#কাননে_এত_ফুল (পর্ব-৯)
লেখক— ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
১৫.
অভ্রর আগমনে বেশি লজ্জা পেলাম। ধুরর! আমার মৈত্রী আপুকে রোজা না রাখার কথা বলাই ঠিক হয়নি। ছিঃ কী লজ্জা! এদিকে ঐ বিটকেলে মৃদুল ভাই! তার কি বোধগম্য হয়না যে কেন রোজা রাখিনি? হাসে কেন সে? আস্ত বদমাইশ! মিফতা ভাইকে ভালো ভেবেছিলাম এখন সেও এমন করছে! এই দিন দেখার আগে আমি একটা চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে আত্মহ’ত্যা কেন করলাম না? এই জীবন রেখে কী হলো! লাভ টা কোথায়?
উহু! লাভ ক্ষতির কথা আসছেনা। আমার জীবন তো দরকারই। আল্লাহ মাফ করুক। ছিঃ সু’ই’সা’ই’ড করার কথা কেন ভাবলাম?
রাগে অপমানে মুখ কালো করে উল্টো পথে হাঁটলাম। অর্থাৎ এইখানে এখন আর থেকে অপমানিত না হয়ে বাড়ি গেয়ে আইসক্রিম খাওয়া ঢের ভালো! তাছাড়া বাহিরে যা বাতাস হচ্ছে! এই আবহাওয়া দারুন ইঞ্জয় করা যাবে। আর বেশি কিছু হলে সমস্যা নেই। প্রতি দশ কদমে তো স্টপেজ আছেই। মানে আমার বন্ধুদের বাসা। এরা সব আমার কাছের। সবচেয়ে কাছের যেটা সেটার বাসা মিনিমাম ষাট কদম দূরে। আর দরকার হলে ভিজে ভিজে বাসায় যাব, বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হয়ে বিজলীর মত ক্ষমতা লাভ করব। তবুও এদিকে আর আসছিনা। কদাপি নহে!
আমি অভ্রকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতেই মৈত্রী আপু চেঁচিয়ে বললেন,
-“এই অর্নি যাস কোথায়?”
আমি পেছন ফিরে সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। অভ্রও থমকে গেছে যেন! আমার কী? আমি নিজের জেদ রেখেই বললাম,
-“দেখা করতে এলাম। দেখা শেষ এবার ফিরে যাচ্ছি।”
মৃদুল ভাই বললেন,
-“তা কাকে দেখতে এলি?”
-“আপনাকে ছাড়া বাকি সবাইকে।”
আমি দ্রুত পা চালিয়ে দরজা পর্যন্ত এসে গেছি পেছন থেকে মিফতা ভাই আর মৈত্রী আপুও দৌঁড়ে আসছে তা বুঝলাম। মৈত্রী আপু বলছেন,
-“অর্নি খবরদার বের হবিনা! বাহির ঝড় হচ্ছে।”
-“হচ্ছে হোক! আমি ঝড়, তুফান উপভোগ করার লোক!”
মিফতা ভাইও বললেন,
-“অর্নি যাস না।”
মিফতা ভাই কথাটা বলতে বলতেই আমার হাত খপ করে ধরে ফেললেন। আমার এবার ভীষণ রাগ হলো। আমি কী আসামী? এভাবে চোরের মত পাকরাও করল কেন আমায়? এত বড় অপমান! তার হাত ছাড়িয়ে নিলাম। দৌঁড়ে গার্ডেনে আসতেই শুরু হলো বৃষ্টি। যে সে বৃষ্টি নয়! রীতিমত প্রলয়! সব ভাসিয়ে নিবে এমন। আমার ভিজে জবথবু হতে দশ সেকেন্ডও লেগেছে কিনা সন্দেহ। আমি যে এখন পা বাড়াব সেই উপায় ও পাচ্ছিনা। কেমন আটকে রইলাম। তখনিই খালামণি ছাতা মাথায় দৌঁড়ে এলো। কাছে এসেই মাথা হাত বুলিয়ে বলল,
-“সোনামণি রাগ করেনা! আমি মৃদুলকে বকে দিব। এইসব নিয়ে হাসা ওর ঠিক হয়নি। থাক বাচ্চা মন খারাপ করিস না। দেখছিস তো কেমন ভিজে গেলি। এই রকম শরীরের অবস্থায় তোর এভাবে ভিজা ঠিক হবেনা। জ্বর আসবে তাছাড়া ভেজা কাপড়ে এই বড় রাস্তা পেরিয়ে যাবি কেমন করে! রাগ করেনা আয় আয়।”
বৃষ্টির পানিতে আমার চোখের পানি বোঝা গেল না। কান্না আর লজ্জা দু’টোই ঘিরে রেখেছে। এরা হাসল কেন? এরা কি অবুঝ নাকি? মেয়েদের যে কখনো রোজা রাখা নিয়ে প্রশ্ন করা বা হাসা ঠিক না তা কি তারা জানেনা? আমি ঠিক করলাম আর এদের সাথে কথা বলব না। চুলোয় যাক সব। আমার খালামণি তো আমাকে কিছু বলেনা। তাকে কষ্ট কেন দিব! আমি জানি এখন আমি চলে গেলে সে ইফতার টাও করবেনা। কেঁদে কুটে এক হাল করবে। আযান দেওয়া হয়ে গেছে। আমিও খালামণির সাথে বাসার ভেতরে ঢুকলাম। তিনি বলছেন,
-“মৈত্রী টা খুব কষ্ট পেত তুই চলে গেলে। আমার ভালো মেয়েটা!”
আমার কপালে চুমো দিলেন। আমার কেন যেন এবার লজ্জা আরো বেশি লাগছে।
হল রুমে আসতেই দেখি সব থমথমে মুখে টেবিলে বসে আছেন। দৃষ্টি সদর দরজায়। আমি আর খালামণি ঢুকতেই তিনজোড়া চোখ নিজেদের দৃষ্টি নিচের দিকে নিবদ্ধ করল। আমার লজ্জা বাড়ছে তো বাড়ছে, থামছেই না। এই যে এরা দৃষ্টি নত করল আমি কি তা বুঝিনি? না বোঝার কিছুই নেই। আমি হালকা গোলাপী রঙের যেই থ্রী পিস পড়েছি সেটা যে ভিজে শরীরে লেপ্টে আছে এবং আমার সেই শরীর যেটাতে এখনো বড় বড় ভাজ পড়ে সেইটা স্পষ্ট। ধুর! আমার আজ বাসা থেকে বের হওয়াই ভুল হয়েছে। না হলে এত কিছু হতো না।
মৈত্রী আপু দ্রুত কদম ফেলে আমার পাশে দাঁড়িয়ে তার সাথে আড়াল করে দোতলায় উঠে এলেন। খালামণি গেলেন সবাইকে খাবার পরিবেশন করতে। আমি এসে আপুর রুমে গিয়ে জামা খুঁজলাম। পড়ার মত পেলাম না। কারণ গতবার আগের গুলো নিয়ে গিয়েছিলাম। আর এগুলো অনেক আগের। তাছাড়া মাত্র দুই সেট তাও একটার জামা আছে তো ওড়না আর পাজামা নেই ওড়না আছে তো জামা নেই। মানে মূল জিনিসটাই নেই।
আপু আমাকে তবুও শাওয়ারে পাঠিয়ে দিলেন। বললেন একটা ব্যবস্থা করছেন ততক্ষণে যেন শাওয়ার নেই। বৃষ্টির পানিতে জ্বর আসে। শাওয়ার নিয়ে আপুকে ডাক দিলাম আপু বললেন দরজা খুলতে। হালকা ফাঁক করে হাত বাড়াতেই কাপড় ধরতে পারলাম। দরজা বন্ধ করে দেখি এটা ব্লাউজ আর পেটিকোট। আমি তো তব্দা খেয়ে গেলাম। আপুকে বললাম,
-“এগুলো কি দিলে? আমি এসব পড়ব!”
-“এখন আর কিচ্ছু পাচ্ছিনা তো রে! আমি ও তো শাড়ি পড়ি। তাই ভাবলাম এর থেকে আর কিছু নেই বেটার। তাছাড়া রোজাও তো ভাঙতে হবে। আমার দেরি হচ্ছে রে। আমার ব্লাউজ তোর হবে। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আয় শাড়িটা পরিয়ে দেই। ঘরেই তো থাকবি বাহিরে তো আর যাচ্ছিস না। লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। আয় আয়!”
১৬.
শাড়িটা সাদা আর ব্লাউজটা লাল। শাড়িটা জামদানি মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে বলছি কারণ আমি শিউর না। শাড়ির ব্যাপারে আইডিয়া তেমন নেই। আপুর সিল্ক শাড়িও আছে আবার তাঁতেরও আছে। সে আমাকে বলল আমাকে এটাই মানাবে আর কমফোর্টেবল ফিল করব। হেয়ার ড্রায়ারে চুল শুকাচ্ছিলাম। আপু রুমে এসে বলল,
-“আয় নিচে। সবাই ইফতার করতে বসেছে।”
-“বসেছে মানে? এতক্ষণে তো শেষ হয়ে যাওয়ার কথা।”
-“আরে কেউ তো শরবত ছাড়া আর কিচ্ছু খায়নি। সবাই নামায পড়ে নিয়েছে। এখন আবার খেতে বসেছে।”
-“এমন কেন?”
-“আমার আর তোর জন্য অপেক্ষা করছে।”
-“আমি যাব না।”
-“এমন করেনা অর্নি! মা সহ সবাই অপেক্ষা করছে। তুই কি এখনো ছোট? এমন অবুঝের মত আচরণ করছিস কেন?”
-“শাড়ি পড়ে যেতে অস্বস্তি লাগছে আপু।”
-“কেন? তুই কী নতুন বউ! ঘরের মেয়ে ঘরে শাড়ি পড়বে নাকি উলঙ্গ হয়ে ঘুরবে সেটা একান্তই তার ব্যপার। এত কিছু ভাবিস না চল। গরম গরম চা খেতেও হবে। চোখ লাল তোর! মনে হয় জ্বর আসবেই। তবে অর্নি!”
-“হুম?”
-“তোকে সুন্দর লাগছে। লাল লাল চোখের কারণ আরো বেশি সুন্দর লাগছে। তোর ফর্সা মুখে লাল চোখ, নাকের লাল ডগা এসব যেন সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমার তো নিজেরই তোকে লুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে রে। আমার ভাইদের চোখ যদি আজ খারাপ হয়ে যায়!”
-“আপু কী বল!”
-“থাক লজ্জা পেয়ে লাভ নেই। চল। আমার ভাইরা ওমন না। অভ্র টাও খুব ভালো।”
নিজেকে আর একবার আয়নায় দেখে নিলাম। খারাপ লাগছে না একটুও। বরং সুন্দরটাই বেশি লাগছে। ইশ! নিজেরই নজর লাগতে পারে। থাক আর দেখা লাগবেনা।
নিচে নামলাম খুব আড়ষ্ট হয়ে। সবার দৃষ্টি টেবিলেই। খালামণি প্রথমে তাঁকালেন। তার এক গাল হাসি দেখে আমার লজ্জা বাড়ে। আজব! আজ কী লজ্জা দিবস? শুধু শুধু লজ্জাই পাচ্ছি। বদমাইশ মাহতিম টাও কেমন করে তাঁকিয়ে আছে, কিছুক্ষণ তাঁকিয়ে থেকেই বলল,
-“আম্মি শাড়ি পড়েছে!”
এই কথা শোনার সাথে সাথেই মৃদুল ভাই পেছন ফিরলেন। আমি স্পষ্ট দেখলাম তার মুখ হা হয়েছে। মিফতা ভাই আর অভ্র রয়ে সয়ে তাঁকালেন। অদ্ভুত! এবার তো সব সার্কাসে পরিণত হচ্ছে। কারো চোখ সরছেনা। মৈত্রী আপু কানে ফিসফিস করে বলল,
-“দেখলি? আমার ভাইগুলোর চোখ সত্যিই খারাপ হয়ে গেছে।”
আমার এবার ইচ্ছা করছে চোখ খুলি। কারণ বারবার এটাকে স্বপ্ন বলে চালাচ্ছি। কিন্তু এটা বাস্তব। চরম লজ্জাজনক বাস্তব! অস্বস্তিদায়ক বাস্তব!
মৈত্রী আপু বললেন,
-“কীরে তোরা খাসনি এখনো?”
মিফতা ভাই হাসলেন। সেই হাসি এতটা প্রাণবন্ত! সে হেসেই বলল,
-“তোদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম।”
-“অপেক্ষা করা ঠিক হয়নি।”
-“হয়েছে।”
-“কেন?”
পাশ থেকে মৃদুল ভাই বললেন,
-“অপেক্ষার ফলটা যে মিষ্টি হয়েছে!”
তার কথা শুনে তার দিকে ফিরতেই দেখলাম তার চোখের সেই বেসামাল দৃষ্টি। আমার কি হলো! আমি আবারও লজ্জা পেলাম। মনে পড়ে গেল সেদিন বারান্দায় তার কোলে বসে পড়ার ঘটনা, সেইটা মনে করেও আমি আরো লজ্জা পেলাম। এই লজ্জায় লজ্জিত হয়ে আমার সেই একরাত কাটলো কেবলই লজ্জার ঘোরে! তারপরে খেতে বসে অভ্রর সেই চাহনীও আমাকে কেমন এলোমেলো করে দিল। তখন আমি কী সঠিক বুঝলাম আমি জানিনা। তবে একটা মেয়ের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যা জানান দেয় তার জানান আমিও পেলাম। এই তিন পুরুষের মুগ্ধতা আমি ধরতে পেলাম। এই মুগ্ধতা ধরার পরেই তাদের থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে চাইলাম। যে আমি সবসময় ক্রাশ খাওয়া আর ফ্লার্ট করায় ওস্তাদ ছিলাম সেই আমিই সেদিন লজ্জায় অস্বস্তিতে মিশে গেলাম। তাদের চোখে পড়লেও আমার গায়ে কাটা দিয়ে উঠতো। উফফ! কী যন্ত্রনা!
#চলবে।
(নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করুন। ভুল ত্রুটি ধরিয়ে দিবেন।)