নন্দিনী_শুধু_আমার পর্ব:৩

0
196

#নন্দিনী_শুধু_আমার

পর্ব:৩

দুইবার রিং বেজে যায় টেলিফোনের, কেউ তোলে না। নির্ঝরের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে। তাহলে কি মেয়েটার শরীর অনেক খারাপ হলো? এজন্যই বাড়ির লোক ফোনটা তুলতে পারছে না? নির্ঝর নিজের আচরণে নিজেই বারবার বিরক্ত হচ্ছে। যেই মেয়ে তাকে ঠকালো, অপমান করলো সেই মেয়ের জন্য কেনো এতো ভাবছে সে? এটা তো একদমই তার ব্যক্তিত্বের বিপরীত। কিন্তু নিজের মনকে শান্ত করবে কীভাবে সে?
দুইবার চেষ্টা করার পর নির্ঝর ভাবে সে আর ফোন দিবে না, যা হয় হোক। কিন্তু পরক্ষণেই শেষবারের মতো একবার চেষ্টা কর‍তে ইচ্ছা হয় তার।
“ইটস ফিরোজ শাহ স্পিকিং, হু ইজ দেয়ার?”
ফিরোজ শাহের নাম শুনে চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে নির্ঝরের। এই কাপুরষ লোকটার সাথে একদমই কথা বলতে ইচ্ছা করছে না তার। একটা পুরুষ মানুষ হয়ে নিজের বোনের উপর এমন অমানবিক অত্যাচার হওয়া দেখে কীভাবে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে?
নির্ঝর চুপ করে থাকে। ফিরোজ কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললো,”আরে ফোন করে কথা বলছেন না কেনো? কে আপনি?”
নির্ঝর কিছু বলতে যেয়েও চুপ করে যায়। কি-ই বা বলবে সে? নন্দিনী এখন কেমন আছে এটা জিজ্ঞাসা করার কোনো অধিকার কি তার আছে?
“রাতবিরেতে কারা যে ফোন করে বিরক্ত করে এটাই বুঝিনা।”
ফিরোজ রাগ করে ফোনটা রেখেই দিবে এমন সময় নিশিতা ছুটে এসে বললো,”এই শুনছো? নন্দিনীর জ্ঞান ফিরেছে। জ্বরটাও কমেছে বেশ। জ্ঞান ফিরতেই বললো ভাত খাবে।”
ফিরোজ ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে বললো,”তুমি খাবার নিয়ে এসো, আমি ওর কাছে যাচ্ছি।”
“কে ফোন দিয়েছে এতো রাতে?”
“জানিনা, কথা বলছে না।”
নিশিতা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। কে ফোন দিতে পারে এখন? মীরন নয়তো?
ফিরোজ ফোনটা রেখে ভিতরে চলে যায়।
নির্ঝর দাঁড়িয়ে ছিলো, দাঁড়ানো থেকে ঝপ করে বসে পড়ে সে। বেশ প্রশান্তি পাচ্ছে সে এখন নিজের ভিতর। মেয়েটা এখন সুস্থ আছে। খাবার খেতে চেয়েছে মানে নিশ্চয়ই এখন শরীরটা ভালো লাগছে তার।

সারারাত ঘুম হয়না আর নির্ঝরের। এক অজানা উত্তেজনায় কেটে যায় সারারাত। সকালে নির্ঝর নিজের ঘরের বিশাল আয়নাটার সামনে দাঁড়ায়। সে যখন কিশোর তখন তার বাবা বেলজিয়াম থেকে আয়নাটা এনেছিলো তার জন্য। সাধারণত ছেলেদের ঘরে এতো বড় আয়না থাকেনা। বোধহয় সবাই মনে করে মেয়েরাই নিজেদের সৌন্দর্য বারবার দেখতে বেশি পছন্দ করে। তাই তাদের বড় আয়নার প্রয়োজন হয়। কিন্তু নির্ঝরের কেনো যেনো বড় আয়নার প্রতি ঝোঁক ছিলো সবসময়। হয়তো বড় আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে নিজের বিশালতার গভীরে হারাতে ইচ্ছা করে।
অবাক হয়ে নির্ঝর নিজের দিকে তাকিয়ে থাকে। আজ তো তার মেয়েটার উপর, নিজের বাবা মায়ের উপর সবার উপর অসম্ভব রাগ হওয়ার কথা। সে তো চায়নি আর নিজের জীবনটা কোনো নারীর সাথে জড়াতে। একবার প্রতারিত হওয়ার পর সেই ইচ্ছাই আর তার ছিলোনা। বাবা মা অনেক জোর করায় যেতে হলো তাকে মেয়ে দেখতে। নন্দিনীর ছবি দেখানো হয়েছে এর আগে। তখন থেকেই মেয়েটার উপর একটা সম্মোহন কাজ করছিলো। আর আজ ওই পদ্মের মতো ফোটা চোখগুলো যখন সামনাসামনি দেখলো তখন থেকেই তার ভিতরটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছিলো। কারো উপর তার রাগ হচ্ছেনা, চাইলেও না।

“নির্ঝর, তুমি কি মেয়েটার প্রেমে পড়েছো?”
“আমি জানিনা।”
“যদি না জানো, তাহলে কেনো ওর কথা ভাবছো বারবার? কেনো স্বস্তি পাচ্ছো না একবিন্দু?”
“এভাবে প্রেম হয়না, মাত্র একবার দেখেই….”
“এভাবেই প্রেম হয়। তুমি স্বীকার করো আর না করো। নন্দিনীর প্রেমে পড়েছো তুমি।”
“যে মেয়েটা আমাকে অপমান করলো তার প্রেমে পড়বো আমি?”
“প্রেম কি বলে কয়ে আসে নির্ঝর? আমি বলছি সব ভুলে তুমি ওর কাছে যাও। নিজের সবটা উজাড় করে তাকে বলো তুমি তার প্রেমে পড়েছো।”

“নির্ঝর বাবা, তুই কার সাথে কথা বলছিস?”
নির্ঝর কিছুটা দমে যায়। সে একা থাকলে প্রায়ই আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের সাথে কথা বলে। নিজেই প্রশ্ন করে আর নিজেই উত্তর দেয়।
“কারো সাথে না মা, কিছু বলবে?”
“অনেক বেলা হলো তো বাবা। খেতে আয়, সবাই অপেক্ষা করছে।”
“হ্যা তুমি যাও, আমি আসছি।”
নির্ঝরের মা আর কিছু না বলে চলে যায়। গতকাল থেকে তাদের মন বিষাদে ছেয়ে আছে। ছেলেটা বিয়ে করতে চায়নি, মেয়ে দেখতে যেতেও চায়নি। তারা জোর করে নিয়ে গেলো। আর এভাবে অপমানিত হয়ে এলো। ছেলেটা কি আর কখনো বিয়ে করতে চাইবে? নির্ঝরের মা হাজেরা বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

আধশোয়া হয়ে বিছানায় বসে আছে নন্দিনী। তার চোখ ঘোলাটে। সেই চোখে না রাগ না কষ্ট। শুধু একরাশ হতাশা।
নন্দিনীর হাত ধরে বসে আছে নিশিতা। তার মন ছটফট করছে গতকাল কি হয়েছে জানার জন্য। কেনো মেয়েটা সারাদিন পর রাতে ফিরে এলো?
“নন্দিনী, শুনতে পারছো আমার কথা?”
নন্দিনী ক্ষীণ স্বরে উত্তর দেয়।
“বলুন ভাবী।”
“আসলে কীভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছি না।”
নন্দিনী কিছু সময় চুপ করে থাকে। নিশিতা ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে উঠে চলে যাবে ঠিক এমন সময় নন্দিনী তার হাত চেপে ধরে।
“বসুন ভাবী। আপনি যা জানতে চাচ্ছেন সব বলবো আমি।”
নিশিতা কিছুটা ইতস্তত করে বসে।
“ভাবী ও আমাকে ঠকিয়েছে।”
নিশিতা হতবাক হয়ে নন্দিনীর দিকে তাকাতেই নন্দিনী হাউমাউ করে চিৎকার দিয়ে কেঁদে ওঠে। গত রাতের পর এই প্রথম নন্দিনী এভাবে কাঁদলো।
নিশিতা জোর করে নন্দিনীর মাথাটা চেপে ধরে বুকের সাথে। ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে নন্দিনী।
“কি বলছো তুমি এসব? মীরন তোমাকে ঠকিয়েছে? এটা কি আদৌ সম্ভব? ও তো কতো ভালোবাসতো তোমাকে। এক নয়, দুই নয় সাত বছরের সম্পর্ক তোমাদের।”
“ভাবী ও যে এতো বড় ধোঁকাবাজ আগে বুঝিনি আমি। ও পূর্ব বিবাহিত। দেড় বছর আগেই ওর বিয়ে হয়ে গেছে। এমনকি ওর স্ত্রীর বাচ্চা হবে বলে ও ওর গ্রামের বাড়িতে গেছে।”
নিশিতা আঁৎকে উঠে তাকায় নন্দিনীর দিকে। চোখজোড়া ওর একদম জবাফুলের মতো লাল হয়ে আছে।
“এসব কি বলছো তুমি? না না এগুলো সত্যি হতে পারেনা।”
“এটাই সত্যি ভাবী। গতকাল ও জায়গামতো না আসায় আমি ওর মেসে যাই যেখানে ও থাকে। ওখানে থাকা দুইটা ছেলে আমাকে সব জানায়।”
আবারও দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ওঠে নন্দিনী। নিশিতা স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে থাকে। এসব কি বলছে নন্দিনী? মীরনের সাথে তারও আলাপ আছে। সে প্রায়ই মীরনের সাথে দেখা করতে যেতে সাহায্য করতো নন্দিনীকে। দুইজন একসাথে ঘুরতে যাওয়ার নাম করে নিশিতা নন্দিনীকে মীরনের সাথে দেখা করাতো। ছেলেটাকে দেখে তো কখনো এমনটা মনে হয়নি তার। কতো ভদ্র মিষ্টি ভাষায় কথা বলতো সবসময়।
“নন্দিনী এমনটাও তো হতে পারে ওই ছেলে দু’টো মিথ্যা বলেছে তোমাকে, বা মজা করেছে।”
নিশিতার দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসে নন্দিনী। তার ছলছল চোখের এমন হাসি দেখে খুব কষ্ট হয় নিশিতার।
“ভাবী এমনটাই যদি হতো তাহলে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষটা হতাম।”
নিশিতাকে বসিয়ে রেখে নন্দিনী উঠে যায়। শরীর ক্লান্ত থাকায় একটু টলে যায় সে।
উঠে যেয়ে নিজের ব্যাগ থেকে কয়েকটা ফটো বের করে সে। সেদিকে তাকিয়ে আবারও নি:শব্দে কেঁদে দেয় সে। এরপর নিশিতার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,”দেখুন ভাবী।”
নিশিতা অবাক হয়ে ফটোগুলোর দিকে তাকাতেই বরফের মতো জমে যায়। এইতো মীরন বরের বেশে আর পাশেই একটা ষোড়শী কন্যার হাস্যোজ্জ্বল মুখে কনেবেশে বসে আছে।
“এসব কি নন্দিনী?”
“মেসের ওদের দেখিয়েছিলো মীরন কিছুদিন আগে স্ত্রীকে। এই ফটোগুলো ওর ড্রয়ারেই ছিলো। আমি বিশ্বাস করছিলাম না তাই ছেলেগুলো আমাকে এনে দিলো।”
নিশিতা পাথরের মতো বসে আছে ছবিগুলো হাতে নিয়ে। কি বলবে এখন সে?

“তুমি কি কোথাও বের হবে নির্ঝর?”
“জ্বি বাবা।”
“শনিবার তো তুমি কোথাও বের হওনা। এইদিনটা তুমি বিশ্রাম করো। আজ কোথায় যাবে?”
নির্ঝর কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললো,”সামান্য কাজ আছে বাবা।”
মোতালিব খান ছেলেকে বেশি ঘাঁটায় না। এমনিতেই তার ছেলে কিছুটা গম্ভীর এবং কম কথা বলে। আর গতকাল যা হয়েছে ওর সাথে, এতে নিজেরাই ওর কাছ থেকে দূরত্ব নিয়ে কথা বলছে।
“এ কি নির্ঝর? তুমি তো কিছুই খেলে না। এগুলো ভালো লাগেনি? অন্য কিছু বানিয়ে দিবো?”
নির্ঝর টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। কি মনে করে মায়ের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসে সে। হাজেরা বেগমের বুকটা কেঁপে ওঠে। তার এমন সুদর্শন ছেলেটা৷ গম্ভীর হলেও মানুষ হিসেবে কোনো তুলনা হয়না তার। তার জীবনটা এমন হলো কেনো? তার আগের স্ত্রী তাকে ফেলে চলে গেলো। এদিকে নন্দিনী মেয়েটাও এই কাজ করলো। হাজেরা বেগমের চোখে হঠাৎ পানি এসে যায় ছেলের জন্য।
“আসছি মা।”
“সাবধানে যাস বাবা।”

নন্দিনী কিছুটা স্বাভাবিক এখন। শুধু মাঝে মাঝে মীরনের কথা মনে করে বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসছে তার।
“আচ্ছা ভাবী, গত রাতে যে এসেছিলেন উনি নির্ঝর?”
“হ্যা, উনার সাথেই তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছিলো।”
“ভাবী উনি মনে হয় আমার উপর খুব রেগে গিয়েছিলেন তাইনা?”
“ওসব কথা এখন ভেবো না তো। একটু স্বাভাবিক চিন্তা করার চেষ্টা করো এখন।”
“কিন্তু ভাবী উনি যদি সত্যিই আমার উপর রেগে যান তাহলে বাবার হাত থেকে বাঁচালেন কেনো?”
“হয়তো মানুষটা ভালো নন্দিনী।”
নন্দিনী নিশিতাকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই কলিংবেলের আওয়াজ শুনে ভাবীর দিকে তাকায় সে।
“এই সময় আবার কে এলো ভাবী?”
“তাতো বলতে পারবো না। বাবা আর তোমার ভাইয়া তো অনেক আগেই বেরিয়েছে।”
নিশিতা উঠে গেলো নন্দিনীর পাশ থেকে। নন্দিনী ফটোগুলো দেখে আবারও হু হু করে কেঁদে ওঠে।

দরজার বাইরে নির্ঝরকে দেখে বেশ চমকে ওঠে নিশিতা। লোকটাকে গতকাল যেমন সুদর্শন মনে হয়েছিলো, সকালের মিষ্টি আলোয় তারচেয়ে কয়েকগুণ বেশি সুদর্শন লাগছে। কিন্তু চোখের নিচে কেমন কালি পড়েছে। মনে হচ্ছে রাতে ঘুম হয়নি তার। কিন্তু কথা হচ্ছে, উনি এখন এখানে কেনো?
“ইয়ে মানে আপনি?”
নির্ঝর অপ্রস্তুত হয়ে কিছুটা হাসলো। সে নিজেও জানেনা কেনো এসেছে সে এখানে। ওদের কী-ই বা বলবে?
“কে এসেছে বউমা?”
মর্জিনা বেগম এগিয়ে আসতেই নির্ঝরকে দেখে অবাক হয়ে যান।
“এ কি বাবা তুমি এখানে?”
“না মানে আসলে, এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। ভাবলাম গতকাল যাকে এমন অসুস্থ দেখে গেলাম উনি এখন কেমন আছেন একটু দেখে যাই।”
কথাটা বলেই হালকা করে ঠোঁটে কামড় দেয় সে। কি বলে ফেললো সে এটা? বললেই হতো তাদের সাথে কথা বলতে এসেছে।
মর্জিনা বেগম আর নিশিতা পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে।
“ঠিক আছে বাবা, এসো না ভিতরে এসো।”
“আচ্ছা আপনাদের অসুবিধা থাকলে নাহয় আমি পরে আসবো।”
মর্জিনা বেগম হেসে বললো,”কি যে বলোনা বাবা। এসেছো যখন পরে কেনো আসবে? এখনই এসো।”
নির্ঝর ইতস্তত করে ভিতরে ঢুকলো। নিজের আচরণে নিজেই বারবার অবাক হয়ে যাচ্ছে। সে তো কখনোই এমন ছিলোনা। এসব কি করছে সে?
“বাবা তুমি বসো এখানে।”
নিশিতা এখনো অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
মর্জিনা বেগম নিশিতার হাত ধরে টেনে কিছুটা দূরে নিয়ে যায়। গলার স্বর নামিয়ে বললো,”হা করে দাঁড়িয়ে থেকো না। যা বলছি মন দিয়ে শুনো। তোমার যে নীল জামদানী শাড়িটা আছে ওটা সুন্দর করে পরিয়ে দাও নন্দিনীকে। বেশি সাজাতে হবে না। শুধু চোখে একটু কাজল আর কপালে একটা নীল টিপ দিয়ে দাও। এরপর ওকে নিয়ে এসো এখানে।”
নিশিতা হতবাক হয়ে বললো,”মা এসব কি বলছেন? নন্দিনীর শরীরের এই অবস্থায় ওকে সাজাবো? তাছাড়া বাবা বা আপনার ছেলেও বাড়িতে নেই। ওদের কাছে কিছু জিজ্ঞাসা না করে….”
মর্জিনা বেগম মহাবিরক্ত হয়ে নিশিতার দিকে তাকায়। এই মেয়েটার সবকিছু ভালো কিন্তু একটু বেশি বুঝে, এটা পছন্দ না তার। সে তার শ্বাশুড়ি, সে যা বলবে তাই শুনবে সে। সে এতো কথা বলবে কেনো তার উপরে?
“তোমাকে যা বললাম তাই করো। অতিরিক্ত কথা বলবে না। যাও বলছি।”
নিশিতা ভ্রু কুঁচকে শ্বাশুড়ির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে যায় ভিতরে।

“ভাবী কি করছেন আপনি এগুলো? আমাকে এভাবে সাজাচ্ছেন কেনো?”
নিশিতা উত্তর দেয়না। চুপচাপ নিজের কাজ করতে থাকে সে। ভীষণ রাগ হচ্ছে তার শ্বাশুড়ির উপর। সে একজন মাস্টার্স করা মেয়ে। তার সাথে তার শ্বাশুড়ি এমনভাবে কথা বলে যেনো সে বাড়ির কাজের লোক। খুব তাড়াতাড়িই আলাদা হয়ে এই সংসার ছাড়তে হবে এমনটা চিন্তা করে সে।
“কি হলো ভাবী? চুপ করে আছেন কেনো? আমার শরীরটা খুবই দূর্বল। তাছাড়া আমার মনের অবস্থাও ভালো নয় যে সাজগোজ করবো।”
নিশিতা তাও চুপ করে থাকে। সে এখন নন্দিনীর চোখে কাজল দিতে ব্যস্ত।
নন্দিনী বিরক্ত হয়ে বললো,”ভাবী তখন থেকেই চুপ করে আছেন কেনো? দয়া করে কিছু বলুন।”
টিপটা কপালে দিয়েই নিশিতা তাকায় নন্দিনীর দিকে। এই সামান্য সাজেই মেয়েটাকে এতোটা মোহনীয় লাগছে যে সে চোখ ফেরাতে পারছে না। আচ্ছা, নির্ঝর সাহেব কি তাহলে নন্দিনীর প্রেমে পড়েছে? একবার দেখাতেই মন দিয়ে ফেলেছে?
“এইতো খুব সুন্দর লাগছে। এবার এসো আমার সাথে বসার ঘরে।”
“বসার ঘরে যাবো মানে? কে এসেছে ওখানে?”
নিশিতা কিছু না বলে মুচকি হাসে। নন্দিনী হালকা চিৎকার করে উঠে বললো,”ভাবী মীরন এসেছে তাইনা?”
নিশিতার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। হাত দিয়ে নন্দিনীর মুখ চেপে বললো,”চুপ করো। কি বলছো এসব? যে ছেলেটা এভাবে তোমাকে ঠকালো, তুমি তার আশা করছো? অবাক হয়ে যাই তোমার কথা শুনে।”
কর্পূরের মতো উবে যায় হাসিটা মুখ থেকে নন্দিনীর।
“তাহলে কে এসেছে ভাবী?”
“গেলেই দেখতে পাবে।”

“আজ বরং আমি উঠি খালাম্মা। উনি সুস্থ আছেন জেনে ভালো লেগেছে। অন্য একদিন নাহয় আসবো।”
মর্জিনা বেগম তাড়াতাড়ি করে বললো,”আরে কি যে বলো বাবা। এখনই উঠে যাবে কেনো? কিছুই তো খেলে না।”
“আমি খেয়ে এসেছি, এখন কিছু খাবো না।”
“একটু অপেক্ষা করো, ও আসছে।”
নির্ঝর ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললো,”জ্বি কি বললেন? কে আসছে?”
মর্জিনা বেগম কিছু বলার আগেই নির্ঝরের পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখে নন্দিনী এসেছে। তার চোখে মুখে ভয় আর বিস্ময়। মর্জিনা বেগম স্তম্ভিত হয়ে নন্দিনী আর নির্ঝরকে কাছাকাছি দেখে। কি সুন্দর মানিয়েছে ওদের। মেয়েটাকে আজ এতো সুন্দর লাগছে কেনো? নীল শাড়িতে যেনো সাক্ষাৎ আকাশ থেকে নেমে আসা পরী। মর্জিনা বেগম নজর লেগে যাওয়ার ভয়ে চোখ নামিয়ে নেয়।
“ওইতো নন্দিনী চলে এসেছে।”
নির্ঝরের মনে হলো তার হৃৎস্পন্দন হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেছে। চাইলেও নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সে। পিছনে ঘুরে তাকানোর যেনো সাহস পাচ্ছে না সে। এই বয়সে এসে কিশোর বয়সীদের মতো বুকের ভিতর প্রেমের উথাল-পাতাল হওয়া কি স্বাভাবিক? নির্ঝর বুঝতেই পারেনা।
মর্জিনা বেগম উঠে দাঁড়ায়। হাত ধরে নন্দিনীকে টেনে সামনে নিয়ে আসে। নির্ঝর এক পলক সেদিকে তাকিয়েই চোখ বন্ধ করে ফেলে। কলেজ জীবনে ক্লাসের এক ম্যাডামকে খুব ভালো লেগেছিলো তার। না প্রেম নয়, নেহাৎ ভালো লাগাই। সে যখন শাড়ি পরে আসতো এভাবেই নির্ঝর তার দিক থেকে চোখ নামিয়ে নিতো। অতিরিক্ত সুন্দর কিছু বেশিক্ষণ দেখা যায়না।
নন্দিনী হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে নির্ঝরের দিকে। এসব কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না সে।

ছাদের এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে নির্ঝর আর নন্দিনী। নন্দিনীর মনে হচ্ছে আবার জ্বর আসবে। বারবার কেঁপে উঠছে শরীর। মর্জিনা বেগম জোর করে তাদের ছাদে পাঠিয়েছে। সে বা নির্ঝর কেউ চায়নি।
“নির্ঝর সাহেব।”
নির্ঝর চোখ তুলে তাকায়। মেয়েটার কণ্ঠ এতোটা সুন্দর, যেনো সুর করে গান করছে। নির্ঝরের মনে হলো সে সারাজীবন এই নির্ঝর সাহেব ডাক শুনে কাটিয়ে দিতে পারবে।
“জ্বি বলুন।”
“আপনি দয়া করে স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ান।”
“আমি স্বাভাবিক আছি।”
নন্দিনী বুঝতে পারে না সে কোনদিকে কথা এগিয়ে নিবে। এই মানুষটার উদ্দেশ্য কি তাও বুঝতে পারছে না সে। সে শুনেছিলো মেয়েদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় খুব প্রখর হয়। তারা অনেক কিছু বুঝতে পারে। কিন্তু সে এখনো বুঝতে পারছে না?
“আপনি কি আমাকে কিছু বলতে চান নির্ঝর সাহেব?”
নির্ঝর পূর্ণ দৃষ্টি মেলে নন্দিনীর দিকে তাকায়। তার কাজল দেওয়া লাল টকটকে চোখগুলো দেখে বুকের মধ্যে সূক্ষ্ম ব্যথা হয় তার।
“আসলে নন্দিনী ম্যাডাম, আপনি গত রাতের পর কেমন আছেন জানতে এসেছিলাম।”
নন্দিনী হঠাৎ শব্দ করে হেসে দেয়। নির্ঝরের সমস্ত সত্ত্বা কেঁপে ওঠে। এভাবে কোনো মেয়ে তাকে ঘায়েল করতে পারে সে কোনোদিন ভাবেনি।
“এটা তো আপনি ফোন করেও জেনে নিতে পারতেন।”
নির্ঝর কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললো,”জ্বি ঠিক বলেছেন। আজ তবে আসি?”
“নির্ঝর সাহেব।”
“বলুন।”
“আপনি শুধু আমি কেমন আছি জানতেই আসেননি। আমাকে দেখতেও এসেছেন, তাইনা?”
নির্ঝর উত্তর দেয়না। এই শীতেও কেমন ঘাম ঝরে তার।
“কেনো এলেন নির্ঝর সাহেব? যে মেয়েটা আপনাদের অপমান করলো তাকে কেনো দেখতে এসেছেন আবার?”
নির্ঝর যেনো নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই। সে নিজেও জানেনা সে কি বলছে বা কি করছে।
“ভুল তো মানুষ মাত্রই হয় নন্দিনী ম্যাডাম।”
নন্দিনী অবাক চোখে তাকায় নির্ঝরের দিকে।
“ভুল? হ্যা ভুল তো বটেই। সাত বছর ধরে একটা ভুল মানুষকে ভালোবেসেছি আমি। এতোদিনে একবিন্দুও মনে হয়নি সে আমাকে ঠকাচ্ছে। আমার দিক থেকে ভালোবাসার তো কমতি হয়নি। তবে কেনো আমি ঠকে গেলাম?”
নির্ঝরের অসহ্য লাগে কথাগুলো। সে জানেনা কেনো এমন বিষের মতো কানে বাজলো তার কথাগুলো। সে ভালোবাসতেই পারে একজনকে। নির্ঝর নিজেও তো পূর্বে বিবাহিত। তাও এমন কেনো লাগছে তার?
“পুরোনো কথা নাহয় ভুলে যান নন্দিনী ম্যাডাম।”
নন্দিনী উত্তর দেয়না। তার সামনে দাঁড়ানো এই সুদর্শন মানুষটার সাথে কি কোনো মিল আছে মীরনের? মনে হয় না। এই মানুষটা উজ্জ্বল ফর্সা, বেশ লম্বা, বলিষ্ঠ স্বাস্থ্য। আর মীরন শ্যামলা, কম উচ্চতার। সে কেনোই বা এই মানুষটার মধ্যে ওই প্রতারককে খুঁজবে?
হঠাৎ নির্ঝর একটা অদ্ভুত কথা বলে বসলো। সে নিজেও জানে না কীভাবে এটা বলতে পারলো সে?
“সবকিছু ভুলে কি আমরা একসাথে পথ চলতে পারিনা নন্দিনী ম্যাডাম?”
নন্দিনী চমকে উঠে তাকায় নির্ঝরের দিকে। সে কি মজা করছে? কিন্তু তার চোখ দেখে তো মনে হচ্ছে না সে মজা করছে। চোখের গভীরতায় কি ভীষণ আকুলতা। নন্দিনীর বুক কাঁপতে থাকে।
“আমি আপনাকে জোর করবো না। সেই অধিকারও আমার নেই। ভয়ংকর অতীত থাকতেই পারে। আমারও আছে, আপনারও আছে। আমরা দুইজনই কারো না কারো কাছ থেকে ঠকেছি। এই ভগ্ন হৃদয় দু’টো কি কাছাকাছি আসতে পারেনা?”
নন্দিনী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বললো,”করুণা করতে চাইছেন আমাকে?”
নির্ঝরের মুখটা অন্ধকার হয়ে যায়। জোর করে ম্লান হেসে বললো,”না ভালোবাসতে চাইছি। বিশ্বাস করুন, আমি নিজেও ভাবতে পারিনি গতকাল আপনার ওই মায়াভরা চোখে আমি কি দেখেছি। সত্যিই এর আগে ভীষণ রাগ হয়েছিলো আমার আপনার উপর। কোনোদিনই আপনার মুখ দেখতে চাইনি আমি। কিন্তু আমি নিজেও জানিনা এক পলকে আমার কি হয়ে গেলো। গত রাত পুরোটাই আমার কেটেছে নির্ঘুম আর আপনার চিন্তায় বিভোর হয়ে। এটা আমার আচরণের সাথে একদমই বেমানান। তবুও আমি নিজের অজান্তেই আপনার চোখে হারিয়ে গেলাম।”
নন্দিনীর ভীষণ জ্বর আসছে। শরীরের উত্তাপ সে টের পাচ্ছে। মীরনকে এতো সহজে ভোলা তার পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু যে মানুষটা এভাবে নিজেকে ভেঙেচুরে দিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তাকে কি বলবে? মীরন তাকে ঠকিয়েছে, কিন্তু নন্দিনীর ভালোবাসা তো মিথ্যা ছিলো না। সে তো এখনও ওই প্রতারককেই ভালোবাসে।
নন্দিনীকে চুপ করে থাকতে দেখে নির্ঝর থেমে যায়। নিজেকে কিছুটা সামলে সূক্ষ চোখে তাকায় সে নন্দিনীর দিকে।
নন্দিনী কাঁপা গলায় বললো,”কি দেখছেন ওভাবে?”
“আপনার টিপটা ভ্রু যুগলের মাঝ বরাবর বসেনি, বাঁ পাশে বেঁকে গেছে।”
নন্দিনী অনিচ্ছাসত্ত্বেও টিপ ঠিক করার ব্যর্থ চেষ্টা করে কিছুক্ষণ।
আচমকা নির্ঝর একটা অবাক করা কাজ করলো। সে টিপটা কপালের ঠিক মাঝ বরাবর বসিয়ে দিলো। অতি সন্তর্পণে করার চেষ্টা করলো যেনো নন্দিনীর কপালে তার স্পর্শ না পড়ে। কিন্তু এতোই কি সহজ? প্রকৃতি তো চায় তারা একে অপরের কাছে আসুক। ঠিকই কিছুটা স্পর্শ লেগে যায় নির্ঝরেত আঙ্গুলের নন্দিনীর কপালে।
নন্দিনীর স্থাণুর মতো জমে যায় উত্তাপভরা কপালে হিমশীতল স্পর্শ পেয়ে। কাঁপুনি ধরে যায় তার।
“আপনার শরীরে তো অসম্ভব জ্বর নন্দিনী। আগে কেনো বলেননি?”
নন্দিনীর হঠাৎ মনে হলো সে জ্ঞান হারাচ্ছে। জ্ঞান হারানোর ঠিক আগ মুহুর্তে একটা পুরুষালী মুখাবয়ব চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার। যার মুখ জুড়ে একরাশ উৎকণ্ঠা। যেনো নন্দিনীর কিছু হয়ে গেলে তার অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। নন্দিনীর জ্ঞান হারানোর দুই সেকেন্ড আগেই ঠিক করে এই মানুষটাকে সে কষ্ট দিবে না।

(চলবে….)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here