প্রমত্ত_অঙ্গনা #লেখিকা_আরোহী_নুর ৩৪,৩৫

0
383

#প্রমত্ত_অঙ্গনা
#লেখিকা_আরোহী_নুর
৩৪,৩৫

″আমার তো প্রথম থেকেই আদ্রিশকে পছন্দ ছিল না।″

″বাবা আমরা কি পারি না আঁখিকে আবারও একটা সুযোগ দিতে?″

আহিলের কথার উত্তরে আশরাফ খান কিছুই বললেন না,শুধু নিরবতাই পালন করে গেলেন।

আদৃত হাওয়ার বেগে গাড়ি টানল আদ্রিশের খোঁজে,যেহেতু দুপুর গড়িয়ে গেছে সেহেতু আদ্রিশ তার কাজের স্থানেই থাকবে বাড়িতে থাকার কথা নয়,সে হিসেবে সেদিকেই পথ ধরল আদৃত,পৌঁছে গেল সেখানে অবশেষে।

আদ্রিশ চেয়ারে মাথা হেলিয়ে দিয়ে বসে আছে চোখ বুজে,তিক্ত সকল ভাবনার চাপে মাথাটা বুঝি এখনই ফাটবে,চোখের সামনে যেন ধরা পরছে জীবনে করে যাওয়া সকল ভুল,বুঝে উঠতে সক্ষম হচ্ছে ভালোবাসার উপর মোহ এর অবস্থান করিয়ে কতো বড় ক্ষতি করে গেছে সে নিজের,চাইলেও সে এবার আঁখিকে ফিরাতে পারবে না,এদিকে রিদিকাকে পাশে রাখার চিন্তা যেন এখন দূর দূর অব্দি নেই,আজ বুঝতে পারছে কাছের মানুষের কাছ থেকে ধোঁকা মেনে নেওয়া কতটা যন্ত্রণার।ঠিক তখনই আদৃত এসেই আদ্রিশের কলার চেঁপে ধরে দার করিয়ে প্রবল এক ঘুষিতে তাকে ফ্লোরে ফেলে দিলো,আদ্রিশ তার জবাবে নিজেও আদৃতের উপর ঝাপিয়ে পরল,দু’জনেরই মধ্যে লেগে গেল লড়াই,কেউ কেউ থেকে কম যাচ্ছে না,আদৃত আদ্রিশের উপর বেশ ভারী পরছে তবে,যেহেতু সে আদ্রিশের তুলনায় বেশি দক্ষ ও বলিষ্ঠও।আদৃত আদ্রিশকে মারতে থেকে বলল।

″তোকে আমি ছাড়ব না আদ্রিশ,তুই আমার কাছ থেকে আমার আঁখিকে কেড়ে নিয়েছিস,আমার ছয় টা বছর অন্ধকারে ভরে দিয়েছিস।″

″আমি আঁখিকে কেড়ে নেই নি,ও আমার ছিল,তোর আসার অনেক বছর আগ থেকেই ওর সাথে আমার পরিচয় ছিল,ওকে ভালোবাসি আমি সেই ছোটবেলা থেকেই কিন্তু মধ্যখানে এসে তুই আমার জায়গা নিতে চেয়েছিলি, আমার আঁখিকে কেড়ে নিতে চেয়েছিলি কিন্তু আমি তা হতে দেই নি,আমার আঁখিকে আমার কাছে ধরে রেখতে যা করতে হয়েছে সব করেছি আমি,কারণ ও শুধুই আমার।″

আদ্রিশের তিক্ত বাণী শুনে আদৃতের রাগের পরিমাণ যেন সীমা পেড়িয়ে গেল,আদ্রিশের উপর দ্বিগুণ হারে ভারী পরল সে।এবার আর আদ্রিশ আদৃতের জবাবে তাকে যথেষ্ট টক্কর দিয়ে উঠতে পারছে না,অতিরিক্ত মারে আদ্রিশকে বেশ দমিয়ে নিয়েছে আদৃত,মা*র*তে মা*র*তে অনেকটা দূর্বল করে ফেলেছে তাকে তাও মা*র*ছে,সময়ের সাথে আদৃতের রাগ যেন বাড়ছেই,যতই মারছে ততই মা*র*তে মন চাইছে,একমাত্র আদ্রিশের প্রানহীন নিস্তব্ধ শরীর যেন তাকে শান্ত করতে পারবে, সেই ভাবনায় আদ্রিশকে মে*রে প্রায় অচেতন অবস্থায় ফ্লোরে ফেলে পাশের চেয়ার তুলে তার উপর দিয়ে মারবে তখনি আঁখি এসে চেয়ারটা পাকড়াও করে।

″কি করছেন ডা.আদৃত?পাগল হলেন আপনি?ওকে মারলে আপনার কি হবে ভেবেছেন?″

″না ভাবি নি আমি আর ভাববোও না,ওর সাহস হয় কী করে তোমাকে নিজের বলে দাবী করার,তুমি আমার ছিলে আমার আছো আর আমারই থাকবে,ওকে আমি প্রাণে মেরে ফেলব।″

″তুই এখনও দাবী করিস আদৃত ও তোর!দেখ ও যদি আমায় আজও ভালোই না বাসত তবে আমাকে কেন বাঁচাত তোর হাত থেকে?মানে বুঝতে পারছিস ও আমাকে এখনও ভালোবাসে,ও আমার।″

আদৃত আবারও আদ্রিশের দিকে তেড়ে আসতে নিলে তার আগে আঁখি আদৃতকে আটকিয়ে বলে।

″দাঁড়ান ডা.আদৃত ওকে জবাবটা আমিই দেই।ছিঃআদ্রিশ,তুমি সত্যিই একটা নিচ,কী দেখে যে তোমাকে জীবনে জায়গা দিতে গেলাম,তোমার জন্য এতো করলাম।তুমি কী মনে করো আমি তোমাকে এখনও ভালোবাসি তাই বাঁচিয়েছি?না আদ্রিশ,বরং আমি চাই নি ডা.আদৃত তোমার মতো নোং*রা*কে মেরে নিজের হাত নোং*রা করুক,কারণ উনি তোমার মতো সস্তা না।আমি চাই না তোমাকে মারার দরুন উনার ভবিষ্যত নষ্ট হোক,সবটাই উনার কথা ভেবে করেছি,যেখানে দূর দূর অব্দি তোমার কোনো ছোঁয়া নেই।চলুন ডা.আদৃত এর মুখ দেখতেও ইচ্ছে করে না এখন আমার।″

″এতটা বাজে হয়ে গেলাম আমি তোমার কাছে?″

″বাজে কে তো সবাই বাজে নজরেই দেখবে তাই না?চলুন ডা.আদৃত। ″

″না আঁখি আমি একে না মেরে শান্তি পাবো না,ওকে তো আমি…″
আদৃত আবারও এগিয়ে গেলে আঁখি তাকে আরও একবার বাঁধা দেয়।তার গালে হাত রেখে শান্ত স্বরে বলে।

ও এতো কিছু করার পরও আমাকে হারিয়ে গেছে ডা.আদৃত,এতো চেয়েও আমাদের আলাদা করতে পারে নি,নিয়তি ঠিকই আমাদের মিলিয়ে দিয়েছে এতেই ওর হার,ওকে ছেড়ে দিন ওর অবস্থায় চলুন আমার সাথে আপনি।″

আঁখির অল্প শান্ত ছোঁয়া মুহুর্তেই আদৃতের সকল রাগ যেন পানি করে দিল,তবে গা জ্ব*লে উঠল আদ্রিশের।

″আঁখি,তুমি ভুলে যেও না তুমি শুধুই আমার,ওই আদৃতকে ছোঁয়ার ভুল করো না,ভালো হবে না।″

″নিজের অবস্থা দেখো আগে,উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতাও জুটিতে উঠতে পারছ না,এদিকে হুমকি দেও আমায়।চলুন ডা.আদৃত। ″

আঁখি আদৃতের হাত ধরে নিয়ে যেতে শুরু করে,আদ্রিশ অসহায়ের মতো আঁখির আদৃতের ধরে থাকা হাতের দিকে তাকিয়ে থাকে।
______________

আজ কুলি করতে যেয়ে রিদিকার দাঁতের ভিতরের দিক থেকে দুটি আক্কেল দাঁত উঠে চলে আসল।রিদিকা অস্থির হয়ে পরল,ও ভালোয় বুঝতে পেরে গেছে ওর শরীরে তৃতীয় ডোজ দেওয়া শেষ,এদিকে আদ্রিশও তাকে ভুল বুঝে গেল,এতো বড় হার রিদিকা কেমনে মানবে!রিদিকা তো হার মানবার পাত্র না।রাগে ক্ষোভে রিদিকার নিজেকেই মারতে ইচ্ছে করছে,ঘরের বিভিন্ন জিনিস ছুড়ে ভেঙে দিয়েছে ইতিমধ্যে। এবার চেঁচিয়ে বলছে।

″না রিদিকা হার মানবে না,আদ্রিশ শুধু আমার,আমার হয়েই থাকবে,ও আমার থেকে দূরে যেতে পারে না,আর যদি তা চায় তবে ওরও সেই হাল হবে যা বাকিদের হয়েছে।না আমি এভাবে বসে থাকব না,আমি আমার সৌন্দর্য হারাতে পারি না,এসব ছাড়া আমার আদ্রিশ আমাকে কি করে ভালোবাসবে!

এবার ছুটে গিয়ে রিদিকা আদ্রিশের ছবি হাতে নিল,তারপর সেটার উপর হাত বুলিয়ে পাগলের মতো অঙ্গভঙ্গিতে বলতে লাগল।

″আমি জানি তুমি আমার রুপে মগ্ন হয়ে আমায় পেতে চেয়েছ,ওই আঁখিকে সরিয়ে আমাকে নিয়ে এসেছ তবে আমি কিভাবে তোমায় যেতে দিই,তোমাকে বাঁধতে হলে তো আমার এই রুপের প্রয়োজন,তুমি চিন্তা করো না,আমি ঠিকই তোমার সেই সুন্দরী রিদিকাতে পরিণত হবো আবার,এসব ভাইরাস আমার কিছুই করবে না।আমি বড় ডাক্তার দেখিয়ে আবারও আগের মতো হয়ে যাব,অতঃপর দু’জন আবারও আগের মতো ভালোবেসে থাকব।তোমাকে আমি কোথাও যেতে দিব না।তুমি শুধুই আমার।
______________

আঁখি ফোন করে তার ড্রাইবারকে বলে দিয়েছে গাড়ি এসে নিয়ে যেতে,তারপর সে নিজেই আদৃতের গাড়ি ড্রাইব করতে শুরু করে,আদৃতকে ড্রাইব করতে দেয় না,রাগে এখনও একরকম কাঁপছে সে,আঁখি ড্রাইব করছে আর আদৃত পাশেই বসে আছে,কিছুই বলছে না আদৃত, একটু পর পর ঠোঁট কামড়াচ্ছে,হাত মুঠো করছে,শরীরের কাপড় ঢিলে করছে,আঁখি জানে আদৃত অতিরিক্ত রাগে আত্নহারা হয়ে পরে,বর্তমানে রাগ দমন করতে না পেরে তার উক্ত অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে,আঁখি এবার গাড়ি থামিয়ে দিলো।
তারপর নেমে ওপর দিকে এসে আদৃতের পাশের দরজা খুলল।

″চলুন আমার সাথে।″

অতঃপর আদৃতকে আঁখি একটা খোলা মাঠের মতো জায়গায় নিয়ে গেল,যেখানে বাতাস বইছে বেশ,এবার পানির বোতল খুলে আঁখি আদৃতের সামনে ধরল।

″পান করে নিন,ভালো লাগবে।″

আদৃত বিনা বাক্যে তা হাতে নিয়ে এক চুমুকে পুরো বোতলের পানি পান করে নেয়,অতঃপর ছুড়ে ফেলে বোতলটা,কিছুক্ষণ অল্প নিস্তব্ধতা পালন করার পরও রাগ দমনে ব্যর্থ হয়ে হাটু মুড়ে বসে সজোরে চিৎকার করে উঠে,আঁখি শান্তনা স্বরুপ আদৃতের পাশে বসে তার কাধে হাত রাখলে আদৃত পিছন মুড়েই আঁখিকে জড়িয়ে ধরে বেশ শব্দ করে কেঁদে দেয়,আদৃতকে আঁখি এই প্রথম কাঁদতে দেখল,যাতে চোখ বেয়ে তারও বেড়িয়ে এলো জল।

″কেন আঁখি?কেন আমাদের সাথে এমন হলো?কি দোষ ছিল আমাদের?কেন ওরা আমাদের সাথে এমন করল?তুমি হয়ত কল্পনাও করতে পারবে না আমি এই ছয় টা বছর কতো যন্ত্রণায় পোঁড়েছি,কতটা পীড়া হয়েছে আমার যখন যখন ভেবেছি তুমি আদ্রিশের সাথে আছো,যে আমি তোমার পাশে কোনো ছেলের আনাগোনাও সহ্য করতে পারি না।আমাকে ক্ষমা করে দিও আঁখি,আমি তোমাকে বাঁচাতে পারি নি,রক্ষা করতে পারি নি ওই আদ্রিশের ছলনার হাত থেকে,সেদিন যদি ওদের কথায় কান না দিয়ে ওসব ভুলভালে মন ভাসিয়ে না চলে যেতাম তবে এমনটা কখনও হতো না।আমায় ক্ষমা করে দিও।″

″আপনার কোনো দোষ ছিল না,সবই আমাদের কপালের লিখন ছিল,যা চাইলেও কেউ বদলাতে পারত না কখনও।নিয়তি আবার আমাদের মিলিয়ে দিয়েছ তো,তাই অতীত ভেবে কষ্ট পাওয়ার চেয়ে বর্তমান ভেবে খুশি হওয়াটাই ভালো হবে, তাই না?প্লিজ আপনি কান্না বন্ধ করুন এবার।″

আদৃতকে ছাড়িয়ে তার চোখের জল মুছে দিতে দিতে কথাগুলো বলে গেল আঁখি,আদৃত বিমোহিত দৃষ্টি আঁখির উপর স্থির রেখে বলে গেল।

″তুমি কি আমার অতীতের ওই বিষাদ মুছিয়ে দিবে আঁখি?ভালোবাসবে আমায় আবার ঠিক আগের মতো?আনন্দে ভরিয়ে দিবে আমার জীবন আবারও?বলো না আঁখি,বলো না ভালোবাসতে শিখাবে,আবারও হাসতে শিখাবে,আমাকে নিয়েই মত্ত হবে আবারও?″

আদৃতের কথাগুলো শুনে মুখে মলিনতা বিরাজ করে যায় আঁখির, উঠে দাঁড়ায় সে,নিরাশ ভাব নিয়ে আদ্রিশও উঠে পরে।

″কি হলো আঁখি,কিছু বলছ না যে?″

″কি বলব আমি,অনেক কিছু পাল্টে গেছে ডা.আদৃত,আমি সেই আগের আঁখি নই আপনার,আপনি অবিবাহিত আর আমি এখন ডিভোর্সি,আপনার জীবনে আমি প্রথম নারী হলেও আমার জীবনে আপনি প্রথম ভালোবাসা হয়েও দ্বিতীয় পুরুষের মর্যাদা পাবেন যা আমি কখনই মেনে নিতে পারব না,আমি আপনার যোগ্য না।″

″খবরদার আঁখি যদি কথাটা আবারও বলেছ তো,আমার জীবনে এসব কিছু কখনও মেটার করে না,আর এসব কথা তোমার মুখে মানায়ও না,আমার তুমি হলেই চলবে আর কিছু চাই না।″

″আপনি বুঝতে পারছেন না,সমাজে আপনারও আলাদা নাম ডাক আছে,অবিবাহিত হয়ে ডিভোর্সিকে বিয়ে করলে কি হবে ভাবতেই পারছেন।″

″এসব কথা আমার হিটলার আঁখির কাছ থেকে গ্রহণযোগ্য না,সমাজের কথা ভেবে আমরা নিজেদের জীবন নাশ করে তো পারব না,সমাজের কিছু বাজে লোকদের কথা শোনার ভয়ে বেঁচে থাকা তো ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে না।″

″কিন্তু আপনার পরিবারও কী…″

″হুশ,একদম চুপ আর কোনো কথা না।এতোদিন দাবী খাটাই নি,কিন্তু এখন খাটাব,আমি তোমাকে আর হারাতে পারব না,নয়ত পাগল হয়ে যাব।″

কথাগুলো বলার ছলে পকেট থেকে হিরের আংটি বের করে আঁখির অনামিকা আঙুলে পরিয়ে দিল আদৃত।

″এ কী করলেন আপনি!″

″বেশ করেছি,অনেক আগেই করা উচিৎ ছিল।এই আংটিটা আমি ছয় বছর আগে কিনেছিলাম তোমাকে প্রপোজ করব বলে কিন্তু আমি ব্যর্থ হয়েছিলাম সেদিন,তারপর থেকে কখনও আংটিটা আমি নিজের থেকে দূর করি নি,সবসময় আমার কাছে রাখতাম,এটা আমায় মনে করিয়ে দিত আমি কী হারিয়ে গেছি।″

″এতো ভালোবাসেন আমায়!″

″আমার ভালোবাসার গভীরত্ব খোঁজতে এসো না সুখপাখি নিজেই তলিয়ে যাবে।″

″বড্ড ভয় করছে যে সেপথে আবারও এগিয়ে যেতে।″

″আমি থাকতে ভয় কিসের,বিশ্বাস করে হাতটা ধরো,শেষ নিশ্বাস অব্দি আগলে রাখব।বলো না একবার ভালোবাসো,আমাকে আপন করে নিতে চাও।″

″আমার সময় লাগবে।″

″ঠিক আছে নাও সময়,দিলাম দু’দিন ভেবে নাও,দু’দিন পর যদি আংটিটা হাতে না দেখি তাহলে ভাববো পর করে দিয়েছ আর যদি ওটা হাতে থাকে তাহলে ভাববো নতুন করে আপন করে নিতে চাও।″

″মাত্র দু’দিন।″

″যা তোমার জন্য দু’দিন তা আমার জন্য শত যুগ সুখপাখি,আর দূরত্ব সইতে পারব না তোমার।″

″আর যদি আংটিটা খুলে নেই,চলে যাবেন আমাকে ছেড়ে?″

″ মরণের পর সেই আঁখিরাতেও পিছু নিব তোমার সমস্যা হবে কী তাতে?তোমার সমস্যা হলে হোক,এই আদৃত না হয় তোমার পা*গ*ল প্রেমিক হয়েই রয়ে যাবে।″

চলবে…

#প্রমত্ত_অঙ্গনা
#লেখিকা_আরোহী_নুর
(৩৫)

আঁখি আদৃত আবারও হাসপাতাল চলে আসলো,আদৃতের মনের সব রাগ ধুয়ে গিয়ে পেলো সুখের ঠিকানা,আঁখিকে আবারও ফিরে পেয়েছে সে,আর খুব জলদি তাকে নিজের করে জীবনে নিয়ে আসবে,আশায় ভরে উঠল মন।অপরদিকে আঁখির মনের সুখের দোলা দোলছে,এতবছর পর আবারও নিজের সত্য ভালোবাসাকে ফিরে পেয়েছে সে,তবে মনে আছে বেশ দ্বিধাদ্বন্দও,এতো কিছুকে অদেখা করে কিভাবে সে আদৃতের জীবনের সাথে জড়িয়ে যেতে পারে,আদৃত তো তাকে দু’দিনের সময় দিয়েছে তবে সে কি পারবে দু’দিনের মধ্যে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে?না আংটিটাও খুলে নেওয়ার ক্ষমতা কুলিয়ে উঠতে পারবে না আঁখি।এতবছর পর ভালোবাসার মানুষটিকে ফিরে পেয়ে তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা কুলিয়ে উঠতে পারছে না।

হাসপাতালে আসতেই দু’জনের উপর পরল আবার অজস্র কাজের চাঁপ,আদৃত তাড়াতাড়ি তার সকল কাজ সেরে নিচ্ছে, আঁখির সাথে সে কিছু সময় কাটাতে চায় একান্তে, তার মনে জমে থাকা অজস্র কথা তাকে জানাতে চায়।

আঁখির হঠাৎ একটা কাজ পরে ডা.আশরাফ খানের সাথে।উনার কেবিনের সামনে গিয়ে দরজায় নক করবে তখনি ভিতরে ইন্সপেক্টর জিসানকে দেখতে পায়,আশরাফ খানের বিপরীত দিকের চেয়ারে বসে আছে সে,দরজা বেশ খানিক খোলা থাকায় তাকে স্পষ্ট দেখতে পেলো আঁখি।আঁখি ভিতরে না গিয়ে বরং বাইরে দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনতে লাগল।

″হুম ইন্সপেক্টর জিসান,তা আপনার এখানে আসার কারণ জানতে পারি?″

″ডা.আশরাফ খান,আমি এখানে এসেছি অনেক জরুরি একটা প্রয়োজনে।″

″কি সাহায্য করতে পারি আমি আপনার?″

″ড্রাইবার মফিজ মিয়াকে তো আপনি চিনেন?শুনেছি উনি আপনার বাড়িতে আগে ড্রাইবার হিসেবে ছিলেন।″

″হ্যাঁ ও অনেক ভালো লোক,অনেক বিশস্তও,আমার বাড়িতে অনেক বছর কাজ করেছে,কিন্তু গত ৪ বছর আগে ও হঠাৎ আমার চাকরি ছেড়ে দেয়,কারণ জিজ্ঞেস করলে তেমন কিছু বলতে চায় না,কিছুদিন পর জানতে পারি সে তার পরিবার নিয়ে তার দেশের বাড়ি চলে যায়।″

″সে জায়গাটা কোথায় বলতে পারবেন?″

″যতটুকু জানি ওর আসল বাড়ি বরিশালে,কিন্তু সঠিক জায়গা বলতে পারব না।″

″উনার কোনো আত্নীয় আছে এখানে আপনার পরিচিত?বা এমন কাউকে চিনেন যেখানে উনি কাজ করতেন?″

″না,এমন কাউকে আমি চিনি না,আর ও আমাদের বাড়ি ছাড়া আর কোথাও চাকরি করে নি কখনও।তা আপনি এতসব কেন জানতে চাইছেন?″

″আপনাকে আমি বেশি কিছু বলতে পারব না,তবে এটুকু বলতে পারব যে একটা কেসের জন্য উনার খোঁজ করছিলাম আমি,কিন্তু উনার ঠিকানায় এসে জানতে পারলাম উনি এখন আর সেখানে থাকেন না।আচ্ছা চলি তাহলে।″

জিসানকে উঠে আসতে দেখে আঁখি সেখান থেকে সরে দাঁড়ালো, জিসান তাকে না দেখেই চলে গেল।আঁখি মনে মনে এক গভীর ভাবনায় ডোব দিল।
____________

আদ্রিশ কক্ষে প্রবেশ করল দূর্বল শরীর নিয়ে,ম*দে*র নেশায় মশগুল হয়ে এসেছে,শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষত তার,অবশ্য চিকিৎসা নিয়ে এসেছে,রিদিকা তখন বিছানায় বসে ছিল,আদ্রিশকে উক্ত অবস্থায় দেখে রিদিকা বিচলিত হয়ে তার পাশে ছোটে আসলো।

″কি হয়েছে আদ্রিশ তোমার?তোমার শরীরে এসব ব্যন্ডেজ কিসের?″

রিদিকা আদ্রিশের ক্ষতগুলোতে হাত বুলিয়ে কথা বলতে লাগলে আদ্রিশ তাকে সজোরে এক ধাক্কা দেয়,যাতে সে ছিটকে ফ্লোরে গিয়ে পরে।এবার আদ্রিশ গর্জে উঠে বলতে লাগে।

″বা*জে,নোং*রা নারী আমার পাশে আসার চেষ্টাও করবি না,আজ তোর জন্যই আমার এ হাল,তোর দিকে তো তাকাতেও ইচ্ছে করে না এখন আমার।″

″তুমি আমায় অবিশ্বাস করছ আদ্রিশ,আমি শুধুই তোমার,আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে, তুমি যা দেখেছ সব বানোয়াট।″

″জানিনা কি বানোয়াট কি সত্য,কিন্তু যেদিন তোকে হাতেনাতে পেয়ে যাব সেদিন তোর আমার বাড়িতে শেষ দিন হবে,এখন সর আমার চোখের সামনে থেকে।আমার সামনেও পরবি না বলে দিলাম।নিজেকে যদি নির্দোষ প্রমাণ করতে পারিস তবে আমার কাছে আসিস ভেবে দেখব তোর কথা।″

″ও তাই,আমার কোনো দোষ আছে কি না তার প্রমাণ ছাড়াই আমাকে দোষী মানলে,আমার সাথে বাজে ব্যবহার করছ,আর ওই আঁখি,যে কি না তোমাকে এতো অপমান করল,তোমাকে মারলো ও,তোমার পরিবারকেও নিয়ে গেল,তারপরও ও ভালো,বড় তো সেদিন চেঁচিয়ে বলছিলে ওর নামে কেস দিবে,কোথায় কি করলে শুনি?″

আদ্রিশ তেড়ে গিয়েই এবার রিদিকার থুতনী চেঁপে ধরল।রাগে ক্ষোভে ক্ষেপে উঠে বলে এবার।

″ওই নোংরা মুখে যদি আর একবারও আমার আঁখির নাম নিয়েছিস তবে ওই মুখ সেলাই করে দিব আমি,রাগে বলেছিলাম বলে আমি আমার আঁখির বিরুদ্ধে যাব কি করে ভাবলি তুই!আমি ওকে ভালোবাসি,ও আমাকে প্রাণে মেরে ফেললেও ততটাই বেসে যাব,আমার তো ভুল হয়েছে তোর মতো নোং*রা*কে এনে ঘরে তোলা,তকে স্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া,সত্যি বলতে আমি তোকে কখনও ভালোবাসি নি, তোর প্রতি আমার ছিল অল্প ভালোলাগা,তোর ডং করা নম্র ভদ্র ব্যবহারে আমি অল্প আকর্ষিত হয়েছিলাম তোর প্রতি,তোর সৌন্দর্য আর শরীর কেমন জানি টানত আমাকে তোর কাছে,তাই তোকে পেতে চেয়েছিলাম,কিন্তু কেন জানি তোকে বিয়ে করতে গেছিলাম!তোর মতো নোংরাকে বিয়ে ছাড়াও তে ভো*গ করতে পারতাম, কিন্তু না মোহকে আমি ভালোবাসা ভেবেছি,কিন্তু এখন বুঝতে পারছি,সত্যি বলতে এখন আর তোর প্রতি কোনো আকর্ষণ আসে না আমার।তোর কাছে আসতেও কেমন জানি বিচ্ছিরি অনুভুতি আসে,তোকে তো দেখতেও মন চায় না।সর আমার চোখের সামনে থেকে।″

রিদিকাকে আবারও প্রবল ধাক্কা দিয়ে ফেলে চলে গেল আদ্রিশ তার কক্ষের বাইরে।
_____________

″আচ্ছা চলি ডা.আদৃত,আর কালকে দেখা হচ্ছে।″

″এই যে আঁখির মিস্টার ড্রাইবার আপনার ম্যাডাম আজ বাড়ি আসবেন না বাড়ি চলে গিয়ে বলে দিবেন বাকি সবাইকে,এবার যান আপনি।আর ডা.সাহেবা আপনি বরং আমার সাথে চলুন।″

″দেখুন রাত হয়ে গেছে বাড়ি যেতে হবে।″

″আমি কোথায় বলছি এখন দিন,আর আমিও তো তোমায় বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি।″

″আপনার বাড়ি!″

″হ্যাঁ বাড়িটা আমার কিন্তু কিছুদিন পর তোমারও হবে।″

″এতো কনফিডেন্ট!অভার কনফিডেন্ট কিন্তু ভালো না।″

″আহনাফ আদৃত মির্জার কনফিডেন্ট কখনও সস্তা বা লোক দেখানো হয় না।″

″ফ্লার্ট করছেন আমার উপর?″ভ্রু নাচিয়ে বলল আঁখি।

″আমি তো ভালবাসা প্রকাশের অল্প প্রচেষ্ঠা করছি মাত্র,কেউ ফ্লার্ট মনে করলে আমার কি করণীয়,তবে যাই করছি নিজের হবু স্ত্রীর সাথেই তো করছি।″

আলতো স্বরে মিনমিনিয়ে আঁখির চোখে চোখ রেখে আদৃতের বলে যাওয়া কথা আচমকা এক লজ্জায় ফেলে দিল আঁখিকে,মুচকি হেসে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল।

″আপনি বড্ড ফাজিল হয়ে গেছেন,নিরামিষ ছিলেন সেটাই ভালো ছিল।″

″হুম চলুন এবার,মা বলেছে তোমাকে নিয়ে যেতে,আজ থাকতে হবে তোমায় আমাদের বাড়িতে।
তবে চলুন আমার মায়ের ছেলের হবু বউ,থুক্কু ডা.আঁখি।″

″আপনি সত্যিই বড্ড পাজি হয়ে গেছেন।″

কথাটা বলে আঁখি লজ্জামিশ্রিত হাসি দিয়ে আর আদৃতের দিকে না তাকিয়েই গাড়িতে উঠার জন্য দরজা খোলতে হাত বাড়াবে তার আগে আদৃত এসে হালকা টানে দরজাটা খুলে দিল।

″এবার ভিতরে যাও।″

আঁখি উত্তরে মৃদু হেসে ভিতরে ঢুকে গেল।

গাড়ি চলছে আপন গতিতে,আজকে আদৃতের চেহারা থেকে হাসি যেন নামছেই না,আলতো এক বাঁকা হাসি ঠোঁটের কোণে স্থির রেখে গাড়ি চালাতে মনোনিবেশ করেছে আদৃত,আঁখি লক্ষ্য করছে তাকে খুব তীক্ষ্ণ নজরে।ফর্সা চেহারাতে খোঁচা দাঁড়ি তার বড্ড মানানসই,বাইরের বাতাস তার চুল দুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, আজ বাতাসের সাথেও বেশ হিংসে হচ্ছে আঁখির,প্রেমিক এই পুরুষের সানিধ্যে নিজেকে ছাড়া সে কাউকেই মেনে নিতে যে চাই নি কখনও,হোক না কেন সে অস্তিত্বহীন কোনো কিছু।
আঁখির ধ্যানে বাঁধা দিয়ে সামনে দৃষ্টি স্থির রেখেই বলল আদৃত এবার।

″আমার কি নতুন করে রূপ ফুটেছে?″

″কেন?″

″না মানে,ছয় বছর পর আজ কাউকে আবারও বিমোহিত হয়ে তাকাতে দেখতে পেলাম অপলকে।″

″আড়চোখে আমাকে দেখছেন বুঝি!″

″আমার মন তো তোমারই পাশে,সে তো সর্বক্ষণ তোমাকেই দেখে যায়।″

″কথা শিখে গেছেন বড্ড।″

″তোমার সান্নিধ্যের পাওনা। তা গান শুনবে?″

″গান শোনা কখন থেকে পছন্দের তালিকায় এলো?″

″যখন থেকে প্রেমে পড়েছি তোমার। ″

আঁখি আবারও মৃদু হেসে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল।আদৃতও মুচকি হাসিতে একটা গান বাজিয়ে দিল।

কি করে বলব তোমায়!
আসলে মন কি যে চায়,
কেন সে পালিয়ে বেড়ায়,তোমার থেকে।
তুমি জানতে পারো নি কতো গল্প পোড়ে যায়।
তুমি চিনতে পারো নি আমাকে হায়…

গানটির একপর্যায়ে আদৃত লক্ষ্য করতে পারে আঁখি কান্না করছে,সাথে সাথে গান বন্ধ করে গাড়ি আটকিয়ে আঁখির জন্য পেরেশান হয়ে উঠে।

″কি হয়েছে আঁখি?কাঁদছ কেন?″

″আমাকে কি আপনি কখনও ক্ষমা করতে পারবেন?হয়ত আমার ভালোবাসার কাছে দমে গিয়ে আমাকে নিজের জীবনে ভরে নিতে চাইছেন,কিন্তু মন থেকে কি কখনও ক্ষমা করতে পারবেন?″

″কিসের ক্ষমা আঁখি?কি বলতে চাইছ তুমি?″

″এই তো,আপনি আমায় ভালোবেসে আর কাউকে জীবনে ভরে নিতে চান নি,এক আমিতেই সীমাবদ্ধ থাকলেন আপনি আর আমি অনায়াসে জীবনে এগিয়ে গেলাম,আসলেই আমার ভালোবাসায় খুঁত ছিল তাই তা পুর্ণতা পায় নি,নিঁখুত তো ছিল আপনার ভালোবাসা যা আমার ভালোবাসার কাছে মান হারিয়েছে।″

আদৃত এবার আঁখিকে টেনে বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলল।

″কখনও না আঁখি,এমনটা আর কখনও বলো না।তোমার ভালোবাসায় কোনো খুঁত ছিল না,বরং তোমার অসহায়ত্ব আর দূর্বলতার সুযোগ আদ্রিশ নিয়েছে এতে তোমার কোনো দোষ ছিল না।″

″জানেন আপনি যখন চলে গেছিলেন তখন আমি অনেক ভেঙে পরেছিলাম,কোথাও গিয়ে মনের শান্তিটুকু পেতাম না,ভাইয়া বাবার সাথে ফ্রি থাকলেও তখন তাদেরও কিছু জানাতাম না,কারণ আমি জানতাম এসব জানালে উনারা আমার সুখের জন্য আপনাকে আমার কাছে নিয়ে আসার চেষ্টা করতেন,যা ব্যাঘাত ঘটাত আপনার সুখের জীবনে,আঙ্কেল আর বাবার সম্পর্ক নষ্ট হতো।তখন একমাত্র আদ্রিশই ছিল যার সংস্পর্শে শান্তি খোঁজে পেতাম,মনের শান্তির লোভে তার সাথে থাকতাম প্রায় সময়,সে সত্যিই তখন আমার দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে আমার পাশে চলে এসেছিল,ওকে ছাড়া থাকতেই পারতাম না,ও আমার অভ্যেসে পরিণত হয়েছিল,যখনই আপনার স্মৃতি আমাকে জ্বা*লা*ত*ন করত ছোটে যেতাম ওর কাছে,ওর প্রতি একটা টান সৃষ্টি হয়েছিল আমার মনে,জানিনা সেটা ভালোবাসা ছিল না কি অন্য কিছু,কিন্তু ওকে আমি হারাতে চাই নি,মন ভাঙার ব্যথা যে কতটা যন্ত্রণাদায়ক তা আপনাকে হারিয়ে বুঝেছি,তাই সে ব্যথা আমি দ্বিতীয়বার সহ্য করার ক্ষমতা জুটিয়ে উঠতে পারি নি।মনের শান্তির পরিণামস্বরুপ ওকে পেতে স্বার্থপর এর মতো সব ত্যাগ দেই আমি।আমাকে ক্ষমা করে দিবেন আপনি?″

″পাগলি কি যে বলে।ওই আদ্রিশ তার কর্মফল নিশ্চয়ই পাবে,এখানে তোমার কখনও কোনো দোষ ছিল না,তাছাড়া আমার সুখপাখির মুখে ক্ষমা চাওয়া আমি কখনও মেনে নিব না।দেখো তোমার কান্নায় আজ আকাশটাও কান্না করে দিয়েছে,চলো না এই বেদনার জলে দু’জন সুখ মাখাই।আজ যে আমার এই নিরামিষ মনটাও উতলা সে বৃষ্টির জলে নেচে উঠতে চায় আঁখি তোমার সনে,ভিজবে কি আজ আমার সাথে?″

″আঁখির চোখের জল মুছে তার দিকে হাত বাড়িয়ে প্রস্তাবটা দিল আদৃত।″

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here