#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৩২.
#ফাবিয়াহ্_মমো .
মাহদির চালাকিটা ধরতে পারলো না মাহতিম। ছাদের দরজা দিয়ে ঢুকার পর পিছু ফিরেও দেখলো না। মাহদি যে ছাদের দরজা লাগিয়ে পেছন থেকে পালিয়ে গিয়েছে সেটাও বুঝলো না। মাহতিমের উত্থাল-পাত্থাল মন শুধু মেহনূরকে নিয়ে চিন্তিত ছিলো, আশেপাশের পরিস্থিতির উপর নজর ছিলো না তার। দু’কানে যখন শুনতে পেলো মেহনূর অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় কাঁদছে, তখন মন ও মস্তিষ্ক তীব্র উত্তেজনায় ফেটে পরলো। কি থেকে কি হলো সেটা নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবতে পারলো না মাহতিম। সবকিছু ছেড়ে-ছুড়ে ওভাবেই ফেলে দৌঁড় লাগালো ছাদের দিকে। সিড়ির প্রতিটি ধাপে হুলস্থুল ভঙ্গিতে পা ফেলে একদৌঁড়ে যখন মেহনূরের রুমে ঢুকলো, তখন নিশ্বাসের টানে হাঁপাতে থাকা মাহতিম দরজার প্রবেশদ্বারে থম মেরে দাঁড়িয়ে গেলো। ভেতরে ঢুকার জন্য বাড়িয়ে দেওয়া পা-টা আর যেনো এগুলো পারলো না, তৎক্ষণাৎ অচল হয়ে থেমে গেলো পা-টা। ঠোঁট খুলে অনবরত নিশ্বাস ছাড়ছিলো মাহতিম, কিন্তু চোখের সামনে যে দৃশ্য দেখতে পাচ্ছিলো তাতে ভেতরের অবস্থা কাহিল করে দিচ্ছিলো তখন। হাতদুটো মুঠোবন্দি করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণের সীমায় আবদ্ধ রাখার প্রতিজ্ঞায় ছিলো। বুকের হৃদপিন্ডটা এতোক্ষন দৌড়ের জন্য ধড়াস-ধড়াস করছিলো, কিন্তু এখন যে অবস্থা হচ্ছে তাতে তাকিয়ে থাকার দিব্যি নেই। মাহতিম তৎক্ষণাৎ নিজের দৃষ্টিদুটো ফ্লোরে নামিয়ে ফেললো। বাইরে থেকে আসা আলোয় রুমটা তখন উজ্জ্বল ছিলো, জানালাগুলো খোলা থাকার জন্য শোঁ শোঁ করে বাতাস প্রবেশ করছে এখন। সিলিং ফ্যানটা মৃদ্যু রেগুলেটর পেয়ে বেশ অল্প গতিতে ঘুরছে, দমকা হাওয়ার জন্য রুমের পরিবেশটা বেশ ঠান্ডা হয়ে আছে। মাহতিম তখনো স্বাভাবিক হতে পারছিলো না, একটু আগে মাহদির কাছে যে ঘটনা শুনলো, তার সাথে এই দৃশ্য কোনোভাবেই খাপ খায় না। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে মেহনূর, গায়ের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে গাঢ় বেগুনির শাড়ি। কনুই অবধি ঢেকে থাকা ব্লাউজটা আজ যেনো অপ্রস্তুত দেখা যাচ্ছে, অজান্তেই সেটা ফর্সা পিঠকে উন্মুক্ত করে মাহতিমের বুকে এফোড়-ওফোড় করে দিচ্ছে। পিঠের উপর থেকে লম্বা আচঁলটা সরে বিছানার ঢাল বেয়ে নিচে পরে আছে। দীর্ঘ কেশগুলো বেণীমুক্ত হয়ে এলোমেলো অবস্থায় আঁচলের সাথেই ফ্লোরে স্থান নিয়েছে। ঘুমন্ত মেহনূর উপন্যাসের পাতায় মশগুল ছিলো, সেই মশগুলের রেশ কখন যে দীর্ঘ হলো টের পায়নি। ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের ‘ শাপমোচন ‘ বইটা বেখেয়ালি ভঙ্গিতে খোলা পরে আছে। নিদ্রামগ্নে ডুবে আছে ছোট্ট দেহের মানুষটা। যার মুখটা বাইরের আলোয় নীলাভ হয়ে আছে এখন, ঠোঁটদুটোর লালচে রঙটা আশেপাশের মানুষকে কতোখানি নাজুক করে দিচ্ছে সে হিসেব অসংগত। মাহতিম কিছুক্ষণ স্থির রইলো ঠিকই, কিন্তু পরক্ষণে নিজেকে সংযত করে জোরে দুটো নিঃশ্বাস ছাড়লো। চোখদুটো উপরে তুলতে-তুলতে মুষ্ঠিবদ্ধ হাতদুটো স্বাভাবিক করতে থাকলো। মেহনূরের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে ধীরে-ধীরে ওর দিকে এগুতে লাগলো। বিছানার দিকে যতো নিকটগামী হচ্ছিলো, ততই বেসামাল হচ্ছিলো ওর দেহমন। মেহনূরের খুব কাছাকাছি যাওয়ার ইচ্ছাটা আজ দারুণভাবে ফলাতে পারতো মাহতিম, কিন্তু সে ইচ্ছা ধূলোয় উড়িয়ে মেহনূরের পাশে গিয়ে বসলো। ঘুমন্ত মুখটাকে একটুখানি ছুঁয়ে দেবার তেষ্টায় ডানহাতটা বাড়িয়ে দিলো। সেই তেষ্টাকে সাঙ্গ করে মেহনূরের কোমল গালটা আঙ্গুলে-আঙ্গুলে ছুঁয়ে দিতে থাকলো মাহতিম। মলিন দৃষ্টিতে নিজের যন্ত্রনাগুলো ক্ষুদ্র করে গুটাতে থাকলো, মনের অদৃশ্য বাক্সে সকল আক্ষেপ জমা রেখে মেহনূরকে গাঢ়দৃষ্টিতে দেখতে থাকলো। ঘুমের ঘোরে লালচে ঠোঁটদুটো কেঁপে-কেঁপে উঠছে মেহনূরের, চোখের পল্লবজোড়াও ফোপানোর ভঙ্গিতে নড়েচড় উঠছে। অধরযুগলের কাঁপুনি দেখে বুকের কোথাও চিড়চিড় করে বিঁধছে মাহতিমের। সেখান থেকে কোনোভাবেই দৃষ্টি সরানো যাচ্ছে না। চুম্বকের মতো আকৃষ্ট করা ওষ্ঠদুটিকে ছুঁয়ে দেওয়ার জন্য মন আকুলিবিকুল করছে, উৎকন্ঠায় ভুগছে, ছটফট করছে তীব্রভাবে। মাহতিম নিজের ব্যকুল ইচ্ছাটা দমিয়ে রেখে মেহনূরের গাল থেকে হাত সরাতে লাগলো, আঙ্গুলগুলো গাল ছুঁতে-ছুঁতে কম্পিত ওষ্ঠের উপর রাখলো। হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে ওষ্ঠদুটি আলতো স্পর্শে ছুঁয়ে দিলো মাহতিম। বৃদ্ধাঙ্গুলটা নিরবে সরিয়ে নিতেই বাকি চারটে আঙ্গুল দিয়ে মেহনূরের অধরজোড়ায় আলতো চাপ দিলো। সেই চাপের স্থায়িত্ব বেশিক্ষণ রাখলো না, কয়েক মূহুর্ত্তের ভেতর সরিয়ে নিলো। লালচে ঠোঁটের উষ্ণতাটুকু পেতে নিজের ঠোঁটে আঙ্গুল ছোঁয়ালো মাহতিম। অজানা প্রাপ্তিতে, চাপা গ্লানিতে, অদ্ভুত শান্তিতে চোখ বন্ধ করে ফেললো সে। মেহনূরের সাথে কাটানো প্রতিটি মূহুর্তই চোখের পলকে স্মৃতিচারণ করে ফেললো। চোখ করা অবস্থায় মুচকি হাসিতে হেসে দিলো মাহতিম, ধীরে-ধীরে ঠোঁট থেকে হাত নামিয়ে নিলো। দমকা হাওয়ায় খসখস করে বইয়ের পৃষ্ঠা উড়ছে, বাতাসের তেজ বেড়ে যেতেই হুরহুর করে পৃষ্ঠা উলটে যাচ্ছে। মাহতিম বইটা নিঃশব্দে বন্ধ করে ফেললো, সেখান থেকে তুলে নিয়ে পাশের টেবিলে রেখে দিলো। রুমের কোণায় থাকা আলমারির দিকে নজর পরলো তার, চুপচাপ আলমারির কাছে গিয়ে দুই দ্বার খুললো। ঘ্যাচ করে শব্দ হতেই দ্বারদুটো খুলে গেলো, কিন্তু শব্দের সুক্ষ্ম আওয়াজে নড়েচড়ে উঠলো মেহনূর। ঘুমের মধ্যেই উপুড় অবস্থা থেকে বাঁ’কাত হয়ে শুলো। মাহতিম এক পলকের জন্য পিছু ফিরে মেহনূরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলো, মেহনূর জেগে গেলো কিনা সেটাই যেনো সজাগ দৃষ্টিতে দেখছে। না, মেহনূর উঠেনি, কিছু টেরও পায়নি। মাহতিম স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে কম্বল বের করলো, আলমারির দুই দ্বার আগের চেয়েও কম শব্দ করে বন্ধ করলো। মেহনূরকে কম্বলে ঢেকে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। কিন্তু নিচে যেতে পারলো না মাহতিম। ছাদের দরজা বাইরে থেকে আটকানো দেখে প্রচুর অবাক হলো। দরজায় কয়েকবার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে পুনরায় মেহনূরের রুমে ফিরলো। মেহনূরের বিছানায় যতটুকু জায়গা ছিলো তাতেই মাহতিম গুটিশুটি পাকিয়ে কম্বল টেনে শুয়ে পরলো। মাঝখানে দূরত্ব থাকলেও সেটা অবশ্য বিশাল দূরত্ব না। মেহনূর অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ঘুমালেও মাহতিম ওর দিকেই মুখ করে ঘুমালো। মেহনূর তখনও ঘুমে বিভোর ছিলো।
.
মাহতিমের সাথে চালাকি করে নিজেকে সম্রাট-সম্রাট লাগছে মাহদির। বড় ভাইকে টেক্কা দেওয়াটা কোনো চাট্টিখানি কথা না। তার উপর ভাই যদি নিরাপত্তাকর্মীর সদস্য হয়, তাহলে তো হিংস্র বাঘের সাথে লড়াই বলা চলে। এসব নিয়ে ভাবতে-ভাবতে নিজের প্রতি গর্ব বোধ করছে মাহদি। এদিকে মাহদির রুমের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো সিয়াম। মাহদিকে ওমন বিজয়ী স্টাইলে হাসতে দেখে তৎক্ষণাৎ হাঁটা থামিয়ে ফেললো। তাড়াতাড়ি মাহদির কাছ থেকে আড়াল হওয়ার জন্য দরজার পাশ থেকে উঁকিঝুঁকি চালাতে থাকলো। মাহদি কেনো হিহি করে হাসছে সেটাই এখন বিষ্ময়ের ব্যাপার। ওর মতো ছোটকা পোলাপান না-জানি কি করে এসেছে কে জানে? সিয়াম সেটাই তখন ধরার জন্য চটজলদি রুমে ঢুকে গেলো। হাতদুটো বুকের কাছে ভাঁজ করে সরু দৃষ্টিতে বলতে লাগলো,
– নতুন করে কি করেছিস বলে ফ্যাল পাগলা। যদি এবার ধরা খাস! মাহতিম তোর পিঠের চামড়া তুলে শুটকি বানাবে।
সিয়ামের কথা শুনে মাহদি গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকালো। এতোক্ষণ যেই হাসিটা ঠোঁটে লেগে ছিলো সেটা গাম্ভীর্যের আড়ালে ঢেকে গেলো। সিয়ামের দিকে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
– আমি কি দোষ করেছি? তুমি না ঘুমিয়ে এখানে কি করছো?
মাহদির কথায় চোখদুটো আরো ছোট করলো সিয়াম। হাতদুটো স্বাভাবিক করে মাহদির দিকে এগিয়ে গেলো। মাহদি যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছিলো, কিন্তু সিয়ামের জন্য সেটা সম্ভব হলো না। মাথায় সজোড়ে একখানা চাট্টি খেয়ে ওমনেই ধরাশায়ী হলো মাহদি। তখনই পেটের কথাগুলো সিয়ামের কাছে গড়গড় করে উগরে দিলো,
– সিয়াম ভাইয়া, তোমার মারগুলো খুব লাগে। দয়াকরে আর মেরো না। আমিতো কিছুই করিনি। কাল ভাইয়া চলে যাচ্ছে। এদিকে আমার বউ ভাইয়ার শোকে-শোকে সন্ধ্যার দিকে খুব কাঁদছিলো। এমনেই জানো, আমার এসব ভালো লাগে না। এজন্য ভাইয়াকে ছাদে আঁটকে দিয়েছি। চার রাউন্ড গেম খেলেই দরজা আবার খুলে দিয়ে আসবো।
সিয়াম কথাগুলো শোনার পর বিশাল বড় হা করে তাকালো, অক্ষিকোটরও বড়-বড় করলো। পিটপিট করে চোখের পাতা ঝাপটাতে লাগলো। আহাম্মকের মতো কিছুক্ষণ চেয়ে থাকতেই বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
– তুই সত্যিই এই কাজ করেছিস?
মাহদি দ্রুত মাথাটা উপর-নিচ দোলাতে লাগলো। কথাটা হ্যাঁ সূচকে বোঝানোর পর সিয়ামের চোখে-মুখে এমনি অবস্থা দেখা গেলো, যেনো খুশীর ফোয়ারা উপচে-উপচে পরছে। সিয়াম চওড়া একটা হাসি মাহদির কাধটা গর্বিত সূচকে চাপড়ে বললো,
– ওয়েল ডান শয়তানের হাড্ডি! যা কাজ করেছিস না, আহা! তোকে তো চুমিয়ে চুমিয়ে লালপল্টু বানাতে মন চাচ্ছে। আয় বাবু আয়, তাড়াতাড়ি বুকে আয়। তোকে একটু আদর করি, আয়।
সিয়ামের অবস্থা দেখে ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে গেছে মাহদি। সিয়াম বারবার মাহদিকে কাছে টানাটানি করছে, ঠোঁটদুটো চুমু স্টাইলে উঁচিয়ে-উঁচিয়ে হাবিজাবি প্রলাপ বকছে। মাহদি চোখ-মুখ বিরক্তিতে ডুবিয়ে সিয়ামের দিকে এক ধাক্কা মারলো। আকস্মিক ধাক্কা খেয়ে সিয়াম একটু পিছিয়ে গেলে ওমনেই হুড়মুড় করে বিছানা থেকে নেমে দরজার দিকে দৌড় লাগালো মাহদি। দরজার বাইরে যেই পালাতে নেবে ওমনেই মাথা পিছু ঘুরিয়ে কাটকাট ভঙ্গিতে বললো,
– ভাইয়া যে ছাদে আছে, এ ব্যাপারে যেনো কেউ না জানে। মা যদি জানতে পারে, তাহলে কিন্তু সমস্যা হবে। নীতি আপুকে চাইলে বলতে পারো। কিন্তু ফারিনকে ভুলেও বলতে যাবে না।
কথাটুকু শেষ করেই ছুট লাগালো মাহদি। বিছানায় পরে থাকা সিয়াম মাহদির অবস্থা দেখে আনমনেই হাসতে লাগলো। হাসতে-হাসতে খোলা জানালার বাইরে তাকালো সিয়াম। রাতের আকাশটার দিকে দৃষ্টি যেতেই ঠোঁট থেকে হাসি সরে যেতে থাকলো। আগামীকাল থেকে দুটো বন্ধু একই যন্ত্রণা অনুভব করবে। একই ব্যথায় জর্জরিত হতে থাকবে দিনের-পর-দিন। প্রিয়তমাকে দূরে রাখার ব্যাথায় দগ্ধ হবে হৃদয়। অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাবে মনের প্রতিটি স্তর। সৌভিক তো এতোদিন সহ্যসীমায় আঁটকে ছিলো, মাহতিম কি করবে সেটা তো আগেভাগে বলা যায়না। কখনোই না।
.
তিলতিল করে এগিয়ে যাচ্ছে সময়। গভীর হচ্ছে ততো রাতের প্রহর। দূর থেকে ভেসে আসছে শহুরে কুকুরের ডাক। মাঝে-মাঝে শোনা যাচ্ছে ট্রাকের শ্রুতিহীন হর্ণের আওয়াজ। মাথার উপর ঘূর্ণায়মান ফ্যানটা বেশ ভালোই বাতাস ছড়াচ্ছে। সেই বাতাসের জোরে হিম হয়েছে মেহনূরের দেহ। শীতের প্রভাবে কাটা দিয়ে উঠছে শরীরের পশমস্তর। মেহনূর হালকা মতোন জেগে উঠলে কম্বলটা থুতনি পযর্ন্ত টেনে নিলো। পাদুটো গুটিশুটি পাকিয়ে ঠিক করে শুতেই হঠাৎ সৎবিৎ ফিরে পাওয়ার মতো চমকে উঠলো মেহনূর! ওমনেই গায়ের কম্বলটা সরিয়ে শোয়া থেকে তড়িঘড়ি করে উঠতে নিলো, কিন্তু যেই মুখটা ডানে ফিরালো, ঠিক তখনই মেহনূরের উঠাটা থেমে গেলো সহসা। দুহাতের কনুইদুটোতে ভর রেখে আধশোয়া ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে মেহনূর। ডানপাশে যে ব্যক্তিটি শুয়ে আছে, তাকে দেখে গায়ের চামড়া এখন শীত ছাড়াই কাটা দিচ্ছে। মেহনূয প্রথমে চিন্তা করলো, হয়তো সে ভুলভাল দেখছে। কিন্তু যখনই মাহতিমের দিকে হাত বাড়িয়ে মোটা পেশির বাহুটা ছুঁলো, তখনই নিশ্চিত হলো এটা মাহতিমই। মেহনূর কিছুক্ষণ নির্বাক চাহনিতে তাকিয়ে থেকে পুনরায় বালিশে মাথা রেখে শুলো। মাহতিমের ঘুমন্ত মুখটার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো মেহনূর। গালটা হাতের তালুতে রেখে ঘুমিয়ে আছে মাহতিম, অন্যহাতটা বিছানার উপর রেখে দিয়েছে সে। মেহনূর ঘুমন্ত চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে থাকলো ঠিকই, মাহতিমকে নিয়ে কোনো অভিব্যক্তি সে প্রকাশ করলো না। যেভাবে শুয়েছিলো, ঠিক সেভাবেই মাহতিমের দিকে পিঠ দিয়ে ঘুমালো মেহনূর। চোখদুটো বন্ধ করার অনেক চেষ্টা করলেও মাহতিমের উষ্ণতার জন্য বেচইন অনুভব করছিলো। ওই হাতটা যখন দেহের উপর থাকে, পেছন থেকে আঁকড়ে ধরে, শক্তভাবে আগলে রাখে, পরম উষ্ণতায় খোলসের মতো আবদ্ধ করে দেয়, বুকের উষ্ণতা দিয়ে বুঝিয়ে দেয় ‘ আমি তোমার সাথেই আছি ‘, তখন মেহনূর নিজেকে কতটা নিরাপদ অনুভব করে সেই অনুভূতি ব্যক্ত করা অসম্ভব ব্যাপার। মাহতিম ঘুমের মধ্যে ঠিকই তলিয়ে ছিলো, টের পায়নি মেহনূর যে একটুখানি উষ্ণতার জন্য আবারও তার কাছে ঘেঁষছে। মেহনূর নিচের ঠোঁটটা দাঁতে চেপে একধাপ পেছনের দিকে পিছিয়ে গেলো, মাহতিমের হাতটা বিছানা থেকে উপরে তুলে ওর বুকটার সাথে সন্তপর্ণে পিঠ মিলিয়ে দিলো। শূণ্যে ধরে রাখা মাহতিমের হাতটা নিজের দেহের উপর নামাতে লাগলো মেহনূর। এবার হাতটার জায়গা পরিবর্তন করে পেটের উপর নামাতে থাকলো। ভারী হাতটার ওজন পেটের উপর ছেড়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। বড় একটা ঢোক গিলে মাহতিমের হাতটার উপর নিজের হাত রেখে দিলো মেহনূর। সে যে চলে যাচ্ছে, বহুদিনের জন্যই ছেড়ে যাচ্ছে। কবে আসবে, কখন ফিরবে, কিচ্ছু বলেনি মানুষটা। কিভাবে আত্মার সাথে জুড়ে গেলো সবকিছু, কিভাবে তার জন্য একটু-একটু করে কষ্ট অনুভব হচ্ছে, মেহনূর এতোসব প্রশ্নের উত্তর কিছুতেই জানে না।
.
নরম বিছানায় গোল হয়ে বসে আছে সবাই। রাত তখন তিনটা বিশ বাজে। নীতির মুখটা অমাবস্যা রাতের মতো কালো হয়ে আছে, বাকিদের অবস্থাও এক। মাহদি ঢুলতে-ঢুলতে নীতির কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে, অথচ বাকিদের চোখে ঘুম নেই। একটু আগে যে লোমহর্ষক খবরটা পেয়েছে তাতে হুঁশ-জ্ঞান বিগড়ে আছে সবার। আগামীকাল কেমন ঝড় আসতে চলেছে কেউ ধারণা করতে পারছে না। প্রীতি কোনোভাবেই স্থির হতে পারছে না। অস্থির ভঙ্গিতে বারবার হাতের তালু হাত ঘষছে। নীতির সামার ভেকেশান শেষ হয়েছে চারদিন আগেই, কিন্তু সেটা গোপন রেখেছিলো নীতি। আজই মেইলে খবর এসেছে দ্রুত কান্ট্রিতে ফিরে যাওয়ার জন্য। নীতি যে ক্যাম্পাসের আন্ডারে পড়াশোনা করছে, সেখানে হুট করেই প্রোগ্রাম দিয়ে ফেলেছে, যেই প্রোগ্রাম এ্যান্টেন্ট করা খুব জরুরী। নীতি না পারতে কাল দুপুরের দুটো টিকিট কেটে ফেলেছে, যেখানে একসঙ্গে দু’বোনই ফিরে যেতে বাধ্য। যদি কোনো কারণে ভিসা জটিলতায় পরতে হয়, তাহলে আর রক্ষে নেই। এদিকে মাহতিমের ফুপুও মেয়েদের ফেরা নিয়ে টেনশনে পরে গেছেন, প্রোগ্রাম এ্যান্টেন্ড করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা তিনিও জানেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বীভৎস যে খবরটা এসেছে, সেটার জন্যই মূলত ঘুম হারাম অবস্থা চলছে। সৌভিক অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর মুখ খুললো। নিজের ডার্ক সার্কেলের চোখদুটো এলার্জির জন্য কচলাতে-কচলাতে বললো,
– মাহতিমকে আগে ঠিকঠাক মতো বিদায় করা দরকার। মাহতিম আগে কাজে ফিরুক। আপাতত সবকিছু সিচুয়েশনের উপর ছেড়ে দে। তোরা বেশি ভাবিস না। ভাবীর দিকে খেয়াল রাখার জন্য কেউ-না-কেউ ঠিকই প্রেজেন্ট থাকবে, টেনশন নিস না।
সৌভিক শেষ করলেধ চোখদুটো তখনো কচলাচ্ছিলো। ওর অবস্থা দেখে পাশ থেকে ফারিন বলে উঠলো,
– চোখ কচলিয়েও না ভাইয়া। চোখ প্রচুর ব্যথা করবে। অলরেডি খুব লাল হয়ে গেছে। আর কচলিয়েও না।
সৌভিক কয়েক সেকেন্ডের জন্য ফারিনের দিকে তাকালো।ফারিন ‘ না ‘ সূচকে মাথা নাড়িয়ে বারণ করার ইশারা দিচ্ছিলো। এদিকে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়তে-ছাড়তে তৌফ বলে উঠলো,
– শালার একটা কাহিনী ফিনিশ মারলে আরেকটা কাহিনী টপকায়া পরে। তোরা আমারে বল, এই মূহুর্তে ওই বা’ন্দি ছেড়ির আহনের দরকার আছে? হুদাই তো মুখটা খারাপ হয় না। এইসব বা’লের উপ্রে ছা’লের কারবার দেখলে মুখটা আরো নষ্ট হয়। আমারে আর ভালো হইতে দিলো না।
তৌফের বিশ্রী ভাষা শুনে সবাই বিরক্তিতে তাকালো। কিন্তু মুখ ফুটে কিচ্ছু বলার অবস্থায় ছিলো না কেউ। মাহদি যদি জেগে থাকতো, তাহলে মিনি বাঘের মতো হামলে ধরতো ঠিকই। এটাকে মাহতিমের জুনিয়র কপি বলা চলে। ত্যাড়াত্যাড়া কথা বললে ডিরেক্ট এ্যাকশন! সামিক সবার নিরবতাকে চ্ছিন্ন করে বেখেয়ালী সুরে বলতে লাগলো,
– তৌফ ভাই, প্লিজ ব্রাদার, তুমি এখন মুখ খারাপ করো না। সবার মাথাই এলোমেলো হয়ে আছে। কি করলে সবকিছু ঠিক হবে কেউ জানি না। তুমি জাস্ট প্রে করো, ওই মামী যেনো ভাবীর জীবনে কিছু না করে। ভাবী যে হাজারটা উষ্টা খেলেও অভিযোগ করবেনা, এটার সুযোগই মামী লুফে-লুফে খাবে। মাহতিম ভাই না থাকলে কি অঘটন ঘটবে, তোমরা সবাই এ বিষয়ে কম-বেশি জানো। শেফালীর মতো ধুরন্ধর মহিলাকে ট্যাকেল দেওয়ার জন্য মাহতিম ভাই জোশ খেলা দেখিয়েছে। কিন্তু এখন পুরো ম্যাটারটাই আলাদা।
সামিকের কথায় সায় জানাতে গিয়ে আবার মুখ খারাপ করলো তৌফ। এবারের ভাষাটা নর্দমার মতো জঘন্য করে বিশ্রী ভঙ্গিতেই বললো,
– স্কুল কলেজের বাথরুম দেখছোস না? ওইসব বাথরুমে স্পেশাল কিছু কমোড থাকে জানোস তো? ওই বাথরুমের সুঘ্রাণ এতোই ভালো, পাবলিক দশ মাইল দূর থাকলেও নাক টিইপা হাঁটে। ওইসব বাথরুমে এইগুলারে ঢুকায়া টানা একমাস আঁটকায়া রাখতে মন চাইতাছে। বিশ্বাস কর, সবগুলায় জন্মের শিক্ষা পাইবো। যাগোর কারেন্ট বেশি, ওগোর কারেন্ট এমনেই ছুটানো দরকার।
তৌফের প্রতি বাজেভাবে ক্ষেপে গেলো প্রীতি। কিন্তু নীতির বাধা পেয়ে আর যেনো এগুলো না। সবাই একসঙ্গে সশব্দে নিঃশ্বাস ছাড়লে ভূতুড়ে পরিবেশের মতো অনুভূত হলো তখন। নিরবতা আঁকড়ে ধরলো কঠিনভাবে।
.
পূব আকাশে দেখা যাচ্ছে দগদগে অরুণ পিন্ড। কিচিরমিচির আওয়াজে মুখর পরিবেশ। ভোরের খোলস ছেড়ে অরুণ আলোয় পরিণত হয়েছে আকাশের রূপ। শহুরে কোলাহল কিছুটা হ্রাস পেলেও পাখির ডাকে-ডাকে মনোরম লাগছে এখন। মেহনূর আড়মোড়া ভেঙ্গে চোখের পল্লব খুলে তাকালো, গা থেকে কম্বল সরিয়ে হাত দুটো টানা দিয়ে নিলো। বড় একটা হাই ছাড়তে-ছাড়তে হঠাৎ চৈতন্য পাওয়ার জন্য হড়বড় করে উঠে বসলো সে। আশেপাশে, চতুর্দিকে মাহতিমকে খুঁজতে লাগলো, কিন্তু কোথাও খুঁজে পেলো না তাকে। মেহনূর পাগলের মতো উন্মুখ হয়ে মাথায় খোপা পাকাতে থাকলো। শাড়িটা ঠিক করে মুখটা কোনোমতে ধুয়ে তাড়াতাড়ি নিচে নামতে লাগলো। সিড়ি দিয়ে নিচে নামলো ঠিকই, কিন্তু বাড়িতে কাউকে খুজেঁ পেলো না। এদিক-ওদিক সবদিকে তাকিয়ে দেখলো মেহনূর, কেউ আশেপাশে ছিলো না। মেহনূর উন্মাদের মতো এই রুম থেকে ওই রুমে দেখতে থাকলে হঠাৎ পেছন থেকে একটা চাকর কৌতুহলে থমকে দাঁড়ালো। মেহনূরকে দেখে বিষয়টা বুঝতে পেরে নিজ থেকেই বলে উঠলো,
– দিদিমনি, আপনি কি মাহতিম বাবাকে খুঁজছেন?
মেহনূর অনবরত হাঁপাতে-হাঁপাতে পিছু ফিরে তাকালো। ঠোঁট খুলে হাপানির মতো নিঃশ্বাস ছাড়তেই পাগলের মতো হ্যাঁ সূচকে মাথা ঝাঁকাতে থাকলো। বয়োবৃদ্ধ ষাটোর্ধ্ব চাকর সিরাজ মেহনূরের দিকে ব্যথিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
– দিদিমনি, বাবা যে গাড়িতে চড়লো। গাড়ি ছেড়েছে কিনা —
বৃদ্ধ কথাটা শেষ করার সুযোগ পেলো না, মেহনূরের জোরালো পদক্ষেপের গতিতে সেখানেই হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে রইলো। মেহনূর কখনো শাড়ি পড়া অবস্থায় দৌড়ায়নি, আজ যে দৌড়াতে গিয়ে কতটা কষ্ট হচ্ছে, মেহনূর তবুও প্রাণপণে দৌড় লাগিয়ে বিশাল ড্রয়িংরুমটা পার করার চিন্তায় ছিলো। কিন্তু তখনই সশব্দে বাইরের হাওয়াটা গরম হয়ে উঠলো, গাড়ির দরজাগুলো ঠাস-ঠাস করে আটকানোর আওয়াজ হচ্ছিলো, মূহুর্ত্তের ভেতর দুটো হর্ণ বাজতেই সবচেয়ে ভয়াবহ শব্দ হিসেবে আওয়াজ হলো, গাড়ি ছেড়ে যাওয়ার শব্দটা।
– চলবে
#FABIYAH_MOMO .
( নোটবার্তা : অনেক অনেক দেরি করার জন্য দুঃখিত 💔। সত্যিই দুঃখিত। মন্তব্যের অপেক্ষায় রইলাম আমি। ভালোবাসা-কৃতজ্ঞতা সবার প্রতি। )