প্রমত্ত_অঙ্গনা #লেখিকা_আরোহী_নুর ২৪,২৫

0
412

#প্রমত্ত_অঙ্গনা
#লেখিকা_আরোহী_নুর
২৪,২৫

রহমত চাচার লুঙ্গি আর শার্ট পরে দ্বিধাদ্বন্দ্বের সহিত আঁখির কক্ষ থেকে বেরুল আদৃত।ঘরের উপস্থিত সবাই অধীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে ছিল তখন আঁখির কক্ষের পানে,আদৃত এবার বেড়িয়ে এলে রহমত আর মরিয়ম একে ওপরের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসতে লাগলেন,আঁখি কোনোমতে তার হাসি দমিয়ে রাখল কিন্তু পেরে উঠল না আর আদৃত সামনে এসে দাঁড়াতেই আঁখি হু হা করে হেসে দিলো।

″নট ফেয়ার আঁখি।এখানে হাসির কি হলো!লুঙ্গিই তো পরেছি।″

″লুঙ্গিই তো পরেছেন সেটাই তো হাসির জিনিস,আপনাকে রহমত চাচার বড় ভাই দেখাচ্ছে। হা হা হা হা″

আঁখি হাসতে হাসতে শেষ,হেসেই যাচ্ছে, আঁখির হাসি দেখে আদৃতও হেসে দিল অবশেষে,আদৃতের হাসিতে আঁখি হাসি কিছুটা দমানের চেষ্টা করে বলল।

″এভাবে হাসেন না কেনো সবসময়?হাসলে আপনাকে সত্যিই অনেক ভালো লাগে,আর হাসতে কিন্তু টাকা লাগে না বুঝলেন ডা.সাহেব।″

″হাসানোর জন্য তোমার মতো কেউ নেই আঁখি।″

আদৃতের হঠাৎ বলে ওঠা কথাটা আঁখিকে বেশ অস্বাভাবিকতায় ফেলে দিলো,হাসি থামিয়ে এবার স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে বলল।

আচ্ছা এসব ছাড়ুন আর চলুন কেক রেডি এবার কেটে নেওয়া যাক।

অতঃপর সবাই মিলে কেক কাটল,গার্ডদেরও আনিয়ে নিল আঁখি,কেক কাটা পরে সবাই ছবি উঠল।আদৃত লুঙ্গি আর শার্ট পরে ছবি উঠাতে না চাইলে আঁখি জোর করে কয়েকটা ছবি তুলে নিল তাকে তারপর জোরে জোরে হাসল কিছুক্ষণ।

ছেলেকে ঘুম পারিয়ে বিছানার এক প্রান্তে বসে চোখের জল ফেলছে শুভ্রতা,স্ত্রীকে সান্তনা দেওয়ার মতো সক্ষমতাও আদিলের নেই,তবুও তার পাশে গিয়ে বসল,তার কাঁধে হাত রেখে বলল।

তুমি চিন্তা করো না,তুমি দেখো আমি কিছু না কিছু একটা করব,আমাদের এভাবে আর আদ্রিশের উপর বোঝা হয়ে থাকতে হবে না।

শুভ্রতা ঝাটকা দিয়ে আদিলের হাত ছাড়িয়ে নিল,কর্কশ কন্ঠে বলল এবার।

আর কখন?কখন করবে তুমি কিছু?আমি আর আমার ছেলে বুড়ো হয়ে গেলে?মানুষের দাসত্ব করে জীবন কাটিয়ে দিলে তখন?প্রথমে ভেবেছিলাম তোমাকে পেয়ে হয়ত আমি সৌভাগ্যবতী হয়েছি কিন্তু না আমার দূর্ভাগ্য ছিল যে তোমাকে ভালোবেসেছিলাম,পড়ালেখা করো নি কখনও,গু*ন্ডা*দের মতো টইটই করে ঘুরে বেড়িয়েছ এখানে সেখানে,দায়িত্ব বোধ কখন ছিল তোমার মধ্যে?এক আমি ভালোবেসেছিলাম বলে হয়ত তোমার কপালে বউ জুটেছে নইলে তাও জুটত না,তোমার অযোগ্যতা তো সবাই বুঝে গিয়েছিল তাই বাবাও সম্পত্তির প্রায় সকল অংশই আদ্রিশের নামে লিখে দিয়েছেন আর তোমাকে দিয়েছেন জঙ্গল এলাকার এমন এক জমি যা কখনও কেউ কিনবে কি না সন্দেহ আছে,আমার তো যাওয়ারও কোনো জায়গা নেই নইলে তোমার মতো বেকার আর বোঝার সংসার কখনও করতাম না,কখনও আর এভাবে অপমান অবহেলা সহ্য করতে হতো না আমার।

কথাগুলো বলে শুভ্রতা ফ্লোরে বসে পরে কাঁদতে লাগল।

আদিলের চোখ টপকে বেড়িয়ে এলো অসহায়ত্বের জল,সারা পৃথিবী ওর বিরুদ্ধে চলে গেলেও শুভ্রতা কখনও তার সঙ্গ ছাড়ে নি,তার সক্ষমতা হয়ে থেকেছে সে সর্বক্ষণ, কোনোদিন তার বিপক্ষে যায় নি শুভ্রতা,জোর গলায় কখনও কথা বলে নি তার সাথে,আদিলের মনের বল হিসেবে পাশে থেকেছে শুভ্রতা,ভালোবেসে যে বিয়ে করেছিল তাকে,গবীরের মেয়ে তাই বেকার হলেও বাবার সম্পত্তি দেখে শুভ্রতার বাবা মা নির্দ্বিধায় মেয়ে তুলে দিয়েছিলেন আদিলের হাতে,বড়লোকের বড় ছেলে ছিল আদিল,মা বাবার অতি আদরে বিগড়ে গিয়েছিল,পড়ালেখা একদম করত না,সারাদিন মা*স্তা*নি,র*ক*বা*জি করে বেড়ানো তার স্বভাব ছিল,টেনেটুনে এসএসসি পাশ করার পর আর পড়ে নি,বিভিন্ন খারাপ অভ্যেস ছিল তার,কিন্তু শুভ্রতা আসার পর পরিবর্তন আসে আদিলের জীবনে,জীবনে সঠিক দিশা পায় আদিল,খারাপ সঙ্গ ও নেশা ত্যাগ করার সাথে সাথে তার মধ্যে দায়িত্বজ্ঞানটাও চলে আসলো তবে যে ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল,চাইলেও আর বাকি পড়ালেখা এখন করতে পারবে না আদিল,কোনো চাকরি হলেও অজ্ঞতার কারণে সেটা টিকে না বেশি দিন,টেনেটুনে এসএসসি পাশ করে গেলেও শিক্ষার যথেষ্ট জ্ঞান সে আয়ত্ত করতে পারে নি,তাছাড়াও মুর্খতার কারণবশত বংশের নাম ডোবাবে ভেবে তার বাবা দাদাও সম্পত্তির বেশিরভাগ অংশ করে দিয়েছেন আদ্রিশের নামে,আদ্রিশই একমাত্র আদিলের সংসারের চাবিকাঠি।ভরসার নাম হিসেবে শুভ্রতার ছোঁয়া থাকায় এতে আফসোস কখনও হয় নি আদিলের কিন্তু আজ যেনো লজ্জায় ম*রে যেতে ইচ্ছে করছে তার,আজ যদি ঠিকমতো পড়ালেখা করত বা অন্য কাজে মন দিত তবে স্ত্রী সন্তান নিয়ে এমন অনিশ্চিত জীবন যাপন করতে হতো না তার, আফসোসের সাথে তিক্ত অভীমান নিয়ে চলে গেল আহিল কোথাও বেড়িয়ে।

আদৃতের কাপড় এখনও শুকোয় নি,ভিজে কাপড় পরে আদৃত বাড়ি যাওয়ার মন বানিয়ে নিলে আঁখি বাঁধা দিলো।

″দেখুন রাত ২ টা বাজে,এদিকে আপনার কাপড় এখনও পুরো ভিজে রয়েছে তাই আপনি আজকে এখানে থেকে যান কাল সকালে না হয় চলে যাবেন।″

″না আঁখি আমি চলে যাই।″

″আরে শুধু শুধু জেদ করবেন না তো,আপনাকে জেদ করা মানায় না,ফালতু জেদ করেন আপনি।গেস্ট রুম আমি রেডি করিয়ে দিচ্ছি ওখানে গিয়ে শুয়ে পরুন ″

″কিন্তু। ″

″কোনো কিন্তু না,চুপচাপ এখানেই থাকুন।তা লুঙ্গিতে আপনাকে কিন্তু দারুণ লাগছে।″

মশকরা করে কথাটা বলে হেসে হেসে চলে গেল আঁখি,আদৃতের মনে ভালোলাগার অনুভুতি আরেকদফা খেলিয়ে গেল,আদৃত জানে আঁখি সে ব্যতীত অন্য কোনো ছেলের সাথে কোনোদিন এতটা ফ্রি হয়ে কথা বলে নি,বা বলেও না,ছেলেদের থেকে দূরেই থাকে আঁখি,আদৃতই প্রথম কোনো ছেলে ছিল যার সাথে নিজের পরিবার ব্যতীত এতো সহজে মানিয়ে নিত আঁখি,আদৃতের সাথে মনের সকল কথা ভাগ করে নেওয়া,তাকে বিরক্ত করা,তার সাথে ঝগড়া করা সবকিছুই জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল আঁখির,আর আঁখির আজকের আচরণে আদৃত বুঝতে সক্ষম হলো আঁখি এখনও আদৃতের সে অবস্থান থেকে তাকে সরাতে সক্ষম হয় নি।

ঘুম থেকে ওঠে ফ্রেস হতে গেল রিদিকা,হঠাৎ ব্রাশ করতে গিয়ে একদিকের এক আঙ্কেল দাঁতে ব্যাথা অনুভব করতে পারল,ব্রাশ বের করে তাতে অনেক র*ক্ত লেগে থাকতে দেখতে পেলে সাথে সাথে কুলি করল,অনেক র*ক্ত বেরুলো সে দাঁত দিয়ে কুলির সাথে,রিদিকা এবার দাঁতে হাত লাগিয়ে বুঝতে পারল দাঁতটা নড়ছে,যাতে ঘাবড়ে উঠল তার মন,এ বয়সে তার দাঁত নড়বে কেন?গতকাল আচমকা এতো চুল আসল,এদিকে শরীরটাও কেমন দূর্বল লাগছে আজ কাল,বিষয়টা কি আদ্রুিশকে তার জানানো দরকার?না রিদিকা এসব কথা বর্তমানে আদ্রিশকে জানাবে না,সে নিজেই ডাক্তারে যাবে ভেবে নিয়েছে।

সারাটা রাত্রী বিনিদ্র গেল শুভ্রতার,রাগের মাথায় আদিলকে এতো সব কথা শুনিয়ে গেছিল সে,আদিল চলে যাওয়ার অনেক্ষণ পর সে তার কৃতকর্মের জন্য আফসোস করতে শুরু করল,সারারাত বাড়ি ফিরে নি আদিল,ফোনও অফ আসল তার,যা পেরেশান করে তুলল শুভ্রতার মন,আদিলকে যে বড্ড ভালোবাসে সে।সব জেনেই তো আদিলকে মেনে নিয়েছিল সে তবে আজ কীভাবে এমনটা করে যেতে পারল,কীভাবে মাফ করবে নিজেকে শুভ্রতা।

সাত সকালে ঘুম থেকে ওঠে পরল আদৃত,কাপড়গুলো শুকিয়ে গেলে পরে নিল এবার,সকালের শুরুটা আঁখির হাসিমাখা মুখ দেখে করতে চাইল তাই ফ্রেস হয়ে আগে তাকে খোঁজতে শুরু করল,কিন্তু কোথায় সে তার তো কোনো খোঁজ নেই,আঁখিকে খোঁজতে খোঁজতে বাগানের দিকে গেল আদৃত।

বাগানের দোলনাতে বসে রাতে উঠা ছবিগুলো দেখছিল আঁখি,আদৃতের লুঙ্গি পরনের ছবি দেখে এখনও অনেক হাসি পেলো আঁখির, অল্পতে মনে পরল আঁখির সে বিষাদময় দিনগুলোর কথা,যেদিন আদৃত নামক ভালোবাসার মানুষটাকে সে ডা.সানিয়ার সাথে দেখেছিল,বুকের ক্ষতের পরিমাণ সেদিন সয়ে যাওয়ার সীমারেখায় ছিলো না,কিশোরী মন সেদিন পাগলের মতো কেঁদেছিল,আদৃত যখন দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছিল সেদিন ম*রে যেতে মন চাইছিল আঁখির,আদৃতের ছবি বুকে নিয়ে কতো দিন আর কতো রাত সে কেঁদে অতিবাহিত করেছে তা শুধু আঁখি জানে,একসময় যে সে অসুস্থ হয়ে পরেছিল,পীড়া সহ্য করতে না পেরে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টায় কলেজের ছাঁদ থেকে লাফ দিতে গিয়েছিল,কতো কঠিন ছিল সে দিনগুলো,তবে কার জন্য এসব করে গেল আঁখি,যার সুখের জন্য এমনটা করল সেই তো আজ সুখী নয়,দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করল আঁখি,হালকা ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি ঝড়তে শুরু হয়েছে হঠাৎ করে,আঁখির মনে পরল একটা গান,প্রায় দিনে আদৃতের স্মৃতিতে গানটা গাইত আঁখি,তার দেওয়া বিষাদময় অনুভুতি গানে ফুটিয়ে তুলত,আজও গানটা হঠাৎ গাইতে মন চাইল তাই গাইতে শুরু করল।

ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুঁয়ো না…
আমার এতো সাধের কান্নার দাঁগ ধুয়ো না…
সে যেন এসে দেখে পথ চেয়ে তার কেমন করে কেঁদেছি…
সে যেন এসে দেখে পথ চেয়ে তার কেমন করে কেঁদেছি…

হঠাৎ পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে গান বন্ধ করে পিছনে তাকাল আঁখি,আদৃতকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ হকচকিয়ে গেল।আদৃত বলল।

″বন্ধ করলে কেন আঁখি?গাও না,তোমার সুর যে আগ থেকেও আরও মধুময় হয়ে দাঁড়িয়েছে,শুনতে বড্ড মন চাইছে,শোনাবে না?″

″কেনো? কখনও তো এ সুর অসহ্য লাগত আপনার।″

″এমনও তো হতে পারে তখন ভালোলাগাকে অসহ্য লাগা মনে করেছি।″

″ভালো লাগুক বা বিরক্ত এটাই সত্য যে সেই ছয় বছর পূর্বে আর ফিরে যাওয়া সম্ভব না।″

স্বাভাবিক ভাবে আঁখির বলা যাওয়া উক্ত কথা কতটা যন্ত্রণা দায়ক আদৃতের প্রেমিক হৃদয়ের জন্য তা শুধু সে জানে।

দুপুর ঠিক বারোটার দিকে কক্ষে প্রবেশ করল আদিল,কক্ষের এক কোণে বসে কান্না করছিল শুভ্রতা হঠাৎ কক্ষে আদিলকে দেখতে পেয়ে ছুটে গিয়েই তার পায়ে লেপ্টে পরল,কান্নায় ফুঁপিয়ে ওঠা স্বরে অসহায়ের মতো বলতে শুরু করল।

আমায় ক্ষমা করে দাও গো তুমি,আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি,তুমি বিহনে আমি বাঁচবো না,আমার চাই না কোনো টাকা পয়সা,তোমার কোনো চাকরি,আমার শুধু তুমি হলেই চলবে,তোমার বদলে আমি সব অপমান অবহেলা মুখ বুঝে সহ্য করে নিব।শুধু তুমি আমায় ছেড়ে যেও না।আমি রাগের মাথায় কি না কি বলে গেছি,তুমি আমায় মা*রো,গালিগালাজ করো কিন্তু আমাকে ছেড়ে যেও না।

আদিল এবার শুভ্রতাকে পা থেকে টেনে তুলে বুকে জড়িয়ে নিয়ে কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলল।

পাগলি বউ আমার,এভাবে কেউ কাঁদে,অধিকার খাটিয়ে তুমি না রাগলে কে রাগবে আমার উপর,কিভাবে ভাবলে তোমাকে ছেড়ে আমি চলে যাব,জীবনে অনেক ভুল করেছি আর না,আমি অনেক জায়গায় কথা বলে এসেছি সপ্তাহ খানিকের মধ্যে কোথাও না কোথাও একটা চাকরি বা কাজ হবেই তখন তুমি রিহান আর মা সবাইকে নিয়ে আমি আলাদা কোথাও চলে যাব,আর দেখে নিও তোমাদের সবার দায়িত্ব পালনে আমি সক্ষম হয়ে দেখাব।

দেখতে দেখতে কেটে গেলো বেশ কিছু দিন,ভালোই যাচ্ছে আঁখির দিনগুলো,আজ আবারও রাতে রাইড করার ইচ্ছে জাগল মনে তাই বাইক নিয়ে বেরুলো,খান ম্যানশনের বাহির থেকে বাড়িটা দেখে আসলো সে,রাত প্রায় ১১ টা,বাড়ির রাস্তা দিয়ে বাইক নিয়ে ঢুকছিল আঁখি কিন্তু হঠাৎ বাইকের চাকায় কিছু লেগে বাইক নিয়ন্ত্রণ হারায় আঁখির,যথেষ্ট দক্ষ থাকায় পরে যাওয়া থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে নেয়,বাইক একপাশে রেখে রাস্তার দিকে তাকায় আঁখি,দেখতে পায় কিছু কীল পরে আছে,বুঝতে পারে অনেক কিছুই,বিচক্ষণতা নিয়ে চোখ ঘোরাল এবার,তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে কিছু ইঙ্গিত দিয়ে দিলে পিছন থেকে মাথায় কিছুর বারি পরার আগেই বড় সে লাঠিটা পাকড়াও করে আঁখি,লাঠি ধরেই পিছনের জনকে ঘুরিয়ে সামনে এনে এক ঘুষি দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়,দেখতে পায় হুডিওয়ালা মাস্ক পরিহিত কাউকে।

চলবে…

#প্রমত্ত_অঙ্গনা
#লেখিকা_আরোহী_নুর
(২৫)

হুডিওয়ালা অজ্ঞাত সে জন উঠেই আঁখির উপর আবার আক্রমণ করতে আসলো হাতে থাকা ছু*রি দিয়ে, ছুরিঘাত করার আগেই আঁখি তার হাত ধরে একটা মোচড় দিল যাতে ব্যথায় কুঁকড়ে ওঠে ছুরিটা ছেড়ে দিল সে, আঁখি তাকে বেশ জোরালো কয়েকটা ঘুষি আর লাথি দিল,অজ্ঞাত জন আঁখির গায়ে একটাও আঁচড় দিয়ে উঠতে সক্ষম হলো না,বরং আঁখির সাথে পেরে না ওঠে মুখ থুবড়ে মাটিতে পরল।এবার হাতের পাশে লাঠি পেয়ে আবার আঁখির উপর আক্রমণ করতে গেলে আঁখি লাঠিটাও ধরে নেয়,তারপর সেই লাঠি কেড়ে নিয়ে তার পিঠ বরাবর প্র*হা*র করলে আবারও মুখ থুবড়ে পরে গেল সে,আঁখি এগিয়ে গিয়েই তার মাথা মাটির সাথে চেঁপে ধরে ওপর হাতে তার এক হাত পিছন দিক দিয়ে মুড়ে ধরে এবার কর্কশ গলায় বলল।

কে তুই?আমার সাথে কেন লাগতে এসেছিস?লাগতে আসবি ভালো কথা ক্ষমতা দেখে তো আসবি!শুধু শুধু মা*র খেলি,এবার বল কে তুই?আমাকে কেন মা*র*তে এসেছিস?
কিছুই বলল না সে জন,অজ্ঞাত ব্যক্তির হুডিটা অনেক আগেই মাথা থেকে সরে গেছে,চুল খোঁপা করা যাতে কাঠি লাগানো,আঁখি এবার তার চুল বেশ জোরে মুঠো করে ধরল।

বল কে তুই?নইলে এখনই সব চুল ছিঁড়ে ফেলব,এতো মা*র*ব যে নিজেকেই ভুলে যাবি,বল কে তুই কে?বল?বলবি না তো ঠিক আছে,এখনই তোর মুখোশ খুলে দেখছি তুই কোন ক্ষেতের মূলা।
আঁখি তাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে এবার তার মুখোশ খোলার চেষ্টা করলে সে তাকে ধাক্কা দিয়ে উঠে পালাতে শুরু করে,আঁখিও বেশ গতিতে তাকে ধাওয়া করল,আঁখির সাথে দৌঁড়ে পেরে উঠারও ক্ষমতা সে জন কুলিয়ে উঠতে পারছে না,আঁখি তার অনেক পাশে এসে তাকে ধরার জন্য হাত বাড়ালে তার খোঁপাতে তার হাত যায়,এক টান দিলে তার খোঁপার কাটা সহিত কিছু চুল আঁখির হাতে চলে আসে,কিন্তু সে জন অন্ধকারে কোথাও মিলিয়ে যায় প্রাণ বাঁচিয়ে।

আজ রিদিকা আসলো ডাক্তারের কাছে,একাই এসেছে,নিজের শরীরের এমন পরিস্থিতি সম্পর্কে সে আদ্রিশকে জানাতে চায় না বর্তমানে কিছু,বড্ড ভয় হয় তার আদ্রিশকে হারিয়ে ফেলার,যে আদ্রিশ তার প্রাণের প্রিয়া আঁখির উপর রিদিকাকে নিয়ে এলো সামান্য বাচ্চার দোহাই দিয়ে তাকে নিয়ে কীভাবে কোনো সুযোগ নিবে রিদিকা!আদ্রিশ আজ দু’দিন হলো একটা কাজে শহরের বাহিরে গেছে সে সুযোগে ডাক্তারে চলে আসলো রিদিকা,ডাক্তার তাকে চেক আপ করে কিছু টেস্ট করানোর জন্য দিলেন,সে টেস্টগুলো করে বসে রইল রিপোর্টের জন্য।এবার তার রিপোর্ট দেখে বেশ চিন্তিত হলেন ডাক্তার,ডাক্তারের দুরাশাগ্রস্থ চেহারা দেখে অস্থিরতা আরও বেড়ে গেল রিদিকার।জিজ্ঞেস করল ডাক্তারকে।

″কি হয়েছে ডাক্তার?কি সমস্যা দেখলেন আমার?″

″দেখুন মিসেস রিদিকা রাহমান, আপনার কোনো রোগ হয় নি,বরং আপনার শরীরে এক ধরনের ভাইরাস পাওয়া গেছে।″

″হোয়াট! ভাইরাস?কিন্তু আমার শরীরে ভাইরাসের উৎপত্তি কীভাবে হলো?″

″সেটা উৎপত্তি হয় নি,বরং সেটা আপনার শরীর অব্দি পৌঁছানো হয়েছে।এই ভাইরাসের বিষয়ে আমি এখন তেমন কিছু বলতে পারব না কারণ ভাইরাসটা নতুন ধরনের একটা ভাইরাস,আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি এটা মনুষ্য সৃষ্টি, যা কোনো মাধ্যম ব্যতীত আপনার শরীরে প্রবেশ করে নি।উক্ত ভাইরাস আপনার শরীরের কর্মক্ষমতা নষ্ট করে দিচ্ছে।″

″এখন আমার কী করণীয় আছে ডাক্তার?কী হবে আমার?″

″আরে ঘাবড়াবেন না,ভাইরাসটা এখন আপনার শরীরে অল্প পরিমাণে আছে, আমি কিছু ঔষধ লিখে দিচ্ছি আপনি সেগুলো সেবন করুন,আর আপনার ব্যবহার্য সকল পুরাতন পন্য বদলে ফেলুন সেগুলো থেকেও সমস্যা হতে পারে,আমাকে ভাইরাসটা নিয়ে একটু রিসার্চ করতে হবে,এটা সম্পর্কে ভালোভাবে জানার পরই আপনাকে যথেষ্ট কোনো পথ্য আমি দিতে পারব।

আঁঁখি কাঠিটা হাতে নিয়ে অনেক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছে,কাঠিটা কোথাও যেন দেখেছে আঁখি,খুব খেয়াল করে হয়ত তখন দেখে নি নয়ত আঁখির স্মৃতি খুবই প্রখড় মনে করে নিত মুহুর্তেই,তবুও মস্তিষ্কে প্রচুর জোর দিয়ে ভাবছে,তাকে সেই অজ্ঞাত জন পর্যন্ত পৌঁছাতেই হবে,তাকে যে বড্ড প্রয়োজন আঁখির,কিন্তু হঠাৎ খেয়াল করল
আঁখি দেরি হচ্ছে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য,তাই ওটা রেখে দিলো একটা ড্রয়ারে তারপর কাভার্ড থেকে পরার জন্য কাপড় বের করবে তখনই কাভার্ডের একটা থাকের উপর চোখ গেল,নীল রঙের রেপিং পেপারে আবৃত বাক্স,মনে পরল ওটা আঁখির জন্মদিনে আদৃত দিয়েছিল,আঁখি সেটা সেই যে রেখেছিল এখনও খোলার কথা মনে নেই।এবার বাক্সটা হাতে নিয়ে খুলে নিল।ভিতর থেকে বেড়িয়ে এলো কালো রঙের একটা কাতান শাড়ি, অদ্ভুত সুন্দর তার কাজ,এক কালার শাড়িটার সোনালি রঙের পাইর,আঁচলের দিকে হালকা কাজ,কালো শাড়ি বলতেই আঁখির ভালোলাগার একটা বড় অংশ,উপহারটা দেখে বেশ খুশি হলো আঁখি,বাক্সে একটা চিরকুটও পেল সে।চিরকুটটা উঠিয়ে পরতে লাগল সেটা।

মিস প্যারা
তোমাকে কালো শাড়িতে বেশ মানায়,কালো রঙের শাড়ি যেন তোমার জন্যই বানানো হয়।আসলেই সৌভাগ্যবান হবে সে শাড়ি যা চড়বে তোমার গায়,সৌন্দর্য তোমার বাড়িয়ে দিবে বহুগুণ, এতটা গুছিয়ে কথা বলতে জানিনা, জানো তো খুব ভালো করেই তুমি,চেষ্টা করলাম শুধু মাত্র সাথে চাহিদাও অল্প,একদিন গায়ে জড়িয়ে নিও এই সৌন্দর্য, হয়ত আকাশের চাঁদটাও হার মানবে সেদিন তোমায় রূপে,তোমার রূপের তেজে ঈ*র্ষা*ন্বি*ত হয়ে হয়ত লুকাবে সে সেদিন মেঘাতলে।
চোখা নাকওয়ালা।

চিরকুটটা পরে আঁখি হেসে দিল,চোখা নাকওয়ালা ডাকটা আঁখি প্রায় ডাকত আদৃতকে,যাতে বিরক্ত হতো আদৃত খুব,চেঁচিয়ে উঠত কখনও কখনও আর আঁখি তাকে উত্তপ্ত করে মজা নিত।কখনও আদৃত– আঁখির বা অন্য কোনো নারীর প্রশংসা করে নি,আজ তার মুখে নিজের জন্য প্রসংশা শুনে কি প্রতিক্রিয়া করবে ভেবে পাচ্ছে না।

″স্যার আজ কয়েকদিন থেকেই এতো খোঁজ নিয়েও আমরা প্রমত্ত অঙ্গনা সম্পর্কে তেমন কোনো সন্ধান পেলাম না।এদিকে ইশানা আর রিয়াদের দু’টো ফোনই আমরা পা*বে*র পিছনের জঙ্গল থেকে পেলাম,কিন্তু দু’জনের লা*শ তো আলাদা দুই স্থানে ছিল,কিছুই তো বুঝে ওঠা যাচ্ছে না।″

″ব্যপারটা খুব সিম্পল, ইশানার সাথে অ*বৈ*ধ সম্পর্কে ছিল রিয়াদ,সে রাতে তারা একসাথে ছিল পা*বে,সাথে প্রমত্ত অঙ্গনাও ওদের উপর নজর রাখছিল তখন,সুযোগ বুঝে সে সেখানের একটা বন্ধ রুমে ইশানাকে মে*রে ফেলে রাখে,অতঃপর তার ফোন দিয়ে রিয়াদকে ইশানা সেজে পাব এর পিছনের দিকটায় আনিয়ে নিয়ে তাকেও প্রানে মা*রা*র প্রচেষ্ঠা করে, কিন্তু রিয়াদ হয়ত কোনোরুপ নিজেকে বাঁচাতে জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে মেইন রোডে উঠতে গিয়েছিল, তখন নিজে থেকে বেখেয়ালে নয়ত প্রমত্ত অঙ্গনার ধাক্কায় গাড়ির নিচে এসে যায় রিয়াদ।আর তারপর তো প্রমত্ত অঙ্গনা হাসপাতালে এসেই তাকে মা*র*তে সক্ষম হয়।″

″কিন্তু স্যার প্রমত্ত অঙ্গনা হাসপাতালে কিভাবে প্রবেশ করল?কারণ হাসপাতালের সামনের সিসিটিভি দিয়ে তো ওকে প্রবেশ করতে দেখা যায় নি।″

″ও হাসপাতালের সামনা দিয়ে প্রবেশ করে নি,এদিকে গেলে ধরা পরার সুযোগ বেশি ছিল হয়ত তাই,খুব সম্ভবত হাসপাতালের পিছনের দিক দিয়ে কোনোরকম দেয়ালের দিকটায় চড়ে হাসপাতালে প্রবেশ করেছে।সে যেই হোক খুব দক্ষ একজন।একে তো আমার স্যালুট করতে মন চাইছে,এতো নিখুঁত আর দক্ষতার সাথে হয়ত আজ অব্দি কোনো অপরাধীই পার পেয়ে যেতে পারে নি।তবে তাকে তো আমি ধরবই।কিন্তু তার আগে আমাদের নকল প্রমত্ত অঙ্গনা সম্পর্কে জানতে হবে,আর তাকে খোঁজে বের করতে হলে আমাদের ৪ বছর আগের সেই দু’টি খুন সম্পর্কে আবারও সন্ধান করতে হবে,আগা থেকে শুরু করলে গোড়ায় তাড়াতাড়িই পৌঁছাব ইনশাআল্লাহ। খু*ন দু’টো যশোর জেলায় হয়েছিল,আজ সন্ধ্যায় আমি দু’জন কনস্টেবল নিয়ে যশোরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হব,তুমি এদিকটার খেয়াল রেখ।″

আজ হাসপাতালে আদৃত আসে নি,কেমন জানি ফাঁকা ফাঁকা লাগছে আঁখির,কাজের ফাঁকে তো আদৃতের সাথেই তার আড্ডা জমে থাকত দিনভর,গম্ভীর সে লোকটা বেশি কথা বলতে না জানলেও আঁখির বকবকানি তো শুনত সারাদিন,মাঝে মধ্যে আঁখির সাথে মগ্ন হতো তার অতি গম্ভীর কিছু আলাপচারিতায়, বেশ ভালোই লাগে আখির তা।আদৃতকে দেখলেই যেন মনে হয় সে আবারও সেই ছয় বছর আগে ফিরে গেছে,তাই হুট করে আজ তার না আসা কেমন জানি এক খালিলাগা অনুভুতি জন্ম দিলো আঁখির মনে,ফোন দিবে আদৃতকে তখনই আদৃতের ফোন আসল।

″আরে ডা.সাহেব কোথায় আপনি?″

″আর বলো না অল্প জ্বর আসাতে মা ঘর বন্ধী করেছে আমায়।এমন বন্ধ অবস্থায় না আমি আমি হার্ট অ্যাটাক করে মা*রা যাই।″

″আরে কি যে বলেন?আপনি ভাগ্যবান যে আপনার পাশে আপনার মা-বাবা আছেন আপনাকে দেখাশোনা করার জন্য,আপনাকে ভালোবাসা দেওয়ার জন্য।আমার তো এমন অবস্থা যে ঘরে ম*রে পরে থাকলেও কর্মচারী দেখাশোনা ব্যতীত আহ্লাদ করে যে কেউ বুকে টেনে নিবে এমন কেউ নেই।″

″এভাবে বলো না আঁখি, দেখবে আশরাফ স্যার আর আহিল একদিন ঠিকই তোমায় মেনে নিবে।তুমি নিরাশ হয়ো না প্লিজ।″

″হুম, ভালো থাকুন রাখি কাজ আছে,নিজের খেয়াল রাখবেন কিন্তু।″

″হুম,বাই,তুমিও নিজের খেয়াল রেখো।″

আহিল তখন আঁখির কেবিনে এসেছিল কিছু কাজে আঁখির বলা কথাগুলো স্পষ্ট শুনতে পেল সে,যাতে এক মুহুর্তেই বুক হাহাকারে ভরে গেল তার বোনের জন্য।আঁখি ফোন রেখে দেখতে পেল আহিলকে।

″আরে ভাইয়া তুই?কোনো কাজে এসেছিস?″

″ডা.আঁখি আমি আপনার সিনিয়র স্যার বলে ডাকবেন আশা করি।″

″বয়েই গেছে আমার তোকে স্যার ডাকতে,আমি তোকে ভাইয়া বলব, কারণ তুই আমার ভাইয়া,আর তুই করেও বলব,কি করবি করে নিস।″

″আপনি কিন্তু বে*য়া*দ*বি করছেন ডা.আঁখি।″

″কি দেখেছিস তুই বে*য়া*দ*বির,সবকিছু আমিই করি উনারা কিছু করেন না,বাপ ছেলে বুড়ো বয়সে ঢং করতে শিখেছে,আমাকে সামনে থেকে জুনিয়র বলে অপদস্ত করবে আর আমার জন্মদিনে লুকিয়ে আমার কেবিনে এসে গিফট রেখে যাবে।″

এই রে এর কেবিনে গিফট রেখেছিলাম এ কিভাবে জানল!আর বাবাও একি কান্ড করলেন!যতই বলুক না কেনো বাবা আঁখিকে কখনও পর করতে পারবেন না।

কি ভাবছিস ভাইয়া এটাই তো আমি কিভাবে জানলাম?আরে ভাইয়া আমি তোর ছোট হতে পারি কিন্তু বুদ্ধিতে তোর নানি,আমার কেবিনের সামনের সিসিটিভি তো আর এমনি লাগানো হয় নি।বাপ ছেলে কীভাবে লুকিয়ে ধিমি পায়ে এসেছিল।হা হা হা হা।

আঁখি খিল খিল করে হেসে উঠলে আহিল আর দাঁড়ালো না সেখানে,জানে এখানে থাকলে ধরা পরবে সে আঁখির কাছে,আঁখি যে তাকে হাসিয়ে এবং মানিয়েই ছাড়বে,তাই বেগতিক পায়ে চলে গেল,আঁখি এখনও হাসছে।

″শুনছ শুভ্রতা আজ আমাদের একাউন্টে আঁখি ২ লক্ষ টাকা পাঠিয়েছে,বলল আগামীতে আরও পাঠাবে, আমি মানা করলেও মানল না,বলল আমাদের কিছু লাগলে ওকে বলতে।মেয়েটা যখন থেকে জীবনে এসেছে আমাদের শুধু দিয়েই যাচ্ছে, মানুষ এতোটাও ভালো হয় কখনও তাকে না দেখলে বুঝতামই না,কোনোদিনও হয়ত তার ঋণ শোধ করার তৈফিক জুটিয়ে ওঠতে পারব না।″

″ঋণ শোধ করার কথা বাদই দেও,এখন তো ওর সাথে কথাটাও বলে ওঠার পরিস্থিতি রয়ে যায় না,দম বন্ধ লাগে আমার আদিল,প্লিজ কোনোমতে এখান থেকে নিয়ে চলো।″

″আর একটু অপেক্ষা করো,আমি সবকিছু ঠিক করে দিব,বর্তমানে এই টাকার কথা যাতে মা ব্যতীত আর কারো কানে না যায়।″

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here