চন্দ্রাণী(১৫)

0
164

#চন্দ্রাণী(১৫)
রাস্তা থেকে বাড়ি খানিকটা দূরে। টগর চন্দ্রকে হাসানোর জন্য বিভিন্ন গল্প করছিলো আর চন্দ্র মনে মনে ভাবছিলো,”কে বলবে এই হাসিখুশি প্রাণবন্ত ছেলেটা ক্রিমিনাল,নেশাখোর? ছন্নছাড়া হয়ে গেলে কি মানুষ নিজেকে ধরে রাখতে পারে না আর? ”

টগর বিরক্ত নিজের উপর নিজে। একটা মেয়েকে ইমপ্রেস করা এতো টাফ?
আগে তো মনে হয় নি এরকম।কতো মেয়েই তো একবার একটা পজিটিভ সাইন পাবার অপেক্ষায় থাকতো। অথচ এই মেয়েকে কি-না সামান্য কফি খাওয়াতে রাজি করাতে গিয়ে ঘাম ছুটে গেলো, সেই সাথে কতো নাটক যে করতে হলো!
উফ বাবা!
কেমনে মানুষ প্রেম করে? কতটা অভিনয় প্রতিভা থাকলে মানুষ প্রেম করতে পারে টগর তাই ভাবছে।

চন্দ্রর কেমন আনইজি লাগছে। সকালে এসেছিলো তখন ইন্সপেক্টর নির্জর সাথে ছিলো, এখন আর কেউ সাথে নেই।এই লোকটা যদি চন্দ্রকে মেরে ফেলে?
অথবা যদি নিয়াজকে খবর দেয়?
কোন ভরসায় এলো চন্দ্র এখানে? বাড়িতে কাউকে তো বলে ও আসে নি যে এই বাড়িতে আছে।

নিজের বোকামির জন্য নিজের চুল নিজের ছিড়তে ইচ্ছে করছে চন্দ্রর।টগর লাউটা হাতে নিয়ে সোজা রান্নাঘরে চলে গেলো। তারপর চন্দ্রকে বসতে বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো।সুপারি বাগানটার পরে টগরের ছোট চাচার বাড়ি।ওই বাড়িতে গিয়ে চাচাতো বোন রিমিকে ডেকে আনলো।

চন্দ্র একা একা বসে রইলো। তার ভীষণ ভয় হচ্ছে। টগর ঘর থেকে বের হতেই চন্দ্রর মনে হলো ও বুঝি নিয়াজকে খবর দিতে গেছে।
কেমন আতংকিত লাগছে চন্দ্রর।

নিজেকে নিজে সাহস দিয়ে চন্দ্র বললো, “এতো ভেঙে পড়ছো কেনো?এর চাইতে দুঃসাহসিক কাজ ও তো তুমি করেছো চন্দ্র।শান্ত হও।”

মন বারবার ভয় পাচ্ছে অথচ মস্তিষ্ক বারবার বলছে কিছু হবে না,তোমার কোনো ক্ষতি হবে না।

মন ও মস্তিষ্কের এই দোলাচলে ভুগতে ভুগতে টগর ফিরে এলো। রিমি চন্দ্রকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেলো। টগর বললো, “আমার মেহমান উনি।একা একা বোর হবে ভেবে তোকে নিয়ে এলাম।তোরা গল্প কর,আমি কফি নিয়ে আসছি।”

রিমি তখনও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। চন্দ্র বিব্রত হয়ে বললো, “কেমন আছেন আপনি? ”

রিমি বিড়বিড় করে বললো, “ভালো আছি,আপনি? ”

চন্দ্র মুচকি হেসে বললো, “জি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। কি নাম আপনার?”

রিমি বললো, “রিমি,আপনার নাম?”

চন্দ্র বললো, “আমি চন্দ্রাণী তালুকদার।”

রিমি তখনও হতভম্ব। টগর ভাইয়ের ঘরে একটা মেয়ে,কিছুতেই রিমি হিসেব মেলাতে পারছে না।এই মেয়েটাকে রিমি চেনে ও না।দেখে মনে হচ্ছে শহরের মেয়ে।কথাবার্তা,ভাবভঙ্গি সবই আলাদা।

রিমি এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো, “আপনি কি টগর ভাইয়ের স্পেশাল কেউ?”

চন্দ্র বুঝতে না পেরে বললো, “কেমন? ”

রিমি গলা নামিয়ে বললো, “লাভার না-কি আপনি ওনার?”

চন্দ্র লজ্জিত হয়ে বললো, “আরে না,কি বলছেনে এসব?”

রিমি অবিশ্বাসের সুরে বললো, “মিথ্যা কথা কইবেন না আপা।কেউ না হইলে টগর ভাই এমনে এমনে কাউরে বাড়িতে আনে?আবার তার লাইগা কফি ও বানাইতে যায়?টগর ভাই তার ঘরে কাউরে জায়গা দেয় না।আমাগোরে ও না।মাঝেমাঝে আমার মা, আমি আসি এই বাড়িতে।যতই চেষ্টা করি একটু কিছু করে দেওয়ার,উঠান বাড়ি ঝাড়ু দিয়ে দেওয়ার, ঘরটা মুছে দেওয়ার কিছুতেই উনি রাজি হন না।এমনকি গল্প করতে ও আসতে দেন না কাউরে।
একটা কাজের মেয়েও রাখতে চান না।পুরাই মহিলা মানুষ এভয়েড করে চলেন। অথচ সেখানে আপনাকে নিজে নিয়ে এলো?কিছু না কিছু তো আছেই।”
চন্দ্র হেসে বললো,”বিশ্বাস করুন,এরকম কিছুই না।উনি আমার পরিচিত শুধু। তাছাড়া এক গ্রামের মানুষ যখন একজন অন্যজনের বাড়ি আসতেই পারে। ”

টগর রান্নাঘরের দরজা বন্ধ করে কা*টা জায়গা বরাবর লাউটা আলাদা করে ফেললো। তারপর দ্রুতহাতে সবগুলো প্যাকেট বের করে নিলো।লাউটা আবারও আগের মতো জোড়া দিয়ে রেখে কফি বানাতে বানাতে মনে পড়লো এই লাউ যখন ওরা বাড়িতে নিয়ে রান্না করার জন্য কা*টতে যাবে তখন তো বুঝা যাবে এটা আগেই কাটা ছিলো।ফ্রিজ থেকে ফ্রোজেন করে রাখা পিৎজা বের করে ওভেনে দিলো টগর।
তারপর রান্নাঘরের দরজা খুলে দিলো যাতে ওদিকে শব্দ যায়।এরপর তাকের উপর থেকে শিল/পাটা ফেলে দিলো লাউয়ের উপর। মুহূর্তেই খণ্ডবিখণ্ড হয়ে গেলো লাউটা।

ধপ করে ভারী কিছু পড়ার শব্দ পেয়ে রিমি আর চন্দ্র দুজনেই ছুটে গেলো রান্নাঘরের দিকে। গিয়ে দেখে টগর অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

চন্দ্রকে দেখে লজ্জিত হয়ে বললো, “এক্সট্রিমলি সরি চন্দ্রাণী,আসলে আমার সাথে ধাক্কা লেগে পাটাটা পড়ে গেলো নিচে।আপনার লাউটা একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। ”

চন্দ্র উদ্বিগ্ন হয়ে বললো, “না না,ছি!ওসব নিয়ে ভাববেন না।আপনার কোথাও লাগে নি তো?আপনি ঠিক আছেন?”

টগর হেসে বললো, “আমি ঠিক আছি।প্লিজ কিছু মনে করবেন না আপনি। ”

চন্দ্র হেসে বললো, “কি যে বলেন। সামান্য একটা লাউ ছিলো।”

টগর মনে মনে বললো, “আপনার কাছে যেটা সামান্য লাউ আমার কাছে সেটা অসামান্য জিনিস। ”

পিৎজা বেক হতেই ওভেন থেকে বের করে নিলো টগর। তারপর ট্রে-তে করে কফি,পিৎজা সাজিয়ে সার্ভ করলো।
রিমি তখনও অবাক। টগর ভাই আজ প্রথম তার হাতের পিৎজা খাওয়াচ্ছে তাকে।অথচ কতো দিন ওরা সবাই মিলে বলেছিলো কখনোই রাজি হয় নি।রেষ্টুরেন্ট থেকে হোম ডেলিভারিতে ওদের বাড়ি পাঠিয়েছে। সবসময় বলতো আমার ছন্নছাড়া জীবন গুছিয়ে দিতে যে আসবে আমার জীবনে,তাকে খাওয়াবো আমার নিজের হাতের পিৎজা।
এই কি সেই তাহলে?

কফি খেতে খেতে চন্দ্র বললো, “আপনি পিৎজা ও বানাতে পারেন?”

রিমি ফোঁড়ন কেটে বললো, “আপনি হয়তো বিশ্বাস করবেন না,ভাইয়া কখনোই ওনার বানানো পিৎজা আমাদের কাউকে খাওয়ায় নি।সবসময় বলতো যে তার বউ হবে তাকে খাওয়াবে শুধু।আজকে আপনার সুবাদে খেতে পারলাম। ”

টগর আড়ষ্ট হয়ে গেলো রিমির কথা শুনে। এটা ঠিক যে তার একটা সুপ্ত ইচ্ছে ছিলো এটা।কিন্তু আজকে চন্দ্রকে বাসায় এনে শুধু কফি খাওয়াতে ইচ্ছে করলো না। তাই বলে রিমি এরকম কিছু ভেবে নিবে তাও টগরের ধারণায় ছিলো না।

চন্দ্র বিব্রত হয়ে বললো, “আমি উঠি,বাসায় চিন্তা করবে।”

টগর উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “চলুন,আপনাকে এগিয়ে দিই।রিমি,তুই চলে যা।”

রিমি বের হতে হতে বললো, “উনি কে টগর ভাই?”

টগর হেসে বললো, “চিনিস না তো তুই ও?উনি চেয়ারম্যান সাহেবের বড় মেয়ে।অবশ্য গ্রামে থাকে না উনি তাই চিনিস না। ”

চন্দ্র হাটতে হাটতে ভাবতে লাগলো টগরের কথা। ছেলেটাকে যতটা খারাপ ভেবেছে তা না।অনেক ভদ্র মনে হচ্ছে। অন্তত একা বাসায় চন্দ্রর খারাপ লাগবে ভেবে একটা মেয়েকে নিয়ে এসেছে এই ব্যাপারটা চন্দ্রর ভীষণ ভালো লেগেছে। মানুষটার সবই ভালো অথচ কেনো এসব খারাপ কাজে জড়িয়ে গেলো?
অথচ এরকম একজন লয়্যাল মানুষ সব মেয়েই এক্সপেক্ট করে।

টগরের ভীষণ রিল্যাক্স লাগছে।কাজটা যতটা কঠিন হবে ভেবেছিলো ততটাই সহজ হয়েছে।পথেই ফোন এলো টগরের।রিসিভ করতেই নির্ঝর বললো, “টগর বলছো?”

টগর বিরক্ত হয়ে বললো, “হ্যাঁ বলছি,বলুন।”

নির্ঝর বললো, “আচ্ছা, তোমার বাবার যে স্বাভাবিক মৃত্যু হয় নি জানো তুমি? ”

টগর শান্ত স্বরে বললো, “হ্যাঁ জানি।”

নির্ঝর বললো, “আমাকে তো বল নি এই কথা? আমি তো জানতাম তোমার বাবা স্বাভাবিকভাবেই মারা গেছেন।”

টগর বিরক্ত হয়ে বললো, “আপনি তো জিজ্ঞেস করেন নি।আর এটা বলার মতো কোনো ঘটনা না।সেই সময় পুলিশ তদন্ত করে কোনো কিছু পায় নি।”

নির্ঝর বললো, “এই সময় পেতে ও পারে টগর। ”

টগর একটা নিশ্বাস ফেলে বললো, “আমার আর কোনো আশা নেই এসব ব্যাপারে। আমার মা থাকতে যদি জানা যেতো তাহলে হয়তো আমার আগ্রহের অন্ত থাকতো না।আমার মা এই কষ্ট নিয়ে দুনিয়া ছেড়েছেন। এখন আর এসব জেনে কি হবে বলেন?আমার বাবা মা কেউ-ই ফিরে আসবে না।দুনিয়ার আদালতের বিচার আমার আর চাই না।বিচার হবে ওই দুনিয়ায় গেলে।প্রতিটি ধূলো কণা পরিমাণ সবকিছুর বিচার হবে।”

নির্ঝর বললো, “তুমি না চাইলেও আমি এর তদন্ত করবো।”

চলবে…

রাজিয়া রহমান

জয়েন করুন আমার ফেসবুক গ্রুপ রাজিয়ার গল্প কুটির এ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here