#আঁধারের_তারাবাজি
#অভ্রায়ীনি_ঐশি
#পর্ব_৩২
তবে মোম উত্তর দিলো না।সে ব্যস্ত হলো তারাহুড়ো করে গাড়ি থেকে নামতে।তাকে এভাবে নামতে দেখে নভও নামলো গাড়ি থেকে।দেখলো মোম পাশে থাকা একটা দোকানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়েই নভ বলে উঠলো..
“জিমান??” মোম জিমানকে দেখে এভাবে ছুটলো??”
আর ভাবলো না নভ।নিজেও এগিয়ে গেলো মোমের কাছে।জিমান সামনে তাকিয়ে ছিলো।পেছন থেকে কারোর মুখে নিজের নাম শুনে ফিরে তাকালো সে।মোম আর নভকে একত্রে দেখে একটু বিষম খেলো। তবে পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিলো,,,স্বাভাবিক কন্ঠে বললো..
” মৌচাক??তুমি??”
মোমের মুখমন্ডল কঠিন রুপ ধারন করছে,, কাঠিন্যতা বজায় রেখেই একটু হাসলো..
“ভালো আছো?”
অবাক হলো জিমান।মৌচাক এতোটা স্বাভাবিক আছে??,,নিজেকে ধাতস্থ করে বললো..
“আছি।ত্ তুমি ভালো আছো?”
মৃদু হাসলো মোম।তবে উত্তর দিলো না।পাল্টা প্রশ্ন করলো..
“ঐ দিন এমনটা কেন করলে তুমি?”
থমকালো জিমান,কি উত্তর দিবে এখন??,,চুপ রইলো সে..
মোম আবারও বললো..
“তুমি তো আমার অসুস্থতা নিয়ে সবই জানতে।তাহলে আগে কেন না করোনি তুমি??কেন বিয়ের দিন আমাদের পরিবারের এতো বড় অসম্মান করলে তুমি??”
মাথা ঝুকালো জিমান,,
মোম নিজের মাথাটা একটু চেপে ধরলো,তা দেখে নভ চিন্তিত হলো।মোমকে ধরে বললো…
“মোম,আর ইউ ওকেয়??কষ্ট হচ্ছে তোমার??”
মোম হাতে বাধা দিয়ে বললো..
“আমি ঠিক আছি।”
বলেই আবার জিমানের দিকে তাকালো..
“কি হলো বলো??কেন করলে এমন টা?”
জিমান একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। বলতে শুরু করলো..
“আমি তোমার প্রতি দুর্বল ছিলাম মোম।আমার পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়েও আমি তোমাকে বিয়ে করবো বলেছি।সব ঠিক ঠাক ছিলো।হলুদও হলো আগের দিন।তবে তুমি হয়তো জানো না,হলুদ শেষে বেশ রাত করে তোমার চাচাতো ভাই আবিদ,আমাদের বাড়ি এসেছিলো।জানি না কেন,,,আমাকে অনেক মেরেছে সেদিন।তখন সে জানিয়েছে তোমার ব্যপারে।”
ভ্রু কুচকালো মোম,,
“আমার ব্যপারে??আমার ব্যপারে সবটাই তুমি জানতে।আর কি জানালো সে?”
জিমানের কন্ঠে জোর এলো,,বললো..
“আমাকে তুমি সবটা বলোনি মোম।তুমি একটা চিটার…”
একথা শুনেই তেতে উঠলো নব,,,তেড়ে এসে বললো..
“হেই,,,আমার মোমকে নিয়ে একটাও বাজে কথা বলবে না, মুখ ভেঙে দেবো,বলে রাখলাম।”
মোম নভকে আটকে বললো..
“প্লিজ,আপনি মাথা ঠান্ডা করুন,,ও কি বলে শুনতে দিন,।”
বলেই আবার জিমানের দিকে তাকালো..
“কি চিট করেছি আমি তোমার সাথে??আবিদ ভাইয়া কি বলেছে তোমায়??”
জিমান তীব্র ঘৃণার সাথে বললো..
“তোমার সাথে আবিদের ভালোবাসার সম্পর্ক ছিলো না??”
মোম স্বাভাবিক ভাবেই বললো..
” সেটা তোমাকে আমি আরো আগেই জানিয়েছি জিমান।”
“হ্যা,জানিয়েছো।কিন্তু তুমি কি এটা জানিয়েছো?যে তুমি ভার্জিন না??ঐ আবিদের সাথে তোমার মধুময় রাত্রি জাপন হয়েছে?”
কথাটায় যেন বাজ ফেললো মোমের মাথায়।কি শুনলো এটা??মাথাটা কেমন চক্কর দিয়ে উঠলো।পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলো সে।,,,,অবাক চোখে নভের দিকে তাকিয়ে দেখলো নভও তার দিকেই অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে।,,,
এটা দেখে চোখ থেকে আপনাআপনি জল গড়িয়ে পড়লো মোমের,,তার রোমিও তাকে বিশ্বাস করছে না??
নভের দিকে তাকিয়েই মোম মাথা নাড়িয়ে বললো…
“এ্ এটা স্ সত্যি নয়,,,ব্ বিশ্বাস করুন।আমার চ্ চরিত্রে দাগ ল্ লাগেনি।”
বলতে বলতেই ঢলে পড়লো মোম,,,নভ বেশ দ্রুত গতিতে তাকে আগলে ধরলো নিজের বুকে।
জ্ঞান হারালো মোম,কয়েকবার ডেকেও জাগাতে পারলো না নভ তাকে।,, এরপর নভ জিমানের দিকে তাকিয়ে বললো…
“তোমাকে ভুল বোঝানো হয়েছে।আমার মোম এখনো ভার্জিন।এটা আর কেউ না হোক,আমি বিশ্বাস করি।পৃথিবীর সবাই এসে বললেও আমি বিশ্বাস করবো না যে আমার মোম ঐ আবিদের সঙ্গে……। যাই হোক,থ্যাংকস টু ইউ।কারন,তুমি যদি ঐ দিন মোমকে বিয়ে করতে নারাজ না হতে, তাহলে আজ মোম আমার বউ হতো না।,,আআর,ঐ আবিদকে তো আমি পরে দেখে নিচ্ছি…। ”
আর থামলো না নভ।পাজা কোলে তুলে নিলো মোমকে। গাড়িতে উঠেই মোমকে ডাকতে লাগলো,,,আলতো করে মোমের গালে চাপর দিলো,তবে লাভ হলো না।,,,একটু পরেই নভ খেয়াল করলো মোমের নাক বেয়ে চিকন রক্তের স্রোত বেয়ে আসছে।একে একে কান থেকে,আর মুখ থেকেও।
দিক বিদিক হারিয়ে ফেললো নভ।,,,জোরে জোরে ডাকতে লাগলো মোমকে..
“মোম,,,এই মোম,,চোখ খুলো??এই কষ্ট হচ্ছে তোমার???উঠো না জুলিয়েট??এই,,উঠো,,চোখ খুলছো না কেন??”
তাকালো না মোম,,না খুললো চোখ,অসার হয়ে পড়ে রইলো তার নভের কোলে,,নভ তাড়া দিয়ে ড্রাইভারকে বললো গাড়ি হসপিটালের দিকে নিয়ে যেতে,,,,,,,
——-
“সরি মি. রায়ানিশ।সি ইজ নো মোর।”
অপারেশন থ্রিয়েটার থেকে বেরিয়ে ডাক্তার যখন এই কথাটি বললো,মুহুর্তেই আত্মা কেপে উঠলো নভের।আশপাশের আর কোনো শব্দ কানে যেন পৌছালো না।শোশো শব্দে কিছু একটা উড়ছে।কি এটা???মোমের প্রান পাখি??
না, না,,,এটা মোমের প্রান পাখি নয়।মোের প্রান পাখি তো নভের দেখার কথা নয়।তার আগেই তো নভের প্রান পাখি উড়ে যাওয়ার কথা।,,,তাহলে কি এটা???
ঐ তো মোম,,,এই তো নভের সামনে দাড়িয়ে কিটকিটিয়ে হাসছে।কি মিষ্টি সেই হাসি।হাসির শব্দ,,। নভ চিন্তা করলো…আগে মোম এভাবে কখনো হেসেছে??
কই মনে পড়ছে না তো??এটাই প্রথম।,,নভ আবার মুগ্ধ দৃষ্টি দিলো তার মোমেতে।,,
আরেহ…এটা তো ঐ হলুদ শাড়িটা,যেই শাড়িতে নভ প্রথম তার জুলিয়েটকে দেখেছিলো??,,,একিহ!!মোমের চুল না ঘাড়ের একটু নিচে পর্যন্ত কেটে দিয়েছিলো নভ??কিছুক্ষণ আগেও তো অতটুকুই ছিলো।তাহলে এখন আবার সেই চুল হাটু ছাড়ালো কি করে, সেই প্রথম দিনের মতো?
চুলগুলোতো উড়ছে,শাড়ির আঁচল টাও উড়ছে মোমের।কিন্তু হাওয়া কোথায়??
নভ এদিক ওদিক তাকালো,জানালা গুলো তো থাই গ্লাস দিয়ে বন্ধ। তার কাছেও তো হাওয়া লাগছে না।তাহলে মোমের চুল কিকরে উড়ছে????
কিটকিটিয়ে হাসির শব্দের সাথে ভেসে এলো নুপুরের ঝুমঝুম শব্দ আর কাচের চুড়ির রিনঝিন শব্দ। মোম একপা একপা করে পেছনে যেতে লাগলো।আরে??পেছনে তো অপারেশন থ্রিয়েটার।মোম সেখানে কেন যাচ্ছে? তার নভ তো তার সামনেই…
নভ উত্তেজিত হলো,,,নিঃশ্বাস দ্রুত গতিতে ফেলতে লাগলো,,,, চিৎকার দিয়ে ডাকলো..
“মোম???কোথায় যাচ্ছো মোম??তোমার রোমিও এখানে,তোমার সামনে।ওদিকে যায় না মোম, আমার কাছে এসো,,,আমার কাছে এসো,,, মোমমমমম!!!”
বলেই কোলে থাকা হুডিটা ছুড়ে ফেলে ছুটলো অপারেশন থ্রিয়েটারের দিকে,শুধু তার মোমের কাছে।
—-
এদিকে এতোক্ষণ নভকে এমন স্তব্ধ হয়ে থাকতে দেখে নিশান,ইশু,লিজা মিলে ডাকছিলো তাকে।ধাক্কাও দিয়েছে কয়েকবার,তবে নভের কোনো নড়চড় হলো না সে তাকিয়েই রইলো অপারেশন থ্রিয়েটারের দিকে।একটু পর পর হাসছিলো,আবার অবাক হচ্ছিলো,ভ্রু কুচকাচ্ছিলো।হঠাৎ এমন উত্তেজিত হয়ে মোম মো করতে করতে ছুট লাগালো কেন,কেউই বুঝলো না।,,
হাউমাউ করে কাদতে কাদতে জ্ঞান হাড়ালো আতিয়া। ঢলে পড়লো রুবির কোলে,হঠাৎ রুবি সামলাতে না পাড়ায় আতিয়া সহ পড়তে নিলেই ধরে নিলো আখি,,,।এরপর রুবি ও আখি মিলে কয়েকজন নার্সের সাহায্যে আতিয়াকে একটা কেবিনে নিয়ে গেলো।
জয়নাল স্তব্ধ হয়ে বসে আছে।তার মোমমা আর নেই।তার ফুলের মতো মেয়েটা আর নেই।আর কখনো তার মেয়ে ঐ মধুর কন্ঠে তাকে আব্বু বলে টেনে টেনে ডাকবে না।,,আর ভাবতে পারলো না জয়নাল।ফুঁপিয়ে কেদে উঠলো,,,অবন আর জহির এগিয়ে এসে ধরলো তাকে।তাদের চোখের জল।এই কয়েকদিনেই মোম যে তাদের আপন হয়ে উঠেছে।আর দেখতে পারবে না মোমকে??,,
নোভা মাত্রই সিড়ি বেয়ে উঠে এলো হসপিটালের তৃতীয় তলায়।একটু আগেই খবর পেয়ে ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে এলো সে।,,,এখানে এসেই তার কিউটিপাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনে থমকে গেলো সে।এলোমেলো দৃষ্টি ফেললো ফ্লোরে। বিরবির করে আওড়ালো…
“আমার কিউটিপাই,,আ্ আর নেই!!!”
বেশি কিছু চিন্তা করতে পারলো না।তার আগেই কানে ভেসে এলো কলিজার বোন হারিয়ে ফেলা এক অভাগা ভাইয়ের আর্তনাদ।।।শব্দের উৎস খুজতেই এদিক ওদিক তাকালো সে।সামনে দিয়ে ডান কোনো ফ্লোরে বসে থাকা মোয়ানকে দেখে থমকালো নোভা।,,একি অবস্থা ছেলেটার??গম্ভীর,গোমড়ামুখো,বোকাসোকা ছেলেটা এভাবে কাদছে?,,,
কাধ থেকে ব্যাগটা লুটিয়ে পড়ে গেলো নোভার।,,,মোয়ানের চিৎকার করে বলা কথাগুলো তার ভেতরটা পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে…
“এটা তুমি কি করলে আল্লাহ???আমার কলিজাটা কেন ছিড়ে নিলে তুমি???কেন এতো চেষ্টার পড়েও আর কটাদিন সময় দিলে না তুমি???তুমি এতো নিষ্ঠুর কি করে হলে???আমার দোয়াটা কবুল করতে পারলে না??আমার বোনিটাকে নিয়ে নিলে??আ্ আমি কি করে বাচবো????””
একবার ফ্লোরে বারি মারছে,আবার দেওয়ালে নিজের মাথা ঠুকছে।নিজের চুল নিজে টানছে মোয়ান, তো আবার নিজের বুকে নিজেই ধুমধুম করে কিল বসাচ্ছে। তবুও কমছে না অন্তরের যন্ত্রণা, বোনি হারানোর যন্ত্রণা যে কখনোই কমবে না তা জানে মোয়ান।তবুও নিজেকে মিথ্যা শান্তনা দিতে এসব পাগলামি করছে সে।আর কি করার আছে তার??
নোভা ছুটে এলো মোয়ানের কাছে।দেওয়ালে মাথা ঠুকতে থাকা মোয়ানকে অনেক কষ্টে থামিয়ে নিলো।নিজের সর্বশক্তি দিয়ে ঝাপটে ধরলো তাকে।নিজেও বসে পড়লো এলোমেলোভাবে মোয়ানের সামনে।মোয়ানকে এমন ভাবে ঝাপটে ধরলো যে মোয়ান আর হাত পা ছোড়াছুড়ি করতে পারছে না,,,,নোভা কাদতে কাদতেই মোয়ানকে সামলে বললো…
“কি,করছেন কি আপনি।এমন পাগলামি কেন করছেন?নিজেকে সামলান একটু।”
মোয়ান আর ছোড়াছুড়ি না করতে পেড়ে ঢলে পড়লো নোভার বুকে।এটা কে বা কাহারা,তা দেখার বা বোঝার মতো অবস্থা নেই মোয়ানের।নোভার শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরলো মোয়ানকে।,,নোভাকে জড়িয়েই হাউমাউ করে কাদতে কাদতে বললো মোয়ান…..
“আল্লাহ আমার বোনি কে কেড়ে নিয়েছে অভয়া,,,আমার কলিজটা ছিড়ে নিয়ে নিলো,,আমার কলিজা ছাড়া আমি কি করে থাকবো,,,”
“প্লিজ,, আপনি নিজেকে একটু সামলান।এমন পাগলামি করবেন না।”
কে শোনে কার কথা।মোয়ান নিজের মতোই কাদতে লাগলো. .
“আমার বোনি,,আমার কলিজার টুকরো। আমি কি করে থাকবো ওকে না দেখে??আমার বোনিটা আর কোনোদিন আমায় ডাকবে না,,,,শখ করে আমাকে আর তোতা আনতে বলবে না??ঝগড়ার পরে আমার থেকে সরি হিসেবে আরেকটা টেডি চাইবে না???ওর দুষ্টামি, ওর হাসি মাখা মোমের মতো মুখটা না দেখে আমি কি করে থাকবো??আমার বোনিকে বাচিয়ে দাও তোমরা,,,আমার কাছে এনে দাও আমার বোনিটারে,,এনে দেও না???”
।এতোক্ষণ যার চিৎকারে কেপে কেপে উঠছিলো পুরো হসপিটাল,সেই ছেলোই এখন শান্ত,গুটিসুটি হয়ে পড়ে রইলো নোভার বুকে।,থেকে থেকে ফোঁপানির আওয়াজ আসছে।কাঁপছে মোয়ানের পুরো শরীর।যা নোভা খুব সহজেই উপলব্ধি করতে পারছে।,,,, সে নিজেও কাঁদছে।তবে মোয়ানের কান্নার কাছে তারটা কিছুই না।,ভাবলো নোভা…
“অবশেষে আরো কতগুলো মানুষের প্রিয় একটা মুখ বিদায় নিলো পৃথিবী থেকে। সবাই কি করে নিজেদের সামলাবে??আচ্ছা?আমার ভাইয়া??নভ ভাইয়া কোথায়?ও সইতে পারবে তো,নিজের ভালোবাসা হারানোর কঠিন যন্ত্রণাটা??”
++++চলবে++++