#নন্দিনী_শুধু_আমার
পর্ব: ৬
খুব জোরেসোরে একটা চড় খেয়ে ছিটকে যায় মীরন। হতভম্ব হয়ে যায় সে। মিনিট দুই সময় নেয় ধাতস্থ হতে। এখনো বাম গালটা ঝা ঝা করে জ্বলছে।
পিছনে তাকাতেই দেখে নন্দিনী কাঁপছে রাগে থরথর করে। মীরন কখনো ভাবতেও পারেনি নন্দিনীর মতো এতো সরল, কোমল একটা মেয়ে এতোটা হিংস্র হয়ে যেতে পারে। তার চোখমুখ দিয়ে যেনো আগুন ঝরছে।
মীরন হতবাক হয়ে বললো,”তুমি আমাকে চড় মারলে নন্দিনী?”
নন্দিনী এখনো যেনো স্বাভাবিক হতে পারছে না। প্রচন্ড রাগে শরীর অবশ হয়ে আসছে তার।
মীরন ছুটে এসে নন্দিনীর হাত ধরার চেষ্টা করে। আচমকা আবারও গোটা কয়েক থাপ্পড় বসে তার গালে। সে অবাক হয়ে নন্দিনীর শক্তি দেখে। একটা ক্ষীপ্র বাঘিনীর মতো যেনো ঝাপিয়ে পড়েছে তার উপর।
“নন্দিনী কি করছো? ছেড়ে দাও আমাকে, ছেড়ে দাও।”
নন্দিনীর চাপা গলায় বললো,”একদম আমার সামনে আসবি না। তোর ওই মুখ দেখতেও চাইনা আমি আর। নরকের কীট একটা। যে মুখটা একবার দেখার জন্য আমি নিজের সবকিছু ছেড়ে দিয়ে চলে গিয়েছিলাম, আজ সেই মুখটা দেখে আমার ঘৃণা হচ্ছে।”
মীরন কোনোরকমে নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়। ঠোঁটের কোণায় নোনাস্বাদ পেয়ে বুড়ো আঙুল ঠেকায় সেখানে। সাথে সাথে জ্বালা করে ওঠে। আঙুলটা সামনে এনে দেখে কালচে একটা তরল। মানে রক্ত পড়ছে?
“তুমি আমাকে এভাবে মেরেছো নন্দিনী?” মীরনের চোখে বিস্ময়। সে কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছে না।
নন্দিনী মীরনের অনেকটা কাছে এগিয়ে আসে। চোখে চোখ রেখে তাকায় সে মীরনের দিকে। শুক্লপক্ষের চাঁদের আলোয় নন্দিনীর মুখটা ভয়ংকর লাগে মীরনের।
নন্দিনী ফিসফিস করে বললো,”এখন তো আমি মেরেছি। ভালোয় ভালোয় এখান থেকে পালিয়ে যা। জানিস তো, আমার জার্মান শেফার্ডটা কতোটা হিংস্র। আমি একবার চিৎকার করে ডাক দিলেই ও ছুটে এখানে চলে আসবে। আর জার্মান শেফার্ড রেগে গেলে কতোটা দানবীয় হতে পারে, তা নিশ্চয়ই তোকে বলে দিতে হবে না।”
মীরন ঈষৎ কেঁপে ওঠে। নন্দিনী কলেজে থাকা অবস্থায় রাজীব শাহ মেয়েকে ছোট্ট একটা জার্মান শেফার্ড শাবক উপহার দিয়েছিলো। নন্দিনীর ভীষণ প্রিয় কুকুর। শুধু নন্দিনী ছাড়া কাউকেই মানে না ও। মাঝে মাঝে ক্ষীপ্র হয়ে ওঠে নন্দিনীকে ছাড়া। আর একবার নন্দিনীকে কেউ আঘাত করলে ও এতোটাই হিংস্র হয়ে যায় যে, নন্দিনী নিজেও ঠেকাতে পারে না। যেদিন রাজীব শাহ নন্দিনীর শরীরে ঠান্ডা পানি ঢেলেছিলো সেদিন কুকুরটিকে বেঁধে রাখা হয়েছিলো অন্য ঘরে।
মীরন নন্দিনীর দিকে তাকাতে ভয় পাচ্ছে। এক নতুন নন্দিনীকে যেনো দেখতে পাচ্ছে সে।
“তুই কি যাবি এখান থেকে? নাকি তোর উপরে যাওয়ার ব্যবস্থা করবো?”
মীরন চোখ লাল করে বললো,”কাজটা ভালো করলে না নন্দিনী? এতোদিন আমার ভালো রূপটা দেখেছো। খারাপ রূপটা দেখো নাই। এখন দেখবা সেইটা।”
“তুই যা করার করে নিতে পারিস। আর তোর খারাপ রূপ দেখিনি মানে? আমার কাছে এই পৃথিবীতে তোর মতো খারাপ কেউ নেই।”
মীরন রাগে গরগর করতে করতে সেখান থেকে চলে যায়। মীরন চলে যেতেই নন্দিনী জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে। মাথা ছিঁড়ে পড়ছে তার তীব্র যন্ত্রণায়। সে নিজেও জানেনা সে কি করেছে। শুধু জানে এটা তার করা উচিত ছিলো।
দরজা ঠেলে ঘরে ঢোকার মুখে একটা কালো ছায়া তার সামনে থেকে চলে যায়। কেউ যেনো অনেক আগে থেকেই খেয়াল রাখছিলো তার উপর। সে আসতেই তাড়াতাড়ি করে সরে যায়। নন্দিনী স্পষ্ট বুঝতে পারে ওটা রেশমা।
খাটের উপর ধপ করে বসে পরে নন্দিনী। হালকা চিৎকার করে ডাক দেয় রেশমাকে।
রেশমা যেনো অপেক্ষাতেই ছিলো। ছুটে এসে দাঁড়ায় নন্দিনীর সামনে। ভীষণ ভয় করছে তার এই মানুষটাকে দেখে।
“আমার জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে আয়। মনে রাখবি একদম বরফ শীতল পানি আনবি।”
রেশমা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,”কিন্তু এই শীতে আপনি ঠান্ডা পানি খাবেন?”
রেশমা কথা শেষ করতে পারে না। নন্দিনীর লাল চোখে তার দিকে তাকায়। রেশমা ছুটে চলে যায় সেখান থেকে।
শান্তভাবেই পানির গ্লাসটা হাতে নেয় নন্দিনী। রেশমা এখনো কাঁপছে ভয়ে। শান্ত মানুষ রেগে গেলে ভয়ংকর হয়। নন্দিনী ঢকঢক করে পুরো পানিটা খেয়ে নেয়।
“রেশমা।”
“জ্বি আপা।”
“তুই কি জানিস তুই একটা অন্যায় করেছিস?”
রেশমা উত্তর দেয়না। টাকার লোভে পড়ে ভুলটা করে ফেলেছে সে। সবাই যখন গায়ে হলুদে ব্যস্ত ছিলো, তখন মীরন নামের লোকটা তাকে দেখে টাকার লোভ দেখায়। ও ভেবেছিলো মীরনকে তো তার নন্দিনীর আপা ভালোবাসে। হয়তো সামনাসামনি দেখা হলে সব ভুলে যাবে। কিন্তু নন্দিনীর এই রূপের সাথে তো ও পরিচিত না। ভয় এদিক ওদিক তাকায় সে।
“কি হলো চুপ করে আছিস কেনো?”
রেশমা ঝট করে নন্দিনীর পায়ের কাছে বসে পড়ে। পা দু’টো জাপটে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,”আমার ভুল হয়ে গেছে আপা, অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি লোভে পড়ে। আমারে ক্ষমা করে দেন।”
“পা ছাড় রেশমা।”
“না ছাড়বো না। আগে আমারে ক্ষমা করে দেন, তারপর ছাড়বো।”
নন্দিনী গ্লাসটা এগিয়ে দেয় রেশমার দিকে।
“যা আরেক গ্লাস পানি নিয়ে আয়। গলা শুকিয়ে আসছে আমার বারবার।”
রেশমা দেরি না করে উঠে দাঁড়ায়। গ্লাস হাতে নিয়ে দৌড়ে যায়। এখনো ভয়ে বুক ধরফর করছে তার।
পানি নিয়ে ফিরে এসে দেখে নন্দিনী শুয়ে পড়েছে। অল্প চাঁদের আলো জানালা গলে ভিতরে আসছে। সেই আলোয় নন্দিনীকে অপ্সরাদের মতো লাগছে। রেশমা অবাক হয়ে দেখে, এতোটুকু সময়ে কেউ ঘুমিয়ে পড়তে পারে? কে বলবে এই নিষ্পাপ চেহারার মেয়েটাকেই একটু আগে দেখে কি ভয় করছিলো তার। রেশমা আর জাগায় না তাকে।
“খান সাহেব, যা শুনলাম তা কি সত্যি?”
মোতালিব খান গম্ভীর গলায় বললো,”কি শুনেছো?”
“শুনলাম আপনার হবু ছেলের বউ নাকি বিয়ের পাকা কথার দিনে প্রেমিকের সাথে পালিয়েছিলো? এরপর আবার কি মনে করে রাতে ফিরে এসেছে। তার সাথেই আবার ছেলের বিয়ে দিচ্ছেন?”
মোতালিব খান ভ্রু কুঁচকে তাকায়। বিরক্তিতে চোয়াল ঝুলে আসে তার।
“কোথায় শুনলে?”
“বাজারে সবাই বলাবলি করছিলো খান সাহেব। এসব কথা কি চাপা থাকে? বিশিষ্ট ব্যবসায়ী রাজীব শাহের একমাত্র মেয়ে প্রেমিকের সাথে পালিয়ে আবার ফিরেও এসেছে। সবার মুখে মুখে এই খবর এখন।”
মোতালেব খান হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলে,”কিছুই করার নেই। নির্ঝরকে তুমি ভালো করেই চিনো। ও একবার যা বলে তাই করে ছাড়ে।”
“খান পরিবারের মানসম্মানের কথাটা তো একবার ভাবা উচিত। এতো বড় খানদানি পরিবার আপনাদের।”
মোতালিব খান কিছু বলতে যাবে তার আগেই একটা গম্ভীর কণ্ঠ শুনে দুইজনই চুপ করে যায় ওরা।
“মোস্তাফা চাচাজান, আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন, আমি আবার মনে করিয়ে দিচ্ছি। আপনার পরিবারটিও নেহাৎ কম বড় নয়। বাজারে এক নামে সবাই জোয়ার্দার বাড়ি নামে জানে। মোস্তাফা জোয়ার্দার একজন নামকরা ব্যবসায়ী। তো আপনার মেয়েটাও তো বছর দুই আগে পালিয়ে বিয়ে করলো এক মোটর মেকানিককে। দুইদিন পর তো ঠিকই মেনে নিলেন মেয়ে জামাইকে। কতো বড় করে অনুষ্ঠান করলেন বিয়ের। এখন শুনেছি আপনার জামাইকে আপনি আপনার একটা চালের আড়ৎ লিখে দিয়েছেন?”
অপমানে আর অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বসে মোস্তাফা জোয়ার্দার। মোতালিব খান ইতস্তত করে বললো,”আহা নির্ঝর, তুমি মাঝখান থেকে এতো কথা বলছো কেনো?”
নির্ঝর মুচকি হেসে বাবার পাশে এসে বসে। ধূসর রঙা পাঞ্জাবি, এলোমেলো চুলে যেনো রাজপুত্র লাগছে ছেলেকে। মোতালিব খান একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়।
“কথা তো আমি বলতে চাইনি বাবা। তুমি যদি উনাকে প্রশ্রয় না দিতে এতোগুলো কথা বলার জন্য, আমি কথা বলতে আসতাম না। তুমি যখন নিশ্চুপ হয়ে নিজের হবু পুত্রবধূর দুর্নাম শুনছো বাইরের একটা মানুষের কাছে, আমি তো চুপ থাকতে পারিনা। আমার হবু স্ত্রীর এ বাড়িতে কোনো অসম্মান আমি সহ্য করবো না।”
মোস্তাফা জোয়ার্দার উঠে দাঁড়ায়। লজ্জায় আর অপমানে লাল হয়ে আছে তার মুখ।
গলার টাইটা ঠিক করতে করতে মোতালিব খানের দিকে তাকিয়ে বললো,”বাড়িতে ডেকে ছেলেকে দিয়ে এভাবে অপমান না করালেও পারতেন খান সাহেব। এ কথা তো শুধু আমার না, বাজারের সবাই বলাবলি করছে। তার জন্য আমাকে এভাবে অপ্রস্তুত করা হলো?”
মোতালিব খান উঠে দাঁড়িয়ে বললো,”আহা মোস্তাফা রেগে যেও না, বসো তো তুমি।”
নির্ঝর উঠে এসে মোস্তাফার কাঁধে হাত রেখে বললো,”চাচাজান, ভুল মানুষ মাত্রই হয়। আজ যদি আপনার মেয়ে তার প্রেমিকের কাছ থেকে প্রতারিত হয়ে ফিরে আসতো, আপনি কি তাকে বিয়ে দিতেন না? নাকি সারাজীবন বন্দী করে রাখতেন তাকে বাড়িতে?”
মোস্তাফা নির্ঝরের হাত ঝটকা দিয়ে ফেলে বললো,”ব্যবসা ভালোই শিখেছো ছোট খান। রাজীব শাহ এখন বাজারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। তার মেয়েকে বিয়ে করা মানে প্রতিপত্তি আরো জোরদার হবে বাজারে। আমরা বুঝিনা ভেবেছো?”
মোতালিব খান কিছুটা রেগে যায়। তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই নির্ঝর মিষ্টি করে হেসে বললো,”মহান সৃষ্টিকর্তা আমাকে যা দিয়েছেন আমি তাতেই সন্তুষ্ট। বাজারে রাজীব শাহ, ফিরোজ শাহ, মোস্তাফা জোয়ার্দারসহ যতো ব্যবসায়ী আসুক না কেনো, ছোট খান কে টেক্কা দেওয়ার মতো এখনো কেউ আসেনি। আর যাই হোক, আমাকে বিয়ে করে শ্বশুরের ব্যবসায় নজর দিতে হবে না।”
শেষ কথাটা সে কিছুটা টিটকারি দিয়েই বলে।
মোস্তাফা জোয়ার্দার আর কথা বাড়ায় না। হনহন করে হেঁটে চলে যায়।
“কাজটা তুমি ভালো করলে না নির্ঝর।”
নির্ঝর অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকায়।
“কোন কাজটা ভালো করিনি বাবা?”
“তুমি ভালো করেই বুঝতে পারছো আমি কোন কাজের কথা বলছি। আমাদের পার্টনারদের সাথে সম্পর্ক খারাপ করছো তুমি। ব্যবসা পুরোটা তোমাকে বুঝিয়ে আমি কিছুদিন অবসরে আছি। এখনো বাজারে বড় খান নামটা সবাই মনে রেখেছে। সেখানে তুমি শত্রু বাড়াচ্ছো। ব্যবসা এতো সহজ নয়।”
নির্ঝর চোয়াল শক্ত করে ফেলে। বাবাকে কথা বলার সুযোগ দেয় সে।
“তাছাড়া তুমি যে কাজটা করছো, মানুষ তো কথা বলবেই। কয়জনের মুখ বন্ধ করবে তুমি? আজ মোস্তাফা বললো, কাল অন্য কেউ বলবে। পরশু আবার অন্য একজন বলবে। তুমি কি এভাবেই মানুষের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করে যাবে? এরপর তো বাজারে খানদের একঘরে করে ফেলবে। কীভাবে টিকে থাকবে তুমি?”
নির্ঝর শান্ত চোখে তাকায় বাবার দিকে।
“আমার স্ত্রীকে নিয়ে কেউ বাজে মন্তব্য করলেই আমি এভাবেই রুখে দাঁড়াবো। আমার কাছে ব্যবসার থেকে পরিবার আগে।”
মোতালিব বিরক্তিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায় ছেলের দিকে। এই ছেলেকে নিশ্চয়ই জাদু করেছে ওই মেয়ে। নাহলে ছেলে এমন পাগল হতে পারে না এ কয়দিনে। রূপের কথাই যদি বলতে হয়, নির্ঝরের আগের স্ত্রী শিরিন ছিলো ভূবনভোলানো সুন্দরী। নন্দিনী তার ধারে কাছেও না। তাহলে নির্ঝর কেনো এমন পাগল হলো?
“সাবধান করে দিচ্ছি নির্ঝর। পরবর্তীতে আর কোনো ঝামেলা হলে তখন আমাকে বা তোমার মা কে তোমার পাশে পাবে না। প্রতিটা পদক্ষেপ খুবই সাবধানে নিবে। কথাটা মাথায় রেখো।”
রাগে মোতালিব খানের ফর্সা মুখ লাল হয়ে যায়। বাবাকে রাগাতে চায়না নির্ঝর। স্মিত হেসে বাবার দিকে তাকায়। মোতালিব খান রাগে ওখান থেকে চলে যায়।
আগামীকাল নন্দিনীর বিয়ে, আজই ওদের বাড়িতে একটা সাজসাজ রব। পুরো বাড়ি সাজানো হচ্ছে। ছোট ছোট মেয়েরা নন্দিনীকে মেহেদী পরাচ্ছে হাতে। মর্জিনা বেগম মুখে পান দিয়ে সারাবাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে। সুখী সুখী চেহারা তার।
নিশিতা এক কোণায় দাঁড়িয়ে চুপচাপ বাড়ি সাজানো দেখছে। ওর ও খুব শখ ছিলো ওর বিয়েতেও এভাবে বাড়ি সাজানো হবে, ধুমধাম করে অনুষ্ঠান হবে। কিন্তু বাবার টাকা না থাকায় এগুলো কিছুই হয়নি। এমনকি শ্বশুরবাড়ি থেকেও কোনো আয়োজন করা হয়নি। মেয়ের জন্য রাজীব শাহ যতো খরচ করছে, ছেলের বেলায় তা কিছুই করেনি। একটাই কারণ মেয়ে হতদরিদ্র পরিবারের। বিয়েতে তাকে তেমন কোনো গহনাও দেওয়া হয়নি।
“তুমি এইখানে কি করো দাঁড়ায়? ওদিকে সবাই হাতে মেহেদী দিচ্ছে, তোমার হাত খালি কেনো?”
শ্বাশুড়ির কথায় একটু চমকে যায় নিশিতা। জোর করে হেসে বললো,”ওসব ছেলেমানুষী ব্যাপার মা। ওরাই আনন্দ করুক।”
“তা তুমি কি এই বয়সে বুড়ি হয়ে গেলে মা জননী?”
নিশিতা উত্তর দেয়না। আজ তার বুকের মধ্যে কেমন একটা ভোঁতা যন্ত্রণা হচ্ছে। তার বিয়েটাই যদি এমন সুন্দরভাবে হতো। কতো শখ ছিলো তার।
“কি হলো, কি ভাবতেছো?”
“কিছু না মা।”
মর্জিনা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,”যাও মেহেদী নিয়ে আসো। আমারে পরায় দাও।”
নিশিতা অবাক হয়ে তাকায় শ্বাশুড়ির দিকে।
“কি হলো হা করে দেখছো কি? তোমরা যদি এই বয়সে বুড়ি হয়ে যাও, আমি নিজেই একটু ছেলেমানুষী করি নাহয়।”
“মা আপনি সত্যি মেহেদী দিবেন?”
“যাও তো, নিয়ে আসো। ভীষণ শীত পড়ছে, রোদে নিয়ে আসো।”
নিশিতা একটু ইতস্তত করে চলে যায়।
“দেখি তোমার হাতটা দাও।”
নিশিতা আরো অবাক হয়। সে এসেছে শ্বাশুড়িকে মেহেদী দিতে।
“মা ঠিক বুঝলাম না আপনার কথা।”
মর্জিনা বেগম বিরক্ত হয়ে নিশিতার হাত টেনে নেয় নিজের কোলের মধ্যে। এরপর যত্ন করে তার হাতে মেহেদী দিতে থাকে। নিশিতা হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে শ্বাশুড়ির দিকে। কেনো যেনো চোখটা ভিজে উঠছে তার বারবার। সে অন্য হাত দিয়ে চোখ মোছার চেষ্টা করে লুকিয়ে।
“কিশোরী বয়সে ভালো মেহেদী দিতে পারতাম। চাঁদ রাতে বাড়ির সব মেয়ে বউরা ঘিরে ধরতো আমারে মেহেদী পরার জন্য। সবাইরে দিতে দিতে আমি নিজে দেওয়ারই সময় পাইতাম না। মেহেদী না দিয়েই ঘুমায় যাইতাম। কিন্তু সকালে উঠে দেখতাম আমার হাতে সুন্দর করে মেহেদী দেওয়া।”
“কীভাবে মা?”
“আমার আম্মা আমারে পরিয়ে দিতেন রাতে, আমি ঘুম থাকা অবস্থায়। কোনো ঈদেই এর অন্যথা হতোনা।”
মর্জিনা বেগমের চোখে পানি চলে আসে। নিশিতার গলাটাও ধরে আসে।
“এরপর বিয়ে হয়ে আসলাম এই বাড়ি। বিশাল যৌথ পরিবার, প্রায় জনা বিশেকের সংসার। চাঁদ রাতে অনেক রান্নাবান্না করা লাগতো। কাজ শেষে ঘরে ফিরতে ফিরতে রাত বাজতো দুইটা। ওই সময় আর শক্তি হইতো না গো মা মেহেদী দেওয়ার। আম্মার কথা খুব মনে পড়তো তখন। আজ আম্মা থাকলে নিশ্চয়ই পরিয়ে দিতেন।”
মর্জিনা বেগম ম্লান হাসে। নিশিতার দুই গাল বেয়ে পানি পড়ছে। মর্জিনা বেগম দেখেও না দেখার ভান করে। একমনে মেহেদী পরিয়ে দিতে থাকে সে নিশিতার হাতে।
“বয়সটা তখন কম ছিলো। ঈদের দিন খালি হাতে ঘুরতে কষ্ট হইতো। কেউ দেখতো না সেই কষ্ট। পরে আস্তে আস্তে নিজের সংসার হলো। তোমার শ্বশুরের ব্যবসা বড় হলো। কাজের লোকের ছড়াছড়ি বাড়িতে। আমি করার মতো কোনো কাজই পাইনা। ছোট সংসার, ঝামেলা নেই। চাইলে সবসময় হাত মেহেদী রাঙিয়ে রাখতে পারি। কিন্তু সেই ইচ্ছেটা আর করতো না জানো? কতোকাল পর আবার সেই মেহেদী হাতে নিলাম।”
নিশিতা হাত টেনে নেয় নিজের দিকে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে শ্বাশুড়ির দিকে।
মর্জিনা বেগম বিরক্ত হয়ে বললো,”হাত টেনে নিলা ক্যান? শেষ হয়নি তো এখনো।”
“মা, আজ আপনার আম্মা বেঁচে থাকলে আপনারে মেহেদী দিয়ে দিতো না হাতে?”
“কেনো বলো তো?”
“মনে করেন আজকের জন্য আমি আপনার আম্মা। আজ আমি মনভরে আপনার হাতে মেহেদী দিয়ে দিবো। আপনি কিচ্ছু বলতে পারবেন না।”
মর্জিনা বেগম কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,”কি বলো মা গো?”
“এইযে আমাকে মা বলে ডাকলেন। এখন চুপ করে বসুন তো। আপনাকে মেহেদী পরিয়ে দিবো আমি।”
মর্জিনা বেগম মন্ত্রমুগ্ধের মতো হাত এগিয়ে দেয়। সে জানেনা সে কেনো কাঁদছে। চোখের পানি কোনোভাবে বাঁধ মানছে।
“মা গো তুমি আমারে ক্ষমা করে দাও। তোমার সাথে আমরা অন্যায় করছি। ফিরোজের বাবার উপর কথা বলার সাহস কোনোদিন হয়নি আমার। আমার একমাত্র ছেলের বউয়ের জন্য অনেক কিছু করার ইচ্ছা ছিলো আমার। উনি উনার মতোই একজন ব্যবসায়ীর মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিয়ে ঠিক করে রেখেছিলো। কিন্তু ফিরোজ গোঁ ধরে বসলো তোমাকেই বিয়ে করবে। উনি গেলেন রেগে। তোমাকে কিছুই দিতে দিবেন না উনি। ফিরোজ তখন নিজে তেমন কিছু করেনা। আমি উনার পায়ে পড়ে গেলাম। কোনো কথাই উনি শুনলেন না আমার। আমি কি অন্যায় করেছি তোমার সাথে।”
নন্দিনীর চোখ দিয়েও পানি ঝরছে। তবুও কিছু না বলে নিজের কাজ করতে থাকে।
হঠাৎ মর্জিনা বেগম নিশিতার দিকে তাকিয়ে বললো,”আমার আঁচল থেকে আলমারির চাবিটা নাও তো মা।”
“কেনো মা?”
“আজ ওখান থেকে যতো গহনা ইচ্ছা তুমি নাও, পরে ঘুরে বেড়াও। সবাই দেখুক শাহ বাড়ির বউ কতো সুন্দর।”
“কিন্তু মা, বাবা দেখলে তো….”
“আমি বুঝে নিবো। তোমার এতো কথা ভাবতে হবে না। যেটা যেটা নিতে মন চায় তুমি নাও। এক মেয়ে চলে যাওয়ার দিনে আমি বুঝতে পারছি, আমার আরেক মেয়েকে নিয়েই বাকিটা জীবন কাটাতে হবে।”
মর্জিনা বেগম মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে। নিশিতাও তাকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে দেয়।
কান্নাকাটি শুনে ফিরোজ দৌড়ে এসে এমন অদ্ভুত দৃশ্য দেখে থমকে যায়। যে দুইজন কোনোভাবেই দুইজনকে দেখতে পারেনা, সাপে নেউলে সম্পর্ক যাদের মধ্যে তারা আজ হঠাৎ জড়াজড়ি করে কাঁদছে কেনো? ফিরোজ কিছুই বুঝতে না পেরে মাথা চুলকায়। আচ্ছা কান্না কি ছোঁয়াচে? তার এমন কান্না পাচ্ছে কেনো হঠাৎ?
“দেখি কেমন মেহেদী দিয়েছো?”
জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নন্দিনী। মানুষটা তাকে লজ্জা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত সবসময়। আগামীকাল বিয়ে, অথচ তার নাকি আজই হবু বউকে দেখার জন্য কলিজা ছটফট করছে। তাও আবার এই কথা বলেছে তার বাবাকে। রাজীব শাহ অপ্রস্তুত হয়ে আমতা আমতা করে নন্দিনীকে ডেকে দিয়েছে। এই ভরসন্ধ্যায় এখন তাকে নিয়ে ছাদে আসতে হয়েছে।
“কি ব্যাপার? হাত দেখাও।”
নন্দিনী লজ্জায় লাল হয়ে বললো,”আগামীকাল দেখলে হতো না? কাল আমাদের বিয়ে, আর আজ আপনি আমাকে দেখতে এসেছেন। বাড়িভর্তি মানুষ, কি বলবে বলুন তো?”
নির্ঝর ভ্রু কুঁচকে বললো,”আমি কি অন্য কারো বউ দেখতে এসেছি নাকি? ওসব অভ্যাস আমার নেই।”
নন্দিনী মুখ টিপে হেসে বললো,”অন্য কাউকে দেখতে দিলে তো?”
নির্ঝর ঠোঁট কামড়ে হাসে।
হঠাৎ রাস্তার দিকে চোখ পড়তেই নন্দিনীর গত রাতের কথা মনে পড়ে। মুহুর্তেই মুখটা কালো হয়ে ওঠে ওর।
মীরনের চোখে কাল রাগের আগুন দেখেছে সে।
“ঠিক আছো নন্দিনী?”
“আচ্ছা নির্ঝর সাহেব, একটা কথা বলবেন?”
“কি কথা?”
“এতো কিছুর পরেও আমাকে মেনে নিতে একটুও কষ্ট হয়নি আপনার? আমার কেমন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে সবকিছু।”
নির্ঝর কিছুটা গম্ভীর হয়ে বললো,”এসব কথা হঠাৎ?”
“এমনিই বলছিলাম, তেমন কোনো কারণ নেই।”
“তুমি হয়তো জানো না নন্দিনী, আমি শিরিনকে কতোটা ভালোবাসতাম। ও আমাকে কখনো কিছু বুঝতেও দেয়নি। হঠাৎ একদিন দেখি ও নেই। নেই মানে কোথাও নেই। আমাকে চিঠি লিখেছে, আমাকে নাকি ওর কোনোদিনই ভালো লাগেনি। অভিনয় করেছে আমার সাথে এতোদিন। এতোটা ভেঙে পড়েছিলাম যে, নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছা করতো। সবার কাছে হাসির পাত্রে পরিণত হয়েছিলাম। সবাই বলতো নির্ঝর খানের বউ পালিয়েছে, নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা আছে। এমন কতো হাসিতামাশা শুরু হয়। এমনকি শিরিন টাকা নেওয়ার জন্য এটাও বলেছিলো আমি নাকি তাকে মারধোর করতাম। যাকে এতোটা ভালোবাসলাম, সে যদি এমন অপবাদ দেয় তাহলে কতোটা কষ্ট হয় বলে বোঝানো যাবে না। আমি ভেবেছিলাম আর কোনো মেয়ের সংস্পর্শেই কখনো যাবোনা। কিন্তু সেদিন রাতে তোমার ওই চোখজোড়া দেখে আমার ভিতরটা তোলপাড় হয়ে গেছে নন্দিনী। সেদিন রাতে আমি একটুও ঘুমাতে পারিনি তোমার দুশ্চিন্তায়। আমার মনে হয়েছে তুমি যেমন কারো দ্বারা ঠকেছো, আমিও তো ঠকেছি। দুইটি অপ্রাপ্তিতে ভরা হৃদয় পাশাপাশি এসে দুইজন কি দুইজনকে তৃপ্ত করতে পারে না?”
নির্ঝর একদমে কথাগুলো বলে চুপ করে যায়।
কিন্তু নন্দিনী কথা বলতে পারে না। তার কানে একটা কথাই বাজতে থাকে, ‘আমি শিরিনকে কতোটা ভালোবাসতাম।’
সে নিজেও তো মীরনকে ভালোবাসতো। কিন্তু নির্ঝরের কথাটা কেনো মেনে নিতে পারছে না সে? সে কি নির্ঝরকে এতোটাই ভালোবেসে ফেলেছে যে একান্ত নিজের করেই শুধু পেতে চাচ্ছে? পুরোনো ছায়াও যেনো উনার পাশে সহ্য করতে পারছে না নন্দিনী।
নির্ঝর নন্দিনীর দিকে ঝুঁকে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,”নন্দিনী ম্যাডাম, চোখে পানি কেনো?”
“কই না তো।”
“স্পষ্ট দেখছি যে।”
নন্দিনী কড়া গলায় বললো,”ভুল দেখেছেন।”
নির্ঝর মিনিট দুয়েক চুপ করে থেকে শব্দ করে হাসতে থাকে। হাসতে হাসতে চোখে পানি চলে আসে তার। নন্দিনীর রাগ হওয়া উচিত। কিন্তু সেই হাসির দিকে তাকাতেই তার রাগ পানি হয়ে যায়। গাঢ় নীল শার্ট, এলোমেলো চুল, খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে এই লোকটাকে এতো সুদর্শন কেনো লাগছে? একটা পুরুষকে কেনো এতো সুন্দর হতে হবে?
হাসি কিছুটা থামিয়ে নির্ঝর ঘোর লাগা গলায় বললো,”শিরিনকে হিংসা করছো নন্দিনী?”
নন্দিনী অপ্রস্তুত হয়ে বললো,”কখনোই না, কেনো হিংসা করবো?”
নির্ঝর বাঁকা ঠোঁটে হেসে বললো,”এই সামান্য একটু করছো তাইনা?”
নন্দিনী একটু জোর গলায় বললো,”একটুও না, একটুও না। বললাম তো।”
নির্ঝর বুকে দুই হাত বেঁধে নন্দিনীর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। নন্দিনীর লজ্জায় সেদিকে তাকাতে পারে না।
“আমার দিকে তাকাও নন্দিনী।”
“না।”
“একটু তাকাও, দুই সেকেন্ডের জন্য।”
নন্দিনী ঈষৎ ভেজা চোখে তাকায় নির্ঝরের দিকে। সাথে সাথে চোখের পাতা কেঁপে ওঠে তার। এমন মাতাল করা কেনো চোখজোড়া?
নির্ঝর নন্দিনীর ডান হাতটা টেনে নিজের বুকের বাঁ পাশে আলতো করে চেপে ধরে। নন্দিনীর দমটা বন্ধ হয়ে যায়।
“বিশ্বাস করো নন্দিনী, এখানে এখন শুধুই তোমার অস্তিত্ব। এই মণিকোঠায় শুধু একজনের বসবাস এখন, একান্তই একজনের। আর সে হলো তুমি। যদি তুমি আমাকে না-ও ভালোবাসো, আমি যেভাবেই হোক তোমার ভালোবাসা আদায় করে ছাড়বো। হৃদয়ের ঠান্ডা প্রকোষ্ঠে স্থান পেয়ে আমাকে ভালো না বাসার অপরাধে তো তোমাকে বন্দী করে রেখেই দিবো এখানে নাহলে।”
নন্দিনী বরফের মতো জমে যায়। সে চিৎকার করে বলতে চায়,’আমিও আপনাকে ভালোবাসি নির্ঝর সাহেব, অনেক অনেক ভালোবাসি।’
কিন্তু বলতে পারে না। গলায় যেনো আটকে আছে তার কিছু।
পশ্চিমের আকাশ লাল করে সূর্য ডুবেছে কিছুক্ষণ। এখনো আকাশ কিছুটা রক্তিম।
নির্ঝর নেশাক্ত গলায় নন্দিনীর দিকে তাকিয়ে বললো,”চোখের পানে চাহিনু অনিমেষ, বাজিলো বুকে সুখের মতো ব্যথা।”
[শেষ পংক্তিটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা থেকে ধার করা।]
(চলবে……)