#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৪৩.
#ফাবিয়াহ্_মমো .
মাহতিমের চোখের সামনে যা ঘটলো তা চিন্তার বাইরে ছিলো! গায়ের রক্ত যেনো হিম হয়ে গেছে তার! সে ভাবতে পারেনি, কল্পনাও করেনি, মেহনূর তার জন্য থেকে যাবে। এমনই একটি মূহুর্তে তার জুতাজোড়া নিয়ে ব্যস্ত হবে সেটা ভাবনার ভেতরেই আনা দুষ্কর ছিলো। হাতের ফোনটা থেকে অনেকক্ষণ ‘ হ্যালো, হ্যালো ‘ করে শব্দ ভেসে এলো ঠিকই, শেষে সাড়া না পেয়ে কেটে গেলো সেটা। মাহতিম তখনও আশ্চর্যের রেশ কাটিয়ে স্বাভাবিক হতে পারেনি। তার মনেও পরেনা এতোটা আশ্চর্য তার কর্মজীবনে কোনো অপারেশন চলাকালীন হয়েছিলো কিনা। ভেতরের অস্বাভাবিক দূরাবস্থাটা চট করে সামলে নিয়ে খিটখিটে মেজাজে গলা তুললো মাহতিম,
– তুমি ওদের সাথে গেলে না কেনো? কি সমস্যা ছিলো ওদের সাথে যেতে? আমার সাথে চালাকি করার চেষ্টা করছো, না? যাওনি কেনো?
মুখ তুলে সরল দৃষ্টিতে তাকালো মেহনূর, তাকিয়ে থাকতেই জুতার গিটটা দুহাতে টাইট দিয়ে স্থিরচোখেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। স্মিত হাস্যে শান্ত গলায় বললো,
– আমিযে আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
শিরশির করে কথাটা যেনো বেজে উঠলো কোথাও, তবুও সেটা ভাব-সাবে প্রকাশ করলো না মাহতিম। মুখের অবস্থা পূর্বের চেয়েও কাঠিন্য করে হনহন গতিতে মেহনূরের ডানসাইড কেটে সোজা বাইরে বেরুলো, প্যান্টের ডান পকেট থেকে চাবি বের করতেই চট করে জিপে উঠে বসলো। বসতেই শরীরটা যেনো চিনচিন করে উঠলো তার, আবারও গতরাতের ব্যথাটা শিরায়-শিরায় সিগন্যাল দিয়ে যাচ্ছে, ব্যথাটা সাধারণ মানুষের জন্য তীব্র, তবে এটা আপাতদৃষ্টিতে তার জন্য কিছুই না। এক সেকেন্ডের মতো দাঁত শক্ত করে চোখদুটো বন্ধ রাখলো সে, জোরে একটা দৃঢ়ভঙ্গির নিশ্বাস ছাড়তেই স্টিয়ারিংয়ে দুহাত রাখলো মাহতিম, যেই স্টার্ট দিয়ে জিপের ব্রেকজনিত ব্যাপারটা চেক দিতে নেয়, তখনই দরজার দিকে দৃষ্টি থমকে স্টিয়ারিংয়ের হাতদুটো শক্ত হয়ে এলো। দরজা দিয়ে পায়ে-পায়ে বেরিয়ে এলো নীলাভ ছায়ার মানবী, তার মুখটা করুণ লজ্জায় আবৃত হয়ে আছে, দ্বিধাগ্রস্ত দৃষ্টিদুটো ভূমিতে নিক্ষেপ করে পেটের কাছে হাতদুটো কচলাতে-কচলাতে জিপের কাছে চলে আসছে, একজোড়া তীক্ষ্ম-বিচক্ষণ চোখ তার আগমন দেখে অনিমেষ নয়নজোড়ায় তাকিয়ে আছে। নীল শাড়িটার দিকে পর্যবেক্ষণশীল দৃষ্টিদুটো একবার রাখতেই তার মেমোরি সেন্স জানান দিলো, শাড়িটা তারই কিনে দেওয়া। দূরত্বটুকু পায়ে হেঁটে ঘুচাতেই ড্রাইভিং সিটের পাশে এলো মেহনূর, আড়চোখে দেখতে পেলো, তার ব্যক্তিগত মানুষটা আজ আগের মতো হাসি-হাসি চোখে দেখলো না। সে একটুও যেনো গ্রাহ্য করলো না, একবারও চোখ তুলে তাকালো না। মেহনূর যে আজ ব্যতিক্রম করে সেজেছে তা কি চোখে পরেনি? এইযে ব্লাউজের হাতাটা ছোট পরেছে, তারই কিনে দেওয়া শাড়িটা গায়ে পেঁচিয়ে নিয়েছে, বাইরে বেরুলে কখনো পিঠ উন্মুক্ত ব্লাউজ না পরা সত্ত্বেও আজ পরেছে, এগুলো কি তার চোখে পরছেনা? মেহনূর মুখ তুলে দেখলো, মাহতিম তার দিকে একদম তাকিয়ে নেই, সে জিপ স্টার্টের জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতিটা নিয়ে ফেলেছে। শাড়ি পরে জিপে উঠতে এবারও হিমশিম খেলো মেহনূর, মাটি থেকে বেশ উঁচু লেগস্ট্যান্ডটায় পা উঠাতে ব্যর্থ হচ্ছিলো, তার পা’টা ফসকে যাচ্ছিলো বারবার। ব্যর্থতার অথৈ জলে হাবুডুবু খেলেও মনে শেষ আশাটুকু ছিলো যে, মাহতিম এখুনি হাত বাড়িয়ে তাকে উঠতে সাহায্য করবে, কিন্তু আফসোসের গলাধঃকরণ করে মাহতিম এসবের কিছুই করলো না, বরন্ঞ্চ ঝাঁঝালো গলায় ধমক লাগিয়ে এখানে ফেলে যাওয়ার হুঙ্কার দিয়ে বসলো। দূর থেকে বাগানের ফুলে পানি দিতেই পুরো দৃশ্যটা দেখছিলো সিরাজ কাকা, তিনি অবস্থা বেগতিক দেখে তাড়াতাড়ি পানির পাইপ ফেলে গ্যারেজের দিকে ছুটে গেলেন, একই দৌড়ে তিনি বগলচাপা করে লাল বস্তুটা মেহনূরের কাছে এনে রাখলেন, মেহনূর কাঁদো-কাঁদো চেহারায় দৃষ্টি ফেলে দেখলো, তার পায়ের কাছে জিপে উঠার জন্য একটা টুল রাখা হয়েছে। মেহনূর টুল থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ডানে তাকিয়ে সিরাজ কাকার দিকে তাকালো, বৃদ্ধ সিরাজ অভয় সূচকে মাথা নাড়িয়ে টুলে পা বাড়ানোর ইশারা করলেন। অদ্ভুত এক আনন্দে উদাসী মুখের মধ্যেই হাসিটুকু উঁকি দিলো মেহনূরের, টুলে পা ফেলে জিপে উঠে বসতেই দায়িত্বভার হিসেবে ঝুলন্ত আঁচলটুকু মেহনূরের কোলে তুলে দিলেন সিরাজ কাকা। মাহতিম এসবের দিকে ভ্রুক্ষেপ পযর্ন্ত করছিলো না, সে শুধু সিরাজ কাকার দিকে চোখ দিয়ে বাড়ির দিকে ইশারা করলো। শব্দহীন মুখে একবার ‘ হ্যাঁ ‘ সূচকে মাথা নাড়িয়ে অব্যক্ত আজ্ঞাটা বুঝিয়ে দিলেন সিরাজ। গোলাকার স্টিয়ারিংটা দুটি দক্ষ হাতের চালনা পেয়ে সমস্ত জড়তা ছেড়ে গতিশক্তি ধারণ করলো, জিপটা শোঁ শোঁ করে বাড়ির শূন্য ঠোকাঠা মাড়িয়ে বেজায় স্পিডে ছুটতে লাগলো।
.
হৃদয়ের কপাটগুলো ভয়ের আস্তরণে নড়বড়ে হয়ে আছে, অবচেতন মনটা মিনিটে-মিনিটে অদ্ভুত কিছুর আভাস দিচ্ছে। সেই আভাসে আরো সংকুচিত হয়ে লজ্জাবতী পাতার মতো কুঁকড়ে যাচ্ছেন মারজা। তার সরল মনের শান্ত আঙিনাটা এই যাত্রা নিয়ে কোনোভাবেই স্বাভাবিক থাকতে পারছেনা, তার মাতৃতুল্য অমূল্য স্নেহের মনটা অজানা-অচেনা ভয়ের কোটরে ঢুকে গেছে, মনে হচ্ছে এবার খুবই খারাপ কিছুর মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। ভেতর থেকে কোনোভাবেই ভালো কিছুর ‘ শুভসংকেত ‘ পাচ্ছেন না, হাজার চেষ্টা করেও শান্ত থাকার বদলে চাপা অস্থিরতায় উদ্বিগ্ন হয়ে পরছেন তিনি। একটু পরপর সবার আগমন নিয়ে খবর নিচ্ছেন, মাথা ঘুরিয়ে পেছন থেকে তাদের গাড়ি দেখা চেষ্টা করছেন, বোতল খুলে ঢকঢক করে পানি খাচ্ছেন, আবার মাঝে-মাঝে পানিটা কুলি করে চলন্ত গাড়ির খোলা জানালা দিয়ে ফেলছেন। পেছনের সিটে বসা অনামিকা মারজার কীর্তিকলাপ দেখে কৌতুহলী হওয়ার পরিবর্তে বিরক্ত হচ্ছে, এই মহিলা কিসের ঢং শুরু করেছে? ঢং করার কি জায়গা পেলো না? এমন ফালতু ভাবে কেউ হাইরোডে কুলি করে? ‘ মেন্টাল ‘ বলে মনে-মনে বিরক্তির বার্তা ছুঁড়লো অনামিকা। রজনী এমনভাবে ড্রাইভিং করছে যেনো সে ট্যূরের চূড়ান্ত স্ফূর্তিতে মেতে আছে। মোবাইল টেপা বাদ নিয়ে কানে সাদা-সাদা দুটো ইয়ারপড গুঁজলো অনামিকা, ফেসবুক স্ক্রল করতেই একটি লোমহর্ষক লাইভ টেলিকাস্ট দেখে আতঙ্কে তার মুখটা হা হতে লাগলো। নিষ্পলক দৃষ্টিতে লাইভের অবস্থাটা দেখতেই গলা শুকিয়ে খরা, বহু কষ্টে ভীতগ্রস্থ চাহনিদুটো ফোন থেকে সরাতে পারলো অনামিকা, কথা বলতে গেলো কিন্তু কন্ঠস্বর যেনো তোতলা সুরে বিকৃত হয়ে গেলো তার,
– ফু-ফু-ফু-ফুপ…ফুপি রাস্তায় স্ট্রাই— ,
.
বেপরোয়া স্পিডে শহরের হাইরোড মাড়িয়ে মাইক্রোবাসটা ছুটছে। সমুদ্র দেখার অভিলাষে তন-মন যেনো প্রফুল্লতায় মেতে উঠেছে, মাইক্রোর সেই বদ্ধ পরিকর চলন্ত পরিবেশে সুর উঠলো নীতির,
‘ দুঃখটাকে দিলাম ছুটি আসবেনা ফিরে, ‘
নীতির হাসিতে গেয়ে উঠলো প্রীতির চন্ঞ্চল মন,
‘ এক পৃথিবী ভালোবাসা রয়েছে ঘিরে, ‘
দুবোনকে ছাড়িয়ে ড্রাইভিং সিট থেকে বললো তৌফ,
– ‘ দুঃখ টাকে দিলাম ছুটি আসবেনা ফিরে, ‘
মুচকি হাসিতে নিজেও ঠোঁট নাড়ালো সৌভিক,
– ‘ এক পৃথিবী ভালবাসা রয়েছে ঘিরে, ‘
সবাইকে টেক্কা দিয়ে হাতদুটো পাখির ডানার মতো ঢেউয়ের ভঙ্গি করে গাইলো ফারিন,
– ‘ মনটা যেন আজ পাখির ডানা, ‘
পাশ থেকে কলি ছিনিয়ে গেয়ে উঠলো মাহদি,
– ‘ হারিয়ে যেতে তাই নেইতো মানা, ‘
ঠোঁটের কাছে ফিসফিসিয়ে বলার মতো সুর তুললো সিয়াম,
– ‘ চুপি চুপি চুপি সপ্ন ডাকে হাত বারিয়ে, ‘
খিলখিল হাস্য ধ্বনিতে সবাই যেনো মিলে গেলো তখন। পুরো মাইক্রোতে যেনো হাসির কলরব ছুঁয়ে-ছুঁয়ে যাচ্ছিলো, পেছনের সিট থেকে গিটারের টুংটাং আওয়াজে কাঙ্ক্ষিত গানের মিউজিক বাজতেই দারুণ উল্লাসে, দারুণ আমেজে একসাথে গলা মিলিয়ে গাইলো সবাই,
মন চায় মন চায়,
যেখানে চোখ যায়,
সেখানে যাব হারিয়ে
ওওও
মন চায় মন চায়,
যেখানে চোখ যায়,
সেখানে যাব হারিয়ে।
.
দুপুরের তৃতীয় প্রহর চলছে, অরুণের তেজী চাকাটা আজ ম্রিয়মাণ। গ্রীষ্মের মতো দাপট না দেখালেও শীতের হিমেলে উষ্ণতা ছড়াচ্ছে। হাইরোডে এখন জ্যাম নেই, আজ যে কেনো এমন জ্যাম নেই তা ধরতে পারছেনা মাহতিম। বেকুবের দলটা ফোনই ধরছেনা, এদিকে মেহনূরকেও জিপে রাখা সম্ভব না। ধ্যাত! কেনো করলো এই কাজ? কেনো ওদের সাথে গেলো না? রাগটা সম্পূর্ণ নিজের মধ্যেই চেপে রাখলো মাহতিম। এই মূহুর্তে রাগ দেখিয়ে লাভ নেই, একটু আগে কল এসেছে সামনের পরিস্থিতি খুবই খারাপ! সড়ক অবরোধ করে দলবল জুটিয়ে গাড়ি ভাঙচুর করছে, যত্রতত্র আগুন জ্বালিয়ে হাহাকার অবস্থা! রাজনৈতিক অবস্থাটা ইতিবাচকের পাশাপাশির কতটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে তা আর বলার প্রয়োজন রাখেনা। বাঁহাতের হাতঘড়িটায় একপলকের জন্য চোখ বুলিয়ে ফের সামনের দিকে তাকালো, খুব একটা সময় খুব। কখন-কিভাবে-কোনদিক দিয়ে বিপদ এসে হানা দেয় বুঝতে পারছেনা, ভয়টা নিজের জন্য না হলেও পাশে থাকা মানুষটার জন্য হচ্ছে। ড্রাইভিংয়ের ফাঁকে-ফাঁকে কালো সানগ্লাসের আড়ালে নজর রাখাটা থেমে নেই, পাংশুটে ছোট্ট মুখটা কেমন মিইয়ে গেছে। একরত্নি হাসি নেই সেখানে, উজ্জ্বলতার রেশ নেই, দৃষ্টিদুটোও বিষণ্ণ, ঠিক নুইয়ে পরা ছোট্ট চারাগাছের মতো। মুখটা বায়ে ফিরিয়ে চলন্ত জিপ থেকে ছুটে যাওয়া দৃশ্যগুলো চুপ করে দেখছিলো মেহনূর। মাথাটা সিটের সাথে হেলান দিয়ে ঘুম-ঘুম অবস্থায় দেখছিলো। আজও গাধার মতো গায়ে গরম পোশাক নেই, আবার শাড়িটাও অতো মোটা পরেনি। কাঁপুনি ধরানো ঠান্ডা বাতাসে একটু পরপর বাহুতে হাত ঘষে উষ্ণসূচক করছিলো সে, আঁচলটা দিয়ে গা ঢাকা সত্ত্বেও কাঁপুনি কমছেনা। পাশ থেকে আড়চোখে ড্রাইভ করা অবস্থায় ওসব কীর্তিকাণ্ড দেখে চোখ সামনের দিকে ঘুরালো মাহতিম, কিছু একটা চিন্তা করে স্পিড খানিকটা কমিয়ে আনতেই চিন্তার অঙ্কটা ক্ষণিকের ভেতর ফলে গেলো। মেহনূর ঘুমে বিভোর হয়ে যেই মাথাটা বাঁদিকে রাস্তা বরাবর ছেড়ে দিতে নিলো, সাথে-সাথে একসেকেন্ডও দেরি না করে ঘাড়ের পেছনে হাত গলিয়ে মেহনূরকে আগলে ধরলো মাহতিম। তন্দ্রাচ্ছন্ন মেহনূর নির্ঘুম রাত্রির ক্লেশে ঘুমাতে না পারলেও প্রশান্তিময় জিপের ভ্রমনে গভীর তন্দ্রায় ডুবে গেছে, মেহনূরকে বুঝতে না দিয়ে আস্তে করে ওর মাথাটা নিজের কাধে রাখলো মাহতিম। গ্রীষ্মের তালুফাটা গরমে যখন তৃষ্ণার্ত গলাটা ঠান্ডা পানির স্বাদ পেয়ে অদ্ভুত শান্তিতে চোখ বুজে আসে, মাহতিমও যেনো কাধের উপর উষ্ণতার ভর পেয়ে চোখদুটো ক্ষণকালের জন্য বন্ধ করেছিলো। আজ যদি জিপটা নিজে না চালাতো, তবে ওই ঘুম-ঘুম বিষণ্ণ কোমল মুখটায় অসংখ্য ছোঁয়া ছুঁইয়ে দিতো মাহতিম। উন্মাদের মতোই দুহাতে মুখটা তুলে কাজটা করতো সে, একটুও বাধা-নিষেধ মান্য করে নিজের প্রগাঢ় ইচ্ছাটা পাথর চাপা দিতো না। বুক হালকা করে নিশ্বাস ছাড়লো মাহতিম, হঠাৎ প্যান্টের ডান পকেটটায় সুড়সুড়ি দিয়ে উঠলো। তার ভাইব্রেট ফোনটা কলের জন্য বাজছে, মাহতিম ফোনটা বের করে দেখলো সামিকের নাম্বার থেকে কল এসেছে। জিপটা সুযোগ মতো রাস্তার একপাশে থামিয়ে কলটা রিসিভ করলো মাহতিম, মেহনূরের ঘুমন্ত দেহটা একইভাবে ধরে রেখে ছোট্ট স্বরে ‘ হ্যালো, হ্যাঁ সামি– ‘ বলতে নেবে তখনই কথাটা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে আতঙ্কগ্রস্থে চেঁচিয়ে উঠলো সামিক,
– মাহতিম ভাই, তুমি কোথায়? ভাই খবরদার তুমি আর এগিয়েও না। এখানে গাড়ি ভাঙচুর করছে! রাস্তায় স্ট্রাইক চলছে ভাই, তুমি জলদি জিপ ঘুরাও! তাড়াতাড়ি ঘুরিয়ে গাজীপুরের রাস্তা ধরো! আর এগিও না। আমি সবাইকে নিয়ে আমার বন্ধুর বাসায় উঠেছি। সামনের রাস্তা খুবই জঘন্য, ওরা গাড়িতে আগুন পযর্ন্ত দিয়ে ফেলছে! তোমাকে নেটওয়ার্কের জন্য কলও দিতে পারছিলাম না। ভাই প্লিজ তাড়াতাড়ি, প্লিজ তাড়াতাড়ি পালাও।
সামিকের অস্থির কন্ঠের চেঁচামেচি শুনে নিজেকে ধাতস্থ রাখলো মাহতিম। পরিস্থিতি যতোই নাগালের বাইরে যাক, নিজের ধূর্ত মস্তিষ্কটার উপর ভালোই ভরসা আছে। সামিককে শান্ত হতে বলে নিজেও কয়েক মিনিটের ভেতর যুৎসই প্ল্যান সাজিয়ে নিলো। এর জন্য কিছুক্ষণ গুগলে ঘাঁটাঘাটি করলো মাহতিম, বৃদ্ধাঙ্গুলে উপর-টু-নিচ স্ক্রিল করতেই হঠাৎ একটা কনটেন্ট দেখে বৃদ্ধাঙ্গুলটা থেমে গেলো তার। সানগ্লাসের ভেতর দিয়ে বুদ্ধিদীপ্ত দৃষ্টিদুটো সেই ইংরেজিতে লেখা কনটেন্টে বুলাতেই ঠোঁটে বিচক্ষণতার বাঁকা হাসিটা খেলে গেলো। এখন তাকে জরুরী দুটো কল করতে হবে, পাওয়ারটা আবারও খাটানোর সময় এসে পরেছে। কলটা ডায়ালে ফেলে কানে চাপতেই মেহনূরের দিকে মুখ করলো মাহতিম, সানগ্লাসের দৃষ্টিটা মেহনূরের মুখের উপর ফেলে চাপা হাসিতে বিড়বিড় করে বলে উঠলো,
– ‘ এবার যদি বায় চান্স আউট অফ কন্ট্রোল হই, আংশিক মধুচন্দ্রিমা হয়েই যাবে। ‘
.
রাতের খোলসে ঝিমিয়ে আছে মহিনপুরের গ্রামটা। গ্রামের নামটা এতোদিন ধামাচাপা ছিলো অনিচ্ছুক কারণে, তবে এটা যেহেতু খোলাশা হয়েই গেছে সেক্ষেত্রে বলা উচিত এটা মেহেরপুরের কাছাকাছি। গ্রামটা মূলত মেহনূর আফরিনের শৈশবের স্মৃতিখানি, তার বেড়ে উঠার একমাত্র স্থল ছিলো। কিন্তু ‘ বিয়ে ‘ নামক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সেই গ্রাম থেকে আজ বহুদূরে বসবাস করছে।’ স্বামী ‘ নামক পুরুষের সাথে তার বৈবাহিক সম্পর্ক এখন পন্ঞ্চম মাসে পর্দাপণ করেছে, এ নিয়ে ক্যালেন্ডারের সামনে দাঁড়িয়ে দিন হিসাব করলো হান্নান শেখ। হ্যাঁ, পন্ঞ্চম মাসটা শুরু হয়েছে বৈকি, কিন্তু সম্পর্কটা আদৌ স্বামী-স্ত্রীতে পরিণত হয়েছে কিনা সেটা জানাটা জরুরী। তিনি জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা এখন জঘন্য নিয়মে শুধরাতে চাইছেন, হোক সেটা ভুল, সব ভুলেরই তো সমাধান আছে। যদি তার নাতনী ওই ধুরন্ধর লোকের সাথে এখনো সম্পর্ক স্থাপন না করে থাকে, তাহলে তিনিও ষোলআনা মিলিয়ে কাহিনী শেষ করে দিবেন। ওই বদমাইশের বাচ্চাটাকে সামনে পেলে সবার আগে ওর মাথাটা থেতলে দিতেন তিনি। কতো বড় চালাকি করেছে ওই শয়তান! তারই বাড়িতে ঢুকে, তারই নাকের নিচে থেকে-থেকে দাবার গুটি সাজিয়ে নিয়েছে, আবার সুযোগ মতো ছোঁক করে ছোবল মেরে গুটি সরিয়ে ফেলেছে। তিনি কি এতোদিন চোখে পট্টি মেরে ঘুমাচ্ছিলেন নাকি? ওই হারামির কর্মকাণ্ড কি করে তিনি দেখতে পেলেন না? নির্ঘাত ওই বদমাইশের বাচ্চা অনেক তথ্য হাতিয়ে ফেলেছে। মেহনূরকে বিয়ে দেওয়ার সময় ছোট্ট একটা শর্ত রেখেছিলো হান্নান শেখ, তার ছোট নাতনীটা যেহেতু এখনো বয়সে পাকা হয়নি, তাই তাকে কাবিন করেই রাখা হোক, সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই। এ কথায় মাহতিম তার সাথে সম্পূর্ণ দ্বিমত পোষণ করে বলেছিলো, বিয়েটা যেহেতু হয়েই গেছে সেক্ষেত্রে বাড়ির বউ বাড়িতে ফিরলেই যুগোপযোগী, বাপের বাড়িতে না থেকে আসল বাড়িতে থাকাটাই ঠিক হবে। মারজা যদি সেদিন ‘ হ্যাঁ, হ্যাঁ ‘ করে জোর না দিতো, তাহলে হান্নান শেখ খুব সহজেই তার সহজ-সরল নাতনীকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে সরিয়ে আজ আনতে পারতেন। খুব সহজেই আরেক পাত্র খুঁজে তাদের ভুলভাল বুঝিয়ে বিয়ে দিয়ে দিতেন। নিজের কপালে গুণে-গুণে দশটা ঝাড়ুর বারি লাগাতে ইচ্ছে করছে, তিনি যে খাল কেটে নিজ বাড়িতেই কুমির চাষ করেছেন সেটা বুঝতে পেরে কঠিনভাবে আফসোস হচ্ছে। ওমন সুপুরুষের মাথায় চতুর বুদ্ধির ক্ষমতাটা আসলেই আশ্চর্যজনক! মাহতিম আনসারী খুবই বিপদজ্জনক মানুষ এ নিয়ে মনে আর সন্দেহ নেই হান্নান শেখের।
.
আজ সবকিছু বিপক্ষে চলে যাচ্ছে, বলা নেই, কওয়া নেই, হুট করে আকাশ চিঁড়ে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। চোখের সামনে প্রায় একহাত পযর্ন্ত বৃষ্টির জন্য স্পষ্ট দেখা যাচ্ছেনা, নিগুঢ় অন্ধকারে তলিয়ে আছে আকাশের গুমোট চেহারা। মাথায় বৃষ্টি নিয়ে তবুও জিপ ছুটাচ্ছে মাহতিম। বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি চালানো অনেকাংশে নিষিদ্ধ হলেও মাহতিম উলটো স্পিড বাড়িয়ে চালাচ্ছে। বৃষ্টি ফোঁটা যেনো ঠান্ডার একেকটা গোলার মতো আকাশ থেকে ঝরছে, একদম দেহের পশম ছুঁয়ে অন্তঃস্থলে ছুড়ির মতো মারছে। এর চেয়েও ঠান্ডা পানিতে ট্রেনিং নেওয়ার কার্যকরী দক্ষতা তার আছে, অথচ আজ চিন্তার ঘড়িটা বারবার মেহনূরের জন্য টিকটিক করছে। গ্রাম্য রাস্তাটায় পানি জমার কারণে জিপের বেদম গতিতে ‘ ছলাৎ ছলাৎ ‘ করে পানি ভাঙ্গার আওয়াজ উঠছে, সুনশান চারদিকে, কোনো ধরনের কোলাহল নেই, শহুরের হর্ণের ছিঁটেফোঁটা যন্ত্রনাও নেই এখানে। ঢাকা থেকে অদূরে যানবাহনের কালোধোঁয়া মুক্ত পরিবেশে গাজীপুর জেলার রাজেন্দ্রপুর উপজেলার রাজাবাড়ি বাজার ইউনিয়নের চিনা শুখানিয়া গ্রামে সম্পূর্ণ গ্রাম্য পরিবেশে গড়ে উঠেছে ‘ নক্ষত্র বাড়ি ‘ রিসোর্ট। রিসোর্টটি শ্রীপুরের কাছে অবস্থিত। দেশের জনপ্রিয় দম্পতি তথা চলচ্চিত্র পরিচালক তৌকির আহমেদ এবং অভিনেত্রী বিপাশা হায়াতের সুকৌশল চিন্তাধারায় নির্মিত বানিজ্যিক রেসোর্টির উদ্দেশ্যে যাত্রা ধরেছে মাহতিম। শীতে দাঁত কপাটি দিয়ে কাঁপতে থাকা মেহনূর কাঁপতে-কাঁপতে মাহতিমের দিকে বললো,
– এটা কি আমাদের গ্রাম?
মাহতিম তার দিকে না তাকিয়ে কপালের চুলগুলো আবার ব্যাকব্রাশ করে কাটকাট সুরে বললো,
– না।
মেহনূর আর প্রশ্ন করার অবস্থা পাচ্ছিলো না। ঠান্ডায় তার বুকের ভেতর ভারী হয়ে গেছে। নাক বন্ধ হওয়ার ফলে মুখ খুলে নিশ্বাস নিচ্ছে। প্রচণ্ড অসহ্য অনুভূতিতে ছটফট করছে মেহনূর। শৈশব থেকে এই ঠান্ডার জন্য করুণভাবে ভুগছে, নিশ্বাস আঁটকেও আসছে এখন। ড্রাইভিংয়ের ফাঁকে বামে তাকালো মাহতিম। কাঁপতে থাকা উন্মুক্ত পিঠটায় বৃষ্টির বিধ্বংসী ফোঁটাগুলো হিংস্রভাবে পরছে। সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে গরম গলায় বললো মাহতিম,
– পাকনামো করে পিঠ খোলা ব্লাউজ পরেছো কি জন্যে?
কাঁপতে-কাঁপতে লাল চোখ তুললো মেহনূর। ঠান্ডায় দাঁতকপাটি লাগার সুরে অত্যন্ত ধীরভাবে বললো,
– আপনার জন্য।
চকিত ভঙ্গিতে আবার বামে তাকালো মাহতিম। তাকানোটা অস্থায়ী রেখে দ্রুত চোখ সরিয়ে ‘ নক্ষত্রবাড়ি ‘ রেসোর্টের সদর দরজা দিয়ে জিপ ঢুকিয়ে দিলো। বুকিংজনিত কাজটা কলেই সম্পণ্ণ করেছিলো বলে দ্রুততার সাথে নিজেদের কটেজ পেয়ে গেলো। কটেজ পযর্ন্ত যাওয়ার দূরত্বটুকু বৃষ্টির মধ্যেই একসঙ্গে হাঁটা দিলো। মাহতিম বড়-বড় পা ফেলে এগিয়ে গেলেও তার সাথে তাল মেলাতে না পেরে পিছিয়ে পরলো মেহনূর। অসহন গলায় কাশতে-কাশতে বললো,
– শুনুন,
ঝুম বৃষ্টির জোরালোপূর্ণ আওয়াজে শুনতে পেলো না মাহতিম। সে নিজগতিতে পা চালিয়ে দ্রুত কটেজের ভেতরে ঢুকে গেলো। মেহনূরের জন্য শুকনো কাপড়ের ব্যবস্থা করাটা এখন মূখ্য কর্ম! তার সাথে ওর কোনো পোশাকই নেই, যদি নিজের লাগেজটা খুলে কিছু পাওয়া যায় তা দিয়েই রাতটা চালানোর ব্যবস্থা করতে হবে। লাগেজটা ফ্লোরে ফেলে তাড়াতাড়ি উপর্যুক্ত পোশাক খুঁজলো মাহতিম, ভাঁজ করা ইস্ত্রির শার্টগুলো মাহতিমের ভেজা হাতের পরশ পেয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছিলো, উলোটপালোট করে খুঁজতেই ব্যস্ত ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো মাহতিম,
– তুমি কি আজ রাতটুকুর জন্য আমার শার্ট পরতে পারবে? ভেজা শাড়িতে থাকলে তোমার নিউমোনিয়া হয়ে যাবে। কোনটা পরবে জলদি বলো?
প্রশ্ন করার প্রায় দুই মিনিট পেরিয়ে গেলো। চারপাশ থেকে কোনো উত্তরই এলো না। মাহতিম ভাবলো অভিমানে চুপটি মেরে আছে হয়তো, সে এবার মাথা পিছু ঘুরিয়ে ‘ মেহনূর জবাব দিচ্ছো না কেনো? ‘ বলেই ভ্রুঁ কুঁচকে ফেললো। ডানে-বামে-চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে চিৎকার দিলো,
– মেহনূর !
হাঁটু সোজা করে অগোছালো লাগেজ ফেলেই উঠে দাঁড়ালো মাহতিম! এই প্রথম অস্থিরতায়-উৎকন্ঠায়-উদ্বিগ্নে তার বক্ষস্থল পযর্ন্ত ধুকপুক-ধুকপুক করছে! এক দৌঁড়ে কটেজের রুম থেকে বেরিয়ে ডানে-বামে চোখ ঘুরাতেই কটেজের নিয়নবাতির ঝাপসা বর্ষণে নীল শাড়িটা নজর কাড়লো। কাঠের ও বাঁশের লম্বা লনটার শেষ মাথায় জবুথবু অবস্থায় হাঁটুতে মাথা রেখে হাঁপানো রোগীর মতো কাপছিলো মেহনূর। অপরাধী দৃষ্টিতে দাঁতে-দাঁত শক্ত করে ‘ ও আল্লাহ্, কি করলাম! ‘ বলতেই সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে দৌঁড়ে গেলো মাহতিম। মেহনূরের সামনে পা থামিয়ে ধপ করে হাঁটু ভেঙ্গে বসে পরলো সে। কানে অদ্ভুত শব্দটা বেজে উঠলে নতমাথা ধীরে-ধীরে উঠালো মেহনূর। লাল টকটকে চোখের পাতা টেনে খুলতেই সামনের দিকে তাকালো, ঘোলা-ঘোলা চাহনিতে দেখতে পেলো সাদা শার্টটা দেখা যাচ্ছে। চুলগুলো পানিতে জেলহীন হয়ে কপালের কাছে ছড়িয়ে আছে, টুপ-টুপ করে চুল চুয়ে পানি পরছে তার। ঠোঁটদুটো গাছের কচিপাতার মতো দুলে-দুলে কাঁপছে। মেহনূর একদৃষ্টিতে আধবোজা চাহনিতে তাকিয়ে থাকলে দুঃখী কন্ঠে বললো,
– সরি,
মেহনূরের অবস্থা যেনো ‘ নো নড়া, নো চড়া ‘ ভঙ্গিতে থমকে আছে। মাহতিম আরো নত হয়ে মেহনূরের দিকে এগিয়ে গেলো, ঠান্ডা গালদুটো ধরে মুখটার আরেক ধাপ কাছে এগুলো। ভারাক্রান্ত চাহনি দিয়ে অপরাধী গলায় বললো,
– পেছনে তাকাতে খেয়াল ছিলো না।
নির্যুত্তর মুখে ফ্যাকাশে দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মেহনূর। মাহতিম আবার নরম গলায় বললো,
– বসে আছো কেনো? যাবে না?
চোখ বন্ধ করলো মেহনূর, আবার চোখ খুলে মাহতিমের দিকে তাকিয়ে ধীরে-ধীরে মাথাটা ডানে-বামে নাড়িয়ে দিলো। আশ্চর্যে হতবাক হতেই মাহতিম তৎক্ষণাৎ অস্থির কন্ঠে ক্ষোভ দেখিয়ে বললো,
– যাবে না মানে? ফাজলামি? ফাজলামি করছো?
ক্ষেপাটে চোখদ্বয় জ্বলজ্বল করে উঠলে মেহনূরকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মাহতিম। মেহনূর তখন জুলজুল চোখে মাহতিমকে দেখছিলো। অনেকটা নির্বাকভাবে, অনেকটা ভাবশূন্য চাহনিতে। মাহতিম কোনোদিকে কোনোকিছু পরোয়া না করে মেহনূরের হাঁটুর নিচে ডানহাত এবং ঘাড়ের নিচে বাঁহাত ঢুকিয়ে শূন্যে তুলে ফেললো। পাজকোলে আষ্টেপৃষ্টে আবদ্ধ করতেই বুকের কাছে মেহনূরের একপাশটা লেগে গেলো। মেহনূর অনুভব করছে, মাহতিম তাকে কোলে তুলেই কটেজমুখো হয়েছে, সে চাপা জেদ হিসেবে দৃঢ় বাহুবলে মেহনূরকে চেপে রেখেছে। সিড়ির ধাপগুলো পদে-পদে অতিক্রম করে কটেজের রুমে প্রবেশ করলো মাহতিম, রুমের ঠিক মধ্যখানটায় সিলিং থেকে বিশাল আকারের ঝারবাতি জ্বলছে। সেই ঝারবাতির আলোতেই নান্দনিক শোভায় পরিপূর্ণ রুমটা মনোরম হয়ে আছে। পা দিয়ে দরজাটা চাপিয়ে দিলো মাহতিম, মেহনূরের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে আস্তে-আস্তে রুমের ডানদিকটায় চলে যাচ্ছিলো সে। কন্ঠটা কোমল করে হাসি দিয়ে বললো,
– আমার শার্ট পরতে হবে ম্যাডাম। কোন কালারটা পড়বেন আপনি?
মাহতিমের কথা ও হাসি দুটোই কৌতুহল করে দিলো মেহনূরকে। অনেকক্ষণ পর স্বচ্ছ চাহনিতে প্রশ্ন সূচকে জিজ্ঞেস বললো,
– কেনো?
মাহতিম শুধু হাসলো। মেহনূরের ঘাড়ের নিচে রাখা হাতটা একটুখানি এগিয়ে নিতেই মেহনূর সেদিকে তাকালো। তাকাতে দেরি, ‘ পটাশ ‘ করে শব্দ হয়ে লাইট নিভে গেলো রুমের। ঝারবাতির চোখ ধাঁধানো সোনালী আলোটা নিভে গেলেও রুমে ড্রিম লাইটের মতো মৃদ্যু আলো ছড়ালো। জানালা দিয়ে ঝুমঝুম বৃষ্টির ছন্দময় শব্দ ঘোর পরিবেশে নিয়ে গেলো। গ্রামের মাটি যেনো সিক্ত-অভিসিক্ত হয়ে সুমিষ্ট ঘ্রাণ ছড়িয়ে দিলো। মেহনূর ওই স্বল্প আলোতে দেখতে পেলো, মাহতিমের মুখটা তার দিকে চলে আসছে। খুবই ধীরভাবে মুখটা নিচে নামিয়ে মেহনূরের কম্পন ওষ্ঠজোড়ায় নিশ্বাস ছাড়লো সে, মেহনূর খামচে ধরলো মাহতিমের সাদা কলারটা। আবারও হেসে দিয়ে মেহনূরের থুতনির উপর ঠোঁটদুটো রেখে মৃদ্যু চাপ দিলো মাহতিম, ফিসফিস করে নিজের ঠোঁটদুটো দ্বারা থুতনি ছুঁইয়ে-ছুঁইয়ে বললো,
– তোমাকে প্রথম চুমুটা কোলে তুলে দিবো বলেছিলাম। মনে আছে?
কুঁকড়ে থাকা মেহনূর চোখ খিঁচুনি দিয়ে জড়িয়ে যাওয়া গলায় বললো,
– ম-ম-মনে আছে।
মেহনূরের ঘাড়ের নিচে থাকা হাতটা উপরে তুললো মাহতিম, চোখ বন্ধ করে থুতনি থেকে অধরযুগল সরিয়ে কিন্ঞ্চিত উপরে তুললো। শীতলতার পরশকে উষ্ণতার কোমলতা দিয়ে ঢেকে দিলো সে। বহুদিনের আকাঙ্ক্ষিত-আকন্ঠ-আকুল স্পর্শের কাছে নত হয়ে মেহনূরের
আদুরে অধরযুগল গাঢ় করে আঁকড়ে ধরলো মাহতিম। পিপাসিত মাটি যেমন বহুদিন-বহুকাল পর পানির সন্ঞ্চার পেয়ে সবটুকু পানিই শুষে নেয়, সেই আদুরে ঠোঁটদুটোয় তেমনিভাবে নিজের উন্মত্ততা প্রকাশ করছিলো সে। মেহনূর অনবরত বুক ফুলিয়ে নিশ্বাস নিতেই হাতদুটো কলার থেকে সরিয়ে মাহতিমের ভেজা গলা ছুঁয়ে-ছুঁয়ে ডানগালে রাখলো, অপর হাতটা বাঁ-গাল ছুঁয়ে-ছুঁয়ে ভেজা চুলের ভেতর ঢুকিয়ে দিলো। হঠাৎ মেহনূর চমকে গিয়ে চোখ খুলে তাকালো, নিজের উন্মুক্ত পিঠটায় তরল কিছুর আভাস পেয়ে তৎক্ষণাৎ চুল থেকে হাত নামিয়ে ফেললো। হাতটা নিজের পিঠের দিকে উলটে নিয়ে সেখানে তরল স্পর্শ করলো, সারা শরীর অদ্ভুত ভয়ে কাটা দিয়ে উঠলো মেহনূরের। স্বাভাবিক হাতটা আচমকা কাঁপতে-কাঁপতে নিজের চোখের সামনে আনতেই বুঝলো, ওটা রক্ত! কাঁপা হাত থেকে চোখ সরিয়ে মাহতিমের দিকে তাকালো মেহনূর। ব্যান্ডেজ গলে রক্ত বেরুচ্ছে, রক্তে মেহনূরের পিঠ লেপ্টে যাচ্ছে, এই মানুষটা কি কাটাছেঁড়ার ব্যথা অনুভব করেনা? নির্বিকারে চোখের পল্লবজোড়া বন্ধ করলো মেহনূর। তার বন্ধ চোখজোড়ার দুইকোল ঘেঁষে অশ্রু গড়িয়ে পরলো নিশব্দে-নির্লিপ্তে-নিমিষে।
চলমান .
#FABIYAH_MOMO
#নোটবার্তা : চোখ কঠিন ভাবে ঝাপসা। আর কিছু বললাম না 💔।