নন্দিনী_শুধু_আমার পর্ব: ৫

0
238

#নন্দিনী_শুধু_আমার

পর্ব: ৫

আজ নন্দিনীর গায়ে হলুদ। সেদিনের পর কীভাবে যে সব ঠিক হয়ে গেলো ওর নিজের কাছেই স্বপ্ন মনে হয়। নন্দিনীর জন্য সবকিছু সামলে নেওয়া অতোটা ভোগান্তির না হলেও, নির্ঝরের অনেকটা কষ্ট করতে হয়েছে নিজের পরিবারকে মানানোর জন্য। মোতালিব খান কোনোভাবেই রাজি ছিলো না, এই মেয়েকে পুত্রবধূ করে ঘরে তুলতে। যে মেয়ে তার প্রেমিকের হাত ধরে বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে পারে, আর যাই হোক সেই মেয়ে কখনো খান পরিবারের বউ হতে পারেনা। গোঁ ধরে বসে ছিলো সে। কিন্তু শেষমেশ ছেলের জিদের কাছে হার মানতেই হলো তাকে। যে ছেলে বিয়ের বিরোধী ছিলো, সে নিজে এতোটা উতলা কেনো হলো, তাও আবার এই মেয়ের প্রতি এটাই বুঝতে পারছে না সে। ছেলের সামনে সম্মতি দিলেও মনে মনে একদমই রাজি নয় সে।

নিশিতা দৌড়ে দৌড়ে হলুদের যোগাড় করছে। ছেলের বাড়িতে কোনো হলুদের অনুষ্ঠান হবে না। প্রথম কারণ মোতালিব খান চাননা, দ্বিতীয় কারণ এটা নির্ঝরের দ্বিতীয় বিয়ে। তাছাড়া তার বয়সটাও কিছুটা বেশি। তার ধারণা এখন এসব করা মানে লোক হাসানো। সাদামাটাভাবে বিয়েটা সম্পন্ন করতে পারলেই সে খুশি।
“এভাবে সঙের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে ওদিকটায় দেখো। অতিথিরা সবাই ঠিকঠাক খেতে পারছে কিনা।”
শ্বাশুড়ির কথা শুনে কানটা বিষিয়ে ওঠে নিশিতার। সত্যি কথা বলতে আগে সে নন্দিনীর খারাপ চাইলেও এখন সে মনেপ্রাণে চায় মেয়েটা নির্ঝরের সাথে ভালো থাকুক। সকাল থেকে এতো কাজ করছে সে। সব আয়োজন বলতে গেলে সে নিজে করেছে। আজ তাকেই কিনা মর্জিনা বেগম বললো সে কাজ না করে সঙের মতো দাঁড়িয়ে আছে?
“কি হলো কি? আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো? মনে হচ্ছে চোখ দিয়েই বিষ ছুঁড়বে আমার দিকে।”
নিশিতা মনে মনে বললো,’বিষ আমি পাবো কই যে ছুঁড়বো? আপনিই তো বিষের ড্রাম নিয়ে বসে আছেন।’
কিন্তু মুখে সে এগুলো কিছুই প্রকাশ করতে পারেনা। কারণ তার শ্বাশুড়ির স্বভাব সে জানে। এখন কিছু বললেই চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলবে। পরে অনুষ্ঠানটাই বরবাদ হয়ে যাবে।
“এইতো যাচ্ছি মা। একটা কথা বলবো মা?”
“কি কথা?”
“আপনাকে এই হলুদ শাড়িতে যা মানিয়েছে না, একদম সত্তর দশকের নায়িকা যেনো। কীভাবে এই খোঁপাটা করেছেন বলুন তো? একদম যেনো কালো মেঘের মতো মনে হচ্ছে চুলগুলো।”
মুহুর্তেই মুখটা কোমল হয়ে ওঠে তার। নিশিতা মুখ টিপে হেসে মনে মনে বললো,’পেত্নীর মতো লাগছে আপনাকে। এই বয়সে এমন হলুদ কটকটে শাড়ি কেউ পরে? লাজলজ্জা বলেও বুড়ির কিছু নাই, ছ্যা ছ্যা।’
মর্জিনা বেগম খুশিতে গদগদ হয়ে বললো,”এই তুমি ঠিক বলছো? আমাকে সত্তর দশকের নায়িকাদের মতো লাগছে?”
“সত্যি মানে? একদম সত্যি। কে বলবে আপনার মেয়ের বিয়ে? মনে হচ্ছে আপনারই এখনো বিয়ে হয়নি।”
এটা বলেই জিভ কামড়ে ধরে নিশিতা। একটু বেশিই বলে ফেললো মনে হয়।
হাসি যেনো ধরছে না মর্জিনা বেগমের। লাজুক মুখে নিশিতার হাত চেপে ধরে বললো,”তুমি যাও মা, নন্দিনীর কাছে যাও।”
নিশিতা অবাক হয়ে বললো,”কিন্তু মা খাওয়া দাওয়ার ওদিকে?”
“ও তোমাকে ভাবতে হবে না। আমি আছি কি করতে?”
এরপর আরো লাজুক মুখে হেসে আস্তে আস্তে বললো,”অতিথিরা সবাই দেখুক এখনো কেমন নায়িকাদের মতো নিজেকে ধরে রেখেছি বলো?”
নিশিতা দু:খী মুখে বললো,”বেশ যান আপনি ওদিকটায়। আমাকে কোনো কাজই করতে দেন না আপনি। আমি তো সবাইকে বলি আমার শ্বাশুড়ির মতো মানুষ হয়না।”
মর্জিনা বেগম খুশিতে কেঁদে দেওয়ার উপক্রম। আজ রাতে মনে হচ্ছে তার ঘুমই হবে না। খুশিতে ডগমগ করতে করতে চলে যায় সেখান থেকে। নিশিতা হাসতে হাসতে বললো,”নায়িকারা বুঝি এমন মোটা হয়? নায়িকা সাজার শখ কতো।”

“হ্যা রে নন্দিনী, তুই এই বিয়েতে খুশি তো?”
নন্দিনী চমকে উঠে তার ফুপু আলেয়ার দিকে তাকায়। আলেয়ার কথা বলার ধরণটা কেমন অন্যরকম শোনায়।
“এভাবে বলছো কেনো ফুপু? আমি রাজি না হলে বাবা কি কখনো বিয়েটা দিতেন জোর করে?”
“কি জানি বাবা। বরের শুনলাম আগে একটা বিয়ে ছিলো, আবার বয়সটাও তোর থেকে অনেকটা বেশি। তোদের টাকা পয়সার তো অভাব নেই, তা তোর বাপ কি দেখে এক বিবাহিত লোকের সাথে তোর বিয়ে ঠিক করলো?”
তার পাশে থাকা আরো একজন মহিলা পাশ থেকে বলে উঠলো,”তা নন্দিনী, তোর বরের আগের বউটা চলে গেলো কেনো রে? খুব মারতো নাকি তোর বর?”
এই বলে দুইজন আঁচল চাপা দিয়ে হাসতে থাকে। নন্দিনীর কান গরম হয়ে ওঠে। এরা কি বিয়েতে এসেছে শুধু বদনাম করার জন্য? নাকি বিয়েটা ভাঙার জন্য?
হঠাৎ হাসি থামিয়ে আলেয়া বললো,”তা তুই নাকি কার সাথে পালিয়ে গিয়েছিলি? এজন্যই বুঝি তোর বাপ বিবাহিত লোক দেখে তাড়াতাড়ি তোর বিয়ের ব্যবস্থা করলো?”
নন্দিনী অসহায় চোখে এদিক ওদিক তাকায়। ভাবীকে খুঁজছে হন্যে হয়ে। এই দুইজনের পাশে আর বেশিক্ষণ বসলে সে অজ্ঞান হয়ে যাবে। কিন্তু কোথাও নিশিতাকে বা বাড়ির কাউকে দেখতে পাচ্ছে না সে।

“তা হ্যা গো আপা, আপনার স্বামীটা কোথায়? দেখলাম ওদিকে কোন মহিলার সাথে হেসে হেসে গল্প করছে। মহিলাটিকে বুঝি আপনি চিনেন?”
আগন্তুকের কথা শুনে সাথে সাথে মুখ কালো হয়ে যায় আলেয়ার। তার স্বামী কিনা বিয়েবাড়ি এসে অন্য মহিলার সাথে কথা বলছে? হনহন করে দৌড়ে সেদিকে ছুটে যায় সে। অন্য মহিলাটিও যায় পিছু পিছু।

নন্দিনীর শরীর কাঁপছে এখনো। কান ঝাঁ ঝাঁ করছে। ভীষণ কান্না পাচ্ছে তার।
আগন্তুক মহিলাটি এসে বসে তার পাশে। বোরকা দিয়ে আপাদমস্তক ঢাকা তার। চোখ দু’টিও যেনো ঢেকে রেখেছে। কিন্তু এতো লম্বা মহিলা আগে কখনো দেখেনি নন্দিনো। সে কে বা তার সাথে কি সম্পর্ক কিছুই জানেনা সে। এখন কিছু ভাবার অবস্থাও নেই তার। তার ফুপুর কথাগুলো এখনো কানে বাঁধছে তার।
“তা হ্যা গো মেয়ে, তোমার মুখ গোমড়া কেনো? বিয়ে বাড়িতেও এভাবে মুখ ভোঁতা হয়ে থাকতে হয়?”
নন্দিনী অবাক হয়ে মহিলাটার দিকে তাকায়। কে এই বোরকা পরা মেয়েটা? এতো লম্বা চওড়া মহিলা খুব একটা দেখা যায়না। গলার স্বরটাও কেমন যেনো।
“আপনাকে তো চিনলাম না।”
মহিলাটা খুব হাসে। হাসতে হাসতে তার শরীর কাঁপে। নন্দিনী ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক তাকায়। কি মতলব এই মহিলার আবার?
“মেয়ে বলে কি দেখো, আমাকে চিনতে পারোনি? আমি তোমার কতো কাছের।”
এই বলে মহিলাটা নন্দিনীর কাছে ঘেঁষে বসে। নন্দিনী ভয়ে শিউরে ওঠে।
“এই কে আপনি? সরে বসুন বলছি, সরে বসুন।”
মহিলাটা হঠাৎ নন্দিনীর হাতটা চেপে ধরে। নন্দিনীর শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে যায়। চোর বাটপার না তো আবার?
আচমকা মহিলাটি মুখের উপরের কাপড় উঠিয়ে তাকায় নন্দিনীর দিকে। আর সাথে সাথেই স্তম্ভিত হয়ে যায় সে। হালকা চিৎকার করে উঠে বললো,”নির্ঝর সাহেব, আপনি?”

“তোমার ছেলে কোথায় হাজেরা?”
হাজেরা বেগম অবাক হয়ে বললো,”আমি তো জানিনা।”
“ছেলে কোথায় যাচ্ছে কি করছে কোনো খবর রাখো না। কেমন মা তুমি?”
“তোমার ছেলে কি ছোট বাচ্চা? আমি সবসময় তার খোঁজ রাখবো?”
“হ্যা প্রয়োজন হলে রাখবে। ওই মেয়ের ক্ষমতা কেমন একবার চিন্তা করো। এতোকিছুর পরেও আমার ছেলেকে কেমন হাত করে নিলো।”
হাজেরা বেগম শান্তস্বরে বললো,”এখন আর এসব ভেবে কি হবে বলো? ওরা দুইজন সুখী থাকলে আমাদের কি? তুমি আর রেগে থেকো না।”
মোতালিব খান গম্ভীর হয়ে বললো,”ছেলেটার কপালটাই খারাপ। প্রথম বিয়ের পর বউ পালিয়ে গেলো। আর এই মেয়ে তো বিয়ের আগেই পালিয়ে গেলো। তাও যে তোমার ছেলে কি দেখে এতো পাগল হলো এটাই মাথায় আসছে না আমার।”
হাজেরা বেগম মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। শিরিন মেয়েটাকে তার ছেলেটা অল্প কয়দিনেই অনেক ভালোবেসে ফেলেছিলো। ছেলেটা কিছুটা গম্ভীর, কিন্তু আবার রসিকও আছে। তার খুব কাছের মানুষদের সাথে খুব রসিকতাও করে ও। শিরিনের সাথে বেশ রসিকতা করতো। হাজেরা বেগম কি ভীষণ খুশি হয়েছিলো ওদের বন্ধনটা দেখে। ছেলেটা কতো খুশি হয়েছিলো। সেই মেয়ে রাতের অন্ধকারে পূর্ব প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়ে গেলো। একটাবারও ভাবলো না নির্ঝরের কথা। আচ্ছা, একটুও কি মায়া হয়নি তার সংসারটার উপর, এই বাড়িটার উপর, নির্ঝরের উপর? কীভাবে পারলো ও এই কাজটা করতে? সেই থেকে ছেলেটা আরো গম্ভীর হয়ে গেলো। আগের মতো হাসেনা, রসিকতা করে না বাবা মায়ের সাথে। মেয়েদের উপর থেকে বিশ্বাসই উঠে গিয়েছিলো ওর। সেদিন মেয়েটা পালিয়ে যাওয়ায় হাজেরা বেগম ভেবেছিলো এই বুঝি শেষ। ছেলে আর কোনোদিন বিয়ে করতে চাইবে না। হয়তো একেবারেই নিজেকে গুটিয়ে নিবে নিজের মধ্যে। কিন্তু কীভাবে যে সেই মেয়েটাকেই মন দিয়ে ফেললো ছেলেটা, সে এক বিস্ময়। সে এখনো জানেনা মেয়েটা ভালো নাকি খারাপ। শুধু সে ছেলের মুখে সেই হাসি দেখতে চায়, আর কিছু না। আঁচল দিয়ে চোখ মুছে সে।

ইতোমধ্যে জানাজানি হয়ে গেছে নন্দিনীর হবু বর ছদ্মবেশে নন্দিনীর হলুদে এসেছে। অতিথিরা এমন কান্ড দেখে সবাই অবাক। এ আবার কেমন কথা? ছেলে নাকি বিশাল ব্যবসায়ী? এটা নাকি তার দ্বিতীয় বিয়ে।
সবচেয়ে বেশি অবাক নন্দিনীর পরিবারের সবাই। এমন রাশভারি গম্ভীর একজন মানুষের এই আচরণ তারা হজম করতে পারছে না।
নন্দিনী হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে নির্ঝরের দিকে। মাথা নিচু করে মাথা চুলকে যাচ্ছে সে।
নিশিতা হাসতে হাসতে কাছে এসে বললো,”হলুদের সাজে বউকে কেমন লাগছে দেখতে এসেছিলেন বুঝি নির্ঝর সাহেব?”
মর্জিনা বেগম রাগী চোখে বারবার তাকাচ্ছে স্বামীর দিকে। তার হলুদের সময়ও এভাবে তাকে কেনো চমকে দেওয়া হয়নি এর জবাব মনে হয় রাজীব শাহকে আজ রাতে দিতেই হবে।
ফিরোজ এসে নির্ঝরের কাঁধে হাত রেখে বললো,”তোমাকে দেখলে বোঝাই যায়না এতো রসিক তুমি। সত্যি এতো ভালো লাগলো। এখন মনে হচ্ছে এই বুদ্ধি আগে কেনো এলো না আমার মাথায়?”
নিশিতা মৃদু হাসে ফিরোজের দিকে তাকিয়ে। আজ দিনটা এতো সুন্দর কেনো? যা চোখের সামনে ভাসছে তাই ভালো লাগছে। সবার মনটা অদ্ভুত একটা শান্তিতে নিমজ্জিত হয়ে যায়।
আলেয়া মুখ বাঁকিয়ে বললো,”যতোসব আদিখ্যেতা। দ্বিতীয় বিয়েতে কতো রঙঢঙ। তাও আবার মেয়ে পালিয়েছিলো অন্য একজনের সাথে।”
কিন্তু আস্তে আস্তে বলায় কারো কানে গেলো না সে কথা।
নন্দিনী বার বার আড়চোখে তাকাচ্ছে নির্ঝরের দিকে। মানুষটার একদম বিপরীত এক ব্যক্তিত্ব দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছে ও। আগে যখন মানুষটাকে যতোবার দেখেছে, শুধু গম্ভীরতাই চোখে পড়েছে। একই মানুষের এমন ভিন্ন রূপ দেখে বিস্মিত হয়ে যাচ্ছে সে। সত্যিই কি কারো প্রেমে পড়া যায় এতো তাড়াতাড়ি? সে তো নিজেকে আটকাতেই পারছে না এই মানুষটার প্রেমে পড়া থেকে।
নির্ঝরও বাঁকা চোখে তাকাচ্ছে নন্দিনীর দিকে। আজ মেয়েটাকে এতো সুন্দর লাগছে কেনো? মনে হচ্ছে আকাশ থেকে একটা চাঁদ নেমে এসেছে শাহ বাড়ি। তার মন বলছে খুব তাড়াতাড়ি এই মেয়েটার মন জয় করে নিবে সে।

“কি খেলা আজ তোমার বর দেখালো গো নন্দিনী। আমি তো একদম অবাক।”
নন্দিনী লাজুক মুখে মাথা নিচু করে বললো,”বর বলছেন কেনো ভাবী? এখনো তো বিয়েটাই হলো না।”
নিশিতা নন্দিনীর কাঁধে মুখ ঠেকিয়ে বললো,”মন দেওয়া নেওয়া তো হয়েই গেছে দুই পক্ষের। এখন শুধু কবুল বলা বাকি।”
নন্দিনী নিশিতার দিকে ফিরে বললো,”ভাবী আমার সাত বছরের ভালোবাসা কি তবে মিথ্যা ছিলো?”
নিশিতার মুখ অন্ধকার হয়ে যায়।
“এসব কথা এখন থাক নন্দিনী। পুরোনো কথা ভাবার আর সময় বা সুযোগ কিছুই নেই তোমার আর।”
“আমি অনেক বড় একটা ভুল করে ফেলেছি ভাবী। আমি একটা ভুল মানুষের পিছনে আমার জীবনের এতো বড় একটা সময় কাটিয়েছি। এই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত কি কখনো দ
করতে পারবো আমি?”
“এখন এসব কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দাও নন্দিনী। তোমার সামনে অনাবিল সুখ আর শান্তি অপেক্ষা করছে। তোমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। অতীত নিয়ে পড়ে থেকো না আর।”
নন্দিনী হালকা করে মাথা নাড়ে।
“নাও এখন বিশ্রাম করো তুমি। সারাদিন অনেক ধকল গেলো। আর দুইদিন পরেই তো বরের বুকে থাকবে।”
নন্দিনীর কান গরম ওঠে ভাবীর কথা শুনে। নিশিতা হাসতে হাসতে চলে যায় নিজের ঘরে।

বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে৷ নন্দিনী। সে কি কখনো ভেবেছিলো এমন কিছু হবে? সে তো মীরনের নিম্নমধ্যবিত্ত জীবনে জড়াতে চেয়েছিলো নিজেকে। এতোটাই ভালোবেসেছিলো তাকে যে সে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলো তার ভালোবাসায়। সেই ভালোবাসা তাকে ঠকিয়েছে, খুব বিশ্রীভাবে ঠকিয়েছে। তার রিক্ত হাত দু’টো আঁকড়ে ধরেছে নির্ঝর। নির্ঝরের নিজের বুকও খাঁ খাঁ করছিলো। দুইটা শূন্য হৃদয় পাশাপাশি এসে যেনো পূর্ণতা পেলো। অদ্ভুত একটা ভালো লাগায় বারবার আচ্ছন্ন হয়ে যায় সে। একটু মন খারাপও লাগছে তার। তার নিজের ঘর ছেড়ে, বাড়ি ছেড়ে, প্রিয় মানুষগুলোকে ছেড়ে চলে যেতে হবে তাকে আর দুইটা দিন পরেই। এরপর সে আসবে হয়তো এ বাড়ি, কিন্তু অতিথি হয়ে। এই ঘরে হয়তো আগের মতো আর অধিকার থাকবে না তার। ধূলো জমবে তার গল্পের বইগুলোতে।
হঠাৎ বইয়ের কথা মনে পড়তেই তাকিয়ে দেখে তার বইয়ের তাক ফাঁকা। সেখানে কোনো বই নেই। মাথা খারাপ হয়ে যায় আচমকা নন্দিনীর। সে চিৎকার করে তার মা আর ভাবীকে ডাকে।
মর্জিনা বেগম ছুটতে ছুটতে মেয়ের ঘরে এসে বললো,”কি হয়েছে নন্দিনী? এভাবে চিৎকার করছিস কেনো তুই?”
নন্দিনী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো,”বিয়ের আগেই এভাবে আমাকে পর করে দিলে মা তোমরা? আমার বইগুলো ফেলে দিলে?”
মর্জিনা বেগম আঁচল চাপা দিয়ে হেসে বললো,”এগুলো আমরা কেউ সরাইনি।”
নন্দিনী ভ্রু কুঁচকে বললো,”তোমরা সরাওনি মানে? তাহলে গেলো কোথায়?”
“নির্ঝর এসে সব নিয়ে গেছে। তোর গল্পের বই পছন্দ শুনে ওর ঘরে বড় একটা তাক বানিয়েছে ও। ওখানে তোর সব বই, সেই সাথে ও আরো অনেক নতুন বই কিনে সাজিয়ে রেখেছে।”
মুহুর্তেই নন্দিনীর মুখটা রক্তিম আভায় ছেয়ে যায়। মানুষটা এতো ভালো? আর কতোবার প্রেমে ফেলবে তাকে?
মর্জিনা বেগম হাসতে হাসতে বললো,”ঘুমিয়ে পড়, অনেক রাত হলো।”
মা কে বিদায় জানিয়ে বিছানায় এসে বসে নন্দিনী। বারবার বুকটা কেমন অদ্ভুত একটা শিহরণে কেঁপে উঠছে। একদমই ঘুম আসছে না তার। চোখ বন্ধ করলেই নির্ঝরের ওই হাসিমাখা মুখটা ভেসে উঠছে।

এসব ভাবতে ভাবতে চোখটা লেগে এসেছিলো তার। হঠাৎ কাজের মেয়ে রেশমার ডাকে ঘুম ভেঙে গেলো তার। তাড়াহুড়ো করে ঘুম থেকে উঠে বসে সে।
“কি হয়েছে? এভাবে ডাকছিস কেনো?”
“আপা আপনার বেলকনির নিচে কে জানি দাঁড়ায় আছে।”
“এই কথা বলার জন্য তুই ডেকে তুলেছিস আমাকে? রাস্তায় যে কেউ দাঁড়াতেই পারে। তাতে আমার কি?”
রেশমা কাচুমাচু হয়ে বললো,”সে এদিকেই তাকিয়ে আছে আপা, আপনার ঘরের দিকেই।”
নন্দিনীর ভ্রু কুঁচকে তাকায়। কে আসতে পারে? আবার নির্ঝর সাহেব নয় তো? নির্ঝরের নাম মাথায় আসতেই শিউরে ওঠে সে। তাড়াতাড়ি করে মাথায় একটা ওড়না চাপিয়ে পা টিপে টিপে বেলকনিতে এসে দাঁড়ায় সে।
“ওইযে আপা দেখেন, ওই লোকটা।”
অন্ধকারে বুঝতে পারেনা নন্দিনী। তবে যতোদূর মনে হচ্ছে নির্ঝর সাহেব নয়। নির্ঝর অনেক লম্বা, আর এই মানুষটা ছোট খাটো, চিকন।
হঠাৎ লোকটা একটা সিগারেট ধরায়। আর সেই আগুনে মানুষটার চেহারা দেখে হতভম্ব হয়ে যায় নন্দিনী। মেরুদণ্ড বেয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে যায়। ও এখানে কি করছে? কি চায় ও নন্দিনীর কাছে?
“আপা ওই দেখেন আবার তাকাচ্ছে লোকটা। আপনাকে দেখে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।”
নন্দিনী বুঝতে পারে মীরন তাকে দেখে ফেলেছে। সিগারেট ফেলে দিয়ে এদিকেই তাকিয়ে আছে সে। আশ্চর্য, যে মানুষটাকে এতো ভালোবেসেছিলো সে একটা সময়ে, যার জন্য পরিবার, বাড়ি ছাড়তেও দ্বিধা করেনি আজ তাকে দেখে এতো ভয় করছে কেনো ওর? দূরের অন্ধকারে মিশে থাকা ছিপছিপে দেহের চোখগুলো দেখে বুকটা কেঁপে ওঠে তার। হৃৎপিণ্ডটা যেনো গলার কাছে এসে ধকধক করছে।
হঠাৎ মীরন হাত দিয়ে ইশারা করে ডাকে নন্দিনীকে।
“ও আপা, উনি ডাকে কেনো? খালুজান বা ভাইজানরে ডাক দিই?”
নন্দিনী কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,”কাউকে ডাকা লাগবে না, তুই যেয়ে শুয়ে পড়।”
“কিন্তু আপা…”
“কি বললাম কানে যায়নি? যা যেয়ে শুয়ে পড়।”
রেশমা কিছুটা ইতস্তত করে চলে গেলো। নন্দিনীর ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে মীরনের দিকে।
মীরন বারবার করে ইশারা করছে তাকে কিছু। দূরের কিছু একটা দেখিয়ে গলায় হাত দিচ্ছে। প্রথমে নন্দিনী বুঝতে পারেনি। হঠাৎ করেই সে স্তম্ভিত হয়ে যায়। দূরের কাউকে ও মারার চিন্তা করছে। কাকে মারবে ও? নির্ঝরকে নয়তো?

কালো একটা বড় ওড়না দিয়ে পুরো শরীর ঢেকে নেয় নন্দিনী। তার বুকটা এতো জোরে কাঁপছে, রাতের সুনসান নীরবতায় মনে হচ্ছে বুকের তীব্র শব্দে বুঝি বাড়ির সবাই জেগে যাবে। সে জানেনা তার যাওয়া উচিত হচ্ছে নাকি। কিন্তু মীরনের এই ইশারা তার ভালো লাগছে না। যা হয়ে যাক, সে নির্ঝরের কোনো ক্ষতি চায়না। দোষ করলে সে করেছে একটা ভুল মানুষকে ভালোবেসে, নির্ঝরের তো কোনো দোষ নেই। আর সে নিজেও চাইতো মীরনের মুখোমুখি হতে। তাকে এতো বড় ধোঁকা ও কেনো দিলো ওকে জবাব দিতেই হবে। বিয়ের পর হয়তো মীরনের সাথে দেখা করার সুযোগ বা কারণ কোনোটাই নন্দিনীর থাকবে না। তাই আজই সব কথা শেষ করে আসতে হবে তাকে।

নন্দিনীকে দেখে বাঁকা ঠোঁটে হাসে মীরন। নন্দিনীর কেমন ভয় লাগে হাসিটা দেখে, কেমন যেনো পৈশাচিক একটা হাসি।
“আমি জানতাম তুমি আসবে, আমার নন্দিনী।”
নন্দিনীর গা জ্বলে যায় মীরনের কথায়।
“কীভাবে জানলে আমি আসবো?”
“তোমাকে যে আসতেই হবে নন্দিনী। রেশমাকে সন্ধ্যাতেই কিছু টাকা দিয়ে রাজি করিয়েছি তোমাকে রাতে জাগিয়ে দিতে। ও সেইমতো কাজ করেছে। আর আমি জানতাম আমাকে এখানে দেখলে তুমি আসবেই, পুরোনো প্রেম কি ভোলা যায়?”
নন্দিনী হতবাক হয়ে যায়। রেশমা এতো খারাপ?
“একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো মীরন। আমি তোমাকে আর ভালোবাসি না, একটুও না। বরং আফসোস করি তোমার মতো একটা প্রতারককে আমি এতোদিন ধরে ভালোবেসেছি বলে। আমার ভালোমানুষির সুযোগ নিয়েছো তুমি। তোমাকে কোনোদিন ক্ষমা করবো না আমি।”
মীরন শান্ত ভঙ্গিতে কান চুলকে বললো,”তোমার এই নাটকীয় সংলাপ শুনতে আসিনি গো। আমাকে এখন তোমার কীভাবে ভালো লাগবে? এখন পয়সা ওয়ালা বুড়ো বরের স্ত্রী হতে যাচ্ছো।”
রাগে লাল হয়ে যায় নন্দিনী। চিৎকার করে উঠে বললো,”নির্লজ্জের মতো এখনো এসব বলে যাচ্ছো? তুমি এখনো আশা করো যে তোমাকে আমার ভালো লাগবে?”
“কেনো আমি যদি আমার স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দিই? আমার কাছে আসবে না তুমি? ওই বুড়োটারও তো আগে বিয়ে ছিলো। ওকে বিয়ে করতে রাজি হলে আমাকে কেনো পারবে না?”
নন্দিনীর মুখ থেকে কোনো কথা বের হয়না। এই নরকের কীটটা এসব কি বলছে? ওর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?
“কি হলো নন্দিনী? চুপ করে আছো কেনো? আমি তো তোমার ভালোবাসা ছিলাম বলো? টানা সাত বছর আমার সাথে প্রেম করেছো তুমি। কতো ঘনিষ্ঠ ছিলাম আমরা একে অপরের। আজ যদি আমার স্ত্রীকে ছেড়ে তোমার কাছে আসি? আমাকে কি ফিরিয়ে দিবে তুমি?”
নন্দিনীর মনে হলো তার এখানে আর থাকাই উচিত না। যে এতো নিম্নমানের কথা বলতে পারে, তার সাথে কথা চালিয়ে নেওয়ার কোনো রুচি তার হচ্ছেনা।
যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় নন্দিনী। আচমকা একটা ঠান্ডা হাতের ছোঁয়ায় কেঁপে ওঠে সে। তার হাত টেনে ধরেছে মীরন।
ঝট করে পিছনের দিকে তাকায় নন্দিনী। পৈশাচিক একটা হাসি দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে মীরন। নিজের হাত ছুটিয়ে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে ও। কোনোভাবেই মীরনের শক্ত বাঁধন থেকে হাত ছুটিয়ে নিতে পারে না সে।
“মীরন, বাড়াবাড়ি করোনা। হাত ছাড়ো আমার। আমি কিন্তু চিৎকার করে মানুষ ডাকবো।”
“তাই নাকি? তো ডাকো, কে মানা করেছে? সবাই এসে দেখুক শাহ বাড়ির একমাত্র মেয়ে, যার কিনা দুইদিন পরেই বিয়ে। সে রাতের অন্ধকারে তার প্রেমিকের সাথে দেখা করতে এসেছে। দেখি রাজীব শাহ আর ফিরোজ শাহের মানসম্মান যেটুকু আছে, তা আর থাকে কিনা। এরপর তোমার পিরিতের নির্ঝর সাহেব তোমাকে আর বিয়ে করে কিনা। ডাকো তুমি, মানুষ ডাকো।”
নন্দিনী হতবিহ্বল হয়ে যায়। কি ভুল করে ফেললো সে এখানে এসে? এখন কীভাবে নিজেকে বাঁচাবে নন্দিনী?

(চলবে…..)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here