। আপনি আমি নিজেদের সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার পরেও আমাদের স্ত্রীগণ সেটা অমান্য করলেন। আমি নাকোচ করেছিলাম। ভেবেছি তারা নিজেরাই কেবল এই কথা নিয়ে আছে। এখন যখন দেখলাম মিফতা এবং মৃদুলের মনেও এমন কিছু আছে তখন আমার আর ব্যাপারটা সহনীয় লাগেনি। আমি সুপাত্র মানা করতেও পারব না। কারণ দেখাতেও পারব না। আয়ান আমার পূর্বপরিচিত। বহু আগেই তাকে মেয়ের জামাই করার ইচ্ছা ছিল। আজ কীভাবে কী হলো জানিনা সঠিক। তবে এই বিয়েতে আমি মত দিয়েছিলাম। এবং আইনত এবং ধর্মীও ভাবে এখন তারা স্বামী-স্ত্রী। আপনি কী আমার সিদ্ধান্তে কষ্ট পেয়েছেন?’

-‘অবশ্যই না। মেয়ে আপনার। মেয়ের বিয়ের ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত কেবল আপনার আর আপনার মেয়েরই। এতে আমার আপত্তি থাকার কোনো মানেই হয়না। আমি আমার স্ত্রী পুত্রের এই প্রস্তাব সমর্থন করিনি। তবে অর্নির মত থাকলে আমার আপত্তি ছিল না। এখন যখন সে আয়ানকে বিয়ে করেছে তখন আর আমি কিছু বলার অধিকার রাখিনা।’

মিফতা ভাই আমার হাত তার পাঞ্জাবি থেকে ছাড়িয়ে নিলেন। অবিশ্বাস্য নয়নে চেয়ে আছেন। আমি যেন আরো বেশি অসহায় হয়ে পড়েছি। মিফতা ভাই বললেন,
-‘অর্নি সত্যিই!’
আমি আর কী বলব! মুখ চেপে কান্না রোধ করছি। মৈত্রী আপুর হাতও আমার থেকে আলগা হলো। ছাড়ল না আমার আপা।

আয়ান এতক্ষণ চুপ করেই ছিল। হঠাৎ করেই সে উল্টো দিকে হাঁটা ধরল। পাশেই অবন্তী আপুরা ছিল তার দিকে তাঁকিয়ে কাঠ কাঠ গলায় বলল,
-‘তোর ভাবিকে নিয়ে আসবি।’

মা আর খালামণি সেখানে আর দাঁড়ালেন না। দুই বোন সোজা উপরের দিকে হাঁটা ধরল। দেখলাম দুইজনের চোখ ছলছল করছে। হায়রে! আমি আমার মায়েদের কত কষ্ট দিয়ে ফেললাম। অবন্তী আপুর চোখ মুখেও কী বিস্ময়। আমাকে নিতে এলে আমি গেলাম না। তখন মৃদুল ভাই বললেন,
-‘ও যেতে চায় না। জোর করা হচ্ছে কেন ও’কে?’
খালু শক্ত গলায় বললেন,
-‘মৃদুল!’
আমি মৃদুল ভাইয়ের দিকে তাঁকিয়ে রইলাম। এ কী! তার চোখে কী পানি টলটল করছে? আমি যেতে চাইলাম না তবে বাবা বলল,
-‘অর্নি! এই পরিবেশে এখন তোমার থাকা ঠিক হবে না।’

আমি ভেঙে পড়লাম। এত যন্ত্রনা লাগছে? কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকতেও পারলাম না। চলে এলাম। আসার আগে একবার পেছন ফিরে দেখলাম মিফতা ভাই উপরে উঠছে সিঁড়ি বেয়ে। মৃদুল ভাই থমকে আছে আর ঐ কর্ণারে অভ্র আর তিয়াস ভাই সাথে তাদের বন্ধুরা। মুহূর্তেই পরিস্থিতি পুরো বদলে গেল। এত উৎসব মুখর পরিবেশ এখন নির্জীব! এই এতগুলো লোকের দৃষ্টিতে আমি আজ খুবই নিচে নেমে গেলাম। ভাগ্য! কখন কীভাবে বদলে যায় বলা যায়না। সকালের সুখী আমিটাও এখন অনেক অসুখী।

২৬.
আয়ানদের বাড়িতে আমাকে বরণ করা হলো। আন্টি পূর্বেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। ঘটা করে আয়োজন না করলেও ভালোই প্রস্তুতি নিয়েছে যে তা বোঝাই যাচ্ছে। আমি সারাটা সময় অবন্তী আপুর সাথেই ছিলাম। সে এসে খাবার খাইয়ে দিয়েছে। তবে বেশি খেতে পারলাম না। বুক গলা সব জ্বলে যাচ্ছে। বারবার সবার সেই কষ্ট মাখা মুখ ভেসে উঠছে চোখের সামনে। কী মর্মান্তিক সেই দৃশ্য!

সারাদিনের ধকলে আমার নাজেহাল অবস্থা। এইখানে আসার এক ঘন্টা পরেই আপা এসেছিলেন আমার যাবতীয় সব জিনিস পত্র নিয়ে। মায়ের কড়া আদেশ আমি যেন আর তার কাছে না যাই। এমনিতেও বাবা আর আয়ান আমাকে এইখানেই আসতে বলেছে। আমার কোনো কথার দাম নেই। মায়ের মুখটা ভেসে ওঠে কেবল চোখের পাতায়।

গোসল নিয়েছিলাম। এরপর মাথা ধরেছিল যে তাই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। রাত তখন কয়টা বাজে খেয়াল নেই। নতুন এই পরিবেশে সব কিছুই কেমন অস্বস্তিকর লাগে। আমি অবন্তী আপুর রুমেই শুয়েছিলাম। আপু আমাকে জাগিয়ে দিলেন। বললেন,
-‘অর্নি উঠো। খাবেনা?’
আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলাম। এখন ইচ্ছে নেই। বললাম,
-‘না আপু। ভালো লাগছেনা। প্লিজ এবার আর জোর করিও না।’
আপু আর কিছু বললেন না। রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। আমার ঘুমের রেশটাও কেটে গেছে। বারবার সবার কথা মনে পড়ছে।
অবন্তী আপু এলো কিছুক্ষণ পরে। বলল,
-‘আমার সাথে আসো।’
-‘কোথায়?’
-‘গেলেই দেখতে পারবে আসো।’
ভাবলাম আমার বাড়ির কেউ হয়তো এসেছে। খুশি হলাম। দ্রুত পায়ে সামনে এগিয়ে গেলাম। না কেউ আসেনি। বরং আমাকে একটা রুমে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। বলল,
-‘এইটা তোমার রুম। এইখানে থাকো।’
আমি আৎকে উঠলাম। বললাম,
-‘না না আপু। আমি তোমার সাথেই যাব। এইখানে থাকতে পারব না।’
-‘এটা হয়না। আজ তোমাদের বাসর রাত। ভাইয়া তো আর বাহিরে থাকবেনা। ঠিকই আসবে। তুমি অন্য রুমে থাকবে সেটা তো আর হয়না। বিয়ে হয়েছে তোমাদের।’

আমি অশ্রু সিক্ত হয়ে বললাম,
-‘আপু প্লিজ!’
-‘সরি অর্নি। ভাইয়ের রাগ সম্পর্কে কিছুটা হলেও জানো। আমরা সবাই ঘর সাজিয়েছি। ভেতরে ঢুকে দেখতে পারো। যাও।’
আমাকে ভেতরের দিকে ঠেলে দিয়ে আপু দরজা আটকে দিলেন বাহির থেকে। আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম। দরজায় বারি দিলাম, কতবার ডাকলাম শুনল না। শেষে হাল ছেড়ে রুমে ঢুকলাম। এদিকটা কিছুটা হোটেল রুমের মত একটা ছোট করিডোর পেরিয়েই ভেতরে বড় একটা রুম। লাক্সারিয়াস ব্যাপার আছে। বিছানায় লাল গোলাপ দিয়ে লাভ শেইপ করা। কার্নিশে ফুলের ছড়ছড়ি। ছোট ছোট মোমবাতি নানা রঙের। এই মোমবাতি থেকে ঘ্রাণ ছড়ায়। কেমন নে’শা লেগে যাচ্ছে। রুমটা কেমন অন্যরকম। অস্বীকার গেলেও তো স্বামীর রুম। এটাই একটা শিহরণ তুলছে মনের মধ্যে। বড় গ্লাস সরালেই বারান্দা আছে বোঝা যাচ্ছে। তবে এখন সব বন্ধ, পর্দাও টানা। আমার শরীর ভয়ে চিন্তায় শীতল হয়ে আসছে। আমি গিয়ে সোফায় ধপ করে বসে পড়লাম।
কিছুক্ষণ পরই দরজার নব ঘুরে গেল। আয়ান এসেছে। আমার দিকে একবার তাঁকিয়ে ওয়াশরুমের দিকে গেল। যাওয়ার আগে কাবার্ড থেকে জামা প্যান্টও নিল। এসি চলছে তাতে আরো বেশি দম বন্ধ লাগছে। কিন্তু এসি বন্ধ করার সাহস কুলোয়নি।

ক্ষাণিক পরেই সে রুমে এলো। গোসল নিয়েছে বোধ হয়। আমি মাথা নিচু করে বসে রইলাম। কিছুক্ষণ সে নিজের মত এই কাজ সেই কাজ করল। আমি আড়চোখে কয়েকবার দেখলাম। চাইছি কাজেই ডুবে থাকুক নয়তো ঘুমিয়ে পড়ুক। কিন্তু ভাগ্যের করুন পরিহাস! সে হঠাৎ করেই গম্ভীর স্বরে বলল,
-‘তুমি ঐখানে কী করছ?’
আমার পেটে মোচড় দিয়ে উঠল। নড়লাম না। শাড়ি খামচে বসে আছি। এটা সুতির শাড়ি। অবন্তী আপু পরিয়ে দিয়েছেন। লাল রঙের তাই একেবারে বউ বউ লাগছে নাকি। এটা অবশ্য অবন্তী আপু বলেছেন। এখন তো বউই। লাগার কিছু নেই। তবে যার বউ তাকে আমার ভালো লাগেনা।

-‘তোমাকে ডেকেছি আমি।’
-‘কেন?’
-‘কেন মানে? বোঝো না! এদিকে আসো। আমার হক আদায় করা লাগবেনা?’
আমার বুক টা কেঁপে উঠল। আমার কান্না এসে গেল। ভাঙা গলায় বললাম,
-‘না!’
-‘তোমার হ্যাঁ বা না আমি শুনতে চাইনি। এদিকে আসো।’
আমি কান্না করাতেই ব্যস্ত। সে এবার ধমকে উঠল,
-‘মৌনতা!’
এবার আমি চুপসে গেলাম। মৌনতা! আমার ভালো নাম। পুরো নাম মৌনতা কবির অর্নি। আমার নামে কবির বাবার নাম থেকে নেওয়া আর আপার নামের শারমিন মায়ের নাম থেকে নেওয়া। সেই ছোট বেলায় মৌনতা নামে বাবা ডাকতো। তবে এখন সেই নামে আর কেউ ডাকেনা। কালে ভদ্রে দরকারি কাগজপত্রেই যা নামটির দরকার হয়। এই যেমন কাবিন নামায় ছিল। এমনিতে কেউ মৌনতা ডাকেনা। আমার কাজের সাথে, স্বভাব চরিত্রের সাথেই এই নাম যায় না একদম। তাই।

আমি আর কোনো উপায় পেলাম না। এই লোক কেমন তা আমার জানা হয়ে গেছে। টলমলে পায়ে তার কাছে যেতেই সে মৃদু হাসল। এই প্রথম আমার সামনে আমার কোনো কাজে তাকে হাসতে দেখলাম। এমনিতে তো শক্ত মুখ করে রাখে। এই লোকটি অসম্ভব সুন্দর। তবে তার কাজটাই তাকে আমার চোখে অন্যরকম করে তুলেছে। তাকে আমার সহ্য হচ্ছেনা।

আলতো হাতে আমাকে পেচিয়ে ধরে কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন,
-‘আমি কিন্তু সাধু পুরুষ নই একদমই।’

কিছুক্ষণ উষ্ণ স্পর্শের পর আমাকে অনাবৃত করতে গেলে যখন আমি বাঁধা দিলাম সে মানল না। শক্ত গলায় বলল।
-‘আমার ঐসব সঠিক সময়ের জন্য, তোমাকে আরো কিছুদিন সময় দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করা সম্ভব না। আমার নিজেরই হাতে সময় নেই। চলে যেতে হবে। তাই বলছি বাঁধা দিও না।’

পুরুষের স্পর্শ না কী ধারালো ছু’রির আঘাত কী বলব? হঠাৎ করেই এক অচেনা, অজানা পুরুষ দখল করে নিল আমার সবকিছুতে।
তবে একটা ব্যাপার স্পষ্ট এই লোকের স্পর্শে রয়েছে প্রলয়! নইলে আমি এতটা শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় পড়ে আছি কেন?

#চলবে।
(কথা দিয়ে কথা রাখতে পারিনি। কারণ বলতে গেলে অনেকগুলো। তবে চেষ্টা করেছিলাম। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। সময় স্বল্পতার জন্য রি-চেইক করতে পারিনি। একদম অগোছালো একটি পর্ব।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here