#নন্দিনী_শুধু_আমার
পর্ব:২
বসার ঘরে মাথা নিচু করে বসে আছে রাজীব শাহ। তার এই জীবনে এতোটা অপমানিত কোনোদিন হতে হয়নি তাকে। এভাবে তার মেয়েটা তার মুখে চুনকালি মাখাতে পারলো? সারাজীবন কিনা এই মেয়েটাকেই সে সুশিক্ষা দিয়ে বড় করেছে? আজ বাইরের এতোগুলো মানুষ তাকে চরম অপমান করে চলে গেলো তার বাড়িতেই দাঁড়িয়ে। সে কোনো প্রতিবাদ করতে পারলো না। করবে কীভাবে? তার নিজের মেয়ে তার প্রতিবাদের ভাষা কেড়ে নিয়েছে। ব্যবসায়ী মহলে আর কোনোদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে কি সে?
মর্জিনা বেগম ভিতরের ঘরে বসে আহাজারি করছে। দুপুরের পর থেকে দুইবার অজ্ঞান হয়েছে সে। মুখে পানি ছিটিয়ে, হাতে পায়ে তেল মালিশ করে জ্ঞান ফেরানো হয়েছে তার। বেশ কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে আবার কান্নাকাটিতে ব্যস্ত হয়েছে সে।
নিশিতার মনটা খুশিতে উড়ছে আজ। বিয়ের পর এই পরিবারের লোকগুলো বিশেষ করে তার শ্বশুর আর শ্বাশুড়ি মিলে তার বাবাকে অনেক অপমান করেছে। এমনভাবে কথা বলেছে যেনো মেয়ের বাবা বলে তার কোনো সম্মানই নেই। ফিরোজের তখন অল্প বেতনের চাকরি। এজন্য তাকে নামমাত্র অল্প কিছু গহনা দেওয়া হয়েছিলো এ বাড়ি থেকে। তার শ্বশুর রাজীব শাহ সব রেখে দিয়েছিলো তার একমাত্র মেয়ের জন্য। সব মনে রেখেছে নিশিতা। তার বাবার সেই কান্নাভেজা চোখজোড়া আজও চোখের সামনে ভাসে নিশিতার। সে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের বড় মেয়ে। চাইলেও সে বাবার সাথে সেদিন এ বাড়ি ছেড়ে চিরতরে বেরিয়ে যেতে পারেনি। কিন্তু মনে মনে প্রতিশোধের আগুন জ্বলেছে তার সবসময়। আজ সেইসব দিনের প্রতিশোধ নিতে পেরে খুশিতে পাগল পাগল লাগছে তার। যদিও দু:খী দু:খী মুখ করে থাকতে হচ্ছে তাকে। কিন্তু ভিতর ভিতর সে পাখির মতো উড়ছে।
ফিরোজ ক্রুর চোখে একনাগাড়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছে। তার মন বলছে নন্দিনীর এতো সাহস হবে না এই পদক্ষেপ নেওয়ার। নিশ্চয়ই নিশিতা তাকে সাহায্য করেছে। কিন্তু কোনো প্রমাণ ছাড়া এভাবে একজনকে বারবার জেরা করাটাও শোভনীয় নয়। তাছাড়া সে যাকে দোষী ভাবছে সে আর কেউ নয়, তারই বিবাহিত স্ত্রী আর যাকে সে ভীষণ ভালোবাসে। পরিবারের চাপে প্রকাশ করতে না পারলেও সারা দুনিয়া একপাশে আর তার স্ত্রী একপাশে।
“বাবা আমাদের কি থানায় যাওয়া উচিত একবার?”
রাজীব শাহ উত্তর দেয়না। ক্লান্ত চোখে ফিরোজের দিকে তাকায়।
“মনে হয়না ওরা শহর ছেড়ে পালাতে পেরেছে এখনো। আর যদি পালিয়েও যায়, কতোদূর আর যাবে? কপর্দকহীন ছেলে, বড়জোর ওকে নিয়ে নিজের গ্রামের বাড়ি উঠাবে। ওর মেস থেকে ওর গ্রামের বাড়ির ঠিকানাটা যোগাড় করাটা কঠিন কিছু হবে না। পুলিশের মার খেলে সোজা হয়ে যাবে শয়তানটা। আমার বোনকে নিয়ে পালানো, এতো বড় সাহস।”
হঠাৎ রাজীব শাহ উঠে দাঁড়ায়। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে চাপা গলায় রোষের সাথে বললো,”আজ থেকে ওই মেয়ে আমার কাছে মৃ ত। আমি ভুলে যাবো নন্দিনী নামের কোনো মেয়ে এই বাড়িতে ছিলো। আর সবাইকে নির্দেশ দিলাম ওই নাম যেনো এ বাড়িতে আর নেওয়া না হয়। যে একবার চলে গেছে তাইএ ফিরিয়ে আনার কোনো দরকার নেই। বাইরের এতোগুলো মানুষের সামনে আমার মানসম্মান সব মাটিতে মিশে গেছে। আজ পর্যন্ত ব্যবসায়ী মহলে রাজীব শাহের চোখের দিকে তাকিয়ে কেউ কথা বলার সাহস পেতো না, সেই রাজীব শাহ আজ থেকে একটা হাসির পাত্রে পরিণত হবে। সব হয়েছে ওই মেয়ের জন্য। ও যদি নিজে থেকে ফিরে আসে আমি ওকে মেনে নিবো। যদি বিয়ে করে বাচ্চাসহ ফিরে আসে, তাও আমি মেনে নিবো। এ বাড়ির দরজা ওর জন্য বন্ধ নয়। কিন্তু আমি বা এ বাড়ির কেউ ওকে ফিরিয়ে আনতে যাবো না। এটাই রাজীব শাহের শেষ কথা।”
এতোটুকু বলে রাজীব শাহ আর দাঁড়ায় না। হনহন করে নিজের ঘরে চলে যায় সে। হতভম্ব হয়ে বসে থাকে ফিরোজ। ভিতরের ঘর থেকে স্বামীর সব কথা শুনতে পায় মর্জিনা বেগম। তার স্বামীর জিদ সে জানে। সে যদি একবার বলে নিজে থেকে ওই মেয়েকে ফিরিয়ে আনবে না, তাহলে কারো সাধ্য নেই তার সিদ্ধান্ত পাল্টানোর। আরো জোরে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে সে। নিশিতা খুব সন্তোর্পনে মুখ টিপে হেসে মনে মনে বললো,’কাঁদ বুড়ি, আরো কাঁদ। আমাকে চোর বলা তাইনা? আমি আলমারি থেকে গহনা সরাবো? এবার সবগুলো গহনা তুই পরে বসে থাক।’
মনে মনেই একচোট হেসে নিলো সে। তার শ্বাশুড়ি বিয়ের পর থেকে অনেক কষ্ট দিয়েছে তাকে। না তাকে দিয়ে হাজারটা কাজ করায়নি বা তাকে মারধোরও করেনি। কিন্তু যেটা দিয়েছে তা হলো মানসিক কষ্ট। এমন কোনো দিন নেই নিশিতা শ্বাশুড়ির ব্যবহারে কেঁদে বালিশ ভেজায়নি। আজ সব ক্ষোভ বের করছে সে মন থেকে। আজ তার বড়ই আনন্দের দিন। কিন্তু নন্দিনীর জন্য অল্পবিস্তর দুশ্চিন্তাও হচ্ছে তার। মেয়েটা ঠিকমতো সব সামলে নিতে পারলো তো? নিশিতা খুব ভালো করেই জানে নন্দিনী যে পরিবেশে বড় হয়েছে মীরন তাকে কোনোভাবেই তেমন রাখতে পারবে না। সে এটাও জানে সে যদি সাহায্য না করতো নন্দিনীর সাহস হতো না পালানোর। সে সবটা করেছে তার শ্বশুর শ্বাশুড়ির উপর ক্ষোভ থেকে। নন্দিনীর উপর তার কোনো ক্ষোভ বা রাগ নেই। মেয়েটা ভালো, তাকে পছন্দও করে নিশিতা।
মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিশিতা বললো,’আমাকে ক্ষমা করে দিও নন্দিনী। আমি যা করেছি তোমার বাবা মায়ের উপর রাগ করে। তুমি সুখী হও তাই চাই।’
এখনো সোফায় মাথা নিচু করে বসে আছে ফিরোজ। কি থেকে কি হয়ে গেলো। বোনটা তার বড়ই আদরের। নিশিতা কি সত্যিই এমনটা করতে পারে?
“কি গো এভাবেই বসে থাকবে? ঘুমাতে আসবে না?”
ফিরোজ অবাক হয়ে নিশিতার দিকে তাকালো। ও এমনভাবে কথা বলছে যেনো কিছুই হয়নি, সব স্বাভাবিক আছে। এই পরিস্থিতিতে ও নিশ্চিত হয়ে ঘুমানোর কথা বলছে?
“কি হলো এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো? না ঘুমালে তোমার শরীর খারাপ করবে তো।”
“আমার শরীর নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। তোমার ঘুম আসলে তুমি ঘুমাও।”
নিশিতা নির্লিপ্ত মুখে ফিরোজের গা ঘেঁষে বসে। ফিরোজের কাঁধে হাত রেখে বললো,”তোমার বোন তো ছোট শিশু নয়। কেউ তাকে প্ররোচিত করে বাড়ি থেকে নিয়ে যায়নি। সে যা করেছে স্বেচ্ছায় করেছে। সে কমবয়সী কিশোরী নয় যে কেউ তাকে কিছু একটা বোঝালো সে বুঝে গেলো। গ্রাজুয়েট করা বুদ্ধিমতী মেয়ে সে। নিশ্চয়ই সে সুখী হবে ভেবেই বাড়ি থেকে পালানোর কথা ভেবেছে।”
ফিরোজ অদ্ভুত চোখে স্ত্রীর দিকে তাকায়। কতো অবলীলায় মেয়েটা এসব বলে যাচ্ছে। ওর কথা শুনে মনে হচ্ছে নন্দিনী বোধহয় না পালালেই সেইটা অস্বাভাবিক হতো। পালিয়েই স্বাভাবিক কাজ করেছে। নিশিতার উপর সন্দেহ আরাও তীব্র হচ্ছে তার।
“নিশিতা তুমি বুঝতে পারছো না…..”
ফিরোজ কথাটা শেষ করতে পারেনা। তার আগেই বাড়ির কলিংবেলের আওয়াজ শুনে চমকে ওঠে ওরা দুইজন। রাত বাজে এগারোটার বেশি। এই সময় কে আসতে পারে? দুইজন দুইজনের দিকে তাকায় অবাক হয়ে। দুইজনেরই মনে একই চিন্তা,’নন্দিনী কি ফিরে এলো?’
ততক্ষণে ভিতর থেকে মর্জিনা বেগম আর রাজীব শাহ দুইজনই ছুটে এসেছে। তাদের চোখেমুখে হতভম্ব ভাব। যেনো সবাই ধরেই নিয়েছে নন্দিনীই ফিরে এসেছে।
নিশিতা কাঁপা কাঁপা পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,”দাঁড়াও আমি দেখছি কে এলো।”
নিজের শরীরটা যেনো দরজা পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে পারছে না নিশিতা। নন্দিনী কি সত্যি ফিরে এলো?
ভয়ে ভয়ে দরজা খোলে সে। আর খুলতেই নন্দিনী ঝাপিয়ে পড়ে তার বুকের উপর।
চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলে,”ভাবী, আমার অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে ভাবী। আমি ফিরে এসেছি।”
নিশিতা কাঠের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। এটা কি হলো? এমনটা তো হওয়ার কথা ছিলো না।
নন্দিনীর কান্নার শব্দে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। মর্জিনা বেগম কোনোদিকে না তাকিয়ে ছুটে আসে মেয়ের কাছে। মেয়েকে বুকে টেনে নিয়ে তার কপালে চুমু দিতে থাকে সে।
“কিচ্ছু হয়নি মা তোর। এইতো তোর মা তোর কাছেই আছে। তুই সত্যিই ফিরে এসেছিস আমার কাছে? দেখো ফিরোজের বাবা আমার মেয়ে ফিরে এসেছে আমাদের কাছে। ও ওর ভুল বুঝতে পেরেছে।”
নন্দিনীও মায়ের বুকের উপর মাথা দিয়ে ফোঁপাতে থাকে।
ফিরোজ একবার বোনের দিকে একবার বাবার দিকে তাকায়। রাজীব শাহ ক্ষিপ্র চোখে তাকিয়ে আছে মেয়ের দিকে।
“ওকে ছেড়ে দাও মর্জিনা।”
মর্জিনা বেগম হতবিহ্বল হয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললো,”তুমি এমন করোনা। আমার মেয়েটা নিজের ভুল বুঝতে পেরে ফিরে এসেছে। তুমি ওকে ক্ষমা করে দাও।”
“তোমাকে সরে যেতে বলেছি। এক কথা বারবার বলা আমার পছন্দ না তুমি জানো না?”
মর্জিনা বেগম ভয়ে ভয়ে কিছুটা সরে দাঁড়ায়। মেয়ের বাবার রাগ চণ্ডালের মতো, সে ভালো করেই জানে। একবার রাগ উঠে গেলে সে উন্মাদ হয়ে যায়। আর আজ কিনা সেই মেয়ের জন্যই তাকে এতোটা অপমানিত হতে হয়েছে। সে যদি মেয়েকে কেটে টুকরো করে পানিতে ফেলে দেয় তাও সে অবাক হবে না।
রাজীব শাহ ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে মেয়ের কাছে। নন্দিনী কাঁপছে ভয়ে। দীর্ঘ সাত বছরের ভালোবাসার কাছে নিষ্ঠুরভাবে ঠকে যাওয়ার নিদারুণ কষ্ট, সারাদিন পেটে দানাপানি পড়েনি তার উপর বাবার ভয়। নন্দিনীর মনে হচ্ছে সে যে কোনো মুহূর্তে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে।
ফিরোজ এগিয়ে এসে বাবার হাত চেপে ধরে।
“বাবা শান্ত হও। মানুষ মাত্রই তো ভুল হয়। ও না বুঝে একটা ভুল করে ফেলেছে বাবা। ওকে মাফ করে দাও বাবা।”
“ফিরোজ ভুল করলে ক্ষমা করে দেওয়া যায়, কিন্তু সে অপরাধ করে তাকে ক্ষমা করা যায়না।”
“বাবা ওকে তুমি বকো মারো যা খুশি করো, আগে ঘরে ঢুকতে দাও। মেয়েটাকে দেখলেই মনে হচ্ছে অনেক বড় কোনো ঝড় গেছে ওর উপর দিয়ে। আগে ওর সব কথা শুনি।”
রাজীব শাহ উত্তর দেয়না ছেলের কথার। চিৎকার করে ঘরের ভিতর থেকে হালিমাকে ডাকে।
“হালিমা এক কলস ঠান্ডা পানি নিয়ে এসো এদিকে।”
সবাই অবাক হয়ে রাজীব শাহের দিকে তাকায়। ঠান্ডা পানি দিয়ে কি হবে? কেবলই শীতের শুরু। দিনের বেলায় না হলেও রাতের এই সময় ভয়াবহ কাঁপুনি দেওয়া ঠান্ডা পড়ে। এই সময় ঠান্ডা পানি দিয়ে কি হবে?
মর্জিনা বেগম হাউমাউ করে ওঠে।
“ফিরোজ তোর বাবাকে শান্ত কর। কি করতে যাচ্ছে সে?”
“কানে যাচ্ছে না কি বললাম?”
হালিমা কাঁপতে কাঁপতে এক কলস ঠান্ডা পানি এনে রাজীব শাহের হাতে দেয়।
“ও পাপী হয়ে বাড়িতে ফিরেছে। এই পানি দিয়ে গোসল করে পাপ ধুয়ে ঘরে ঢুকবে ও।”
মর্জিনা বেগম আঁৎকে উঠে বললো,”তুমি কি বাবা নাকি একটা অমানুষ? এই শীতে মেয়েটাকে তুমি এই ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করালে ও তো মরেই যাবে।”
“চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো।”
নন্দিনী ছলছল চোখে বাবার দিকে তাকায়। তার মনে হচ্ছে ভীষণ জ্বর এসেছে। তাপে কাঁপছে সে। এরমধ্যে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করলে আসলেই সে মরে যাবে। ঠোঁট কাঁপতে থাকে তার তিরতির করে।
“বাবা কি করছো এসব? কি পাপ করেছে ও? আর এভাবে পাপমোচন হয়? পাগলামি বন্ধ করো।”
ফিরোজকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় রাজীব শাহ।
“বউমা, তোমার শ্বাশুড়িকে আটকাও, সে যেনো আমাকে বাঁধা দিতে না আসে।”
নিশিতা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এসব আবার কি নিয়ম? কিছুই বুঝতে পারছে না সে। এমন শাস্তির ধরণ কস্মিনকালেও দেখেনি সে।
নন্দিনীর ইচ্ছা করছে বাবার পা জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাইতে। কিন্তু একটা অদৃশ্য বাঁধা তাকে আটকে রেখেছে। যেনো কারো উপর অনেক রাগ, অনেক অভিমান জমেছে তার। মরলে মরবে, কিন্তু তাও চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবে সে। যা হয় হবে।
চিৎকার করে ওঠে নন্দিনী। তার চিৎকারে শোনা যায় অনেক দূর থেকে। সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে তার। ফর্সা মুখ নীল হয়ে গেছে।
“ওরে তোরা আমার মেয়েটাকে বাঁচা। ও মরে যাবে এবার। আমার মেয়েটাকে বাঁচা কেউ।”
মর্জিনা বেগমের চিৎকারের মধ্যেই আচমকা আরেকটা গম্ভীর পুরুষালি গলার স্বর শুনে অবাক হয়ে তাকায় ওরা দরজার দিকে।
“কি হচ্ছে এখানে? কি করছেন আপনি?”
“নির্ঝর তুমি এখানে?”
প্রায় ছ’ফুট লম্বা, শক্ত পেশীবহুল শরীরের নির্ঝর দাঁড়িয়ে আছে নন্দিনীর পাশে। নন্দিনীর শরীর পুরোপুরি নীল বর্ণ ধারণা করেছে, ঠোঁট দু’টো কালো হয়ে আছে।
নির্ঝর নিশিতার দিকে তাকিয়ে বললো,”এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? গরম কাপড় এনে উনার শরীরে পেঁচিয়ে দিন। ভিতরে নিয়ে এক্ষুনি কাপড় পালটে দিন আর গরম সেঁক দিন। আপনাদের সবার সামনে বাড়ির মেয়েকে এমন অমানবিক শাস্তি দেওয়া হচ্ছে, আর আপনারা দাঁড়িয়ে আছেন?”
রাজীব শাহ ইতস্তত করে বললো,”তুমি হঠাৎ এখানে এতো রাতে? কোনো দরকার?”
নির্ঝর রক্তলাল চোখে রাজীব শাহের দিকে তাকায়। নিশিতা ভয়ে ভয়ে শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে নন্দিনীকে চেপে ধরে নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে।
“চলো নন্দিনী, ভিতরে চলো।”
হাঁটার মতো অবস্থা নেই নন্দিনীর। সারা শরীর অবশ হয়ে আছে তার। মনে হচ্ছে কেউ ধাতব কিছু দিয়ে তার শরীর ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে।
সেই অবস্থায় সে পূর্ণদৃষ্টি মেলে নির্ঝরের দিকে তাকায়। নির্ঝর একবারও তার দিকে তাকায়নি। তার দৃষ্টি সমুন্নত।
মর্জিনা বেগম আর নিশিতা নন্দিনীকে ভিতরে নিয়ে যায়।
নির্ঝর অগ্নিচক্ষু ফেলে ফিরোজের দিকে তাকিয়ে বললো,”আপনি কি পুরুষ মানুষ? নিজের বোনকে এভাবে নির্মমভাবে অত্যা চার করা হচ্ছে আর আপনি দাঁড়িয়ে দেখছেন?”
ফিরোজ যথেষ্ট অপমানিত বোধ করে। উত্তর দিতে পারেনা সে। আসলেই তো কি উত্তর দিবে সে? তার বাবাকে যে বাড়ির সবাই যমের মতো ভয় পায়।
রাজীব শাহ গম্ভীর গলায় নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে বললো,”অপমান তো একবার করে গেলো তোমার বাবা। তাতেও শান্তি হয়নি? এবার কি তুমি নতুন করে অপমান করতে এসেছো?”
নির্ঝর রাজীব শাহের দিকে তাকায়। তার সামনে দাঁড়ানো এই মানুষটাকে তার মানুষ বলেই মনে হচ্ছেনা। যে তার নিজের মেয়েকে এই শীতের রাতে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করাতে পারে তার মনুষ্যত্ব নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে নির্ঝরের। এটা কেমন শাস্তির ধরণ?
“দেখুন আপনার সাথে কথা বলার রুচি হচ্ছে না আমার। আমরা যাওয়ার সময় আপনাদের মেয়েকে পরিয়ে দেওয়ার জন্য যে আংটিটা এনেছিলাম ওটা ফেলে গিয়েছি। বাবা বা আমার বাড়ির কেউ চায়নি এ বাড়িতে এসে আংটিটা ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। আংটিটা আমার মরহুমা দাদীর, উনি চেয়েছিলেন তার নাতবউকে ওটা দিতে। বুঝতেই পারছেন ওটা আমাদের কাছে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমি নিজেই এসেছিলাম ওটা ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। কিন্তু আসার পর আপনাদের যে রূপ আমি দেখলাম আমার এখন মনে হচ্ছে নন্দিনী পালিয়ে যেয়ে ভালো কাজ করেছে। ওর সাথে বিয়ে হলে আপনাদের মতো কুৎসিত মানুষদের সাথে আমাদের আত্মীয়তা হতো।”
রাজীব শাহ চোয়াল শক্ত করে দুইহাত মুষ্টিবদ্ধ করে। দুই আঙ্গুল ছেলে কিনা তার মুখের উপর এতো বড় কথা বলছে? শাসন করলে সে করেছে তার মেয়েকে। এই ছেলে এতো বড় কথা বলার কে? বিয়ে হয়েছে নাকি ওর সাথে? ও এভাবে কথা বলবে কেনো?
দাঁতে দাঁত চেপে রাজীব শাহ হালিমার দিকে তাকিয়ে বললো,”ওর আংটি খুঁজে ওর হাতে দাও। তারপর গেটটা ভালো করে বন্ধ করে দাও। যাতে বাড়ির কোনো কর্মকাণ্ডে বাইরের কেউ নাক না গলায়।”
রাজীব শাহ হনহন করে চলে যায়। ফিরোজ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থেকে সেও ভিতরে চলে যায়।
অচেতন হয়ে পড়ে আছে নন্দিনী। ধীরে শ্বাসপ্রশ্বাস চলছে তার। মর্জিনা বেগম মেয়ের মাথার কাছে বসে কেঁদেই যাচ্ছে। নিশিতা হাতে পায়ে জোরে জোরে সরিষার তেল মালিশ করছে।
“মা গো আমার মেয়েটা বাঁচবে তো?”
নিশিতা চমকে উঠে শ্বাশুড়ির দিকে তাকায়। এতো দরদভরা কণ্ঠে কোনোদিন সে কথা বলেনি তার সাথে।
“এরকম কথা বলবেন না মা। ও ঠিক সুস্থ হয়ে উঠবে। আপনি গরম সেঁক দিতে থাকুন।”
“ও যে কেমন নীল হয়ে উঠছে মা। আমার মেয়েটা কি মরে যাবে?”
আর্তনাদ করে ওঠে মর্জিনা বেগম। নিশিতার হঠাৎ ভীষণ কান্না পায়। সবকিছুর জন্য নিজেকে দোষী মনে হচ্ছে তার। সে যদি নন্দিনীকে এভাবে সাহস না দিতো ও এতোবড় পদক্ষেপ নিতোনা। আর তাহলে তার বাবাও এই কাজ করতো না। নিজের সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এইরকম পথ বেছে নিলো সে? কিন্তু নন্দিনী ফিরে এলো কেনো? ও চিৎকার করে বলছিলো ও নাকি ভুল করে ফেলেছে। কি ভুল করেছে ও? মীরন কি তাহলে আসেনি ওকে নিতে? নন্দিনীর জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত কিছুই জানা যাবে না।
“ওর শরীর এখন কেমন মা?”
ফিরোজের কথায় ঝাঁঝিয়ে ওঠে নিশিতা। চোখ লাল করে বললো,”লজ্জা করে না এই প্রশ্ন করতে? কেমন পুরুষ মানুষ তুমি? একটা মাত্র বোন, তোমার সামনে এতোকিছু হয়ে গেলো তুমি চুপ করে সব দেখলে। এখন এসেছো ও কেমন আছে তাই দেখতে।”
ফিরোজ কিছু বলতে যেয়েও বলেনা। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
“ফিরোজ বাবা আমার, যা একটা ডাক্তার ডেকে নিয়ে আয়। আমার মেয়েটা মরে যাবে।”
ফিরোজ নিশিতার দিকে একবার তাকিয়ে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বললো,”খবর দিয়েছি মা, গাড়ি পাঠিয়েছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে।”
নিশিতা নির্লিপ্ত চোখে ফিরোজের দিকে তাকিয়ে থাকে।
বিশাল বারান্দায় রেলিঙের উপর হাত ভর করে দাঁড়িয়ে আছে নির্ঝর। রাত অনেক হয়েছে কিন্তু তার চোখে এক ফোঁটাও ঘুম নেই। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার, কোথায় যেনো রাতজাগা একটা পাখি তারস্বরে ডাকতে ডাকতে উড়ে যায়। নির্ঝরের কোনো দিকে খেয়াল নেই। তার চোখের সামনে একটা কম্পিত নারীর চেহারা ভেসে উঠছে বারবার। ফর্সা গোলাকার মুখমণ্ডল, নীল শিরা ভেসে উঠেছে কপালে। ঠোঁট কাঁপছে তিরতির করে তার। ভেজা শরীরে এক ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যেনো তার দিকে। সেই দৃষ্টিতে মাদকতা।
নির্ঝর বিরক্ত হয়। নিজের চিন্তায় নিজেই অবাক হয়ে যায়। যে মেয়ে তাকে অপমান করে পালিয়ে যায় তার কথা সে কেনো ভাববে? ওই মেয়ের কোনো যোগ্যতা নেই তার ভাবনায় আসার। কিন্তু নিজের ভাবনার উপরও যেনো দখল হারাচ্ছে সে বারবার।
বিরক্ত হয়ে একটা সিগারেট ধরায় সে। ধূমপান করে ধোঁয়ায় নিজের ভাবনাগুলো উড়িয়ে দিতে ব্যর্থ চেষ্টা করে। কেনো ওই চোখজোড়া দিয়ে তাকালো তার দিকে মেয়েটা? কেনো তার ভিতরটা এভাবে উলোটপালোট করে দিলো?
আধখাওয়া সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় সে বারান্দা থেকে। এলোমেলো ভাবনাগুলো একটা ঠিকানা খুঁজে পেতে চায়। আচ্ছা মেয়েটা এখন কেমন আছে? ওর কি খুব বেশি জ্বর এসেছে? কীভাবে খোঁজ নিবে সে? ও বাড়িতে যাওয়ার মতো কোনো ইচ্ছা তো তার নেই।
বিছানায় এসে শুয়ে পড়ে নির্ঝর। চোখজোড়া জ্বালা করছে তার ভীষণ। মেয়েটার উপর রাগ করা উচিত তার। কিন্তু কোনো একটা অজানা কারণে তার রাগ হচ্ছে না, অদ্ভুত একটা আবেগ কাজ করছে। এমন না যে তার জীবনে আগে কোনো নারী আসেনি। সে পূর্বে বিবাহিত। নির্ঝর কিছুটা গম্ভীর, হয়তো সেভাবে ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারতো না। কিন্তু সীমাহীন ভালোবাসা দিয়েছিলো সে মেয়েটাকে গোপনে। বোঝেনি মেয়েটা তার সেই ভালোবাসা। পূর্ব প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়ে গেলো। এরপর আর কোনো মেয়েকে ভালোবাসার মতো সাহস হয়নি তার। ওই কষ্ট সে আর পেতে চায়নি। নন্দিনীকে সে আগে দেখেনি কখনো। আজই প্রথম এক নজর দেখলো। তাতেই এভাবে দূর্বল হয়ে যাওয়া পুরুষ তো সে নয়।
নির্ঝর উঠে বসে। অস্বস্তিতে শীতের রাতেও ঘাম জমে তার কপালে। গায়ের চাদরটা টেনে ফেলে দেয়। খাটের কাছে রাখা টেলিফোন টা কাঁপা কাঁপা হাতে তুলে নেয়। পাশেই নোটবুকে নন্দিনীর বাড়ির ফোন নম্বরটা রয়েছে। মেয়েটা কেমন আছে না জানলে সারারাত নির্ঘুম কাটবে তার। এমন অনুভূতি হচ্ছে কেনো তার সে জানেনা। এই অনুভূতির নাম কি তাও সে জানেনা। তার মতো এমন শক্ত হৃদয়ের পুরুষকে এতো সহজে দূর্বল করে দিতে পারে একটা নারী? তবে কি প্রথম দেখাতেই সে নন্দিনীকে ভালোবেসে ফেলেছে?
(চলবে….)