আঁধারের_তারাবাজি #অভ্রায়ীনি_ঐশি #পর্ব_৩১

0
675

#আঁধারের_তারাবাজি
#অভ্রায়ীনি_ঐশি
#পর্ব_৩১

স্নিগ্ধ শীতল পরিবেশ বিরাজ করছে এহসান বাড়িতে।সময় রাত সাড়ে দশটা।,,নভ আর মোয়ান কোথায় যেন বেরিয়েছে।জানা নেই মোমের।সে আজ তার আম্মি আর আব্বুর সাথেই ব্যস্ত।

নভ জানিয়েছে তারা কাল সকালেই ফিরে যাবে।এতে মোম কিছুটা কষ্ট পেলেও সেটি খুব একটা বেশি টিকলো নাহ।কারন নভ এটাও জানালো যে মোয়ান সহ মোমের আম্মি আর আব্বু নতুন ফ্ল্যাটে উঠছে এই সপ্তাহেই। যে ফ্ল্যাটটি নভদের বাড়ি থেকে মাত্র আধ ঘন্টার পথ।আর নভের রিসোর্ট থেকে হাটা পথেই।,,মোম বেশ খুশি হলো,কারন এবার থেকে সে কিছুদিন পর পরই আম্মি আব্বুর কাছে যেতে পারবে।আর সস্থির নিঃশ্বাস ফেললো এই ভেবে যে আর তার চাচা চাচিদের সাথে থাকতে হবে না।আর না তাদের তিক্ত কথার মুখে পড়বে মোম।,,

সময় গড়ালো।নভ আর মোয়ানও ফিরে এলো,,সবাই মিলে ডিনার সেরে নিয়ে যে যার মতো ঘুমিয়ে পড়লো।,,

পরদিন সকাল বেলায় নাস্তা করেই রেডি হতে লাগলো নভ মোম।,,,নভ আগে রেডি হয়ে নিয়ে বেশ কিছু ব্যাগ গাড়িতে তুলতে লাগলো।যেখানে মোমের জিনিসপত্র আছে।যেগুলো আর এই বাড়িতে রাখতে চায় না নভ।

মোম ছিমছাম একটা থ্রিপিস পড়ে নিলো।চুল ঠিক করছে আয়নার সামনে দাড়িয়ে। নভ ব্যাগ নিয়ে বললো..

“আমি বেরোচ্ছি মোম।তুমি এসো।আর হ্যা,,সাবধানে। ”

মোম সায় জানালো।,,,মোম প্রায় রেডিই।,,চুলে একটা বেনি করে বেনিতে রিবন বাধতেই খেয়াল করলো আয়নায় কারোর অবয়ব দেখা যাচ্ছে। দ্রুত পেছনে ফিরলো মোম,,,একিহ,আবিদ??এখানে কেন?মোম দু তিন বার চোখের পলক ফেলে বললো…

“আ্ আবিদ ভাইয়া??ত্ তুমি এখানে??”

বেশ বিদ্ধস্ত লাগছে আবিদকে।গতকালের সেই ঘটনার পর থেকে আর দেখা মিলেনি আবিদের।,,,,এই এখন এলো,,,

এলোমেলো দৃষ্টি ফেললো ফ্লোরে। থেমে থেমে বললো…

“ত্ তুই,,,,তুই চলে যাচ্ছিস মোম??”

মোম বুঝতে পারলো না কি উত্তর দিবে,,,আমতা আমতা করতে লাগলো…

হঠাৎ আবিদ এগিয়ে এসে ঝাপটে ধরলো মোমের দুই বাহু,,,দ্রুত কন্ঠে বললো…

“তুই,,, তুই যাস না মোম,,,যাস না তুই।তুই আমার কাছে থেকে যা।আ্ আআ আমি কথা দিচ্ছি তোকে,,আর বাজে কথা বলবো না তোকে,,ত্ তোর অসুস্থতা নিয়ে৷ আর কখনো কিছু বলবো না।প্লিজ মোম,,যাসনা তুই..”

চমকে উঠলো মোম,,ব্যস্ত হয়ে নিজেকে ছাড়াতে লাগলো আবিদের হাত থেকে..

“কি করছো কি আবিদ ভাইয়া,,ছাড়ো,,ছাড়ো তুমি আমাকে।”

আবিদ যেন পাগলের মতো আচরণ করতে লাগলো। ছাড়ার বদলে আরো আটকাতে লাগলো মোমকে…

“নাহ,,ছাড়বো না,,আমি তোকে ভালোবাসি মোম,,।আ্ আগের মতো।আমাকে ক্ষমা করে দে মোম৷ আমি ভুল করেছি তোকে ইগ্নোর করে,,,প্লিজ মোম,তুই আমার কাছে থেকে যা।প্লিজ মোম,যাস না।আ্ আমি তোকে ঐ,, ঐ নভের চেয়েও বেশি সুখ দেবো৷ প্লিজ মোম,থেকে যা আমার কাছে।”.

কথা গুলো যেন বিষের মতো ঠেকলো মোমের কাছে।আর নিতে পারছে না যেন।ঝটকা মেরে ছাড়িয়ে নিলো নিজেকে।

” আমি এখন আমার নভের স্ত্রী। আর ও আমাকে ভালোবাসে,,নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে আমায় বুঝেছো??,,তোমার মতো নয় যে আমার অসুস্থতার কথা শুনেই নিজের ভালোবাসাকে ছেড়ে দিবে।অন্য মেয়ে নিয়ে ঘুরবে।,,,আমার নভ এমন নয়,।।সে আগে আমাকে যতটা ভালোবাসতো আমার অসুস্থতার কথা শুনে আরো বেশি ভালোবাসে আমাকে।চোখে আড়াল হতে দেয় না সে আমায়।আমি তার প্রাণ এখন।বুঝেছো??”

কন্ঠে বেশ জোর নিয়ে কথাগুলো বললো মোম।,,,তার এই জোড়ালো কথা গুলোই যেন তীরের মতো বিধলো আবিদের বুকে।ধ্যান হারালো।কাতর চোখে তাকালো মোমের মুখ পানে,,,বললো….

“ত্ তুই তো আমায় ভালোবাসিস মোম,ফিরে আয় না আমার কাছে??আমি আগলে রাখবো তোকে..।ত্ তুই তো ঐ নভ কে ভালোবাসিস না মোম,,..”

মোম শান্ত হলো,,,শীতল কন্ঠে জবাব দিলো…

“আমি আমার নভকে ভালোবাসি।খুব খুব খুব ভালোবাসি ওকে।”

আবিদ মানতে নারাজ।দ্রুত দুপাশে মাথা নাড়িয়ে বললো..

“না না না,,তুই আমায় ভালোবাসিস,,,তুই তো আমায় ভালোবাসিস শুধু।তুই শুধু আমায় ভালোবাসিস”.

শ্বাস দ্রুত গতিতে উঠা নামা করছে মোমের।চেচিয়ে বললো…

” আমি তোমাকে ভালোবাসি না।বাসি না ভালো তোমাকে।আমি শুধু নভকে ভালোবাসি।আমার নভকে ভালোবাসি।”

থমকে গেলো আবিদ।জীবনে ভাবনাতীত ছিলো,যে মোম কোনোদিন বলবে যে মোম তাকে ভালোবাসে না।যেই মেয়ে সারাক্ষণ কানের কাছে ভালোবাসি ভালোবাসি বলে ভনভন করতো,সেই মেয়েই বলছে কিনা তাকে ভালোবাসে না??

মোম নিঃশ্বাস ফেলছে ঘনঘন।নিচ থেকে মুখ তুলে তাকালো আবিদের দিকে,,,শান্ত কন্ঠে বললো..

“শুনেছো তুমি??আমি তোমাকে ভালোবাসি না।অস্বীকার করবো না,আগে বাসতাম ভালো তোমাকে।অনেক ভালোবাসতাম।তবে সময়ের সাথে সাথে উভে গেছে তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা।তুমি আটকে রাখতে পারোনি আমায়,,তুমি বাধ্য করেছো তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা কমিয়ে নিতে??আমি নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করেছি,মরতে মরতে টিকে আছি,তুমি সঙ্গ দাও নি,,দুরে ঠেলে দিয়েছো আমায়।আমি যত নিজেকে শক্ত রাখতে চাইতাম,তুমি আরো আমায় ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছো তোমার ধারালো কথা দিয়ে।সেই গুরো হওয়া মোমকেই আবার জোড়া লাগিয়েছে আমার নভ।এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছে এই জোড়া দেওয়া মোমের গায়ে যে দাগ গুলো আছে,সেগুলো মুছে নিতে।আগের আমিকে ফিরিয়ে দিতে চেষ্টা করে যাচ্ছে নভ।,,”

আবিদ কাতর কন্ঠে ডেকে উঠলো…

“মোম!!!”

“না আবিদ ভাইয়া,,তুমি আমায় আর ডাকবে না। আর নিজের মিথ্যা ভালোবাসার দাবি নিয়ে আসবে না তুমি।এখন তো আমার মনে হচ্ছে তুমি কোনোদিন আমায় ভালোই বাসোনি।,,কি করে পারলে বলো তো??এতোগুলো দিন ভালোবাসার অভিনয় করতে??হয়রান হওনি তুমি??”

আবিদ কাদছে।নীরবে কাদছে।আজ মোমের প্রশ্ন গুলোর উত্তর নেই তার কাছে।কোনো উত্তর নেই,,শুধু এই টুকুই বললো..

“আমি অভিনয় করিনি মোম।একটুও অভিনয় করিনি”

মোম ধীরে এক পা এগিয়ে এলো আবিদের কাছে।আবিদের চোখে চোখ রেখে বললো..

“তোমার আর নভের মধ্যে পার্থক্য কি জানো তো আবিদ ভাইয়া??”

আবিদ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো..

“আমার যেই অপারগতার কথা শুনে তুমি অন্য মেয়ের সঙ্গ নিয়েছো??ঠিক সেই অপারগতার কথা শুনেই আমার নভ হাজার মেয়ের সঙ্গ ত্যাগ করেছে।শুধু মাত্র আমার আঁধার জীবনে তারাবাজি জ্বালানোর জন্য। ”

থামলো মোম,,,আবিদও মাথা নোয়ালো।মোমের বলা প্রতিটি কথাই যে সত্য।,,,,

নীরবতা ভেদ করে মোম বললো…

“আসছি,,,ভালো থেকো আমায় ছাড়া।”

বলেই দ্রুত পায়ে রুম ছাড়লো মোম।
এদিকে শান্ত আবিদ আবার অশান্ত হয়ে উঠলো,,,বারবার করে বলতে লাগলো..

“যাস না মোম,,আমায় ছেড়ে যাস না।ফিরে আয় তুই আমার কাছে।আমার ভালোবাসা মিথ্যা ছিলো না মোম,,আমার ভালোবাসা একটুও মিথ্যা ছিলো না,শুধু একটা মাত্র ভুল পদক্ষেপ নেওয়ার অপরাধে তুই আমায় এতো বড় শাস্তি দিস না মোম।যাস না আমায় ছেড়ে, আমি সব ভুল শুধরে নেবো।প্লিজ ফিরে আয়।”

শুনলো না মোম,একটিবার পেছন ফিরে তাকালোও না।কাদতে কাদতে হাটু ভেঙে ফ্লোরে বসে পরলো আবিদ।বিদ্ধস্ত লাগছে তাকে,,ভীষণ বিদ্ধস্ত।প্রিয় হারানোর বিস্বাদ ছেয়ে গেছে পুরো অন্তর জুড়ে তার।নিজের করা কাজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে খুব।কেন সে মোমের অসুস্থতার কথা শুনে দুরে ঠেলে দিয়েছিলো মোমকে?কেন একটি বার নিজের মনের কথা শুনে ভালোবাসার অধিকার নিয়ে মোমকে শান্তনা দিলো না?কেন, মোমের সাপোর্টিভ পার্টনার হতে পারলো না সে??কেন,,কেন,,কেন?,,

“চোখের সামনে থাকায় তোর বিস্বাদ বুঝিনি আমি।যবে থেকে দুরে গেলি?তবে থেকেই তোর অনুপস্থিতি কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে আমাকে।এমন ভাবে গেলি,আর আমাকে ভুলটা স্বীকার করার সুযোগ দিলি না মোম??আমাকে একটিবার তোর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিজের ভালোবাসা জয় করতে দিলিনা তুই??আমার দোষের পরিমান কি এতোটাই ভারী ছিলো যে তুই পারলি না ক্ষমা করতে??কতটা ছিলো সেই ভারী দোষ?কতটা??,,”

আবিদ পারছে না আর এই অপরুপ সত্যিটা মানতে,।”মোম দুনিয়া থেকে চলে যাবে”,,এই সত্যের চেয়েও যেন বিষাক্ত সত্য ঠেকলো যে “মোম তার নয়,অন্য কারোর হবে”,, মোম তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখবে,তার সাথে হাসি ঠাট্টায় মসগুল থাকবে,তার ছোঁয়ায় মোমের ফর্সা গাল দুটো রাঙা হবে,তার সাথে মধুর রাত্রী যাপন…..

নাহ,,না না না,,আর ভাবতে পারলো না আবিদ,,,চোখ খিচে বন্ধ করে ফেললো। তার মোম এখন অন্য কারোর,,,আজীবনের জন্য অন্য কারোর,,,তার দোষে মোম আজ তার নয়,,,তার দোষে,,, তারই দোষে।,,,

চিৎকারের দামামা যেন শীতল হলো।কানের পর্দায় শো শো করে আওয়াজ বয়ে গেলো আবিদের।হুট করেই অন্তর যেন সেই শো শো শব্দ ভেদ করে ভৌতিক স্বরে গেয়ে উঠলো…

“”” সময় গেলে সাধন,,,হবে না””””

——–
নভের বক্ষ পিঞ্জরে মাথা গুজে কিছুক্ষণ আগের আবিদের কথাই ভাবছে মোম।ভাবছে আর মাথার যন্ত্রণা বাড়াচ্ছে। না পারছে ভাবনা থামাতে,আর না পারছে মাথার যন্ত্রণা কমাতে,সে যেন ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে।

তবুও নিজের মাথাটা চেপে আছে নভের বুকেই।তখন গাড়িতে উঠার সাথে সাথেই যে মোম এভাবে নভকে জড়িয়ে ধরলো, আর ছাড়েনি।বার বার কানে বাজছিলো আবিদের ঐ কথাটি “আমি তোকে নভের চেয়েও সুখে রাখবো”,,… মানতে পারছে না মোম এই কথা।মনে হচ্ছে ছেড়ে দিলেই তার নভ হারিয়ে যাবে।,তাইতো জাপ্টে আছে মোম নভকে।

নভ যে বিরক্ত হচ্ছে এমন কিন্তু নয়।সে তো মহা খুশি,তার জুলিয়েট তাকে নিজে থেকে জড়িয়ে ধরেছে।মাথা রেখেছে তার বুকে।এর থেকে পরম শান্তি,পৃথিবীর আর কিছুতেই আছে কি??নেই,,নভের জন্য নেই।

দুজনের মাঝে কোনো কথা নেই। তবে মন বিনিময় চলছে, নীরবে, নৃভীতে।,,,,,

মোম ভাবছে আজ ঘটে যাওয়া আবিদের কথা,,আর নভ হারাচ্ছে তার মোমের উষ্ণ আলিঙ্গনে।

এভাবেই পার হতে লাগলো সময়,,,সময়ের সাথে সাথে পথও।বেশ কিছুক্ষণ পর হঠাৎ সর্ব নীরবতা ভেঙে মোম নভকে ছেড়ে হালকা চেচিয়ে উঠলো…

” এক মিনিট, এক মিনিট,,,গাড়ি থামান ড্রাইভার চাচা।”

ব্যস।সাথে সাথেই ব্রেক কষলো ড্রাইভার।,, নভ ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো..

“কি হলো মোম,,,কিছু লাগবে??”

তবে মোম উত্তর দিলো না।সে ব্যস্ত হলো তারাহুড়ো করে গাড়ি থেকে নামতে।তাকে এভাবে নামতে দেখে নভ নিজেও নামলো গাড়ি থেকে,,

“মোম আস্তে নামো,,পড়বে তো তুমি,,,,আরে কোথায় যাচ্ছো??দাড়াও…”

কে শোনে কার কথা।মোম ছুটলো সামনে থাকা টি স্টলের দিকে,,,,,,

মোমের যাওয়ার উৎসের দিকে তাকাতেই অবাক হলো নভ।মোম ওকে দেখে এভাবে ছুটছে??,,নভের মুখ থেকে আপনা আপনিই অস্পষ্ট স্বরে বেরিয়ে এলো…

“জিমান??”

++++চলবে++++

[অনেকেই প্রশ্ন করছে আবিদ চরিত্রটা নিয়ে।সত্যি বলতে মাঝে মাঝে এমন কিছু ভুল মানুষকে কাদায়,,সে সত্যিই ভালোবেসেছে মোমকে।তবে নিজের দোষেই হারায়,,কিছু কিছু সম্পর্ক না হয়,এমন ভুল থেকেই ভেঙে গেলো।I wish,আমার সেও একদিন আবিদের মতো অনুভব করুক,আমি তার জীবনে কী ছিলাম।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here