মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤ #পর্বসংখ্যা_৪১. #ফাবিয়াহ্_মমো . শেষ অংশ সংখ্যা .

0
192

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৪১.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

শেষ অংশ সংখ্যা .

সৌভিক গলা ফাটিয়ে চিৎকার দেওয়ার পর তার অবস্থা বিমূঢ়! সে চোখের পলকও ফেলতে পারলো না তখন। কি-থেকে-কি হলো কিছুইতেই আন্দাজ করার অবস্থাতে ছিলো না। শুধু ফ্লোরের উপর তরতর করে ছড়িয়ে পরা রক্তের দিকে তাকিয়ে রইলো, কানের মধ্যে পেছন থেকে সকলের হৈহৈ-রইরই চিৎকারে ‘ কথা বল! ওখানে কি হয়েছে সৌভিক? এই সৌভিক? ‘ শুনতে পাচ্ছিলো, কিন্তু অসাড়ে আঁকড়ে থাকা স্তম্ভিত মন কিছুইতেই জবাব দেওয়ার মতো স্থিতিতে ফিরতে পারলো না। পেছন থেকে সবাই ততক্ষণে হুড়মুড়িয়ে ছুটে আসলো রুমে, এরপর সব যেনো শান্ত-চুপচাপ-নিঃশব্দ। যেই হুল্লোড়টা রাতের তিনটে তেইশের দিকে বাড়ি মাতিয়ে উঠেছিলো, সেটার নূন্যতম শব্দ এখন আর অবশিষ্ট নেই। আবছা অন্ধকারে ডুবো-ডুবো রুমটা এখন সাদা লাইটের আলোয় ফকফকা দেখা যাচ্ছে। স্টাডি টেবিলটার মধ্যখানটা হা করা মুখের মতো ফাঁকা, কাঁচের যেই মোটা আস্তরণটা টেবিলের চার পায়ের উপর দাম্ভিকতার সাথে সেঁটে ছিলো, সেটা এখন বিধ্বস্ত হয়ে ফ্লোরে চূর্ণিত। প্রতিটি কাঁচ-টুকরোর সাথে রক্তের ছিঁটেফোঁটা কামড় দিয়ে লেগে আছে, সাদা টাইলসের উপর ঘণ তরল রক্ত। সৌভিক সবার আগে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে রুমের ডানদিকে নজর ঘুরালো। ফ্লোরে বসে জড়সড় অবস্থায় বিছানায় মুখ গুঁজে ভয়কাতুরে প্রাণীটা রীতিমতো ফোঁপাচ্ছে, অন্যদিকে বিছানায় বসে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে শক্ত-কাঠিন্য মুখটা। থরথর করে সমস্ত শরীর রাগের তপ্ত জোয়ারে কাঁপছে তার। বাদামী শার্টের স্লিভদুটো একটানে কনুইয়ে তোলা হয়েছে, কনুইয়ে আজ স্লিভদুটো ভাঁজ করা নেই। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে হাতের চামড়াটা লম্বাটে হয়ে ফালিফালি হতে গেছে, টলটল করে রক্ত বেরিয়ে আসছে তখন, অথচ মানুষটা নির্বিকার ভঙ্গিতে এমন ভাবে বসে আছে যেনো হাতে কোনো পীড়া নেই। মারজা চোখে-মুখে যেনো অন্ধকার দেখলেন কিছুক্ষণ, মনে হচ্ছিলো যেনো গভীর রাতে কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছেন তিনি। মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলে শরীরটা নেতিয়ে পরে উনার, সাথে-সাথে পাশ থেকে ‘ কাকীমা ‘ বলে চিৎকার দিতেই মারজাকে দুহাতে ধরে ফেলে সামিক। মারজার মাথাটা একহাত দিয়ে তার বুকে আগলে ধরে, অন্যহাত দিয়ে মারজার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। রজনী যেনো হতবুদ্ধির মতো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, অনামিকার শান্ত-দৃঢ় দৃষ্টি কেবল গম্ভীর রূপধারী আহত মানুষটার উপর স্থির। নীতির মুখে বাক্য ফুরিয়ে হতভম্ব অবস্থা, প্রীতি কোনো চিন্তাশক্তিতে নেই। তৌফ শুধু ভয় পাচ্ছিলো মাহতিমের চেহারা দেখে, সিয়াম কাঠ-কাঠ দৃষ্টিতে যেন কথা বলার অবস্থা গুলিয়ে ফেলছে। সৌভিক পুরো পরিস্থিতিটা ঠান্ডা করার জন্য শীতল মস্তিষ্কের সাথে সামাল দিলো, মাহতিমের দিকে পাঠিয়ে দিলো তৌফ-সিয়াম-সাবিরকে। মেহনূরের দিকে চোখের ইশারায় পাঠিয়ে দিলো নীতি-প্রীতি-ফারিনকে। দু’দলের ছ’জনই সম্মতির সূচকে একবার মাথা নাড়িয়ে ইশারা বুঝিয়ে দিলো, এরপর দু’দলে বিভক্ত হয়ে দু’দিকে এগিয়ে গেলো তারা। সৌভিক ঠান্ডা মাথায় অনামিকা, রজনী ও সামিকসহ মারজাকে রুম থেকে পাঠিয়ে দিলো। এই মূহুর্তে সবকিছু গুছিয়ে আনা প্রয়োজন, কি হয়েছে সেটা সেটা ঠান্ডা ভাবে জিজ্ঞেস করাই উচিত হবে। নীতিরা ফ্লোরে ঝুঁকে মেহনূরকে ঘিরে উঠার জন্য তোষামোদ করতে থাকে, নীতি ফ্লোরের উপর দু’হাঁটু বসিয়ে বিছানা থেকে মেহনূরের মাথাটা তুলে, আঁচড়ানো চুলগুলো তখন এলোমেলো হয়ে মেহনূরের মুখ ঢেকে ছিলো। প্রীতি পেছন থেকে মেহনূরের চুলগুলো আঁটো করে উঁচু একটা খোপা পাকিয়ে দেয়, ফারিন নিজের স্লিপার-ট্রাউজারের পকেট থেকে টিস্যু বের করে মেহনূরের ভেজা মুখটা মুছে দেয়। নীতি ওর গালে-কপালে-মাথায় বারবার নরম করে হাত বুলিয়ে দেয়, একটু কান্না থামিয়ে শান্ত হতে অনুনয় করে। ফারিন ওইসময় মেহনূরের হাত-পা ও শরীরের উপর ক্ষত জায়গার সন্ধান করছিলো, কিন্তু যদ্দূর বুঝলো এই ধ্বংসাত্মক অবস্থায় মেহনূরের শরীরে নখ পরিমাণ আঁচড় লাগেনি। একদিকে মনটা শান্ত হলেও সান্ত্বনার স্বাদটা নিতে পারলো না ফারিন, মাথাটা ঘুরিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকালো। মাহতিমের বাদামী শার্টের পিঠটা দেখা যাচ্ছে এখান থেকে, দুটো হাত বিছানার দুপাশে শক্তভাবে রেখে কঠোর ভাবে ফ্লোরের দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে রেখেছে। যেই দুটো হাত দিয়ে বিছানায় ভর রেখেছিলো, ওই জায়গায় গলগল করে ফোঁটায়-ফোঁপটায় রক্ত পরে চাদরটা ভিজে যাচ্ছে। মেহনূরের উপর থেকে সহসা মনোযোগ সটকে গেলো ফারিনের, সে চুপচাপ উঠে দাঁড়াতেই ধীর পায়ে মাহতিমের সামনে দাঁড়ালো। মাহতিমের কিন্ঞ্চিৎ নত মাথায় হাত রাখলো, চুলের চামড়ায় আঙ্গুল বসিয়ে বুলিয়ে দিতেই মুখ তুলে তাকালো মাহতিম। দৃষ্টিটা একদম ফারিনের উপর পরলে ভেতরের শক্তভাবটা একটুখানি হ্রাস করলো, নাক দিয়ে সশব্দে জোরে নিশ্বাস ছাড়তেই মাথাটা নামাতে-নামাতে বললো,
– রুমে যা, ঘুমিয়ে পড়্। টেনশন করিস না।

ফারিন কথাটা শুনলো না। উলটো ভাইয়ের মুখটা দুহাতে উপরে তুলে উদাস দৃষ্টিতে করুণ গলায় বললো,
– তুমি এরকম কেনো করলে ভাইয়া?

ফারিনের প্রশ্নে সবাই যেনো মুখ তুলে তার দিকে তাকালো। কয়েক জোড়া বিমর্ষ চাহনি তাদের দিকে নিবদ্ধ হলেও অশ্রুজোড়া চোখদুটো একবারও সেদিকে তাকালো না। ফারিন গালদুটো ছেড়ে দিয়ে সৌভিকের সাথেই ফ্লোরে আসন পেতে বসলো। সৌভিক মাহতিমের পায়ে কাঁটাছেঁড়া জায়গাগুলো ড্রেসিং করাকালীন একপলকের জন্য ওর দিকে তাকালো, তাকিয়ে ফের কাজে মনোযোগ দিলো। ফারিনও যখন মাহতিমের হাত টেনে ড্রেসিং শুধু করলো, তখন বাধা দিতে গিয়ে মাহতিম বিরক্তির সুরে বললো,
– তোরা দুটো শুরুটা করলি কি? কি জন্যে এখানে বসে আছিস? আমার তো এসব কাহিনী সহ্য হচ্ছে না। আমাকে একটু একা থাকতে দে। মাথাটা একটু ঠান্ডা করি। চলে যা রুম থেকে। রুমে এখন কাউকে চাই না।

ফারিন আর সৌভিক দুজনেই মুখ তুলে মাহতিমকে দেখলো, দেখা শেষ করে না-শোনার ভঙ্গিতে একমনে কাজ করতে থাকলো। মাহতিম জানে, এদের হাজার বললেও এখান থেকে ড্রেসিং সম্পন্ন না করে একপাও নড়চড় করবেনা। তার মধ্যে মাথাটা এতো টনটন করছে, সম্ভবত অতিমাত্রায় ফাস্ট্রেশন থেকে আবার নার্ভগুলো উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। মাহতিম যখন মেহনূরের মুখ থেকে ‘ চরিত্রহীন ‘ শব্দটা শুনে তখনও রাগের উত্তপ্ত পিন্ডটা ফুলে-ফেঁপে উঠেনি, কিন্তু যখন ‘ ভোগবস্তু ‘ শব্দটা শুনে তখন রাগেরটা পিন্ডটা ভস্ম হয়ে ভয়াবহ আকারে উদগীরণ হয়ে যায়। দামাল মুঠোর এক আঘাতেই স্টাডিটেবিলের কাঁচটা চুরমার হয়ে শেষ, বাঁহাতের মুঠো জুড়ে তখন অথৈ রক্তের বর্ষা! মেহনূর চিৎকার দিয়ে যে নিজের ভয়গুলো জানান দিবে, তার আগেই পরপর কয়েকটা তাণ্ডব মাহতিম দেখিয়ে ফেলে। তার বাঁহাতটা কাঁচের হিংস্র খোঁচায় বহু জায়গায় ক্ষতবীক্ষত হয়ে তরতাজা রক্ত বেরুতে থাকে, পাষাণের মতোই রুমের ভেতর যাবতীয় জিনিসপত্র ভাঙার মতলবে ছিলো মাহতিম, কিন্তু বিছানার কোণায় গুটিশুটি পাকানো ভয়ার্ত মূর্তির দিকে দৃষ্টি পরতেই তার হাতের ফুলদানীটা শূন্য থেকে নিচে নামিয়ে ফেললো, চুপচাপ বিছানায় এসে ধপ করে বসলো। শেষমেশ মেহনূরকে ছাদের রুমে ফিরিয়ে আনলো নীতি, শব্দহীন অবস্থার মতো শান্ত হয়ে গেছে মেহনূর। চোখ থেকে পানি পরছিলো ঠিকই, কিন্তু ফুঁপিয়ে কান্নাটা থেমে যায় আপনা-আপনি। বালিশে শুইয়ে দিয়ে গলা পযর্ন্ত কম্বল দিয়ে ঢেকে দেয় ওরা। নীতি ডানপাশে বসেছে, প্রীতি অন্যপাশে, ফারিন তখনো ফিরে আসেনি। নীতি কপালে শান্তসূচকে হাত ছুঁইয়ে দিতে থাকলে নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
– মনটা হালকা করো ভাবী। কি হয়েছে আমাকে খুলে বলো। না বললে কি করে বুঝবো বলো?

মেহনূর চোখ বন্ধ করা অবস্থায় ঠোঁটদুটো মুখের ভেতরে পুড়ে নিলো, শুষ্ক ঠোঁটে জিভ ছুঁইয়ে ধাতস্থ কন্ঠে বললো,
– অনামিকা কেনো চরিত্রহীন ডাকে এটা জিজ্ঞেস করেছিলাম। আর কেনো তিনি ওর পিঠে —

ঠোঁট কুঁচকে ডুকরে কেঁদে উঠে মেহনূর। মুখটা দুহাতের তালুতে ঢেকে নিলে একটু আগের চিত্রগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে। নীতি দ্রুত মেহনূরের উপর শান্ত হওয়ার ইঙ্গিত দিলেও প্রীতির সাথে চোখাচোখি দৃষ্টি বিনিময়ে আলাপ হচ্ছে। প্রীতি যেনো ভয়েই তটস্থ, প্রশ্নপর্ব পুরো শেষ না হলেও বাকি ঘটনা কি হতে পারে, সেটা ইতিমধ্যে দুজনের মাথায় ঢুকে গেছে। রাত তখন চারটার ঘরে ছুঁই-ছুঁই, ফ্যান না চলার জন্য ঘড়ির টিক-টিক শব্দটা বিদঘুটে লাগছে। বাইরের সাথে যেনো পাল্লা দিয়ে ভেতরের অবস্থাও থমথমে। নীতি ড্রিম লাইটের আলোয় রেডিয়াম ধাতুর জ্বলজ্বল করা ঘড়িটার দিকে তাকালো, বুকটা কেমন ধড়ফড় করছে ওর। অজানা ভয়, অনিশ্চিত আশঙ্কা, বিপন্ন পরিস্থিতি নিয়ে সত্যিই বুকটার ভেতর তুফান খেলে যাচ্ছে। যেই কঠিন কথাগুলো বলার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলো, সেগুলো একটার-পর-একটা সাজিয়ে হালকা গলায় কেশে নিলো সে। কাশির শব্দে শুনে সচকিত হলো প্রীতি, বড় বোন নীতি নিশ্চয়ই অতীতের বন্ধ দরজা খুলে ফেলেছে, এখন কিছুক্ষণের ভেতর আসল ঘটনা ব্যক্ত করবে। মেহনূর ঘুমায়নি, চোখ এমনে-এমনেই বন্ধ করা ছিলো। নীতি আরেকদফা অক্সিজেন টেনে নিয়ে সাহসের পিত্তিটা শক্ত করলো, মেহনূরের কপাল থেকে হাত সরিয়ে ওর পেটের উপর থেকে ডানহাতটা তুলে নিলো নীতি। মেহনূর চোখ খুলে তাকাতেই নীতি নিজের হাতদুটোর ভেতর মেহনূরের ডানহাতটা আবদ্ধ করলো, হালকা গলায় বলতে শুরু করলো,

– আমি তোমায় সব বলবো ভাবী। সব গোড়া থেকে বুঝিয়ে বলবো। তুমি একটু শান্ত হও। অযথা চিন্তা করে ভাইয়াকে কষ্ট দিও না। ও মানুষটা তোমায় খুব ভালোবাসে। তুমি তাকে নিয়ে ভুল সময়ে ভুল প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে ফেলেছো। এটার জন্য তোমাকেও দোষ দিতে পারিনা, আবার ভাইয়াও অসময়ে এসব কথা শুনে স্বাভাবিক থাকতে পারেনি। ওগুলো একদম অযৌক্তিক, মিথ্যা, ভিত্তিহীন। ভাইয়া মোটেই আজকের মতো রাগী ছিলো না, কোনোদিন আমরা মনে করতে পারি না ভাইয়া কখনো আমাদের সাথে জঘন্য রাগ দেখিয়েছিলো কিনা। খুব ছোট থেকেই অনামিকা এ বাড়িতে যাতায়াত করতো। রজনী মামী, অনামিকা উনারা এ পরিবারের সদস্যের মতোই থাকতো। পড়াশোনার জন্য ঢাকার পিলখানার এরিয়ায় থাকতো ভাইয়া, যখন ফুপা ছুটিতে বাসায় আসতেন তখন ভাইয়াকে কোনোভাবেই সেখানে আঁটকে রাখা যেতো না। ভাইয়া ছুটে বাসায় আসতো, আর হয়তো তখন থেকেই অনামিকার মন নরম হতে থাকে। আমরা কেউ বিষয়টাকে তেমন পাত্তা দেইনি, কারণ, মনেহতো ওটা বয়সের ঝোঁক। ধীরে-ধীরে বুঝতে শিখলে সব ঠিক হয়ে যাবে। ভাইয়ার ইচ্ছা ছিলো, ফুপা যেই মেয়েকে চুজ করবে তাকেই বিয়ে করবে, সে কোনো প্রেমঘটিত ব্যাপারে জড়াবে না। এই একটা কথার উপর ভাইয়া যেনো বাঘের মতো অটল ছিলো, কোনো মেয়েই তাকে এই কথা থেকে একচুল নড়াতে পারেনি। অনামিকা যে অসুন্দর তা কোনোদিন বলবো না, কিন্তু অশালীন পোশাক আর উগ্র চিন্তাভাবনার জন্য আমরা কেউই ওকে পছন্দ করতাম না। আমরা দশটা মানুষ আপনের চেয়েও আপনের মতো থেকেছি, কেউ আমাদের দেখলে বলতে পারতো না, কে কাজিন বা কে বন্ধু। সৌভিক, তৌফ, সিয়াম ভাই তারা তো আমাদের সাথেই শৈশব কাটিয়েছে, যদিও তারা ভাইয়ার ছোটবেলার বন্ধু। অনামিকা তখন প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়ে, ওই সময় নেভি থেকে ভাইয়ার জয়েন এপ্রুভাল এসে যায়, কিছুদিনের মধ্যেই সব রেডি করে ট্রেনিংয়ের জন্য বিদায় নেয় ভাইয়া। প্রায় ছয়মাসের বেশি সময় সে চট্টগ্রামের ট্রেনিং সেন্টারে ছিলো। একদিন মারজা মামীর অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে যায়, উনিতো আগে থেকেই অসুস্থ ছিলো, তার উপর একদিন বুকে শ্বাস টান উঠে। সবাই পাগলের মতো একগাদা টেনশন নিয়ে হাসপাতালে দৌড় দিলাম, কিন্তু এই টেনশনের ভেতর মস্ত বড় ভুল করি আমরা। আমরা কেউই জানতাম না সারপ্রাইজ হিসেবে ভাইয়া সেদিন সন্ধ্যায় ঢাকায় ফিরবে, এটাই আমাদের দূর্দশা হয়ে দাঁড়ালো। ভাইয়া কাধে ব্যাগ ঝুলিয়ে জার্নির ক্লান্ত শরীর নিয়ে যখন বাড়িতে ফিরলো, কিন্তু তখন বাড়ির অবস্থা সুনশান। ওইদিন শুধু সিরাজ কাকা সাবু খালা বাড়ির অন্যান্য কাজের জন্য ছিলো, তারা ভাইয়ার আগমন দেখে মামীর সিচুয়েশন নিয়ে ফট করে জানায়নি। এদিকে ভাইয়া নিজের রুমে যায়, গোসল নিয়ে পোশাক পালটে হালকা মতোন খেয়েও নেয়, তখনও সিরাজ কাকা মামীর ব্যাপারটা মিথ্যা কথা দ্বারা ঢেকে দিয়েছে। ভাইয়ার যে লম্বাদিনের ধকল শেষে বিশ্রামের প্রয়োজন সেটা সিরাজ কাকা বুঝতো। ভেবেছিলো রাতে চুপ করে অনামিকার কথাটাও এই ফাঁকে বলে দিবে। এরই মধ্যে অনামিকা তখন —

একটানা কথা বলতে গিয়ে কিছুটা হাঁপিয়ে উঠে নীতি। নির্ঘুম রাতের সাথে ফ্লাইটের ক্লান্তিটা এখনো যেনো ঘুচেনি। মেহনূর উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, এরপর কি হয়েছে সেটা জন্য বুকের ভেতর ধ্বক-ধ্বক হচ্ছে। নীতি ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে আবারও মেহনূরের দিকে তাকালো, প্রচণ্ড ভয় হচ্ছে, প্রচণ্ড! যদি মেহনূর উনিশ-টু-বিশ বুঝে তখন? নীতিকে হঠাৎ থামতে দেখে মেহনূর নিজেই উৎকন্ঠার সুরে বলে উঠলো,
– বলুন না নীতি আপু, আমি শুনতে চাই এরপর কি হয়েছে। ওই খালি বাড়িতে তিনটা মানুষ তো ছিলো, উনি তো একা ওখানে ছিলেন না। বলুন না, এরপর কি ঘটনাটা ঘটেছিলো?

নীতি নড়েচড়ে দৃষ্টি নত করলো, শান্ত গলায় বলতে-বলতে ক্রমশ উত্তেজিত হতে লাগলো তার কন্ঠ, যেনো পুরোনো রাগের ভয়ানক জেদটা শরীরের উপর আবারও জেঁকে ধরেছে।

– ওই ন’ষ্টা কোথাকার ভাইয়ার রুমে ঢুকে দরজা আঁটকে দেয়। ভাইয়ার সাথে কেমন বেহায়াপনা করতে চেয়েছে মুখে বলতেও থু আসে। কিছু জিনিস নিজের করে না পেলে, তার প্রতি অদম্য আকর্ষণ জাগে। মূলত অনামিকার এটাই হয়েছিলো। বারবার রিজেকশন খাওয়ার পর নে’শাও করতো এই ন’ষ্টা! এ’লএসডি ড্রা’গে এডি’ক্টেড ছিলো। যেই প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়তো ওখানকারই একদল ওর খাশ বন্ধু ছিলো, সবগুলো শয়তান ছিলো, জাস্ট শয়তান! অনামিকা আর ভাইয়ার মধ্যে কেমন ধস্তাধস্তি হয় কেউ জানে না। কিন্তু ওর অবস্থা আর ভাইয়ার হাল দেখে সিরাজ কাকা বলেছিলো, মাহতিম ভাইয়া ওকে আচ্ছা মতো মে’রেছে। এদিকে সাবু খালা অনামিকার অবস্থা দেখে বলেছিলো ভাইয়া নাকি লালসা মেটাতে গিয়ে রেপ করেছে। তুমিই বলো, আমার ভাইকে দেখার পর কোনো মেয়ে কি তাকে ফিরিয়ে দিতে পারে? আমার কথাগুলো অহংকার ভেবো না ভাবী। আমার ক্লাসমেটরা পযর্ন্ত আমাদের জয়েন ফটো দেখলে মাহতিম ভাইয়াকে ক্রাশ কনফেশনে লেটার দিতো। যেখানে ভাইয়া তুড়ি বাজালেই সুন্দর মেয়ের আনাগোনা চলে আসতো নিশ্চিত, সেখানে ওর মতো ন’ষ্টার দিকে কোন্ দুঃখে তাকাতে যাবে? এরপর যখন —

– থেমে যা নীতি। ভাবীকে ঘুমাতে দে। কাল আমাদের লম্বা জার্নি মনে আছে তো? রেস্ট করতে দে।

দরজার দিকে একসঙ্গে তিনজনের দৃষ্টি চলে গেলো। সৌভিকের চিন্তিত মুখটা এখন পরিশ্রান্ত হয়ে মলিন আকার ধারণ করেছে। হয়তো মাহতিমের মুখ থেকে সেও আসল ঘটনা শুনে ফেলেছে। নীতি আশ্চর্য হয়ে কপাল কুঁচকে বিছানা থেকে নামতেই বললো,

– কাল যাবো মানে? ভাইয়ার অবস্থা কি খুবই ভালো? সে তো ভুলেও ড্রাইভার নিবে না, কাউকে সে জিপও চালাতে দিবে না, তাহলে চালাবেটা কে? কিছুতেই যাবো না আমি। ট্যূরে যাওয়া বাতিল। ওই সা’পের সাথে কোনোমতেই ট্যূরেই যাবো না।

সৌভিক খানিকটা বিরক্ত হয়ে বুকের কাছে দুহাত ভাঁজ করলো। মলিন দৃষ্টি পালটে আক্রোশের ভঙ্গিতে সরল কন্ঠে বললো,
– এসব কথার ভেলকি ওর কানে গেলে এখুনি উঠে এসে চড় লাগাবে।

দৃষ্টিটা তখন নীতির উপর থেকে সরিয়ে এবার নীতির পেছনে ছুঁড়লো সৌভিক। যোগ্যমতো জায়গায় দৃষ্টি স্থির রেখে গমগম সুরে বললো,
– ওর রাগ এখনো কমেনি। কমার মতো ঘটনাও ঘটেনি। হয়তো এখনো সবকিছু ঠিক করার চিন্তায় আছে, নাহলে এইসব ট্যূর-ফ্যূর ফেলে কখন লাগেজ উঠিয়ে বিদায় হতো।

নীতি প্রসঙ্গটা না বুঝে সৌভিকের দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালো। সৌভিকের স্থির দৃষ্টিটা লক্ষ করে সে পেছন ফিরে তাকাতেই দেখতে পেলো, মেহনূরের অবসন্ন দৃষ্টি এখন সৌভিকের দিকে। নীতি মাথাটা দ্রুত ঘুরিয়ে সৌভিকের দিকে অপ্রসন্ন কন্ঠে বললো,
– মানে?

সৌভিক একই তেজে মেহনূরের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নীতির পানে তাকালো। হাতদুটো স্বাভাবিক করে বলে বললো,
– রেস্ট করতে দে এখন, কথা বলিস না। একটু পরই বের হতে হবে। পারলে ভাবীর ব্যাগটা রেডি করে দিস। আর এটা —

অর্ধপূর্ণ কথাটুকু ওখানেই আঁটকে রেখে রুমের বাইরে গেলো সৌভিক। নীতি কিছু বুঝতে না পেরে পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠলো ‘ সৌভিক ভাই কোথায় যাচ্ছো? ‘। সৌভিক হনহন করে যেমন বেরুলো, তার বদৌলতে ‘ ঘ্যাচঘ্যাচ ‘ শব্দ করে রুমের ভেতরে ঢুকলো। তার ডান পা বরাবর পিছু-পিছু বেশ বড় একটা কালো লাগেজও এসে উপস্থিত, সৌভিক হ্যান্ডেলটা ধরে আধহেলানো লাগেজটা সোজা করে রাখলো। হ্যান্ডেলটা ছেড়ে দিতেই তটস্থ সুরে বললো,

– এয়ারপোর্টের গোলমালের জন্য এটা অন্য ফ্লাইটে আঁটকে গিয়েছিলো। এটা আমাকে দিতে বললো, এজন্য দিয়ে গেলাম। নীতি, প্রীতি চলে যা তোরা। ভাবীকে ঘুমাতে দে।

সৌভিকের কথায় দুবোনই সেখান থেকে চলে আসলো। আসার আগে মেহনূরকে ভালো করে বুঝিয়ে দিলো, কিছু দরকার হলে সাথে-সাথে তাদের ডাকতে, ডাকতে যেন দেরি না করে। মেহনূর কম্বল সরিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো। মাথাটা দুহাতে চেপে কিছুক্ষণ গভীরভাবে নিঃশ্বাসপ্রশ্বাস নিলো, শরীরটা খুবই শক্তিহীন লাগছে, মাথাটাও ভনভন করছে। শেষ রাতের সময় চলছে এখন, এই উছিলায় রুমে ঢুকছে হিম জাগানো বাতাস। ঠান্ডা বাতাসটা সূঁইয়ের মতো খোঁচাচ্ছে, ভালোই শীত লাগিয়ে দিচ্ছে। মেহনূর খোলা দরজাটা বন্ধ করার জন্য ফ্লোরের উপর দু’পা ফেললো, হাতে ভর দিয়ে বিছানা থেক্র উঠে দাঁড়ালো। দরজার স্লাইডিং ডোরটা টেনে দিয়ে টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলো। অনেক চিন্তাভাবনার পর, অনেক যুক্তি মেলানোর পর সিদ্ধান্ত নিলো, লাগেজটা খুলে দেখা উচিত। লাগেজের দিকে তাকিয়ে বুক ফুলিয়ে নিশ্বাস নিলো মেহনূর, সেটা নম্রভাবে ছেড়ে দিয়ে হাতদুটো এগিয়ে লাগেজটার হ্যান্ডেল আঁকড়ে বিছানার কাছে টেনে আনলো, বিছানায় তুলতে গিয়ে রীতিমতো হাঁপিয়ে গেলো। লাগেজটা প্রচুর ভারী। আচ্ছা, এটার মধ্যে কি রাগ ভরে-ভরে পাঠিয়ে দিয়েছে? নাকি রাগের সাথে ওই কাঁচের গুঁড়াগুলো ভর্তি করে পাঠিয়েছে? মেহনূর সরু আঙ্গুলগুলো লাগেজের চকচকে দেহের উপর রাখলো, ঠান্ডা-শক্ত লাগেজটা ছুঁতেই কেমন এক ঘোর আবেশে প্রসন্ন হয়ে বন্ধ হয়ে গেলো ব্যথাক্লিষ্ট চোখদুটো। চোখের সামনে অন্ধকার, একদম ঘুটঘুটে অন্ধকার ছেয়ে গেলো, সেখানে কোনো আলো দেখতে পেলো না মেহনূর। হঠাৎ অন্ধকারের মাঝখানটা যেনো চিঁড়ে যেতে লাগলো, চিঁড়টা বড় ফাঁক গলে ভোরের আলোর মতো উজ্জ্বলটা ভেদ করে এলো। হঠাৎ, এক লহমায় সকল অন্ধকার ধূলিসাৎ করে ভোরের আলোয় ফুটে উঠলো সবকিছু, সেই পুরোনো কথা, সেই পুরোনো দিনগুলো মনে পরলো তখন। হাসি-হাসি চোখে বাঁকা হাসিতে তাকিয়ে আছে মাহতিম। চোখের মনি জুড়ে তার হাসি-হাসি চোখদুটোর চাহনিটা মিলে আছে, হঠাৎ মুখটা ধীরভাবে এগিয়ে এনে ফিসফিস আওয়াজে বললো,

অজ্ঞাত পরিচয় আমার, অচেনা ছিলাম একদিন।
দ্বিগ্বিদিক জানতো মানুষ, তুমি-আমি কেউ নই।
সময় যেনো ছল খাটালো, ধরিয়ে দিলো সবই।
তোমায় মন বাড়িয়ে ছুঁই মেহনূর, মন বাড়িয়ে ছুঁই।

চোখ খুললো মেহনূর, সিলভার চেইনটা ধরে একটানে বাম থেকে ডানে ঘুরিয়ে আনলো। লাগেজের উপর পার্টের অংশটা দুহাতে ধরে আস্তে করে উপরে উঠাতে লাগলো মেহনূর, লাগেজ ধীরে-ধীরে খুলে যেতেই নির্লিপ্ত চাহনিতে থমকে গেলো। চিরকুটের মতো চারকোণা হলুদ কাগজটা সবার আগেই দৃষ্টি কেড়ে নিলো ওর, সেখানে সুবিন্যস্ত শব্দে নীল কালিতে লেখা ছিলো,

– আমার ভাগ্যবতী বউ, আমার চিরসঙ্গিনী, আমার মেহনূর আফরিনকে আঠারো শাড়ির ভালোবাসা।

চলমান .

#ফাবিয়াহ্_মমো .

( #নোটবার্তা : দেরির জন্য দুঃখিত পাঠক 💔 )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here