#নন্দিনী_শুধু_আমার
পর্ব: ৭
“বাবা তুমি কি ইচ্ছা করে এসব করছো?”
নির্ঝরের কথায় শোয়া উঠে বসে মোতালিব খান। তার চোখ টকটকে লাল হয়ে আছে।
“কি বলতে চাচ্ছো তুমি?”
“গতকাল রাত পর্যন্তও তুমি সুস্থ ছিলে। আজ সকাল থেকেই তোমার কি এমন হলো যে তোমার ছেলের বিয়েতে তুমি যেতে পারবে না? কতো করে বলছি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছি, তাও যাবে না।”
মোতালিব খান দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”সিদ্ধান্ত যখন আমাকে জানিয়ে দিলে, তখন আমি মানা করেছিলাম। তুমি কি বলেছিলে মনে আছে? তুমি বলেছিলে, বিয়ে তুমি করবে তাই তোমার সিদ্ধান্তই শেষ কথা। তাহলে বেশ, বিয়ে যখন তোমার তখন তো আমার যেয়ে কোনো লাভ নেই।”
নির্ঝর অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে। হাজেরা বেগম অপরাধী মুখে একবার ছেলের দিকে আরেকবার স্বামীর দিকে তাকাচ্ছে। এদিকে একমাত্র ছেলের বিয়ে, অন্যদিকে তার স্বামী গোঁ ধরে বসে আছে সে যাবে না। এই পরিস্থিতিতে তার কি করা উচিত সে বুঝতে পারছে না।
“তাহলে এটাই তোমার শেষ কথা?”
“হ্যা যদি তাই মনে করো তাহলে তাই। বাবা মায়ের অবাধ্য হয়ে তুমি কেমন সুখী হতে পারো তাও দেখে নিবো আমি।”
নির্ঝর কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থেকে হঠাৎ বললো,”শিরিনকে তো তোমাদের পছন্দেই বিয়ে করেছিলাম বাবা। আমি বিয়েটা করতে চাইনি। তোমরা জোর করে বিয়েটা দিলে। এরপর আমি ওকে ভালোবেসে ফেললাম। কিন্তু শিরিন কি করলো? সেই বিয়ে কি পেরেছিলো আমাকে সুখী করতে?”
মোতালিব খান থম মেরে যায়। শুধু জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ হয়।
হাজেরা বেগম এসে স্বামীর হাত চেপে ধরে। তার গলায় অনুরোধের ছোঁয়া।
“তোমার কাছে কোনোদিন আমি কিছু চাইনি। তুমি যখন যা বলেছো আমি তাতেই সায় দিয়েছি। আজ তোমার স্ত্রী হয়ে না, একজন মা হয়ে তোমার কাছে একটা অনুরোধ করবো। কথা দিচ্ছি আর কোনোদিন কোনো দাবী তোমার কাছে আমি রাখবো না।”
মোতালিব খান অবাক হয়ে স্ত্রীর দিকে তাকায়। হাজেরা বেগমের গলা ধরে এসেছে।
“তুমি এমন রাগ করে থেকো না। তুমি না গেলে হয়তো আমিও যেতে পারবো না। আমাদের ছেলেটার জীবনের একটা বিশেষ দিনে ও বাবা মা কাউকেই পাশে পাবে না? আমার ছেলেটা জীবনের একটা পর্যায়ে এসে ধাক্কা খেয়েছে। আমরাই তো দায়ী তার জন্য, তাইনা? ওরা যদি সুখী হতে পারে বাবা মা হয়ে আমাদের আর কি চাওয়ার আছে?”
নির্ঝরের চোখ দিয়ে দুই ফোঁটা পানি পড়ে। মোতালিব খান এখনো শক্ত হয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে।
নির্ঝর চোখের পানি মুছে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,”আমি বসার ঘরে আছি মা। তোমরা কি করবে ভেবে জানাও।”
নির্ঝর দরজা ঠেলে বাইরে চলে যায়। হাজেরা বেগম পানিভর্তি চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকে।
“বাহ নন্দিনী, তোমাকে তো আজ পরীর মতো লাগছে। তোমার স্বামীর তো আজ চোখ উলটে যাবে তোমাকে দেখে। খয়েরি বেনারসি শাড়িটা বুঝি শুধু তোমার জন্যই বানানো হয়েছে।”
নন্দিনী পূর্ণ দৃষ্টি মেলে আয়নার দিকে তাকায়। লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে সে বারবার। বিয়ের দিন কি মেয়েদের রূপ আসলেই বৃদ্ধি পায়? এতোদিন সে শুধু শুনেছে। আজ মনে হচ্ছে কথাটা মিথ্যা নয়। সত্যিই নিজের প্রেমে নিজেই পড়ে যাচ্ছে নন্দিনী।
নিশিতা নন্দিনীর কাঁধে থুতনি ঠেকায়।
“কি গো কি ভাবছো?”
নন্দিনী কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,”আমার খুব ভয় লাগছে ভাবী।”
নিশিতা অবাক হয়ে নন্দিনীকে সামনে টেনে নেয়।
“ভয় করছে মানে? কিসের ভয় করছে তোমার?”
নন্দিনী মাথা নিচু করে বললো,”যদি ও বাড়িতে আমার পালিয়ে যাওয়া নিয়ে কথা ওঠে? শুনেছি উনার বাবা রাজি ছিলেন না বিয়েতে। যদি এটা নিয়ে খুব বাড়াবাড়ি হয়?”
নিশিতা মুচকি হেসে নন্দিনীর মুখ উঁচু করে ধরে।
“নন্দিনী, তুমি কিসের ভয় পাচ্ছো? এই পৃথিবীতে মেয়েদের সবচেয়ে বড় ভরসার আশ্রয়স্থল কোথায় জানো?”
“কোথায় ভাবী?”
“তার স্বামীর কাছে। তার স্বামী যদি তার শক্ত হাত দু’টো দিয়ে বেষ্টনী বানিয়ে স্ত্রীকে জড়িয়ে রাখে, পৃথিবীর কোনো শক্তি নেই সেই মেয়ের কোনো ক্ষতি করার। যতো ঝড়ই আসুক না কেনো, তার স্বামী নি:শ্বাসে জড়িয়ে নিবে সেই ঝড়টুকু। এতোটুকু আঁচও লাগতে দিবে না স্ত্রীর গায়ে।”
নন্দিনী স্বপ্নালু চোখে নিশিতার দিকে তাকিয়ে থাকে। এতো শান্তি লাগছে কেনো তার? মনে হচ্ছে হাওয়ায় ভাসছে তুলার মতো। নির্ঝর সাহেব এভাবে আগলে রাখবেন তো তাকে সবসময়?
দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে নিশিতার সব কথা শুনছিলো ফিরোজ। তার বুকটা কেমন করে ওঠে। নিশিতার গলার উত্তাপ নন্দিনী না বুঝলেও ফিরোজ ঠিকই বুঝতে পারে। বিয়ের পর নিশিতাকে কম অপমানিত হতে হয়নি এ বাড়ি। সে কাপুরুষের মতো শুধু সব সহ্য করে গেছে। প্রথমত সে তার বাবাকে জমের মতো ভয় পায়, দ্বিতীয়ত সে তখন বেকার ছিলো। নিশিতার মনে যে এসব নিয়ে অনেক ক্ষোভ আছে তা সে ভালো করেই জানে। সেই ক্ষোভগুলো পুঞ্জীভূত হয়ে কখন যে কালো মেঘে পরিণত হয়েছে ফিরোজ হয়তো তার কিছুই জানেনা। হয়তোবা সেই মেঘ একসময় ভয়ংকর প্রলয়ে রূপ নিবে। ফিরোজ কখনোই নিশিতাকে হারাতে চায়না।
“আমার একটা পাঞ্জাবিও কি আয়রন করা নেই? করোটা কি তোমরা সারাদিন বাড়িতে বসে?”
চিৎকার করতে করতে ঘর ছেড়ে বের হয় মোতালিব খান। তার চোখমুখ বিরক্তিতে কুচকে আছে। হাজেরা বেগম আমতা আমতা করে বললো,”তোমার জামাকাপড়ে কি আমাদের কাউকে হাত দিতে দাও? তোমার জামাকাপড় ধরলেই তো চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলো।”
মোতালিব খান স্ত্রীকে কিছু বলতে যেয়েও থেমে যায়। আসলেই তো, কি বলবে সে? কথা তো মিথ্যা না। সে সারাজীবনই নিজের জামাকাপড় নিজেই যত্নে রাখে।
নির্ঝর উঠে দাঁড়ায়। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। মায়ের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারা করে। হাজেরা বেগমও ইশারা করে জানায় সে কিছুই জানেনা।
“আমি এখন কি পরে যাবো তাহলে?”
নির্ঝর আর হাজেরা বেগম অবাক হয়ে মোতালিব খানের দিকে তাকায়। তার মানে সত্যিই সে ছেলের বিয়েতে যাওয়ার জন্য রাজি হয়েছে?
নির্ঝর বিশ্বাস করতে পারে না। বাবার কাছে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় বললো,”বাবা তুমি রাজি হয়েছো যেতে?”
মোতালিব খান উত্তর দেয়না। ব্যস্ত হয়ে পাঞ্জাবি খুঁজতে থাকে। একটা পাঞ্জাবিও মনমতো হয়না তার।
নির্ঝর কি মনে করে নিজের ঘরে চলে যায়। দুই মিনিট পরেই ফিরে আসে।
“দেখো তো বাবা, এটা পছন্দ হয় কিনা?”
মোতালিব খান ভ্রু কুঁচকে তাকায় ছেলের দিকে। ছেলে একটা প্যাকেট এগিয়ে রেখেছে সামনে।
“এতে কি আছে?”
“খুলেই দেখো না।”
মোতালিব খান একবার হাজেরা বেগমের দিকে তাকায়। হাজেরা বেগম হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
প্যাকেট থেকে বের হয় সাদা আর হালকা নীলের মিশেলে ভীষণ সুন্দর একটা পাঞ্জাবি। এতো সুন্দর সুতোর কাজ করা দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়।
মোতালিব খান তবুও মুখ শক্ত করে বললো,”এটা কিসের?”
“তোমার আর মায়ের জন্য আমি আগে থেকেই কিনে রেখেছিলাম। আমার বিয়েতে তোমরা আমার দেওয়া কাপড় পরে যাবে এটাই চেয়েছিলাম আমি।”
হাজেরা বেগম খুশিতে ডগমগ করতে করতে বললো,”এই দেখো না আমার পরা শাড়িটাও তো তোমার ছেলেরই দেওয়া। কি সুন্দর হয়েছে।”
মোতালিব খানের বারবার চোখ ভিজে উঠছে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলায় সে। বারবার পাঞ্জাবিটার উপর হাত বোলাতে থাকে।
নির্ঝর বাবার কাঁধে হাত রেখে বললো,”তোমার পছন্দ হয়েছে বাবা?”
মোতালিব খান পাঞ্জাবিটা নিয়ে ঘরে যেতে যেতে বললো,”হুম চলবে। আর তোমরা গাড়ির কাছে যাও সবাই। বরযাত্রীকে গাড়িতে তুলো। আমি আসছি।”
হাজেরা বেগমের ভীষণ শান্তি হচ্ছে। সে ছুটে এসে ছেলের কপালে চুমু দেয়। নির্ঝর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তার মা কে।
“বউমা, শুনছো?”
নন্দিনীকে সাজানো শেষ করে নিশিতা নিজের ঘরে বসে সাজছিলো। শ্বশুরের ডাক শুনে দ্রুততার সাথে উঠে দাঁড়ায় সে। রাজীব শাহ তাকে খুব বেশি ডাকেনা। সে এখনো নিশিতাকে নিজের ছেলের বউ হিসেবে মানতে পারেনি। খুব বেশি কথাও হয়না শ্বশুর আর পুত্রবধূর।
নিশিতা ঘর থেকে বের হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়ায়।
“জ্বি বাবা বলুন।”
“বলছি তোমার বাবার কি কোনোদিন কাণ্ডজ্ঞান হবে না?”
নিশিতা চোখ তুলে তাকায়। তার বাবা আবার কি করলো বুঝতে পারছে না সে।
“এইযে বিয়ে বাড়িতে এতো কাজ, আত্মীয় স্বজনরাই তো একটু সামলাবে সব। না তিনি এখনো এসেই পৌঁছাতে পারলেন না। তা বলছি যে মা জননী, উনিও কি বরযাত্রী আর অতিথিদের সাথেই আসবেন? কেনো নিজের আপন লোকদের সাথে এসে হাতে হাতে একটু কাজ করলে কি উনার জাত যাবে?”
নিশিতা হতবাক হয়ে যায়। রাজীব শাহের কণ্ঠে রাগ নয়, বরং অধিকার আর অভিমানের সুর। সে কবে নিশিতার বাবাকে এতো আপন ভাবা শুরু করলো?
“কি হলো এভাবে বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছো কেনো? তোমার বাবা আসবে কখন?”
নিশিতা আস্তে আস্তে বললো,”উনি আসবেন না বাবা।”
রাজীব শাহ থমকে যায়। তার মেয়ের বিয়ে, সেখানে তার ছেলের শ্বশুর আসবে না? অবশ্য ছেলের বিয়ের পর সে যা ব্যবহার করেছে তার সাথে, না আসাটাও অস্বাভাবিক কিছু না।
রাজীব শাহ কিছুক্ষণ কি যেনো ভাবে। এরপর চিৎকার করে কাজের লোককে ডেকে বলে,”গাড়ি বের করো, আমি বেরোবো।”
“বাবা বরযাত্রী আসার সময় হয়ে গেছে, আপনি আবার এখন কোথায় যাবেন?”
“কেনো নন্দিনী কি শুধু আমার একার মেয়ে? তোমাদের কিছু হয়না? তোমরা অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাতে থাকো। আমি আরেকজনের অভিমান ভাঙিয়ে তাকে নিয়ে আসি।”
নিশিতা ঝট করে চোখ তুলে শ্বশুরের দিকে তাকায়। তার মানে রাজীব শাহ তার বাবাকে আনতে যাচ্ছে?
“হ্যা হ্যা, তোমার বাবাকেই আনতে যাচ্ছি। এভাবে তাকিয়ে থাকার কিছু হয়নি।”
নিশিতার গলা ধরে আসে। এতো পানি আসছে কেনো তার চোখে বারবার?
“ও হ্যা, দেখো ভুলেই গেলাম। এই বাক্সটা ধরো তো।”
“কি আছে এই বাক্সে?”
“আরে বাবা, খুলেই দেখো না। তোমরা বড্ড বেশি প্রশ্ন করো।”
নিশিতার সবকিছুই কেমন অবিশ্বাস্য লাগছে আজকে। রাজীব শাহের এতো ভালো ব্যবহার সে হজমই করতে পারছে না।
বাক্স খুলতেই চোখ কপালে ওঠে নিশিতার। স্তম্ভিত হয়ে যায় সে।
“বাবা।”
“নন্দিনীর জন্য গহনা কেনার সময় এটা খুব পছন্দ হয়ে যায়। তাই নিয়ে নিলাম তোমার জন্য। অনুষ্ঠান বাড়িতে সোনার গহনা ছাড়া মানায় নাকি মেয়েদের?”
নিশিতার কিছুই বিশ্বাস হচ্ছে না। এতো সুন্দর গহনাটা তার শ্বশুর তার জন্য কিনেছে? সত্যিই?
“যাও সাজগোজ করো। এভাবে মুখটা বাংলার পাঁচের মতো বানিয়ে রেখোনা।”
হতভম্ব নিশিতাকে ওভাবে দাঁড় করিয়ে রেখে বেরিয়ে যায় রাজীব শাহ। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার গাড়ির শব্দ শোনা যায়। নিশিতার ইচ্ছা করছে একটু মন ভরে কাঁদে। কিন্তু কেনো যেনো আজ কাঁদতেও পারছে না সে। কি ভীষণ শান্তিতে আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে সে বারবার।
বরযাত্রীর পৌঁছানোর কথা দুপুর একটায়, কিন্তু আড়াইটা বেজে যাচ্ছে বরযাত্রীর দেখা নেই। রাজীব শাহ বারবার ঘর বাহির করছে। দুশ্চিন্তায় হাত-পা কাঁপছে তার।
ফিরোজ বাবার হাত চেপে ধরে বললো,”বাবা তুমি একটু শান্ত হয়ে বসো, আমি দেখছি তো।”
রাজীব শাহ এলিয়ে পড়ে ছেলের গায়ের উপর।
“কি দেখবে তুমি? ওদের কাউকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছেনা। সবার ফোন বন্ধ। কি হবে এখন?”
ফিরোজ বাবাকে চেয়ারে বসিয়ে রেখে দৌড়ে বাইরে গেলো। মর্জিনা বেগম ইতোমধ্যে আহাজারি শুরু করেছে। তার দমবন্ধ হয়ে আসছে বারবার।
নিশিতা মর্জিনা বেগমের মাথাটা বুকে চেপে ধরে বললো,”মা শান্ত হোন দয়া করে। নন্দিনীর মনের অবস্থাটা একবার চিন্তা করুন। আপনি এভাবে ভেঙে পড়লে ও কোথায় যাবে? আপনার এখন শক্ত হতে হবে।”
মর্জিনা বেগম হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললো,”আমার মেয়েটার কপাল এমন পোড়া হলো কেনো রে মা? কি হবে এখন ওর? আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী ওকে বাঁচতে দিবে না, কথা শোনাবে। ও তো মরে যাবে মা রে।”
নিশিতার বুক কেঁপে ওঠে।
“এসব কি কথা মা? চুপ করুন। ওরা আসবে, আসবেই। হয়তো কোনো সমস্যা হয়েছে। দেখবেন একটু পরেই চলে আসবে।”
মর্জিনা বেগম উত্তর দেয়না। আরো জোরে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে।
“হ্যা রে নন্দিনী, তোর বর আসবে না? পালিয়েছে নাকি?”
আলেয়া ফুপুর কথায় চমকে ওঠে নন্দিনী। তার হাত-পা কাঁপছে থরথর করে।
“আমার কি মনে হয় বল তো? তুই পালিয়ে গিয়েছিলি, এজন্য তোকে আর মেনে নিতে পারছে না। হয়তো মুখের উপর না বলতে পারছে না। এজন্য ফোন বন্ধ করে রেখেছে।”
মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসে আলেয়া, সাথে আরো কয়েকজন কি কি বলাবলি করে। নন্দিনীর কান ঝাঁ ঝাঁ করতে থাকে। না না, নির্ঝর সাহেব এমন না। এমন হতেই পারেনা।
“আরে না আমার কি মনে হয় জানো? নন্দিনী ওদের যা অপমান করেছে, ওরা এভাবেই তার শোধ তুললো।”
নন্দিনী মাথা চেপে বসে পড়ে। ও ঘর থেকে মায়ের আহাজারি শোনা যাচ্ছে। নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছা করছে তার। কখনোই নির্ঝর সাহেব এটা করতে পারেনা। সে কি আবারও মানুষ চিনতে ভুল করলো? আবার ঠকে গেলো সে?
“কি হচ্ছে কি? এভাবে ওকে ঘিরে রেখেছেন কেনো আপনারা?”
নিশিতার কথায় থেমে যায় সবাই, শুধু চাপা গুঞ্জন চলতে থাকে।
“ও তেমন কিছু না বউ, নন্দিনীকে একটু স্বান্তনা দিচ্ছিলাম আমরা।”
নিশিতা নন্দিনীর দিকে তাকিয়ে দেখে সে হাঁপাচ্ছে। চোখমুখ লাল হয়ে গেছে তার।
নিশিতা কঠিন গলায় সবার দিকে তাকিয়ে বললো,”ওর এমন কিছুই হয়নি যার জন্য ওকে স্বান্তনা দিতে হবে। এই আপনারা নাকি ওর আত্মীয়? ওর কাছের মানুষ? এই ব্যবহার আপনাদের? বিপদের সময় এগিয়ে আসতে না পারেন, সুখের সময়ও আসবেন না। যান এখান থেকে সবাই, ঘর খালি করুন।”
সবাই চুপ করে যায়।
নিশিতা ঝাঁঝের সাথে বললো,”কি হলো কথা কানে যাচ্ছে না? যান বলছি।”
ঘরের সবাই মুখ কালো করে উঠে চলে যায়।
নন্দিনী ছুটে এসে নিশিতার বুকে আছড়ে পড়ে হাউমাউ করে কেঁদে দেয়।
“ভাবী উনিও আমাকে এভাবে ঠকাতে পারলো? আবারও মানুষ চিনতে ভুল করলাম আমি? আমি তো আর বেঁচে থাকতে পারবো না। সমাজে আমাকে আর বেঁচে থাকতে দিবে না। কয়জনের মুখ বন্ধ করবেন আপনি?”
নিশিতা আঁৎকে ওঠে নন্দিনীর কথা শুনে।
“এসব কি বাজে কথা নন্দিনী? কেনো ঠকাবে উনি তোমাকে? কে বলেছে এসব কথা?”
“তাহলে উনারা আসছেন না কেনো?”
“নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা হয়েছে নন্দিনী, ঠিক আসবে।”
“কোনো সমস্যা হয়নি ভাবী। আমি জানি, উনারা আর আসবে না। কোনোদিন আসবে না।”
নন্দিনীও চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। ওদিকে মর্জিনা বেগমের আহাজারি অন্যদিকে নন্দিনীর এমন চিৎকার করে কান্না, পরিবেশ নারকীয় হয়ে ওঠে। নিশিতার দম আটকে আসে।
বেলা চারটা গড়াতে চললো। ফিরোজ সব জায়গায় খুঁজে এসেছে, বাজারে খোঁজ নিয়েছে। কোথাও কোনো হদিস নেই। এদিকে আকাশে কালো মেঘ জমেছে, যেনো একটু পরেও প্রলয় নামবে। শীতকালে এমন দুর্যোগ কমই দেখা যায়।
উঠোনের মাঝে বড় করে শামিয়ানা খাটানো হয়েছে। ঝড় আসলে উড়ে যাবে, কিন্তু কারোই খেয়াল নেই সেদিকে।
রাজীব শাহ বিছানায় পড়ে গেছে। ওঠার মতো শক্তি নেই তার। ফিরোজ উদ্ভ্রান্তের মতো ছোটাছুটি করছে বারবার। ওদিকে আত্মীয় স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশির চাপা গুঞ্জনে কান পাতা যাচ্ছে না। সবার মুখে মুখে একটাই কথা,”নন্দিনীর বর বিয়ের আগেই পালিয়েছে।”
“এ কি নন্দিনী? সব গহনা খুলে রেখেছো কেনো?”
নন্দিনী বিষাদ ভরা মুখে এক চিলতে হাসি দেয়। সেই হাসিটা এতোটাই কষ্টের যে নিশিতার সহ্য হয়না।
“আপনি এখনো বিশ্বাস করছেন ওরা আসবে? ওরা আর আসবে না ভাবী। নির্ঝর সাহেব প্রতিশোধ নিলেন। তাদের অপমানের প্রতিশোধ নিলেন উনি।”
“এসব কথা বলো না নন্দিনী। উনাকে দেখে আমার তেমন মনে হয়নি।”
“বুঝতে দিলে তো অভিনয়টা জমতো না।”
নন্দিনীর কথা কেমন অপ্রকৃতস্থের মতো শোনায়। নিশিতা তাকে রেখে যেতে পারছে না কোথাও। মেয়েটা যদি অধিক শোকে উল্টাপাল্টা কিছু করে বসে?
সাড়ে চারটার দিকে হঠাৎ দুর্যোগ শুরু হলো। চারদিক থেকে প্রচন্ড বাতাস এলোমেলো করে দিতে লাগলো সব। উঠোনের শামিয়ানা ছিড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা।
“শীতকালে কেউ এমন ঝড় দেখেছো?”
“দেখিনি বাবা, সবই অনুক্ষণ।”
“ভাবী, আমার খুব ঘুম পাচ্ছে জানেন? আপনি কি আমার কাছে একটু থাকবেন?”
নিশিতা কাঁপা গলায় বললো,”আমি আছি নন্দিনী। তুমি ঘুমাও।”
নন্দিনীর কেমন অনুভূতি শুন্য লাগছে। তার মনে হচ্ছে পৃথিবী ঘোলাটে হয়ে আসছে তার সামনে। যে কোনো মুহুর্তে কৃষ্ণকালো রঙ ধারণা করবে এ ধরা।
ঝড় থামার কোনো লক্ষণ নেই। আরো বাড়ছে যেনো। শো শো শব্দ শোনা যাচ্ছে বাতাসের। মর্জিনা বেগম দুইবার জ্ঞান হারিয়ে এখন স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। হয়তো কান্নাকাটির শক্তিটুকুও অবশিষ্ট নেই আর।
ফিরোজ বসার ঘরে মাথা চেপে ধরে বসে আছে। অসম্ভব কান্না পাচ্ছে তার ছোট বোনটার জন্য। কেনো এমন হলো তার সাথে? কেনো হতে হলো?
রাজীব শাহ মৃতের মতো পড়ে আছে বিছানার একপাশে। কোনো খেয়াল নেই তার কোনোদিকে।
নিশিতা অবাক হয়ে দেখছে নন্দিনী কেমন ঘুমিয়ে পড়লো। আচ্ছা ও আবার ঘুমের ওষুধ নিলো না তো? এভাবে ঘুমিয়ে গেলো কেনো ও? এতো শীতের মধ্যেই নিশিতা ঘেমে ওঠে। কিন্তু একবারের জন্যও নন্দিনীকে একা রাখেনি সে। কখন এই কাজ করবে সে? যদি না করে এভাবে ঘুমাচ্ছে কেনো ও?
অসম্ভব কান্না পাচ্ছে নিশিতার। এটা সত্যি সে চেয়েছিলো এই পরিবারের খারাপ কিছু হোক। তাকে আর তার বাবাকে যে অপমান করা হয়েছে তার প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলো সে। কিন্তু এমন কিছু কি সত্যিই চেয়েছিলো সে? এ যে তারই পরিবার। এদের বিপদ মানে তো তার নিজেরও বিপদ। খাটের রেলিঙের উপর মাথা দিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে নিশিতা।
ঝড় থেমেছে বেশ কিছুক্ষণ। নিমন্ত্রিত অতিথিরা খেয়ে বাড়ি ফেরা শুরু করেছে। উঠোনের অবস্থা ভালো না। একটা বড় আম গাছের ডাল ভেঙে শামিয়ানার উপর পড়েছে। লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে বিয়ে উপলক্ষে সাজানো গেট। পুরো উঠোন জুড়ে প্রলয়ের ছাপ।
থালার মতো একটা বড় চাঁদ উঠেছে বাইরে। ঝড় থামার পর শান্ত পরিবেশ। নন্দিনীর ঘুম ভেঙেছে কিছুক্ষণ আগেই। ঘুম ভাঙার পর অস্বাভাবিক রকম শান্ত হয়ে আছে সে। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে।
নিশিতা এসে নন্দিনীর মাথায় হাত রাখে।
“ভাবী, এভাবেও কি প্রতিশোধ নেওয়া যায়?”
নন্দিনীর গলার স্বর শুনে গলা কেঁপে ওঠে নিশিতার। মেয়েটা এতো বিষাদমাখা গলায় কথা বলছে কেনো?
“বলুন না ভাবী, এভাবে প্রতিশোধ নিয়ে জেতা যায়?”
নিশিতা ধরা গলায় বললো,”আমার এখনো মনে হচ্ছে কোথাও একটা সমস্যা হয়েছে। এমন হওয়ার কথা নয়।”
নন্দিনী ম্লান হাসে। শরীর অবশ হয়ে আছে তার। মনে হচ্ছে সারাজীবনের জন্য ঘুমিয়ে গেলে ভালো হতো। কেনো জেগে উঠলো সে?
হঠাৎ গেটের বাইরে গাড়ির আওয়াজ শুনে থমকে যায় ওরা। দুইজন তাকায় দুইজনের দিকে।
“ভাবী আমি কি ভুল শুনলাম?”
নিশিতা উত্তর না দিয়ে জানালা দিয়ে উঁকি দেয়, সে নিজেও তো শুনলো গাড়ির শব্দ। কে এসেছে?
ততক্ষণে ভিতরে খবর এসেছে গেটে কয়েকটা গাড়ি এসেছে। তার মধ্যে একটা গাড়ি ফুল দিয়ে সাজানো।
রাজীব শাহ কাঁপা শরীরে উঠে দাঁড়ায়। মর্জিনা বেগমের দিকে তাকাতেই দেখে সে-ও উঠে দাঁড়িয়েছে। দূর্বল শরীরে দাঁড়াতে পারছে না। তাও তার মন বলছে ভালো কিছু হয়ে যাচ্ছে, খুব ভালো কিছু।
তখনই হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরোজ এসে বললো,”বাবা ওরা এসেছে।”
রাজীব শাহ দুই চোখ বন্ধ করে ফেলে। এমন শক্ত একজন মানুষের দুই চোখ বেয়ে অঝোরে পানি পড়তে থাকে। এতোক্ষণ সে কাঁদেনি, কিন্তু এখন যেনো নোনাপানির বাঁধ ভেঙেছে চোখে।
নিশিতা বাইরে থেকে সব শুনে দৌড়াতে দৌড়াতে ঘরে যেয়ে বললো,”নন্দিনী, আবার সাজগোজ করে নাও। তোমার বর চলে এসেছে।”
নন্দিনীর ধপ করে খাটে বসে পড়ে। অবিশ্বাস্য লাগছে তার সবকিছু। এসব কি হচ্ছে তার সাথে? কেনো হলো এমন কিছু?
(চলবে…..)