নন্দিনী_শুধু_আমার পর্ব:৪

0
180

#নন্দিনী_শুধু_আমার

পর্ব:৪

নির্ঝরের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে রাজীব শাহ। ছেলেটার উদ্দেশ্য এখনো বুঝতে পারছে না সে। যে মেয়ে তাকে অপমান করে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেলো তাকেই কিনা বিয়ে করতে চায় ছেলেটা? এখানে দুইটা কারণ হতে পারে। হয় ছেলেটা অনেক ভালো, আর নাহয় সে নন্দিনীকে বিয়ে করে প্রতিশোধ নিতে চায় অপমানের। এ দুই কারণের মধ্যে আসল কারণ কোনটা এখনো বুঝতে পারছে না রাজীব শাহ।
“তার মানে তুমি বলতে চাচ্ছো তুমি নন্দিনীকে বিয়ে করতে চাও?”
নির্ঝর স্মিত হেসে বললো,”শুধু আমি চাইলে তো হবে না। উনাকেও চাইতে হবে। উনি যদি চান তাহলে অবশ্যই আমি উনাকে বিয়ে করতে চাই।”
রাজীব শাহ ফিরোজের দিকে তাকালো। ফিরোজ এখনো বুঝতে পারছে না কি বলবে। তাছাড়া এই ছেলেটাকে তার নিজেরও পছন্দ হয়েছিলো নন্দিনীর জন্য। মাঝখান থেকে মেয়েটা যে কি করলো।
“যা হয়েছে সব তো তোমার সামনেই হয়েছে। এতোকিছুর পরেও ওকে তুমি কেনো বিয়ে করতে চাও?”
নির্ঝর পূর্ণ দৃষ্টি মেলে রাজীব শাহের দিকে তাকায়। কিছুটা ঘাবড়ে যায় রাজীব শাহ। ছেলেটা সহসা চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেনা। কিন্তু হঠাৎ তাকালে তার অন্তর্ভেদী দৃষ্টি দেখলে বেশ অবাক হতে হয়।
“ভুল মানুষ মাত্রই করে চাচাজান। উনি তো মানুষ, ফেরেশতা নন। নিশ্চয়ই উনি যার হাত ধরে পালাতে চেয়েছিলেন তার সাথে কোনো সমস্যা হয়েছে। এজন্যই তিনি ফিরে এসেছেন। আমার নিজেরও তো একটা কষ্টের অতীত আছে। আমি নিজেও পরিপূর্ণভাবে শুদ্ধ নই।”
এরপর আর কিছু বলার থাকে না। রাজীব শাহ চুপ করে বসে থাকে।
ফিরোজ বাবার দিকে একবার তাকিয়ে বললো,”তোমার বাবা মা কি এই ব্যাপারে জানেন? উনারা কি মত দিয়েছেন? নাকি তুমি নিজেই এই প্রস্তাব নিয়ে এসেছো?”
নির্ঝর উঠে দাঁড়ায়। বুকে দুই হাত বেঁধে মুচকি হেসে বললো,”বিয়েটা আমি করবো। তাই আমার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তবে হ্যা, উনাদের মতামতেরও প্রয়োজন আছে। তবে আপনারা দুশ্চিন্তা করবেন না। তাদের রাজি করানোর দায়িত্ব আমার। আপনারা ভেবেচিন্তে আমাকে জানাবেন। আর অবশ্যই নন্দিনী ম্যাডামের মতামত নিবেন। তার অমতে আমি অবশ্যই তাকে জোর করে বিয়ে করবো না।”
রাজীব শাহ আর ফিরোজও উঠে দাঁড়ায় নির্ঝরের সাথে। তাদের এখনো অবিশ্বাস্য লাগছে সবটা। তারা ভেবেছিলো পরবর্তীতে মেয়েটার বিয়ে দিতে বেশ সমস্যা হবে তাদের। আজ বাজারে যা হলো।
নির্ঝর ফিরে যাচ্ছিলো। আবার কি মনে করে ওদের দিকে ফিরে বললো,”ও হ্যা আর একটা কথা। আপনারা অবশ্যই জোর করে উনাকে রাজি করাবেন না। উনি যদি স্বেচ্ছায় আমাকে বিয়ে করতে চায় তাহলেই শুধুমাত্র বিয়েটা হবে। উনি যদি তার জন্য কিছু সময় চায় তাকে সময় দেওয়া হবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। আজ তবে চলি?”
নির্ঝর আর কথা বাড়ায় না। হনহন করে বেরিয়ে যায় ঘর ছেড়ে।

ফিরোজ এসে বাবার পাশে দাঁড়ায়। মর্জিনা বেগম পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলো। নির্ঝর চলে যেতেই ছুটে তাদের কাছে আসে।
“ফিরোজের বাবা তুমি আর অমত করোনা। আমার মনে হচ্ছে ছেলেটা ভীষণ ভালো। এতোকিছুর পরেও নিজে এসেছে প্রস্তাব নিয়ে। মেয়েটা একটা অন্যায় করে ফেলেছে। তুমি ওকে ক্ষমা করে দাও।”
রাজীব শাহের মুখ লাল হয়ে যায়। চিৎকার করে বলে,”তোমার ওই নির্লজ্জ মেয়ের মুখও আমার আর দেখতে ইচ্ছা করছে না। এসব খবর বাতাসের আগে কানে কানে পৌঁছে যায়। কে বা কারা বাজারে জানিয়ে দিয়েছে বিখ্যাত ব্যবসায়ী রাজীব শাহের একমাত্র মেয়ে প্রেমিকের সাথে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলো। এরপর আবার সারাদিন কাটিয়ে রাতের আঁধারে বাড়ি ফিরে এসেছে। যে বাজারের মানুষেরা রাজীব শাহের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে ভয় পেতো, সেই মানুষ গুলোই আজ আড়ালে আমাকে নিয়ে হাসছে। আর কতো অপমানিত হতে হবে আমাকে ওই মেয়ের জন্য? কোথায় বা বিয়ে দিবো ওকে আমি? যদি নির্ঝরের পরিবার সত্যিই রাজি হয়, আমি একদিনের মধ্যে আপদ আমার বাড়ি থেকে বিদায় করবো।”
রাজীব শাহ কথা থামিয়ে হাঁপাতে থাকে। ফিরোজ এসে বাবার হাত চেপে ধরে বললো,”বাবা এসব কি বলছো তুমি? ও আমাদের বাড়ির একমাত্র মেয়ে, কতো আদরের আমাদের। ওকে তুমি আপদ বলছো? আজ একটা ভুল করে ফেলেছে বলে তুমি ওকে এভাবে বলোনা। মেয়েটা শুনতে পাচ্ছে। কতোটা কষ্ট পাবে একবার ভাবো।”
রাজীব শাহ এক ঝটকায় ছেলের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,”ওর ভাবাভাবি নিয়ে আমার চিন্তা করার কোনো ইচ্ছা নেই। বউমাকে বলো ওর সাথে কথা বলে যেনো ওর সিদ্ধান্ত জানায়। যদি লজ্জা থাকে যেভাবে হোক আমার বাড়ি থেকে বিদায় নিবে ও খুব তাড়াতাড়ি।”
রাজীব শাহ আর কিছু না বলে চলে যায়। মর্জিনা বেগম আঁচলে মুখ চেপে কাঁদতে থাকে।

“সবই তো শুনলে নন্দিনী, কি করবে তুমি এখন?”
জানালার শিক ধরে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে নন্দিনী। আত্মহ ত্যা করা মহাপাপ, তাই আজও সে নিজেকে শেষ করে দিতে পারেনি। নিজের বাবার কাছ থেকে এতো বড় কথা আজ তার শুনতে হলো। আসলে শুনতে তো তাকে হবেই। যে অন্যায় সে করেছে, তার জন্য তার বাবা বাজারে মুখ দেখাতে পারছে না। মেয়ে হিসেবে এই লজ্জা সে কাকে দেখাবে?

“নন্দিনী।”
নিশিতা নন্দিনীর কাঁধে হাত রাখে।
“কি ভাবছো এভাবে?”
“ভাবী আমার কি করা উচিত এখন?”
“আমার মনে হয় তোমার নির্ঝর সাহেবকে বিয়ে করে নেওয়াটাই সবার জন্য ভালো হবে।”
নন্দিনী উত্তর দেয়না। নিশিতা নন্দিনীকে টেনে সামনের দিকে ফেরায়।
“এ কি তুমি এভাবে কাঁদছো কেনো?”
নন্দিনী ফুঁপিয়ে উঠে বললো,”আজ বাবা আমাকে আপদ বললো ভাবী। এই মুখ আর আমার দেখাতে ইচ্ছা করছে না কাউকে। কেনো মরে যাচ্ছি না আমি এখনো?”
নিশিতা নন্দিনীকে বুকে টেনে নেয়। এই সবকিছুর জন্য সে নিজেকে দায়ী করছে। আজ যদি প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে সে নন্দিনীকে উষ্কে না দিতো সবকিছু হয়তো এমন হতোনা। কিন্তু নন্দিনী নিজেও তো মীরনকে পাগলের মতো ভালোবাসতো।
“চুপ করো নন্দিনী, কেঁদো না। বাবা যা বলেছেন কষ্ট থেকে বলেছেন। নিজেই তো শুনলে বাজারে বাবাকে অপমানিত হতে হয়েছে। এজন্যই হয়তো রাগ হয়ে এসব বলেছে। কোনো বাবার কাছে কি তার মেয়ে কখনো আপদ হতে পারে?”
নন্দিনী ফোঁপাতে থাকে।
“আমি বলি কি নন্দিনী, যা হওয়ার তাতো হয়েই গেছে। তুমি নির্ঝর সাহেবকে বিয়ে করে নাও। আমার যতোদূর মনে হচ্ছে মানুষটা খারাপ নয়। তুমি সুখী হবে দেখো।”
নন্দিনী বিষাদ মেশানো ঠোঁটে ম্লান হাসে।
“সুখের কথা বলছেন ভাবী? আমি তো একজনকে নিয়েই সুখী হতে চেয়েছিলাম। সে আমাকে এতো বড় ধোঁকা দিলো। আমি আর কোনোদিনও সুখী হতে পারবো না। আমি মীরনকে ছাড়া আর কাউকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতে চাইনা ভাবী।”
নিশিতা কিছুটা বিরক্ত হয়ে নন্দিনীর দিকে তাকিয়ে বললো,”তুমি কি বুঝতে পারছো তুমি কি বলছো? যে মানুষটা তোমাকে এভাবে ঠকালো তুমি তার কথা ভেবে আর বিয়েই করতে চাওনা? কিন্তু সে তো ঠিকই তার সংসার নিয়ে ভালো আছে। তুমি কেনো নিজের জীবনটা তার কথা ভেবে শেষ করে দিবে?”
“ভাবী, তার ভালোবাসা মিথ্যা ছিলো হয়তো, কিন্তু আমার ভালোবাসা তো মিথ্যা নয়। তাছাড়া নির্ঝর সাহেব আসলেই একজন ভালো মানুষ। আমি কীভাবে অন্যের চিন্তায় বিভোর হয়ে তাকে ঠকাবো, আপনিই বলুন ভাবী।”
নিশিতার ভীষণ রাগ হয় মেয়েটার এমন নাটকীয় কথা শুনে। যে ছেলেটা বিবাহিত হয়েও দিনের পর দিন নিজেকে অবিবাহিত পরিচয় দিয়েছে, সম্পর্ক থাকা অবস্থাতেও অন্য একজনকে বিয়ে করে ফেলেছে আবার পুনরায় প্রেমের অভিনয় করে গেছে নন্দিনীর সাথে তার জন্য এমন ভালোবাসা দেখানো বাড়াবাড়ি ছাড়া আর কিছুই নয়।
“এভাবে দিন চলবে না নন্দিনী। নিজের কথা না ভাবো একবার বাবা আর নিজের ভাইয়ের কথা ভাবো। তোমার জন্য তারা বাইরে মুখ দেখাতে পারছে না। কীভাবে এতোটা স্বার্থপর হতে পারো তুমি?”
নন্দিনীর আহত চোখে নিশিতার দিকে তাকায়। নিশিতা কখনো তার সাথে এভাবে কথা বলেনি। আজ সে-ও তাকে ভুল বুঝছে? মুহুর্তেই চোখজোড়া ছলছল করে ওঠে তার।
নিশিতার একটু কষ্ট লাগে। সে নন্দিনীর পাশে বসে তার হাতের উপর হাত রেখে বললো,”বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে তুমি দেখো। এই তুমিই একদিন নির্ঝর সাহেবের প্রেমে অস্থির হয়ে যাবে। এই কষ্ট সাময়িক। স্বামীই একজন নারীর প্রেমিক হওয়ার দাবিদার।”
নন্দিনী ফ্যাকাশে মুখে তাকায় নিশিতার দিকে। নিশিতার ভরসার হাসি দিয়ে বললো,”তুমি দেখা করো আরেকবার উনার সাথে। আমার মনে হয় তুমি রাজি হয়ে যাবে।”
নন্দিনী উত্তর দেয়না। নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে থাকে শূণ্যের দিকে।

নন্দিনী আর নিশিতা বসে আছে একটা কফিশপে। অনেক কষ্টে নিশিতা নন্দিনীকে রাজি করিয়েছে নির্ঝরের সাথে দেখা করার জন্য। কিন্তু নন্দিনী কোনোভাবেই একা দেখা করতে চায়না। জোর করে নিশিতাকে ডেকে এনেছে। অগত্যা তাকে আসতেই হলো। নির্ঝরের আসার কথা অনেক আগেই, এখনো পৌঁছায়নি সে।
“লোকটার কি সময়-জ্ঞান বলে কিছু নেই? দুইটা মেয়ে এসে বসে আছে, তার এখনো আসার নাম নেই।”
নিশিতা ঝাঝিয়ে ওঠে।
নন্দিনী স্মিত হেসে বললো,”এমন বলছেন কেনো ভাবী? হয়তো উনার কোনো কাজ পড়ে গেছে। আমরা একটু অপেক্ষা করি।”
নন্দিনীর মনটা আজ কিছুটা ভালো। বেশ অনেকদিন পর বাড়ি থেকে বের হয়েছে সে। সেদিকের ঘটনার পর বাড়ি থেকে বের হওয়ার ইচ্ছাটাই মরে গিয়েছিলো তার।
নিশিতা অবাক হয়ে নন্দিনীর দিকে তাকায়।
“বিয়ে হয়নি তাতেই এতো দরদ?”
নন্দিনীর মুখ রক্তিম হয়ে যায়, যদিও সে ওভাবে বলেনি। নিশিতা মুচকি হাসে অন্যদিকে ফিরে।

প্রায় মিনিট বিশেক পর হন্তদন্ত হয়ে কফিশপে ঢুকলো নির্ঝর। ঢুকেই ইতিউতি খুঁজলো নন্দিনীদের। এরপর ওদের দেখতে পেয়ে হাসি ফুটে ওঠে তার মুখে। নিশিতা হালকা ধাক্কা দেয় নন্দিনীকে। নন্দিনী মিইয়ে যায় লজ্জায়।
“আসলে আমি অনেক দু:খিত। কীভাবে যে ক্ষমা চাইবো আপনাদের কাছে। আসলে আমি সময়মতোই রওনা দিয়েছিলাম। রাস্তায় ছোট্ট একটা দুর্ঘটনা হলো, ড্রেসিং করতে যেতে….”
উৎকণ্ঠিত হয় নন্দিনী আর নিশিতা। নন্দিনী ব্যস্ততার সাথে বলে ওঠে,”দুর্ঘটনা মানে? কি হয়েছে?”
নির্ঝর ভাবতেও পারেনি নন্দিনী এতোটা উদ্বিগ্ন হবে। সে কিছুটা অবাক হয়ে বললো,”তেমন কিছু না। এতোটা ভয় পাওয়ার কিছু হয়নি। ইটের সাথে লেগে পায়ের আঙ্গুল কিছুটা কেটে গেছে। এখন ঠিক আছি।”
“সাবধানে চলাফেরা করা উচিত।”
“জ্বি অবশ্যই। এখন কি বসতে পারি আমি?”
নিশিতা জিভ কামড়ে ধরে। তারা যে এখনো মানুষটাকে বসতেই বলেনি সে খেয়ালই নেই।
সে কিছু বলতে যাবে তার আগেই নন্দিনী বলে,”কেউ কি মানা করেছে বসতে? চেয়ার তো রয়েছেই বসার জন্য।”
নির্ঝর মুচকি হেসে চেয়ার টেনে বসে। মেয়েটা কি তাকে একটু একটু পছন্দ করতে শুরু করেছে? এভাবে কপট রাগ করতে দেখে মেয়েটাকে কি সুন্দর লাগছে। আজ যেনো তাকে একটা ফুটন্ত পদ্মের মতো স্নিগ্ধ লাগছে। হালকা গোলাপি শাড়িতে কোনো মেয়েকে এতোটা সুন্দর লাগতে পারে নির্ঝর ভাবতেই পারেনি। সাজসজ্জায় কোনো আতিশয্য নেই। তবুও যেনো চোখজোড়া চুম্বকের মতো টানছে তার দিকে।
নন্দিনী না চাইতেও তার অবাধ্য চোখজোড়া বারবার নির্ঝরকে দেখছে। কফি রঙা জ্যাকেটের নিচে শ্বেতশুভ্র শার্ট, সেই সাথে ছাই রঙা প্যান্ট। এমন অমিল রঙের মিশেলের পোশাকেও মানুষটাকে কতো সুন্দর মানিয়ে গেছে। আগের দিন মানুষটার মুখে দাড়ি ছিলোনা। আজ খোঁচা খোঁচা দাড়িতে যেনো তাকে রাজপুত্রের মতো লাগছে। খুব মনকাড়া একটা পারফিউম, সেই সাথে কফি রঙা রিস্ট ওয়াচ। ব্যস, এতেই মানুষটাকে অধিক ব্যক্তিত্বপূর্ণ লাগছে। নন্দিনী নিজের ভাবনায় নিজেই চমকে ওঠে। এসব কি ভাবছে সে? তার ভালোবাসা তো মীরন। সে কেনো এই মানুষটাকে নিয়ে এতো ভাববে? সে তো আজ এসেছে তাকে বিয়ের জন্য তার সিদ্ধান্ত জানাতে, আর যেটা হলো তার তরফ থেকে ‘না’। সে অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে অন্য কারো স্মৃতি নিয়ে এই মানুষটার ঘরে যেতে পারবে না। তাকে ঠকাতে পারবে না। ভাবীকে যদিও বলেনি। কিন্তু তার এটাই মতামত। কিন্তু তাকে দেখার পর এমন কেনো হচ্ছে তার? সে নিজের সিদ্ধান্তের জন্য কি আরেকটু দেরি করবে? আচ্ছা সে কি দ্বিতীয় বারের মতো প্রেমে পড়তে যাচ্ছে? তা কি কখনো সম্ভব? প্রেম এভাবে হয়?
নন্দিনী চোখ নামিয়ে নেয় নিচের দিকে, চোখজোড়া ভীষণ জ্বালা করছে তার।
“ভাবী বলছিলাম কিছু অর্ডার করি?”
নিশিতা হেসে বললো,”দেখুন, ম্যাডাম কি বলে।”
নন্দিনী অপ্রস্তুত হয়ে বললো,”আপনারা অর্ডার দিন ভাবী।”
নির্ঝর মেনু কার্ডটা এগিয়ে দেয় নন্দিনীর দিকে। নন্দিনী ইতস্তত করে হাতে নেয়। সবকিছুই কেমন ঘোর লাগা মনে হচ্ছে তার।

অর্ডার দিয়ে নির্ঝর আবার এসে বসে নিজের জায়গায়। নিশিতা ব্যস্ততার সাথে হঠাৎ বলে ওঠে,”এই দেখো তো কান্ড। আমার তো অনেক জরুরি একটা কাজ পড়ে গেছে। এখনই মনে পড়লো।”
নন্দিনী অবাক হয়ে বললো,”আপনার আবার কি কাজ ভাবী? আগে তো বলেননি।”
“হঠাৎ করেই মনে পড়লো। সমস্যা নেই, তোমরা কথা বলতে থাকো। আমি কাজটা সেরেই চলে আসবো। কফি আসার আগেই ভাবী হাজির হয়ে যাবে।”
নিশিতা মুখ টিপে হেসে বেরিয়ে যায় দ্রুততার সাথে। নন্দিনী ঠিক বুঝতে পারে ভাবীর চালাকি।
নন্দিনী জড়তার সাথে কাচুমাচু হয়ে বসে। সে একজন গ্রাজুয়েট করা মেয়ে। পদার্থবিজ্ঞানের মতো কঠিন একটা বিষয়ে তার প্রথম শ্রেণির ডিগ্রী। অথচ তার নিজের কাছে এখন মনে হচ্ছে সে ষোলো বছরের একজন কিশোরী, যে স্কুলের গণ্ডিই পার হয়নি এখনো।
“নন্দিনী ম্যাডাম।”
নন্দিনী চমকে উঠে তাকায়।
“জ্বি বলুন।”
“শুনেছি আপনার রেজাল্ট নাকি অনেক ভালো। চাকরি করার ইচ্ছা আছে? না মানে আমাকে ভুল বুঝবেন না আবার। এতো ভালো রেজাল্ট নিয়ে কেউ বসে থাকতে চায়না তো তাই।”
নন্দিনী আরো একপ্রস্ত চমকে যায়। চাকরি করার ইচ্ছা তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই। কিন্তু গ্রাজুয়েশনের পর হঠাৎ মীরন বললো তার বাবা মা নাকি মেয়েদের চাকরি করা পছন্দ করেনা। ছেলের স্ত্রী চাকরি করবে এটা তারা কল্পনাই করতে পারেনা। তাই নন্দিনী চাকরির চেষ্টা করেনি আর গ্রাজুয়েশনের পর। যদিও সে অনেক কষ্ট পেয়েছিলো। কিন্তু মীরনকে হারানোর কষ্ট আরও তীব্র ছিলো তখন।
“আপনি চাইলেই কোনো কলেজে শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করতে পারেন। আপনার ব্যক্তিত্বের সাথে শিক্ষকতা বেশ মানায়। যে গম্ভীর থাকেন সবসময়।”
নন্দিনী অবাক হয়। মানুষটা এতোটা খোলা হৃদয়ের ভাবতেই পারেনি সে। মনে হয়েছিলো ভীষণ রাশভারি একজন মানুষ।
“জ্বি ইচ্ছা আছে।”
“ইচ্ছা থাকলেই হবে। ইচ্ছাশক্তিই মানুষকে অনেক দূর নিয়ে যায়। আর আপনি যদি চান আমাকে সবসময় পাশে পাবেন আপনার। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো আপনাকে সাহায্য করতে।”
নন্দিনীর কেমন কাঁপুনি ধরে। এই মানুষটাকে কীভাবে এখন সে বলবে সে তাকে বিয়ে করতে চায়না? সে যে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যাচ্ছে নন্দিনীর সত্ত্বার সাথে। সে চাইলেও ঠেলে সরাতে পারবে না।
এরপর প্রায় আধা ঘণ্টা দুইজনের কথা হলো। নির্ঝরই বেশি বললো, নন্দিনী শুধু কোনোমতে সায় দিয়ে গেলো। সে চাইলেও নির্ঝরকে কিছু জানাতে পারলো না চেষ্টা করেও। কোথায় যেনো একটা বাঁধা পাচ্ছে।
নিশিতা ফিরে এলো বেশ কিছুক্ষণ পর। এসেই এমন ভাব করলো যেনো অনিচ্ছাকৃতই দেরী হয়েছে। নির্ঝর না বুঝলেও নন্দিনী ঠিক বুঝলো।
“দেরি হয়ে গেলো গো একদম। তোমরা কথা বলেছো তো?”
নন্দিনী উত্তর দেয়না। নির্ঝর স্মিত হেসে বললো,”জ্বি ভাবী, আপনার লাজুক ননদিনীর সাথে একপাক্ষিক কথা হলো কিছুক্ষণ।”
নিশিতা নন্দিনীর মনের অবস্থা বুঝতে তার দিকে তাকায়। নিশিতার মন বলছে নন্দিনী রাজি না হয়ে পারবে না। এমন একজন জেন্টেলম্যানকে নন্দিনী কীভাবে ফেরাবে?

নন্দিনী আর নিশিতাকে বিদায় দিয়ে পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে নির্ঝর। ওরা গাড়িতে উঠলে তবেই ফিরবে সে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে নন্দিনীর দিকে। কিছুতেই এই পদ্মফুলটাকে চোখের আড়াল করতে ইচ্ছা করছে না তার।

“কি ব্যাপার নন্দিনী? চুপ করে আছো কেনো? কি সিদ্ধান্ত জানালে উনাকে?”
“এখনো কিছু জানাইনি ভাবী।”
“সে কি কথা? তাহলে এতোক্ষণ কি কথা৷ বলছিলে তোমরা? তুমি আবার রাজি নও এমন কিছু বলে দাওনি তো?”
নন্দিনীর কিছু বলতে যাবে তার আগেই একজোড়া বলিষ্ঠ পুরুষালি হাত তার দুই বাহু টেনে তাকে রাস্তার একপাশে টেনে আনে। আর সাথে সাথেই একটা ট্রাক দ্রুততার সাথে পাশ ঘেঁষে চলে যায় তার। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে যায় ওরা সবাই। নিশিতা কাঁপতে কাঁপতে নন্দিনীকে জড়িয়ে ধরে। আর একটু হলে কি বিপদ হয়ে যাচ্ছিলো। কথা বলতে বলতে টেরই পায়নি তারা কখন ট্রাক চলে এসেছে।
নন্দিনী কাঁপছে থরথর করে। তার চোখের সামনে দিয়ে ছুটে গেলো ট্রাকটা। কি হতে পারতো এখন তার সাথে?
“এটা কি হতে যাচ্ছিলো? এতো বেখেয়ালি কেনো আপনি? যদি খারাপ কিছু হয়ে যেতো? দেখেশুনে রাস্তায় চলবেন না? আপনি একজন গ্রাজুয়েট মেয়ে অথচ বাচ্চাদের মতো রাস্তা পার হচ্ছেন। কি হতে পারতো বুঝতে পারছেন?”
নন্দিনীর হতবাক হয়ে নির্ঝরের দিকে তাকালো।
নিশিতা কাঁদোকাঁদো হয়ে বললো,”নির্ঝর সাহেব না টেনে আনলে আজ কি সর্বনাশ হয়ে যেতো আমাদের। আপনাকে কি বলে ধন্যবাদ দিবো।”
নির্ঝরের মুখ এখনো রেগে লাল হয়ে আছে। তার হাত কাঁপছে মৃদু। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে নন্দিনীর দিকে তাকিয়ে।
“এভাবে আর রাস্তায় চলবেন না। আপনার জীবনের সাথে আরো অনেক মানুষের জীবন জড়িয়ে থাকতে পারে। জীবনে ছোট্ট একটা ভুল করেছেন বলে এতোটাই বিষিয়ে গেছে জীবন আপনার কাছে? কোনোদিকে আর কোনো খেয়াল নেই আপনার? কতো ঝড়ই তো আঘাত হানে প্রকৃতিতে। প্রকৃতি কি রাগ করে এভাবে থেমে যায়? যদি তাই হতো তাহলে তো আমাদের অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যেতো। প্রকৃতি তার নিয়মেই আবার ঘুরে দাঁড়ায়। আবারও তার সর্বস্ব দিয়ে আমাদের আগলে রাখে। আমরা তো প্রকৃতিরই অংশ। আমরা কেনো নিজেদের জীবনে ঘটা সামান্য দুর্যোগের জন্য সব মায়া কাটিয়ে ফেলবো? এতোটাই বেখায়ালি হয়ে যাবো? আমাকে নিয়ে যদি আপনার কোনো দুশ্চিন্তা থাকে তাহলে আমি আর সামনে আসবো না আপনার। তাই বলে নিজের মনকে এভাবে উদাস করে ফেলবেন না।”
নির্ঝর আর একবারও তাকায় না নন্দিনীর দিকে। হতভম্ব নন্দিনীকে ওভাবেই রেখে বড় বড় পা ফেলে চলে যায় সেখান থেকে। নিশিতা বাঁকা চোখে তাকায় নন্দিনীর দিকে। নন্দিনী অশ্রুশিক্ত হয়ে তাকিয়ে আছে নির্ঝরের যাওয়ার দিকে। তার চোখ রক্তিম হয়ে আছে। আচ্ছা, এটা কি পুনরায় প্রেমে পড়ার পূর্বাভাস?

গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে বসে আছে নন্দিনী। এখনো হাত-পা কাঁপছে তার। আসলেই কি সে বড্ড বেশি বেখেয়ালি হয়ে পড়েছিলো? আসলেই তো, কার জন্য সে জীবনটা শেষ করে দিবে? সে তো তার স্ত্রী এবং অনাগত সন্তানের চিন্তায় স্বর্গের সুখে মেতে আছে। তার জীবন থাকা না থাকায় ওই প্রতারকের কি কিছু আসবে যাবে? আর যে মানুষটা এতোকিছুর পরেও তার কাছে ছুটে আসছে বারবার, তার আহবান গ্রহণ করছে তাকে সে ফিরিয়ে দিবে? এ অধিকার কি তার আছে।
আচমকা মাথা উঠিয়ে বসে নন্দিনী। নিশিতা তখন থেকেই চুপ করে আছে। নন্দিনীকে ভাবতে সময় দিচ্ছে।
“ভাবী।”
“বলো নন্দিনী।”
“আমি আসলে….”
“কি?”
“আমি নির্ঝর সাহেবকে ফিরিয়ে দিতে পারবো না ভাবী। এ সাহস আমার নেই। আমি এখন কি করবো ভাবী?”
নিশিতা শব্দ করে কেঁদে দিয়ে নন্দিনীকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। সে নিজেও জানেনা তার এতো আনন্দ হচ্ছে কেনো। খুশিতে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে তার।
“ননদিনীর বিয়ে লাগলো রে। রাজপুত্রের প্রেমে পড়েছে রাজকন্যা।রাজপুত্র তার মন জয় করে নিয়েছে।”
নন্দিনীর চোখের উষ্ণ পানি টের পায় নিশিতা। লজ্জায় লাল হয়ে আছে নন্দিনী। সত্যিই কি তবে রাজকন্যা আবার প্রেমে পড়লো?

(চলবে…..)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here