এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️ #লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️ — পর্বঃ২৫

0
374

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ২৫

বেশ বিস্মিত নজরে তাকিয়ে আছে ফারিশ আদ্রিতার দিকে। এই মুহূর্তে কোনোভাবেই আদ্রিতার উপস্থিতি আশা করে নি সে। ফারিশ বার কয়েক পলক ফেললো সত্যি দেখছে নাকি। আদ্রিতা জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলছে প্রতিনিয়ত। তার বুক কাঁপছে। এভাবে আচমকা, দৌড়ে ছাঁদে ছুটে আসতে তার খুব কষ্ট হয়েছে কিন্তু ফাইনালি আসতে তো পারলো। আদ্রিতা জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলতে ফেলতেই খুঁড়িয়ে হেঁটে এগিয়ে আসতে লাগলো ফারিশের দিকে। ফারিশের ঘোর তখনও কাটে নি। আদিব ফারিশের কাঁধে হাত রাখলো। মৃদু হেসে বললো,“সময়টা আপনার ভালো কাটুক ভাই।”

আদিব চলে গেল। ফারিশ তার কথাটা শুনতে পেয়েও জবাবে কিছু বলতে পারলো না। তার মানে এটাও আদিবের কাজ। আদিব যাওয়ার পথে আদ্রিতার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেঁসে এতটুকু বলে শুধু,“থ্যাংক ইউ।”

বিনিময়ে মৃদু হাসে আদ্রিতা। আদিব ছাঁদ থেকে বেরিয়ে গেল। তবে শুধু ছাঁদ নয় সে বাড়ি থেকেই বেরিয়ে গেল। আদ্রিতা ফারিশের দিকে এগিয়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়ালো। শীতল স্বরে বললো,
“অবাকটা কি খুব হয়েছেন?”

ফারিশের হুস আসে। তাও থতমত খেয়ে বলে,“খুবের চেয়েও বেশি।”

মৃদু হাসে আদ্রিতা। নিজের হাত ঘড়িটার টাইমটা দেখে বলে,“আমার কাছে খুব বেশি সময় নেই। আসুন খাওয়া দাওয়া শুরু করি।”

ফারিশ নিস্তব্ধ পায়ে এগিয়ে গেল টেবিলের কাছে। ফারিশের হাত ধরে আদ্রিতা। বসিয়ে দিলো চেয়ারে। ফারিশের নির্বিকার চাহনি তখন। আদ্রিতা নিজ চেয়ারে বসে বলে,“আজ আপনার জন্মদিন আমায় আগে বলেন নি কেন?”

ফারিশ স্বাভাবিক হলো। সরু চোখে আদ্রিতার পানে তাকিয়ে বললো,
“আগে বললে কি হতো?”
“আপনার জন্য গিফট নিয়ে আসতাম।”

ফারিশ আচমকা হেঁসে ওঠে। বলে,
“জন্মদিনে গিফটও দিতে হয় জানতাম না তো।”

আদ্রিতা বেশ অবাক হয়। বলে,
“এ কেমন কথা। জন্মদিনে গিফটই তো আসল।”

ফারিশের তড়িৎ উত্তর,
“না গিফট আসল নয়। আপনি যে এসেছেন এটাই আসল।”

আদ্রিতা কি বলবে বুঝতে পারছে না। ফারিশ আদ্রিতার প্লেটে পোলাও, মুরগীর রোস্ট দিলো। বললো,“এগুলো সব আদিব রান্না করেছে খেয়ে দেখুন তো।”

আদ্রিতা যেন এবার আরো অবাক হলো। আদিব রান্না করেছে। বিষয়টা দারুণ তো। আদ্রিতা ফারিশের প্লেটে খাবার দিলো। উৎসাহ নিয়ে বললো,
“আপনার জন্মদিন আপনি আগে খান।”

ফারিশ খাবার নাড়াতে নাড়াতে বেশ স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,“সত্যি বলতে আজ আমার জন্মদিন নয়।”

আদ্রিতা যেন বিস্মিত হলো। চোখ মুখের ভঙ্গি গেল পাল্টে। এই ফারিশ বলে কি! আদ্রিতা বিস্মিত কণ্ঠেই বললো,“মানে।”

ফারিশ পোলাও মুখে দিলো। চোখ বুজে বললো,“উম্ দারুণ হয়েছে। এই ছেলেটার রান্নার হাত এত সুন্দর কেন কে জানে!”

আদ্রিতাও মুখে পোলাও দিল। খেতে সত্যি দারুণ হয়েছে। আদ্রিতা বিচলিত কন্ঠে বললো,“মানেটার উত্তর কিন্তু দিলেন না।”

ফারিশের চোখমুখ বেশ শান্ত। হাবভাবও স্বাভাবিক। সে বললো,“আসলে আমার জন্মদিন কবে এটা আমি নিজেও জানি না। আমার বাবা মা কে তাও জানি না। আজকের এই দিনটায় আমার সাথে আদিবের প্রথম দেখা হয়েছিল। বয়স তখন বড়জোর পাঁচবছর হবে। ছেলেটা এইদিনটাকে আমার জন্মদিন ভেবে সেলিব্রেট করে। ওর নাকি এই দিনটা খুব প্রিয়। আর কিছু না।”

আদ্রিতা যেন মুগ্ধ না হয়ে পারলো না। এই আদিব ফারিশকে কতটা ভালোবাসে তা যেন আজকের দিনটাই জলজ্যান্ত প্রমাণ। চাঁদনীর সাথে আদিবের মিলটা হলে বেশ হবে। চাঁদনী নিশ্চয়ই খুব সুখী হবে। আদ্রিতার ভাবনার মাঝেই ফারিশ বললো,
“ঘৃণা আসলো কি আমার উপর?”

তড়িৎ চমকে উঠলো আদ্রিতা। কথার অর্থ না বুঝে বললো,
“হঠাৎ ঘৃণা আসবে কেন?”
“কেন আবার আমার বাবা মা কে বা কারা জানা যে নেই।”
“এসবে আমার ঘৃণা আসার কোনো কারণ দেখি না।”
“সত্যি কি দেখছেন না নাকি দেখতে চাইছেন না।”
“আপনি যেটা মনে করেন।”

ফারিশ চুপ করে রইলো। মুরগীর রোস্টটা মুখে চিবোতে চিবোতে বললো,“এক ইমাম ছিলেন রংপুরে তার বাড়ি। তিনি যে মসজিদের ইমাম ছিলেন সেই মসজিদেই কে যেন আমায় রেখে যায়। তারপর উনি লালন পালন করেন। নাম দেন ফারিশ মাহামুদ। সেই থেকেই আমি ফারিশ মাহমুদ।”

আদ্রিতা ফারিশের সব কথাটুকু মন দিয়ে শুনলো। তার মনে কিছু প্রশ্ন জাগলো যেমন রংপুর থাকলে ফারিশ ঢাকা আসলো কি করে, আর সেই ইমামও বা কোথায় আর আদিবের সাথে কিভাবে পরিচয় ফারিশের তাও পাঁচবছর বয়সে। আদ্রিতা প্রশ্নগুলো করার জন্য মুখ খুলতে নিতেই ফারিশ বলে উঠল,“আজ এই পর্যন্তই বাকি কথা অন্য আরেকদিন বলবো।”

আদ্রিতা থেমে গেল। গলায় আসা প্রশ্নগুলো গলাতেই আটকে রইলো। প্রায় আধঘন্টা সময় নিয়ে নিজেদের খাওয়া শেষ করলো আদ্রিতা আর ফারিশ। আদ্রিতার পেট খানিকটা ভরা থাকলেও আদিবের রান্নার স্বাদে খাওয়া যেন থামানোই গেল না।’

সময়টা প্রায় দুপুর সাড়ে তিনটার কাছাকাছি। সূর্যের তীব্র তাপ শূন্যের দিকে। আদ্রিতা ফারিশের সোফা রুমে দাঁড়ানো। তাকে যেতে হবে। পাঁচটায় তার একটা সার্জারীর অপারেশন আছে। দ্রুত হসপিটালে পৌঁছাতে হবে। আদ্রিতা হাত ঘড়িটা আবার দেখলো। ফারিশ আসলো তখন। গায়ে জড়ানো ব্লাক হুডি। চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করতে করতে ছেলেটা নামছে। আদ্রিতা কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো তার পানে। পরক্ষণেই চোখ সরিয়ে লাজুক হাসলো। ফারিশ দেখলো কিছু বললো না। আদ্রিতা শান্ত গলায় প্রশ্ন করলো,
“কোথায় যাবেন?”
“আপনার সাথে।”
“হসপিটাল।”
“হুম।”

আদ্রিতা হাল্কা খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেঁটে চললো বাহিরে। সে গাড়ি আনে নি কোনো। ফারিশ তার একটা লাল গাড়ি বের করে বললো,“চলুন যাই।”

আদ্রিতা দ্বিধাহীন গেল। ফারিশ গাড়িতে বসলো। আদ্রিতাও বসলো। ফারিশ গাড়ির সিটব্লেট লাগাতে লাগাতে বললো,
“আপনার পায়ের ব্যাথা এখনও কমেনি?”
“কমেছে।”
“তবে খুঁড়িয়ে হাঁটছেন যে?”
“অল্প স্বল্প আছে এখনো।”

ফারিশ আর কিছু বললো না। আদ্রিতাও চুপ রইলো। গাড়ি চলছিল সূদূরে। চারপাশ কেমন যেন ঠেকছে আদ্রিতার। তারা কি সত্যিই প্রেমিক প্রেমিকা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।’
—-
নিজের চেম্বারে বসে আছে চাঁদনী। সামনেই তার পেশেন্ট বসা। পেশেন্টটা হলো আদিব। তার নাকি মুখের ডানদিকের মাড়ির দাঁতে ব্যাথা। অথচ চাঁদনী দেখে তেমন কিছুই পেল না। আবার মনেও হলো না ব্যাথা আছে বলে। চাঁদনীর বুক দুরুদুরু করছে। ছেলেটার আচমকা আগমনে সে কিছুটা থমকে গিয়েছিল। পরে অবশ্য নিজেকে সামলেছে। আদিবের ভাবখানা এমন ছিল ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানে না। যেন চাঁদনীর সাথে তার আগে কখনো দেখা হয় নি। চাঁদনী বললো,
“আপনার দাঁতে কি সত্যি ব্যাথা করছে?”

আদিবের নিষ্পলক চাহনি। অস্থির দু’খানা চোখ। সে বললো,“সত্যি করছে?”

চাঁদনী জোরে নিশ্বাস ফেললো। বললো,
“আমি কিছু ব্যাথার ঔষধ লিখে দিচ্ছি আশা করি খেয়ে নিলেই কমে যাবে।”

আদিবের ছোট্ট করে জবাব,“আচ্ছা।”
—-
রাস্তা জুড়ে নীরবতা। গাছের পাতা মাঝে মাঝে হঠাৎ হঠাৎ নড়ছে। বাতাসের আনাগোনা নেই তেমন। বিকেল ছাড়িয়ে প্রকৃতি নিস্তেজ প্রায়। ফারিশ চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছে। আদ্রিতাও চুপচাপ বসা। কথা বলতে চাইছে ঠিকই কিন্তু কি বলবে বুঝছে না। আদ্রিতা অনেক ভেবে চিন্তে প্রশ্ন করলো,
“আপনি কি নামাজ পড়েন ফারিশ?”

ফারিশের দ্রুত জবাব,“না।”
আদ্রিতার বিস্মিত আঁখিজোড়া আরো বিস্মিত হলো। নীরব স্বরে বললো,
“কেন?”
“তার কাছে আমার অনেক অভিযোগ।”
“তো নামাজ পড়ে জানাচ্ছেন না কেন?”
“পাপী মানুষের কথা কি সে শোনেন?”

আদ্রিতা ভড়কালো। বার কয়েক পলক ফেলে বললো,
“তিনি সবার কথা শোনেন।”
“তবুও আমার মনে হয় আমার মতো পাপী মানুষের কথা শোনেন না।”
“কি পাপ করেছেন আপনি?”
“যার জন্মই বোধহয় পাপ দিয়ে সে আর কি বড় পাপ করবে।”

আদ্রিতা হঠাৎ যেন কি হলো। সে উচ্চস্বরে বললো,
“গাড়ি থামান।”

ফারিশ গাড়ি থামালো। আদ্রিতা ফারিশে দিকে ঘুরলো। হাত দুটো ধরলো। খুব শান্ত স্বরে বললো,“শিশুরা যখন জন্ম নেয় তারা নিষ্পাপ হয়। আপনিও নিষ্পাপ। মানুষ বড় হয়ে পাপী হয়। কিন্তু আমার মন বলে আপনি পাপী নন ভালো মানুষ। আমার ভালো মানুষ।”

আদ্রিতার “আমার ভালো মানুষ” কথাটা বুঝি সোজা ফারিশের বুকে গিয়ে বিঁধলো। যন্ত্রণা দিলো খুব। তার বিতৃষ্ণায় ধরিয়ে রাখা কণ্ঠটা বলতে চাইলো,“আপনার মন ভুল বলে ডাক্তার ম্যাডাম। আমি দারুণ পাপী মানুষ। এক হাতে মানুষ বাঁচাই আরেক হাতে মানুষ মারি।”

ঠোঁটের কথা ঠোঁটে রইলো। বলা হয়ে উঠলো না। ফারিশ জোরে নিশ্বাস নিলো। বুকে ব্যাথা উঠেছে তার। কিন্তু আদ্রিতাকে বুঝতে দিলো না তা। আদ্রিতা বললো,“আপনি আজ থেকে নামাজ আদায় করবেন। মাগরিব দিয়ে শুরু করবেন। বুঝেছেন।”

ফারিশ কিছু বলে না। আদ্রিতা বলে,
“কথা দিন রোজ নামাজ আদায় করবেন?”

ফারিশের বুক দুরুদুরু করছে। কণ্ঠস্বর আঁটকে আসছে প্রায়। আদ্রিতা আবার বললো,
“কি হলো কথা দিন?”

ফারিশ বেশ উৎকণ্ঠা নিয়ে বললো,“ঠিক আছে।”
আদ্রিতা খুশি হলো। আচমকা ফারিশকে জড়িয়ে ধরলো। ফারিশ চমকে উঠলো এতে। তার নিশ্বাস বুঝি আঁটকে আসলো। ভাড়ি হলো শরীর। এই প্রথম আদ্রিতা তাকে জড়িয়ে ধরেছে। ফারিশ কি করবে বুঝচ্ছে না। বুকে হাতুড়ি পেটার মতো শব্দ হচ্ছে। অস্থিরতায় চারপাশ যেন কাঁপছে। হৃদয় বার বার জানান দিচ্ছে ‘এবার তুই শেষ ফারিশ,এবার তুই শেষ।’ ফারিশের হাত কাঁপছে তারও কি উচিত আদ্রিতাকে জড়িয়ে ধরা। ফারিশ ধরতে পারলো না। তার হাতখানা আদ্রিতাকে ছুঁতে নারাজ। কেমন অবশ হয়ে আছে। তবুও ফারিশের এই মুহূর্তটা ভালো লাগছে। বলতে ইচ্ছে করছে,“আমায় কখনো ছাড়বেন না ডাক্তার ম্যাডাম। আজীবন ধরে রাখবেন। আমি মানুষটা আপনায় ছাড়তে চাইলেও আপনি কখনো ছাড়বেন না। কখনো না।”

#চলবে….

[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ]

#TanjiL_Mim♥️

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here