নন্দিনী_শুধু_আমার পর্ব: ৮ (অন্তিম পর্ব):

0
435

#নন্দিনী_শুধু_আমার

পর্ব: ৮ (অন্তিম পর্ব):

মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে রাজীব শাহ আর মোতালিব খান। রাজীব শাহ চোখ লাল করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মোতালিব খানের দৃষ্টি নির্লিপ্ত।
“আপনি কি এভাবে পুরোনো প্রতিশোধ নিলে মোতালিব খান?”
“কিসের প্রতিশোধ?”
“কেনো সব ভুলে গেলেন বুঝি? আপনি তখন বাজারে বড় ব্যবসায়ী। রমরমা ব্যবসা আপনার তখন। বাজারে এক নামে তখন সবাই চিনে মোতালিব খান কে। আমি সবে নতুন ব্যবসায়ী। হঠাৎ করে সবগুলো ডিল আমি পাওয়া শুরু করলাম। আপনার ব্যবসার অর্ধেকের বেশি চলে আসে আমার হাতে। খুব বেশিদিন সময় লাগেনি আমার আপনার সমকক্ষ হতে।”
মোতালিব খান মুচকি হেসে বললো,”এজন্য আপনি ভেবেছেন আমি সেই শোধ তুলতেই আজ বিয়ে বাড়ি সময় মতো আসিনি?”
রাজীব শাহ চুপ করে থাকে। এখনো শরীর কাঁপছে তার।
“একটু অপেক্ষা করুন শাহ সাহেব। আমি আসছি এক্ষুনি।”
রাজীব শাহ আর ফিরোজ দাঁড়িয়ে থাকে চুপ করে।
মোতালিব খান একটা গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে বললো,”নির্ঝর বের হয়ে এসো। সাবধানে আসবে।”
রাজীব শাহ সহ নন্দিনীর বাড়ির সকলে অবাক হয়ে দেখে গাড়ি থেকে নামছে নির্ঝর। সেই সুদর্শন মুখটা, সেই বুদ্ধিদীপ্ত চোখজোড়া কিন্তু এ কি? কপাল, হাত সব ব্যান্ডেজ করা কেনো? কি হয়েছে নতুন জামাইয়ের?
নির্ঝর গাড়ি থেকে বের হতেই মোতালিব খান তাকে ধরতে যায়। নির্ঝর হালকা হেসে বললো,”আমি পারবো বাবা।”
রাজীব শাহ আর ফিরোজ দৌড়ে আসে নির্ঝরের কাছে। তাদের চোখেমুখে আতঙ্ক।
“কি হলো তোমার? এই অবস্থা কেনো? কি হয়েছিলো?”
হাজেরা বেগমও ততক্ষণে এসে ছেলের পাশে দাঁড়িয়েছে, কার কপালেও ব্যান্ডেজ।
ফিরোজ হতবিহ্বল হয়ে বললো,”এ কি খালাম্মা? আপনারও এই অবস্থা? আপনারা এই অবস্থায় এখানে কেনো? আপনাদের তো হাসপাতালে থাকা উচিত।”

নন্দিনী পায়চারি করছে ঘরজুড়ে। উত্তেজনায় তার সারা শরীর কাঁপছে। এই ঠান্ডার মধ্যেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে তার। বারবার উঁকি দিচ্ছে বাইরে। তার ভাবী আসার কথা খবর নিয়ে। এখনো কেনো আসছে না? নন্দিনীকে আবার সাজতে বলে সেই যে নিশিতা বাইরে গেলো, এখনো আসেনি। নন্দিনীর এখন একটুও সাজতে ইচ্ছা করছে না। শুধু বারবার মনে হচ্ছে মানুষটার কোনো বিপদ আপদ হলো না তো?

“কেউ কি দয়া করে বলবে কি হয়েছিলো আসলে?”
রাজীব শাহের চিৎকার শুনে নির্ঝর তার দিকে তাকিয়ে নির্লিপ্ত গলায় বললো,”আজ হয়তো অনেক খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারতো চাচাজান। আমি হয়তো এখানে না-ও থাকতে পারতাম। ভাগ্য ভালো ছিলো বলেই আজ আমরা আপনাদের সামনে।”
রাজীব শাহ আঁৎকে উঠে বললো,”তার মানে? কি বলছো বাবা এসব?”
“জ্বি চাচাজান। আমরা একটু দেরি করেই রওনা দিয়েছিলাম বাড়ি থেকে। বেশ কিছু কারণে দেরি হয়ে যায় আমাদের।”
এই বলে নির্ঝর বাবার দিকে আড় চোখে তাকায়। মোতালিব খান চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে একপাশে।
“তারপর?”
“আমাদের তাড়াহুড়ো ছিলো শীঘ্রই পৌঁছানোর। আমি যে গাড়িতে ছিলাম, আমার মা ও সেই গাড়িতেই ছিলো। সাথে আমার দুইজন বন্ধু ছিলো। আমি ড্রাইভারকে বলি একটু তাড়াতাড়ি চালাতে। পিছনের গাড়ির থেকে আমরা বেশ কিছুটা সামনে এগিয়ে যাই। তখনই আচমকা আমাদের সামনে একটা ট্রাক এসে পড়ে। এরপর হঠাৎ করেই আমাদের গাড়িতে ব্রেক কষতে না পেরে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় ট্রাকের সাথে। আমার সামনে পুরো পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যায়। এরপর আমার আর কিছুই মনে নেই।”
মোতালিব খান এসে নির্ঝরের পিঠে হাত রাখে।
“ভাগ্যটা হয়তো আসলেই ভালো ছিলো আমাদের। কারণ যেভাবে দুর্ঘটনাটা ঘটেছে জানিনা এতোক্ষণে কি হতো। কিন্তু সংঘর্ষের পরেই গাড়িটা পাশের একটা খোলা মাঠে ছিটকে যায়, আর সাথে সাথেই ওরা আহত হয়।”
রাজীব শাহ আর্তনাদ করে ওঠে। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে তার।
“এসব কি বলছেন খান সাহেব?”
নির্ঝর মুচকি হেসে বললো,”যেভাবে দুর্ঘটনাটা রূপ নিয়েছিলো, আমাদের কারোই এখানে বেঁচে ফেরার কথা না। সৃষ্টিকর্তা আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছেন।”
রাজীব শাহ মাথা ঘুরে পড়ে যেতে গেলেই ফিরোজ তাকে চেপে ধরে শক্ত করে।
মোতালিব খান রাজীব শাহের দিকে তাকিয়ে বললো,”নিজেকে শক্ত করুন শাহ সাহেব। এই পরিস্থিতিতে আমাদের মনোবলই আমাদের সাহস দিয়েছে।”
ফিরোজ তার দিকে তাকিয়ে বললো,”আমরা অনেকবার আপনাদের ফোনে চেষ্টা করেছি। আমাদের জানালে আমরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে যেতাম। কিছু অন্তত উপকার হতো আপনাদের।”
“আমি জানি বাবা, আমাদেরই তোমাদের জানিয়ে দেওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু কিছু কি করার ছিলো আমাদের? ওদেত ফোনগুলো ওখানেই ডেড হয়ে যায়। আর ভিড়ের মধ্যে আমার ফোনটাও কখন যে চুরি হয়ে যায় কিংবা আমি হারিয়ে ফেলি নিজেই বুঝতে পারিনি।”
ফিরোজ চোখ বড় বড় করে বললো,”কি বলছেন চাচাজান?”
“আমি অনেকবার বলেছিলাম, এমনকি ডাক্তাররাও নিষেধ করেছে রোগীকে এই অবস্থায় হাসপাতাল না ছাড়তে। কিন্তু নির্ঝর নাছোড়বান্দা। ও জ্ঞান ফেরার পর থেকে বলে চলেছে, নন্দিনী তার জন্য অপেক্ষা করে আছে। যেভাবে হোক রাতের মধ্যে তাকে এখানে পৌঁছাতেই হবে। ছেলের জিদের কাছে হার মেনে আমাদের এই অবস্থাতেই ফিরতে হলো।”
হাজেরা বেগম এতোক্ষণ চুপ করে ছিলো। তার শরীরের অবস্থা অতোটা খারাপ না হলেও খুব বেশি ভালো না।
“দেখুন ভাই সাহেব, সত্যি কথা বলতে আমার ছেলেটা এক টুকরো খাঁটি সোনা। মিথ্যা বলবো না, আমার ছেলেটা তার আগের স্ত্রী শিরিনকে খুব বেশি ভালোবাসতো। আমি জানি, এই কথা এখানে বলাটা মানানসই নয়। কিন্তু এটা বলতে আমাকে বাধ্য হতেই হলো, শিরিন ওকে ঠকিয়ে চলে যাওয়ার পর ও একদমই ভেঙে পড়েছিলো। আমার সেই আগের নির্ঝরকে আমি খুঁজে পাইনি বহুদিন। অনেকগুলো বছর পর আমার সেই ছেলেটাকে আমি আবার ফিরে পেয়েছিলাম নন্দিনীর জন্য শুধু। যেদিন নন্দিনী পালিয়ে চলে গেলো, আমরা ভেবেছিলাম আমরা হয়তো আর কোনোদিনও আমাদের ছেলেটাকে সুখী দেখে যেতে পারবো না। মেয়েদের উপর থেকে পুরোপুরি হয়তো বিশ্বাস চলে যাবে ওর। কিন্তু আমরা সেদিন অবাক হয়েছিলাম যেদিন ও আমাদের এসে জানালো, বিয়ে করলে ও নন্দিনীকেই করতে চায়। আমি রাজি হলেও ওর বাবা রাজি হতে চায়নি। ছেলেই তার বাবাকে রাজি করিয়েছে। সেদিনের পর থেকে যেনো আমি আবার আমার সেই ছেলেটাকে খুঁজে পেয়েছি। তাই ও যখন জোর করলো আমি আর ওকে বাঁধা দিইনি। আর ছেলের বিয়েতে মা থাকবে না তাতো হয়না। আমার ছেলেটার সেই হাসিমুখ আমি আবার দেখতে পারবো, এই লোভ আমি সামলাতে পারিনি।”
হাজেরা বেগম থামে, তার চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে।
মর্জিনা বেগম পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো বেশ কিছুক্ষণ। এ বাড়িতে পুরুষ মানুষদের উপরে মেয়েদের কথা বলা নিষেধ। এতোক্ষণে সে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলো অন্ধকারের সাথে মিশে। কি মনে করে হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়ায় সে। স্বামীর দিকে একবার তাকিয়ে হাজেরা বেগমের হাত ধরে বললো,”আপনি আসুন আপা, আমার সাথে আসুন। আপনার বিশ্রাম দরকার।”
হাজেরা বেগম মিষ্টি করে হেসে বললো,”আগে ওদের চার হাত এক করে দিই আমরা। এরপর অনেক বিশ্রাম নেওয়া যাবে।”
রাজীব শাহ অবাক হয়ে হাজেরা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো,”চার হাত এক মানে?”
হাজেরা বেগম হেসে বললো,”মানে আবার কি ভাইজান? আজ রাতেই নির্ঝর আর নন্দিনীর বিয়ে হবে। আপনারা যোগাড় শুরু করুন।”
মর্জিনা বেগম হতবাক হয়ে বললো,”আজ রাতেই?”

অনেকক্ষণ ধরে নিশিতা না ফেরায় ভয়ে আধমরা হয়ে যায় নন্দিনী। ঘর থেকে বের হতে ইচ্ছা করছে না তার একদম। কারণ বাইরে এখনো বেশ কিছু অতিথি বসে আছে, সেই সাথে ওর ফুপু আলেয়াও বসে আছে। ওকে দেখলেই টিটকারি মেরে কিছু বলতে আসবে। এখন এসব কিছুই শুনতে ইচ্ছা করছে না নন্দিনীর।
হঠাৎ মনে পড়লো তার দোতলার জানালাটা দিয়ে তাদের বাড়ির সামনের লনটা খুব ভালো দেখা যায়। ইশ! এই বুদ্ধিটা এতোক্ষণে কেনো আসেনি তার?
নন্দিনী তড়িঘড়ি করে দক্ষিণের জানালাটা খুলে দেয়। ঝড় থেমে যেয়ে দারুণ সুন্দর একটা চাঁদ উঠেছে। জানালাটা খুলতেই জংলা বুনোফুলের গন্ধ নাকে লাগে। আশ্চর্য, এই গন্ধটাও আজ এতো সুন্দর লাগছে কেনো?
নন্দিনী পূর্ণ দৃষ্টি মেলে লনের দিকে তাকায়। তাকাতেই হতভম্ব হয়ে যায় সে। চাঁদের আলোয় একজন অতি সুদর্শন যুবককে দেখা যাচ্ছে। শ্বেতশুভ্র পাঞ্জাবিতে তাকে মনে হচ্ছে বুঝি রাজপুত্র। কিন্তু এ কি? উনার সারা শরীরে ব্যান্ডেজ কেনো? কি হয়েছে উনার? শরীরটা থরথর করে কেঁপে ওঠে ওর।

দরজা খোলার শব্দ শুনে চমকে উঠে তাকায় নন্দিনী। তাকাতেই নিশিতাকে দেখে ছুটে আসে সে।
“ভাবী আপনি কোথায় ছিলেন এতোক্ষণ? কি হয়েছে উনার? চুপ করে আছেন কেনো ভাবী? উনার সারা শরীরে ব্যান্ডেজ কেনো?”
নিশিতা গোল গোল চোখে নন্দিনীর দিকে তাকায়।
“কি হলো ভাবী? আপনি কি আমাকে কিছু বলবেন না?”
নিশিতাকে চুপ করে থাকতে দেখে নন্দিনী অধৈর্য্য হয়ে যায়। তাকে ছেড়ে দরজার দিকে যেতেই নিশিতা খপ করে তার হাত চেপে ধরে।
“আরে আরে যাচ্ছো কোথায়? এখন যে তোমাকে বউ সাজতে হবে। আর যে বেশিক্ষণ উনি সহ্য করতে পারছেন না।”
নন্দিনী অবাক হয়ে বললো,”সহ্য করতে পারছে না মানে? উনার শরীর কি খুব বেশি খারাপ?”
নিশিতা মুখ টিপে হাসে। তাকে হাসতে দেখে নন্দিনী আরো হতবাক হয়ে যায়।
“আপনি হাসছেন ভাবী?”
“এখন একটু চুপ করে বসো দেখি। তোমাকে আবারও সাজিয়ে দিই। এখন একেবারে পরীর মতো সাজাবো তোমাকে।”
নন্দিনী অসহিষ্ণু হয়ে বললো,”আগে আমাকে সব খুলে বলুন। নাহলে কোনো সাজগোজ হবে না। উনারা আসতে দেরি করলেন কেনো? আর উনার কি হয়েছে?”
নিশিতা হালকা হেসে নন্দিনীর মুখে হাত রেখে বললো,”তোমার ভালোবাসার টানে উনি আবার ফিরে এসেছেন নন্দিনী। আর কিছু শুনতে চেয়ো না। অনেক বড় একটা বিপদ থেকে সৃষ্টিকর্তা আজ উনাকে বাঁচিয়েছেন।”
হতভম্ব নন্দিনীকে নিশিতা আবার সাজাতে বসে যায়।

ঠিক রাত এগারোটা দশে নন্দিনী আর নির্ঝরের বিয়ে হয়ে যায়। কেমন যেনো ঘোরের মধ্যে চলে গেছে নন্দিনী। মনে হচ্ছে সে একটা স্বপ্ন দেখছে। খুব তাড়াতাড়িই বুঝি স্বপ্নটা ভেঙে যাবে। কিন্তু সে চায়না এই সুন্দর স্বপ্নটা তার ভেঙে যাক। এই স্বপ্ন সে আজীবন দেখে যেতে যায়।
বাঁকা চোখে নন্দিনী নির্ঝরের দিকে তাকায়। ভেঙে পড়া বরের বসার জায়গাটাতেও হাসিমুখে বসে আছে নির্ঝর। একটাবারও যেনো নন্দিনীর দিকে তাকাচ্ছে না সে। আচ্ছা এই মানুষটা এতো সুদর্শন কেনো? তার তো ইচ্ছা করছে সারাজীবন এই মানুষটার দিকে তাকিয়েই কাটিয়ে দিতে পারবে।
নিশিতার ধাক্কায় ঘোর কিছুটা কাটে নন্দিনীর। থতমত খেয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয় সে।
নিশিতা ফিসফিস করে নন্দিনীর কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বললো,”সবাই দেখছে তো ননদিনী। এবার তো একটু চোখ নামাও। তোমার মানুষকে কেউ তোমার কাছ থেকে নিচ্ছে না। তোমার মানুষ তোমারই থাকবে। আজ সারারাত মন ভরে তাকে দেখো। অবশ্য দেখার সময়ে পেলে তো……”
নন্দিনীর লাল হয়ে নিশিতার দিকে তাকায়। নিশিতা কথা শেষ করতে পারে না।
“ভাবী কি হচ্ছে? থামুন না।”
নিশিতা হাসতে হাসতে উঠে চলে যায় সেখান থেকে। নির্ঝরের দিকে তাকাতে যেয়েও তাকায় না। ভাবীর কথাগুলো শুনে লজ্জায় চোখ তুলে তাকাতেই পারছে না সে। তাকালে হয়তো দেখতে পারতো, এক জোড়া মুগ্ধ দৃষ্টি তার দিকে তাকিয়ে আছে নিষ্পলক। নন্দিনী কি সত্যিই বুঝতে পারেনি? হয়তো পেরেছে, তাদের কথা তাদের মধ্যেই নাহয় জমা থাকুক।

যদিও বাসর হওয়ার কথা ছিলো নির্ঝরদের বাড়িতেই। কথা ছিলো বিয়ের পর নির্ঝরের পরিবার নন্দিনীকে নিয়ে রাতেই ফিরে যাবে। কিন্তু রাত অনেক বেশি হওয়ায় সবাই সিদ্ধান্ত নিলো, আজ রাতটা নির্ঝর সহ বাকি সবাই শাহ বাড়িতেই থেকে যাবে। তাই নির্ঝর-নন্দিনীর বাসরও হবে এ বাড়িতেই।
তাড়াতাড়ি করে নিশিতা বাগান থেকে বেশ কিছু ফুল ছিঁড়ে আনাড়ি হাতে সাজিয়ে ফেলেছে ঘরটা। শীতের সময় হাজারও রকম জানা অজানা অনেক ফুলের ছড়াছড়ি বাগানে। মনমতো সাজিয়েছে নিশিতা যথাসম্ভব।
এই ঘর দেখে মুগ্ধ হয়ে যায় ফিরোজ। হতবাক হয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললো,”অপূর্ব সাজিয়েছো নিশিতা।”
নিশিতা উত্তর দেয়না। ফুলের গন্ধে ম ম করছে ঘরটা।
“তুমি আমার বোনটার জন্য যা করেছো সেই ঋণ আমি কোনোদিন শোধ করতে পারবো না নিশিতা। তবুও বলো তোমার কি চাওয়ায় আছে আমার কাছে? আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করবো পূরণ করার।”
নিশিটা ঈষৎ হাসে। তার হাসিটা কেমন বিষাদে মাখা।
“এরকম একটা ফুলের গন্ধে মাখামাখি হয়ে যাওয়া ঘর তো আমিও পেতে পারতাম আমাদের প্রথম রাতে। সেই রাত আর ফিরে আসবে না গো। শুধু শুধু আর আমার চাহিদা শুনে কি করবে তুমি?”
ফিরোজ অপরাধী মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। আসলেই সে নিশিতার অনেক শখ পূরণ করতে পারেনি। এজন্য সে নিজের কাছে ছোট হয়ে থাকে সবসময়।
“নিশিতা একটা কথা বলবো?”
নিশিতা তাকায় ফিরোজের দিকে।
“আমাকে কি ক্ষমা করে দেওয়া যায়না?”
“তোমাকে ক্ষমা না করলে তোমার সাথে এতোগুলো দিন সংসার করতাম না।”
“তাহলে কি আমাকে প্রায়শ্চিত্তের একটা সুযোগ দিতে পারবে?”
নিশিতা ভ্রু কুঁচকে তাকায় ফিরোজের দিকে।
“প্রায়শ্চিত্তের সুযোগ মানে?”
“শুনেছি নির্ঝর আর নন্দিনী নাকি কিছুদিন পরেই একান্তে সময় কাটানোর জন্য কোথাও ঘুরতে যাবে।”
নিশিতা কিছুটা অবাক হয়ে তাকায় ফিরোজের দিকে। ফিরোজের কথা কোনদিকে মোড় নিচ্ছে সে জানেনা।
ফিরোজ হঠাৎ নিশিতা হাত দু’টো চেপে ধরে বললো,”আমরা কি নিজেদের একান্তে সময় দিয়েছি এখনো? বাস্তবতা আর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার সময় দিতে যেয়েই কখন যে তোমার সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে গেলো বুঝতেই পারলাম না। আমাদের খুব বেশি দরকার এখন নিজেদের কিছুটা সময় দেওয়ার, একদম একান্তে।”
নিশিতা অবাক হয়ে যায়। ফিরোজ এই প্রথম শুধুমাত্র নিশিতার কথা চিন্তা করছে।
“তোমার বাবার অনুমতি নিয়ে বলছো তুমি এই কথা?”
ফিরোজ ম্লান হেসে বললো,”তখন বেকার ছিলাম, বাবার উপর কথা বলাফ সাহস ছিলো না। কিন্তু এখন আমি নিজে উপার্জন করি। আমি আমার স্ত্রীর সাথে নিজস্ব সময় কাটাতে চাই। এখানে আর কারো অনুমতি আমার প্রয়োজন নেই নিশিতা।”
নিশিতার বুকটা কেমন কেঁপে ওঠে। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে যেনো সে। আজ নতুন করে কি এই মানুষটার প্রেমে পড়ে যাচ্ছে সে? আসলেই কি তেতো হয়ে যাওয়া সম্পর্কটাকে পুনরায় মিষ্টি ভালোবাসায় রূপান্তরিত করতে একটু সময় প্রয়োজন? নিশিতার দুই চোখ পানিতে ভরে ওঠে। ফিরোজ আলতো করে মুছে দেয় গাল বেয়ে আসা পানির ফোঁটা গুলো। মানুষটার ছোঁয়াও আজ একদম নতুন লাগছে নিশিতার কাছে।

জানালার বাইরে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নন্দিনী। জ্যোৎস্না থইথই করছে বাইরে। কি অপরূপ মনোরম লাগছে সবকিছু। এভাবেও কি ভালোবেসে ফেলা যায় কাউকে? মীরনের কথাটা হঠাৎ মাথায় আসে তার। জোর করে মাথা থেকে সরিয়ে দিতে চায় সে। মীরন ছিলো তার সাত বছরের ভুল, একটা কালো অধ্যায়। আজ তার জীবনের নতুন দিন শুরু হলো, নতুন জীবন পেলো সে আজ থেকে। আজ কিছুই মনে রাখবে না সে, কিছুই না।
পিছন থেকে একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে নির্ঝর। বোঝাই যাচ্ছে সাজগোজের একদমই সময় পায়নি। মুখে কোনো চড়া সাজের আবরণ নেই। শুধু চোখজোড়ার নিচে কাজল নামক একটি কালো রেখার বিচরণ। আচ্ছা কাজল জিনিসটা এতো অদ্ভুত কেনো? কালো একটা রঙ, কি এমন ক্ষমতা আছে ওর? যে কোনো মেয়েকেই রূপবতী করে তোলে?

“নন্দিনী।”
ভরাট কণ্ঠ শুনে একটু কেঁপে ওঠে নন্দিনী। মুখ না ফিরিয়েই বললো,”বলুন।”
“এদিকে তাকাও, ওদিকে কি দেখছো?”
নন্দিনী নিচু গলায় বললো,”জানিনা।”
নির্ঝর ঈষৎ হাসে। আস্তে আস্তে উঠে যেয়ে নন্দিনীর পাশে দাঁড়ায়।
বাইরের জ্যোৎস্নার দিকে তাকিয়ে মনটা আরো ভালো হয়ে যায় নির্ঝরের। কি দারুণ পরিবেশ।
“মানলাম চাঁদটা আমার চেয়েও অনেক বেশি সুন্দর। তাই বলে কি আজ মহারানীর ভাগ শুধু চাঁদই পাবে?”
নন্দিনী হাসবে না হাসবে না করেও হেসে দেয়। কে বলবে, এই গম্ভীর মানুষটা ভিতর ভিতর এতো রসিক?
নির্ঝর মুগ্ধ হয়ে প্রেয়সীর হাসি দেখে। জ্যোৎস্নাও আজ ফিকে হয়ে আসছে যেনো তার প্রিয়তমার রূপের কাছে।

“জানো নন্দিনী? চোখটা যখন অন্ধকার হয়ে আসছিলো, তখন চোখের সামনে বারবার একটা মানুষের মুখটাই ভেসে আসছিলো।”
নন্দিনী পাংশু মুখে বললো,”কার মুখ?”
নির্ঝর উত্তর দেয়না। শুকনো মুখে হেসে বললো,”আজ যদি ফিরে না আসতাম?”
নন্দিনী ঝট করে তাকায় নির্ঝরের দিকে। নির্ঝর নির্লিপ্ত মুখে তাকিয়ে আছে।
“হতেও তো পারতো বলো? চলে যেতাম, আর কখনো দেখা হতো না আমাদের।”
আচমকা ডুকরে কেঁদে ওঠে নন্দিনী। প্রথমে আস্তে, এরপর বেশ শব্দ করে। হতভম্ব হয়ে যায় নির্ঝর।
“আরে আরে করছো কি? সবাই শুনতে পাবে তো। এরপর বলবে তাদের মেয়েকে আমি বাসর রাতেই কাঁদাচ্ছি।”
নন্দিনী থামে না, কাঁদতেই থাকে।
“আচ্ছা কাঁদছো কেনো বলবে তো? কি বললাম?”
নন্দিনী কাঁদতে কাঁদতেই বললো,”কি বলেছেন এখন বুঝতে পারছেন না তাইনা? কেনো চলে যাবেন আপনি আমাকে রেখে? কেনো দেখা হবে না আমাদের? কেনো এই কথাগুলো বলতে হলো এখন আপনাকে?”
নির্ঝর নেশাক্ত চোখে নন্দিনীর দিকে তাকিয়ে বললো,”তুমি কি আমাকে খুব বেশি ভালোবেসে ফেলেছো নন্দিনী?”
নন্দিনী কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। তড়িঘড়ি করে চোখের পানি মুছে ফেলে।
“কি হলো, বললে না যে?”
নন্দিনী গাঢ় গলায় বললো,”জানিনা।”
নির্ঝর ঠোঁট কামড়ে হাসে। নন্দিনী লজ্জায় লাল হয়ে যায়।
“নির্ঝর সাহেব, আপনি বিশ্রাম করুন। আপনার শরীর ভালো না।”
নির্ঝর হঠাৎ করে নন্দিনীর হাত চেপে ধরে বললো,”এই রাতেও বিশ্রাম করতে হবে?”
নন্দিনী চোখ বড় করে তাকায় নির্ঝরের দিকে। তার ইশারা বুঝতে একটুও দেরি হলো না।
“নির্ঝর সাহেব।”
শীতের ফুলের গন্ধে মাদকতার পূর্বাভাস জানান দিচ্ছে বারবার। নির্ঝর ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে আছে নন্দিনীর দিকে। ঘরের মধ্যকার হালকা নীল আলোয় মনে হচ্ছে তার সামনে কোনো পরী দাঁড়িয়ে আছে। ডানা লাগালেই বুঝি উড়ে যাবে।
নন্দিনী নিজেও হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশই। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা বড্ড মুশকিল। হঠাৎ কোথায় একটা রাত জাগা পাখি তারস্বরে ডাকতে ডাকতে উড়ে যায়।

(সমাপ্ত)

[কিছু কথা: এখানেই শেষ হলো আমার আরো একটি ছোট ধারাবাহিক। এই পর্ব দিতে বড্ড বেশি দেরি করে ফেলেছি আমি, এটা জানি। আসলে আমরা কিছুদিন খুব ঝামেলার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। তিনদিন আগেই আমার husband এর ফোন ছিন’তাই হয় চলন্ত বাস থেকে। এরপর আরো কিছু ঝামেলা ছিলো আমাদের। আমার পরীক্ষাও চলছে এর মধ্যে। সবকিছু মিলিয়ে পাগল দশা। চাইলেই আসলে যা কিছু লিখে ফেলতে পারিনা। পুরোপুরি ভাবে মন না দিলে ভালো কিছু আসে না। যাই হোক, চেষ্টা করেছি মন শান্ত রাখার।

‘নন্দিনী শুধু আমার’ এটা নন্দিনী আর নির্ঝর সিরিজের প্রথম গল্প। আপনারা চাইলে এই সিরিজের অন্য গল্প আসবে ইনশাআল্লাহ। তবে এই গল্পের প্লট নিয়ে কিছু কথা আছে। এই গল্পের প্লটটা আমি লিখেছিলাম আমি যখন নবম শ্রেণিতে পড়ি। গল্পের নাম ছিলো ‘ আজ অনন্যার বিয়ে’। সেখানে মেইন চরিত্রে ছিলো অনন্যা আর হৃদয়। ওটাই ছিলো আমার লেখা প্রথম বড় গল্প। তো আমার এক বান্ধবী আমাকে বলে, যে ওর এক মামা আছে, বই পাবলিশ করে। গল্পটা যেনো ওকে দিই, ওর মামা নাকি ফ্রি তেই বই ছাপিয়ে দিবে। তখন আসলে এতো কিছু বুঝতাম না। ভাবলাম ভালোই তো, দিয়ে দিই। অনেক পরে বুঝেছিলাম, আমার ওই বান্ধবী আসলে আমাকে মিথ্যা বলেছিলো। মিথ্যার কারণ এখনো আমি জানিনা। যাই হোক, আজ অনন্যার বিয়ে গল্পের প্লটেরই কিছুটা extended version ছিলো ‘নন্দিনী শুধু আমার’। আপনারা চাইলে ওদের নিয়ে নতুন গল্প আসবে। তবে এখন না, পরে। সবাই ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন। আমাদের জন্য দোয়া করবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here