মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤ #পর্বসংখ্যা_৩১. #ফাবিয়াহ্_মমো . শেষ অংশ .

0
79

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৩১.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

শেষ অংশ .

মেহনূর সংকীর্ণ মনে কুঁকড়ে আছে। মাহতিমের দিকে চোখটা পর্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে তুলতে পারছেনা। মাহতিম ওকে কোলে নিয়ে নিজের রুমে ঢুকে গেলো। দরজাটা চাপানোর জন্য পা দিয়ে হালকা একটা ধাক্কা দিলো দরজাটায়। দরজাটা মৃদ্যু ক্রিয়া পেয়ে বন্ধ হতেই বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো মাহতিম। বিছানার কাছ ঘেঁষে চুপচাপ দাড়িয়ে পরলে এবার কাঙ্ক্ষিত মুখটার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। মেহনূরের নত করা চাহনিটুকু অনিমেষ নেত্রে অবলোকন করে ছোট্ট একটা নিশ্বাস ছাড়লো। ওই মুখটার উপর স্থির দৃষ্টি রেখে বিছানার উপর ডানহাঁটুটা তুলে দিলো মাহতিম। হাটুতে ভর দিয়ে হাতদুটো বিছানার দিকে নামাতে-নামাতে মেহনূরকে বালিশ বরাবর শুইয়ে দিলো। জীর্ণ অবস্থায় গুটিয়ে থাকা মেহনূর প্রচণ্ড জড়তায় নেত্রজোড়া বুজে ফেললো। ওমন আকষ্মিক মূহুর্তে কি করে নিজেকে স্বাভাবিক রাখবে, সেটা নিয়ে ভাববার অবকাশ ছিলোনা। খুব কাছ থেকে অনুভব করতে পারছিলো মাহতিমের সঙ্গটা। মাহতিম যে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, সেই দৃষ্টির মাঝে চোখ মেলে তাকালে যে কত বড় সর্বনাশ হয়ে যাবে, সে সম্পর্কে মেহনূর একটু হলেও অবগত ছিলো। মেহনূরের অপ্রস্তুত মুখটা দেখে মাহতিম কিছুসময় নিরব রইলো, সেই নিরবতার মাঝে ধীরে-ধীরে হাতটা এগিয়ে দিলো তখন। মেহনূরের কোমল গালের উপর আঙ্গুল ছুঁয়ে-ছুঁয়ে বলতে লাগলো মাহতিম,

– তোমাকে আমি কিছুই করবো না মেহনূর। শুধু এটাই চাই তুমি যেনো একটু ইজি ফিল করো। জানি তোমার প্রচুর সমস্যা হচ্ছে, সবকিছুই এলোমেলো লাগছে। আমাকে দেখেও তুমি স্বস্তি অনুভব করছো না। ওভাবে একা-একা কাঁদার চাইতে তুমি আমার সঙ্গেই থাকো। মা-কে এ বিষয়ে বলবো না, মা জানবেও না। তুমি ঘুমাও।

কথাটুকুর ইতি টেনে মাহতিম হাতটা সরিয়ে নিলো। মেহনূরের কাছ থেকে সরে গিয়ে জানালার পর্দাটা টেনে দিলো। নিরুত্তর মেহনূর নির্বোধের মতো তাকিয়ে থাকলে মাহতিম সেদিকে ধ্যান দিলো না। চুপচাপ রুমটা অন্ধকার করে মেহনূরের পাশে চলে আসলো। মেহনূরের দিকে পিঠ দিয়ে ওপাশ ফিরে শুলো। মেহনূর ওই অন্ধকার রুমে কিছুই স্পষ্ট দেখতে পেলো না, তবুও মনে-মনে অনুভব করতে পারছিলো, মাহতিম নামক মানুষটা বেশ দূরত্ব রেখে শুয়ে পরেছে, যতোটা দূরত্ব রাখলে মেহনূর কোনো ভয় ছাড়াই ঘুমাতে পারবে। মেহনূর কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো, সময়ের কাটাটা হুরহুর করে পেরিয়ে ষাটটা মিনিট অতিক্রম করলো। মেহনূর সময়ের হিসাব না জানলেও কানে তখন তিনটা বাজার ঘন্টা বাজলো। ঘুটঘুটে অন্ধকার রুমে আগে কখনো থাকেনি মেহনূর। গ্রামে সবসময় জানালা খুলে ঘুমাতো বলে এমন নিকষ অন্ধকারে পরতে হয়নি। এতোক্ষন কোনো সমস্যা না হলেও এখন ঠিকই বিপাকে পরতে হলো। রুমটা চরম অন্ধকার হওয়ার ফলে মেহনূর একটু হলেও ভীত হতে লাগলো। কোনো সাড়া নেই, শব্দ নেই, দূর থেকে নেড়ি কুকুরের ঘেউ ঘেউ শোনা যাচ্ছে। কুকুরের ডাকটা স্বাভাবিক হলেও পারতো, কিন্তু সে ডাক যে নিশাচর দেখলে শোনা যায় সে সম্পর্কেও জানতো মেহনূর। মূল ভয়টা তখনই আঁকড়ে ধরলো, যখন অশরীরীর ব্যাপার নিয়ে খুব ভয়ঙ্কর একটা কল্পনা করে ফেললো সে। মেহনূর তাড়াতাড়ি দুটো ঢোক গিলে ডানদিকে তাকালো। তাকিয়ে কোনো লাভ হলোনা, কিচ্ছু তখন দেখা যাচ্ছে না, এতো অন্ধকার দেখে গা ছমছম করছে ওর। একদিকে মনের ভয়, অপর দিকে নতুন পরিবেশ, এ দুটো মিলে তছনছ অবস্থা হচ্ছে মেহনূরের। মেহনূর তখন না পারতে মাহতিমের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো, ভয়ে হাতটা ঠান্ডার মতো জমে গেছে, থরথর করে অনবরত কাঁপছে, তবুও শক্ত অবলম্বন খোঁজার জন্য মাহতিমের দেহটাকে খুঁজছে তখন। হাতটা প্রথমে পাতলা কম্বলের পশমী আস্তরণটা টের পেলো, মাহতিম যে গায়ে কম্বল টেনে ঘুমিয়েছে সেটাও মানসপটে চিন্তা করে ফেললো। এদিকে কম্বলের স্তরটা যখন পার হয়ে গেলো, তখন বিদ্যুতের মতো চমকে উঠলো মেহনূর! শিরশির করে উঠলো মেহনূরের ছোট্ট দেহের কাঠামোটা! শরীরের সমস্ত লোমকূপ কাঁটা দিয়ে উঠলো তার! ঠান্ডা হাতটা উষ্ণ দেহের অস্তিত্ব পেলেও ভেতরে-ভেতরে ঝড় তুলে ফেলেছে ওর। মেহনূর চোখ-মুখ কুঁচকে মাহতিমের উন্মুক্ত পিঠটায় কাঁপা-কাঁপা হাত রেখে দিয়েছে। মাহতিম যে শোয়ার পূর্বে টিশার্ট খুলে শুয়েছে সেটা সম্ভবত অন্ধকারের জন্য টের পায়নি। মেহনূর এমন অবস্থায় ফেঁসে যাবে সেটা চিন্তাও করতে পারেনি, তন্মধ্যে ঠান্ডা হাতের পরশ পেয়ে তড়িঘড়ি করে জেগে গেলো মাহতিম। পরিস্থিতি তখন কি হচ্ছে সেটা বুঝার জন্য তাড়াতাড়ি মাথাটা মেহনূরের দিকে ঘুরালো, গা থেকে কম্বল নামিয়ে মেহনূরের হাতটা পিঠ থেকে সরালো ঠিকই, কিন্তু নরম হাতটা মুঠোবন্দি করে ধরলো। ওর দিকে সম্পূর্ণ ঘুরে প্রসন্ন কন্ঠে বললো,

– হাত ঠান্ডা কেনো? কি হয়েছে তোমার?

মাহতিমের প্রশ্ন শুনে লজ্জায়-শঙ্কায়-জড়তায় কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে মেহনূরের, মাহতিম এমন উটকো ঘটনা দেখে কি ভাববে সেটা নিয়ে চিন্তা করলেই নিজের উপর ধিক্কার হচ্ছে। মাহতিম কোনো প্রশ্নাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখালো না, মেহনূরের হাতটা নিঃশব্দে ছেড়ে দিয়ে শান্তসুরে বললো,

– কালকের মতো ওপাশ ফিরো মেহনূর।

মেহনূর কথাটা শুনে কুঁচকানো চোখটা খুললো। অন্ধকার হলেও মাহতিমের দিকে একপলক তাকিয়ে থেকে ধীরে-ধীরে ওপাশ ফিরে শুলো। উত্থাল-পাত্থাল চিন্তাগুলোধীরে-ধীরে সবর থেকে নিরব হতে থাকলে পেছন থেকে পেশীবহুল হাতটা গলার কাছে আঁকড়ে ধরলো। পিঠের উপর থেকে এলোমেলো চুল সরে বালিশের উপর স্থান পেতে থাকলো। চট করে আকস্মিকভাবে উন্মুক্ত বুকের উষ্ণতা দিয়ে জড়িয়ে ধরলো মাহতিম। গলার কাছে রাখা হাতটা দিয়ে মেহনূরকে শক্ত করে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ধরলো। মাথার কাছে চুলের উপর থুতনির কর্তৃত্ব টের পেলো মেহনূর। সেই থুতনিটা যখন কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্থানচ্যুত হলো, তখন ওষ্ঠজোড়ার কঠিন চাপ অনুভব করলো মেহনূর। চোখদুটো অজানা আন্তঃক্রিয়ায় বুজে ফেললো সে, ভেতর থেকে সমস্ত জড়তা ঝেড়ে-কেশে স্বস্তির নিশ্বাস বেরিয়ে এলো। এতোক্ষন কত শত চিন্তা, কত শত ভয়, কত রকমের জড়তা নিয়ে ক্লিষ্ট ছিলো মন, কিন্তু পরিশেষে এবং নির্বিশেষে শান্ত হলো মন। মেহনূর ঠোঁট ভেদ করে নিশ্বাস ছাড়ছিলো, সেই নিশ্বাসের স্পর্শগুলো মাহতিমের হাতের উপর ছড়িয়ে পরছিলো। মাহতিম নিরবে সবটা টের পেয়ে নিচু গলায় বললো,

– সময় হোক মেহনূর আফরিন , যেদিন তোমার সম্মতিটা পাবো সেদিন তোমার মুখটা বুকে চেপে রাখতে দেরি করবো না।

প্রচণ্ড লজ্জায় খিঁচে গেলো মেহনূর। গলার নিচে থাকা মাহতিমের হাতটা দুহাতে খামচে ধরলো তখন। মেহনূরের লজ্জা-করুণ অবস্থাটা টের পেয়ে পেছন থেকে হেসে উঠলো মাহতিম। সেই হাসিতে চোখদুটো ঘুমের জন্য বন্ধ করে ফেললো।

.
দিনের আলো ছড়িয়ে পরলে জেগে উঠলো শহর। নিরব-নিরব রাস্তাগুলো সরব হলো তখন। বাড়ির পরিবেশ জাঁকজমক ভাবে মুখর হয়ে উঠলো, একে-একে সবাই তখন নাস্তার টেবিলে আসতে থাকলো। বাড়ির নতুন বউ হিসেবে আজ মেহনূরের রান্না করার কথা, কিন্তু সেই রেওয়াজে পানি ঢেলে মারজা নিজেই সবকিছু প্রস্তুত করলেন। মেহনূরকে সাজিয়ে-গুছিয়ে পরিপাটি করে নিজের পাশে এনে রাখলেন। মাহতিম যে চালাকি করে ভোর বেলায় উঠেছে, সেই চালাকিটা জায়গামতো ফলিয়ে মেহনূরকে রুমে রেখে এসেছে। মারজা ব্যাপারটা না জানলেও তৌফের খাতিরে বাকি সবাই সেটা জেনে ফেলেছে। মাহদি কাল রাতের কথাটা পেটে চেপে রাখলেও তৌফ কথাটা পেটে রাখেনি, এমন পেট পাতলা ব্যক্তিদের দুচোখে সহ্য করতে পারেনা মাহদি। এখন তো ইচ্ছে করছে তৌফকে কড়া ভাষায় দুটো কথা শোনাতে, ভাইয়ার ব্যাপারে যখন জেনেই গিয়েছো তাহলে সেটা নিয়ে ঢোল পেটানোর মানে কি? মাহদি চুপচাপ কঠোর মুখে শুকনো রুটিতে কামড় দিলো। পাশে বসা ফারিন মাহদির গম্ভীর মুখটা দেখে খটকা মনে সবার অগোচরে বললো,

– কিরে বিট্টু, তোর মুখের এই অবস্থা কেন? সবজি থাকতে ছাগলের মতো খালি রুটি চাবাচ্ছিস কি জন্যে?

মাহদি এতোক্ষন শান্ত ভাবে রুটি চিবাচ্ছিলো, কিন্তু ফারিনের এমন হস্তক্ষেপ ওর মোটেই সহ্য হলো না। মুখটা বিরক্তিতে চুবিয়ে ফারিনের দিকে তাকালো, শুকনো রুটিটায় আরেক কামড় দিয়ে স্থিরদৃষ্টিতে বলতে লাগলো,

– তৌফ ভাইয়া কাজটা ভালো করেনি। গবেটের মতো কাজটা করেছে। সেটার জন্য আমার মুড খারাপ।

মাহদির মুখে বড় বড় ভঙ্গির কথা শুনে অবাক হয়ে তাকালো। চোখের কোটর বড় করে বিষ্ময় সুরে বললো,

– তোর মুখ যে কটকট করে চলে সেটা জানিস? ভাইয়া তো শুধু শুধু তোকে নিয়ে টেনশন করেনা। এইটুকুনি বাচ্চা তুই, যেখানে মুড শব্দটাই স্পেলিং করতে পারবি কিনা সন্দেহ, তার উপর এতো বড় কথা বলিস কিভাবে?

মাহদি এবার তিরিক্ষি মেজাজে তাকালো। হাতের রুটিটায় হিংস্র ভাবে কামড় দিয়ে স্বর নামিয়ে বললো,

– শোনো ফারিন আপু, তৌফ ভাইয়ার উচিত ছিলো চুপ থাকা। ভাইয়া গাধার মতো মাহতিম ভাইয়ার কথাটা তোমাদের জানিয়েছে। সব কথা সবাইকে বলা যায় না। আর তুমি হয়তো ভুলে গিয়েছো আমি ইংলিশ মিডিয়ামের স্টুডেন্ট। তুমি যেই ওয়ার্ডগুলো তুমি এখন চিনছো, সেগুলো আমি বাবু থাকতেই ঠোটস্থ করে ফেলেছি। আমাকে ‘ ছোট ছোট ‘ বলে কাহিনী করো না। নিজের চরকায় ডিজেল দাও।

মাহদি একদমে কথাগুলো শুনিয়ে পুনরায় খাওয়া শুরু করলো। এবার ঠিকই রুটির সাথে সবজি দিয়ে খেলো। হতভম্ব ফারিন দু’কানের মধ্যে যা শুনলো তাতেই স্তব্ধ হয়ে মাহদির দিকে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টিতে নির্বাক হয়ে টেবিল থেকে গ্লাস তুলে নিলো, ঢকঢক করে পানি খেতেই পুচকে ছেলের কথাগুলো স্মরন করতে লাগলো। এদিকে মারজার ডান পাশটায় মেহনূর বসে আছে। সবার খাওয়া-দাওয়া এবং আড্ডা পর্ব যতো দ্রুতগতিতে হচ্ছে মেহনূর ততই শান্ত ভাবে চালাচ্ছে। সবাই গপাগপ খেয়ে চললেও মেহনূর একটা রুটি নিয়ে পরে আছে অনেকক্ষন ধরে। মারজা বারবার তাড়া দিচ্ছেন বেশি বেশি খাওয়ার জন্য কিন্তু মেহনূর পারছিলো না। ঠিক তখনই রুম থেকে পরিপাটি হয়ে বেরুলো মাহতিম। কোমরের কাছে ইন করা গ্রে কালারে শার্ট, কালো বেল্টের সাথে কালো প্যান্ট, হাতে ডার্ক ব্রাউন রঙের ঘড়িটা পরতে-পরতে টেবিলের দিকে আসছিলো মাহতিম। মারজা ছেলের জন্য চেয়ার ছেড়ে উঠতে নিলে মাহতিম ইশারায় মা’কে থামিয়ে ফেলে। মারজা ইশারা পেয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে গেলো, দাঁড়ানো অবস্থায় ভ্রু কুঁচকে বললো,
– তুই বাইরে যাচ্ছিস?

মাহতিম টেবিলের কাছে আসতে-আসতেই জবাব দিলো,
– হ্যাঁ।

জবাবের পাটটা চুকাতেই মেহনূরের দিকে তাকালো। কোনো বিশেষ প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে চট করে নীতির দিকে দৃষ্টি ছুঁড়লো। মেহনূরের পাশের সিটটা দখল করার উদ্দেশ্যে নীতিকে ছোট্ট একটা ইঙ্গিত বুঝালো। ভাই-বোনের ইশারাগুলো একটুও বুঝলো না মেহনূর, ওর কিছু বোধগম্য হওয়ার পূর্বেই নীতি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো, হাসিমুখে সাবিরের পাশে চলে গেলো। খালি হওয়ার সাথে-সাথে সিট আয়ত্ত করে ফেললো মাহতিম। টেবিলের উপর থেকে উল্টানো প্লেটটা একহাতে স্বাভাবিক করে রাখতেই অন্য হাতটা রুটির বোলে চালান দিলো। মেহনূরের প্লেটটার দিকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য তাকালো মাহতিম, এরপর আর কোনো কথা না বলে সোজা মেহনূরের প্লেটে একটা রুটি রাখলো। প্লেটের উপর রুটির আগমন দেখে তৎক্ষণাৎ শিউরে উঠলো মেহনূর, তাড়াতাড়ি বামে তাকিয়ে মাহতিমের দিকে দৃষ্টি রাখলো। মাহতিম এমন ভঙ্গিতে খেতে শুরু করেছে যেনো সে কিছুই জানে না, কিছুই করেনি। মেহনূর চুপ মেরে তাকিয়ে থাকলেও ইতিমধ্যে হাসিপর্ব শুরু হয়ে গেছে। সিয়াম মুখে পানি নিয়ে বহু কষ্টে হাসি আটকে রেখেছে, যদি বায় চান্স আরেকটা দৃশ্য দেখে ফেলে ওমনেই ছলাৎ-ছলাৎ ঝর্ণার মতো মুখ বর্ষণ করে ফেলবে। সৌভিক হাসি আঁটকাতে না পেরে খুক খুক করে কেশে উঠছে, সেই কাশি থামানোর জন্য পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তৌফ। তৌফ হাসি আটঁকানোর পলিসি হিসেবে মুখে ইচ্ছামতো রুটি পুড়ে নিয়েছে। আরেকদিকে নীতি তখন ঠোঁট কামড়ে প্লেটের দিকে ঝুঁকে খাচ্ছে। মারজা ব্যাপারটা উপেক্ষার নজরে রাখলেও শেষমেশ মেহনূরের পক্ষ নিয়ে বললো,

– ও যে খেতে পারছে না দেখতে পারছিস? জোর করে যে খাওয়াতে নেই সেটা জানিস না? এক্ষুনি রুটিটা সরা মাহতিম। ওর উপর জুলুম করতে যাবি না।

মায়ের কথাটা ভালোমতো শুনলো মাহতিম, কিন্তু সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে নিজের ভঙ্গিতে বললো,

– একই নৌকার যাত্রী পেয়ে মজাই লাগছে, ঠিক না মা?

মারজা খুব শান্ত ভঙ্গিতে পানি খেতে নিয়েছিলো, কিন্তু ছেলের মুখে খোঁচা শুনে পানি আর গলা দিয়ে নামলো না। দ্রুত গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে জোরে-জোরে কেশে উঠলো মারজা। মেহনূর দ্রুত শ্বাশুড়ির কাশি দেখে পিঠে হাত বুলাতে থাকলো, এদিকে মারজা একটু শান্ত হয়ে মাহতিমের দিকে চোখ রাঙিয়ে বললো,

– তোকে এইসব কথা বলতে না করেছি না? আমাকে দেখলে কোন্ দিক দিয়ে তোর না-খাওয়া লাগে?

মাহতিম মায়ের দিকে তাকিয়ে খেতে-খেতেই বললো,

– খবরদার মা, চুপ কর। তুমি ফ্যাটি হয়ে যাচ্ছো, মোটু হয়ে গেছো, ভূড়ি বেড়ে গেছে এসব হেনতেন কথা যেনো না শুনি। তোমার ওই প্রতিবেশীদের টিটকারি যদি শুনি, তোমার কিন্তু খবর আছে মা। আমি কিন্তু তোমাকে আগেও বলেছি, আবারও বলছি, তুমি যথেষ্ট সিক। তোমার রোগটা কি সেটা তুমি নিজেও জানো। তাই বলে যদি খাওয়া কমিয়ে দিবে, না খেয়ে থাকবে তাহলে সেটাতো চলবে না। আমি ইনকাম করছি তোমাদের জন্য, নিশ্চয়ই বাবা বেঁচে থাকলে এটা সহ্য করতেন না। তাছাড়া ওইসব প্রতিবেশীদের কাছে তোমার না যাওয়াই ভালো, ওদের একটারও মেন্টালিটি আমার পছন্দ হয়নি। এতোদিন তুমি ‘ বউ বউ ‘ করেছো, এখন বউ এনে দিয়েছি, দয়াকরে ওকে নিয়ে সময় কাটাও। শেষ কথা এটাই বলবো, যদি সুন্দরের কথা বলতে হয়, তুমি যেমনি হও আমার চোখে তুমি মেহনূরের চেয়েও সুন্দর। গলা বাজিয়ে যদি বলা লাগে তাও আমি স্বীকার করবো, আমার মা, মারজা বিনতে ফেরদৌসী যথেষ্ট সুন্দরী।

মাহতিম কাটকাট সুরে কথাগুলো বলে খাওয়ার দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিলো। যেই মিচকি-মিচকি হাসির রোল চলছিলো, এখন সেটা পিনপতন নিরবতায় ছেয়ে গেছে। মাহতিমের ঠাঁট ধ্বনি শুনে সবাই নির্বাক-হতবাক হয়ে আছে। সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য হয়ে আছে মেহনূর। এই অসভ্য উপাধি পাওয়া লোকটার ভেতর নতুন রূপ দেখে আশ্চর্য হওয়া ছাড়া উপায় নেই। এতোদিন যাকে মায়ের সাথে ঠাট্টা-মষ্কারি করতে দেখা যেতো, আজ হঠাৎ করে তার মধ্যে জেদের বিষ্ফোরণও দেখা গেলো। সবাই চুপচাপ চোখ নামিয়ে ফেললো। মেহনূর ওভাবে ড্যাবড্যাবে তাকিয়ে থাকলে কয়েক মূহুর্ত্তের জন্য খাওয়া থামালো মাহতিম। মেহনূরের দিকে তাকানোর পূর্বে সবার দিকে একপলক তাকিয়ে নিলো, সবাইকে নিজ-নিজ কাজে ব্যস্ত দেখে এবার মেহনূরের দিকে তাকালো। গলার স্বরটা যথাসম্ভব নিচু করে জোর খাটিয়ে বললো,
– যদি প্লেটের খাবার শেষ না দেখি তোমাকে আমি ছাড়বো না।

মাহতিমের কথা ও চেহারার অবস্থা দেখে ভীত হলো মেহনূর। সরল চাহনিজুড়ে সঙ্গে-সঙ্গেৎ ভয়ের বিস্তার হলো। মেহনূরকে ইচ্ছে করে ভয় দেখানোর জন্যে মাহতিম কড়া দৃষ্টিতে তাকালো। গলার দিকে তাকিয়ে পুনরায় চোখে-চোখ রেখে বললো,

– গলায় কি যেনো করেছিলাম মনে আছে?

বলতে দেরি, ওমনেই গলার সেই কামড়জনিত জায়গাটায় হাত রাখলো মেহনূর। এবার মারাত্মক ভয়ে জবুথবু হয়ে মাহতিমের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মাহতিম আর বাক্য উচ্চারণ না করে টেবিল ছেড়ে উঠে গেলো। যাওয়ার পূর্বে নীতির কাছে গিয়ে কিছু বলেও আসলো। নিরুপায় মেহনূর সম্পূর্ণ বিষয়টা তখন ধরতে পারলো যখন সবাই খাওয়া শেষ করে চলে গেছে, কিন্তু নীতি তখনও মেহনূরের দিকে নজরদারি করার জন্য বসে আছে। মাহতিম জিপের চাবি তর্জনী আঙ্গুলে ঘুরাতে-ঘুরাতে চোখের সামনে দিয়ে চলে গেলো, কিন্তু মেহনূরকে আর উঠে যেতে বললো না।
.
ঠিক সন্ধ্যায় সময় চলছে। পাখ-পাখালির কলরবে ছাদের জায়গাটা রোমান্ঞ্চকর লাগছে। বাতাসও বইছে ঠান্ডা-ঠান্ডা, মনের উঠোনে মৃদ্যু-মৃদ্যু অনুভূতি জাগানোর মতো শীতল মূহুর্ত এখন। মেহনূর কালো শাড়িটার আঁচল টেনে পিঠ ঢেকে নিলো। লম্বা চুলগুলো এখন আর খোলা নেই, মারজার নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় সেগুলো এখন বেণীর আদলে রূপ নিয়েছে। মেহনূর ছাদে দাঁড়িয়ে দূরের বিল্ডিংগুলো দেখছিলো, নিবিষ্ট মনে ভাবছিলো এতোদিনের মূহুর্ত্তগুলো। চোখ বন্ধ করলেই এখন একটা মানুষের চেহারা ভাসে, বিভিন্ন সময়ে তার বিভিন্ন রূপের ধারণাতীত দেখা মিলেছে। তার সাথে জীবনের প্রতিটি স্তুর মিলাতে এখনো যেনো সময় লাগবে, সেই সময়টা কবে আসবে তার জন্য দৃঢ় প্রতীক্ষায় আছে মেহনূর। উপন্যাসের পাতায় পড়েছিলো, প্রিয়তম মানুষটাকে দেখার জন্য, ছোঁয়ার জন্য বুকের ভেতর যে ছটফটানি হয়, যে যন্ত্রণা হয়, তাকে একটাবার দেখার জন্য যে বিষাদময় কষ্ট, ঠিক কতটা দহনে দগ্ধ হয় অন্দর, ঠিক কতটা মরিয়া হলে মানুষটার জন্য অম্লান বদনে সিক্ত হয় হৃদয়, এসব অনুভূতি ব্যক্ত করা যায় না কখনো। যেদিন শিরায়-শিরায় প্রবাহ হবে অনুভূতির জোয়ার, সেদিনটা হবে অনুভূতির দিন, আকাঙ্ক্ষার দিন, অন্তরে-অন্তর প্রকাশের দিন। সে দিন কি কালিক পরিবর্তন হলেও স্মৃতির পাতায় রক্ষিত থাকবে আমৃত্যু অবধি। মেহনূর চোখ বন্ধ করে রেলিংয়ের দিকে মুখ করেছিলো, আশেপাশের কোনো পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে পারলো না, বুঝতে পারলো না, টেরও পেলো না মাহতিম একটু আগে বাসায় ফিরে এসেছে। মেহনূর বড় একটা নিশ্বাস ছেড়ে চোখ খুলে তাকালো, তখনই ওর মনে হলো কাল ২২ তারিখ। তারিখটার কথা মনে পড়ার পর যেই মনটা এতোক্ষন ভালো লাগায় আচ্ছন্ন ছিলো, সেই মনটা এখন অদ্ভুতভাবে কুঁকড়ে যাচ্ছে। কেনো যাচ্ছে জানা নেই। শুধু মনে হচ্ছিলো, রাতের অন্ধকারে যখন শক্ত অবলম্বন খুঁজবে হয়তো সেই অন্ধকারে কাউকে খুজেঁ পাবে না।

– মন খারাপ?

কথা-কন্ঠ-সুর শুনে চমকে উঠলো মেহনূর। ওমনেই রেলিং থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পিছু ফিরে তাকালো। পকেটে দুহাত গুঁজে উত্তরের জন্য তাকিয়ে আছে মাহতিম। গায়ে নেভি ব্লু রঙের টিশার্ট পরা। বুকের কাছে ইংরেজি বর্ণে সাদা কালিতে লিখা
বুকের কাছে ইংরেজি বর্ণে সাদা কালিতে লিখা, ‘ GUCCI ‘. মেহনূর লেখাটা থেকে চোখ সরিয়ে সরল গলায় বললো,
– আপনি কখন এসেছেন? আপনাকে যে আসতে দেখিনি।

মাহতিম ঠোঁটে হাসি এনে মেহনূরের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। রাতের আধারে ছেয়ে যাওয়া আকাশে দৃষ্টি রেখে বললো,

– যেখানে দাড়িয়ে আছো সেখান থেকে সবার আসা-যাওয়া দেখতে পাওয়ার কথা। অথচ তুমি আমায় দেখোনি।
মাহতিমের কথা শুনে বিমূঢ় হয়ে গেলো মেহনূর। এটা সত্য যে ছাদ থেকে নিচের সবকিছু দেখা যায়, কিন্তু এটাও সত্য যে মাহতিমকে নিয়েই বিভোর ছিলো সে। মাহতিম তখন উত্তরের অপেক্ষা না করে পকেট থেকে ডানহাতটা বের করলো। সেটা রেলিংয়ের উপর রেখে মেহনূরের দিকে এগিয়ে দিলো। মেহনূর মুখ থেকে দৃষ্টি নামিয়ে রেলিংয়ের দিকে তাকাতেই কপাল কুঁচকে ফেললো। মেহনূরের কৌতুহলী মুখটা দেখে ওর দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

– আমার রুমের চাবি। এটা তোমার কাছে রেখে দিও। কাল তো চলে যাচ্ছি, সম্ভবত ছয় মাসের ভেতর ফিরবো না। যদি ইচ্ছে হয় রুমে যেও, নয়তো তালাবন্দি করে দিও।

কথাগুলো শেষ করে চলে গেলো মাহতিম। পিছু ফিরে তাকিয়েও দেখলো না তার কথাগুলো শোনার পর আর স্বাভাবিক থাকতে নেই মেহনূর। যে চাহনি দিয়ে চাবির দিকে তাকিয়ে ছিলো সেই চাহনি ঝাপসা হয়ে অশ্রু ঝরছে। মেহনূর শব্দ আঁটকানোর জন্য ঠোঁট কামড়ে ফেললো, চোখের করুণ অবস্থা ঢাকার জন্য আচঁলটা দুচোখে চেপে ধরলো। আচঁলটা আর শুকনো রইলো না। মাহতিম ভোরের জন্য মাত্র লাগেজ ধরেছে, তখনই রুমে হাঁপাতে হাঁপাতে প্রবেশ করলো মাহদি। একদৌড়ে রুমে ঢুকে মাহতিমের হাতটা টাইট করে ধরলো, হাঁপানোর সুরেই টানতে-টানতে বললো,

– তুমি আমার বউকে কি বলেছো? ওকে তাড়াতাড়ি থামাও ভাইয়া! মা দেখতে পেলে খুব ঝামেলা করবে, তুমি প্লিজ তাড়াতাড়ি এসো। তাড়াতাড়ি চলো! দেরি করো না ভাইয়া, মা জানলে প্রচুর কাহিনী করবে!

মাহতিম তখন কিছুই বুঝতে পারলো না। এমন একটা পরিস্থিতিতে পরলো, তখন মাহদিকে জেরা করার মতো সুযোগ পেলো না। যেই লাগেজটা মনোযোগের সাথে রেডি করছিলো সেটা ওভাবেই ফেলে রেখে ছাদের দিকে দৌড় লাগালো। পিছু-পিছু দৌড় লাগালো মাহদিও, কিন্তু সে ছাদে আর ঢুকলো না। চুপচাপ হাসি দিয়ে ছাদের দরজাটা বাইরে থেকে লাগিয়ে দিলো। হাতদুটো ময়লা ঝাড়ার মতো ঝেড়ে থ্রি-কোয়াটার প্যান্টের দু’পকেটে হাত গুঁজে দিলো। ঠোঁটটা গোল করে বেসুরো ধ্বনিতে শিষ বাজাতে-বাজাতে নিচে নামতে লাগলো।

– চলবে

#FABIYAH_MOMO .

( #নোটবার্তা : আমার পরীক্ষা এখনো চল মান। তাই সবার কাছে বিশেষ বিশেষ দুয়া চাচ্ছি। আজকের পর্বটা বেশ খাপছাড়া হয়ে গিয়েছে, তার জন্য আন্তরিক মনে ক্ষমা চাচ্ছি। তবে সবার প্রতিক্রিয়ার জন্য সত্যিই আমি অপেক্ষায় রইলাম। ❤)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here