মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤ #পর্বসংখ্যা_৪৪. #ফাবিয়াহ্_মমো .

0
60

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৪৪.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

অনুরাগের সময়টুকু সাঙ্গ করে কোমল উষ্ণজোড়া মুক্ত করলো মাহতিম। চোখ খুলে ওই মুখখানিটা ড্রিম লাইটের মৃদ্যু আলোয় দেখার চেষ্টা করলো। আরো কাছ থেকে নিবিড় চাহনিতে মায়াবিদ্ধ হওয়ার জন্য ঘাড়ের নিচে থাকা হাতটা উর্ধ্বমুখী করলো। মুখটার বন্ধ চোখের দৃষ্টিতে দৃষ্টি রাখলো মাহতিম। এবার যেনো চোখ সয়ানো চাহনিতে আবিষ্কার করলো, তার পাজকোলে আবদ্ধ থাকা প্রিয় মুখটার বন্ধ চোখদুটো থেকে নির্মল ধারায় অশ্রু ঝরছে, তার গালের উজ্জল চামড়াটা এমনই রাঙ্গা হয়ে ছিলো যে, প্রকৃতির সদ্য ফোঁটা লাল গোলাপের রসগুলো যেনো গালের চামড়ায় মাখিয়ে দিয়েছে কেউ। মৃদ্যু ভঙ্গিতে হাসলো মাহতিম, রুমের লাইটটা না জ্বালিয়ে আবারও ধীরপায়ে হাঁটতে শুরু করলো। কানের রহস্যময় ছিদ্রপথে বৃষ্টির মুষলধারার শব্দ আসছে, মাটিগুলো ভিজে শ্যাওলার চাপা গন্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে, সেই সাথে গন্ধে মিলেমিশে আছে কিছু নাম-না-জানা ফুলের প্রাণচাঞ্চল্যকর মধুর সুভাষ। মাহতিম ওই আরক্ত মুখের দিকে দৃষ্টি ফেলে তার হাতদুটো নিচে নামিয়ে সোফায় বসিয়ে দিলো। মেহনূরকে সোফায় বসিয়ে তার সামনেই ফ্লোরে হাঁটুগেড়ে বসলো মাহতিম, পূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে মেহনূরের দিকে তাকালো সে। বৃষ্টির স্বচ্ছ শীতল ধারায় সিক্ত হয়ে গায়ের ধবল রঙটা রক্তিম হয়ে উঠেছে মেহনূরের, মুখটা অদ্ভুত আবেশে অনুপম ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে আছে। মেহনূরের শান্ত চাহনিটুকুর সবটুকুই মাহতিমের হাসিমাখা চাহনির দিকে নিবদ্ধ, ঠান্ডা ভাবটা এখনো দেহের অঙ্গে-অঙ্গে শিউরে দিচ্ছে তার, দাঁত কপাটির ভাবটা এখন কম। মাহতিম নিজের ঘোর দৃষ্টিটা সংযত করে রুমের লাইট জ্বালিয়ে লাগেজের দিকে চলে গেলো, সেখান থেকে শার্ট বাছাই করতেই স্বাভাবিক গলায় বললো,

– তোমার গায়ে একটাও হবে না জানি। কিন্তু তোমাকে আজ রাতটুকুর জন্য পরতে হবে। সকালের ভেতর তোমার ভেজা কাপড়গুলোর ব্যবস্থা করে ফেলবো। তুমি কি একটু এ্যাডজাস্ট করতে পারবে? না ভেজা কাপড়েই থাকবে?

একটু আগের ওমন লজ্জা জনিত অবস্থায় পরার জন্য মেহনূর কোনো উত্তর দিবেনা তা ভেবেছিলো মাহতিম। তাই উত্তরের আশা ছেড়ে দিয়ে নিজের জন্য পোশাক নির্বাচনে উদ্যত হলো সে। বৃষ্টিমুখর বর্ষায় মৌনব্রত রুমটায় ছেদন করলো ঠান্ডা একফালি ইতস্তত সুর,

– আপনার, আপনার নেভি রঙের শার্টটা চাই।

চমকে উঠে দুই চোখ বড়-বড় করে তৎক্ষণাৎ ডানে তাকালো মাহতিম। চরম আশ্চর্য নিয়ে মেহনূরের দিকে তাকালে সাথে-সাথে দৃষ্টি নামাতে বাধ্য হলো মেহনূর। মাহতিম কোনো প্রশ্ন ছুঁড়ে আর বিব্রত পরিস্থিতি সৃষ্টি করলো না তখন। ধীরে-ধীরে মেহনূরের সহজ হওয়ার লক্ষণটা দেখে মন হালকা হলো, সে চুপচাপ মেহনূরের উদ্দেশ্যে তোয়ালে ও একসেট পোশাক বিছানায় রেখে নিজেও পোশাক বদলাতে ওয়াশরুমে চলে গেলো। দরজা লাগানোর আগে স্বাভাবিক গলায় বললো,

– তোমার চেন্ঞ্জ করা হলে দরজায় নক দিও।

মেহনূরকে একান্ত অবস্থায় পেয়েও ভেতরের ঝড়টা দামাল সামলালো মাহতিম। উজবুক মেহনূর এবার ঠিকই মাহতিমের ‘ পালাই পালাই ‘ অবস্থাটা বুঝে আপন মনে হেসে ফেললো। সোফা থেকে উঠে চটপট কাপড় ছেড়ে গায়ে শুকনো পোশাক জড়ালো মেহনূর, আয়নার সামনে যেতে-যেতে ভেজা বেণীটা আঙ্গুলে-আঙ্গুলে উন্মুক্ত করে ফেললো। ডানহাতের আঙ্গুলগুলো মাথায় চিড়ুনির মতো ঢুকিয়ে দিতেই আয়নায় নিজের ঢিলেঢালা পোশাকের প্রতিচ্ছবিটা দেখে থমকে গেলো। একমূহুর্ত যেনো নিরব রইলো মেহনূরের দৃষ্টি-নিশ্বাস-দেহ। এরপরেই খিলখিল করে জড়তাহীন মুখটা যেনো বহুদিন পর হেসে উঠলো, আয়নার সামনে হাতদুটো ‘ কাকতাড়ুয়া ‘ স্টাইলে দুপাশে উঠালো মেহনূর, তার চিকন দেহ থেকে নেভি কালারের শার্টটা কতো ঢিলা তা দেখে হাসিতে ফেটে পরলো। পড়নের ট্রাউজারের মাপ দেখে মনে হচ্ছে, যেনো পেটমোটা মোমের ভেতর একরত্নি সরু সুতার পলতে। খুব কষ্টে ট্রাউজারের ফিতা বেঁধে কোমরের সাথে জড়িয়েছে মেহনূর, এতো ঢিলা-ঢিলা পোশাকে আসলেই অদ্ভুত লাগছে এখন। চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে পা টিপে-টিপে ওয়াশরুমের দরজায় আস্তে করে টুকটুক করলো, সেখান থেকে চুপটি করে সরে এসে লাগেজটা গুছিয়ে দিতে ফ্লোরে বসলো। ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ হলে কি ভেবে যে সেদিকে তাকালো, হাতের কবল থেকে ভাঁজকৃত শার্টটা অসহায়ের মতো লাগেজে ফসকে গেলো। ফ্লোর থেকে ধীরগতিতে উঠে দাঁড়াতেই অতি অসহন ভঙ্গিতে ঢোক গিললো মেহনূর, তার সামনে থাকা মানুষটা তরতাজা রক্তের খন্দ নিয়ে উপস্থিত হয়েছে এখন। ভেজা শার্টটা ওয়াশরুম থেকে ধুয়ে আনলেও রক্তের দাগগুলো এখনো ছোপ-ছোপ করে সাদা কাপড়ে দৃশ্যমান হয়ে আছে। বাঁ বাহুটার জন্য ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শার্ট বা গেন্ঞ্জি পরতে পারেনি মাহতিম, কালো ট্রাউজারটা পরেই বেরিয়ে পরেছে এখন। মাথাটা তোয়ালে দিয়ে ঘষতে-ঘষতে সোজা আয়নার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। বাহুর উপর সাদা ড্রেসিংটা রক্তে ধুয়ে-ধুয়ে লাল-রক্তিম হয়ে উঠেছে, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে ফোনটা প্লাস্টিক ব্যাগ থেকে বের করে সৌভিককে কল করলো। কলটা লাউডে রেখে ভেজা চুল মুছতে-মুছতে ওপাশ থেকে কলটা রিসিভ হলো,

– হ্যাঁ, সৌভিক? মা ঠিক আছে? ঔষুধ দিয়েছিস?

প্রশ্নটা শুনে উত্তরের আশায় উৎসুক চোখে তাকালো মেহনূর। ওমনেই দেরি না করে আশ্বস্ত গলায় বললো সৌভিক,

– দোস্ত এখানে সব কন্ট্রোলে আছে। রজনী মামীকে যদি ঠিক সময় না ধরতে পারতাম তখন যে কি হতো! উহ্, ভাবতেই বুকটা শুকিয়ে আসে। মারজা আন্টিকে ঔষুধ খাইয়ে ঘুমাতে পাঠালাম। আমরা সবাই সামিকের বন্ধুর বাসায় উঠেছি। তুই আমাদের নিয়ে টেনশন করিস না। তোদের খবর বল, তুই কি রেসোর্টে উঠছিস?

তোয়ালেতে মুখ মুছতে-মুছতে জবাব দিলো মাহতিম,
– দশমিনিট হলো চেকিং দিয়ে রুমে আসলাম। বাইরে যে কি বৃষ্টি! ড্রাইভ করতে গিয়ে মেজাজটাই বিগড়ে গেছে।

কলের ওপাশ থেকে হাসির আওয়াজ শোনা গেলো, সেই হাসিতে আরো কথা সারছিলো দুই বন্ধু। পেছন থেকে নির্বিকার চাহনিতে চেয়ে থেকে লাগেজটা ঠিকমতো বন্ধ করে রাখলো মেহনূর। মাহতিমের ভেজা শার্টটা পানি চিপড়ে চেয়ারের উপর রাখা ছিলো, সেটাকে হাতে তুলে রক্তের দাগগুলো দেখলো মেহনূর। ওই লন এরিয়া থেকে রুম পযর্ন্ত দূরত্বটা চাট্টিখানি ব্যাপার না, তার উপর এই লোক সমস্ত রাস্তা এই ক্ষেপাটে বৃষ্টির মধ্যে নিজেই ড্রাইভ করে এসেছে। সুখকর অনুভূতিটা স্বল্প সময়ের জন্য স্থায়ী ছিলো। তবুও স্বল্প সময়টুকু তার মনের অলিন্দ স্থানে বুঝিয়ে দিচ্ছিলো, এই মাহতিম আনসারী পুরুষটা ব্যতিত অন্য কোনো পুরুষ স্বস্তির-শান্তির-নির্ভয়ের জায়গাটুকু কোনোদিন দিতে পারবেনা। শার্টটা নিয়ে চেয়ারের উপর টানটান করে মেলে দিলো মেহনূর। কথা বলা শেষ হতেই পিছু ঘুরলো মাহতিম, ওমনেই ক্ষণিকের জন্য চোখাচোখি হয়ে গেলো দুজনের। মেহনূরের রাশি-রাশি লম্বা চুল থেকে বেশ পানি ঝরছে, মাথাটা ঠিক করে মুছেনি দেখে একটু রাগ লাগলো মাহতিমের। তোয়ালেটা কি সাজিয়ে রাখার জন্য দিয়েছিলো? রাগটা দাঁতে চেপে ভেতরে দমিয়ে মেহনূরের দুবাহু ধরে বিছানায় বসালো মাহতিম, তোয়ালেটা নিয়ে তার ঠিক মুখোমুখি হয়ে ফ্লোরে হাঁটু ভেঙ্গে বসতেই বললো,
– আজ যদি তোমার কঠিন ঠান্ডা লাগে তাহলে আমার চেয়ে জঘন্য কেউ হবেনা মেহনূর। তুমি প্রচুর অবাধ্যতা করছো, আমি এসব মোটেও সহ্য করতে পারিনা।

কন্ঠের তেজ দেখে ঘাবড়ে গেলো মেহনূর। আজ তো নির্ঘাত জ্বর-ঠান্ডা-নিউমোনিয়া যা আছে, সব বেঁধে যাবে। কারণ, শীতের এমন করুণ মৌসুমে বরফের মতো বৃষ্টি তাকে গোগ্রাসে ছুঁয়ে ফেলেছে, নিউমোনিয়ার অসুখ থেকে একচুল নিস্তার পাওয়ার জো নেই। ইতিমধ্যে চুলের উপর মাহতিমের বলশালী হাতদুটোর কসরত চলছে যেনো, তোয়ালে দিয়ে চুলের শেষ পানিটুকু হরণ করার তীব্র চিন্তা। মেহনূর বিপাকে ফাঁসলেও আধো-আধো চাহনিতে হাসির ছলে বলে ফেললো,

– আমি কঠিন ঠান্ডায় যদি দম আঁটকে ম-রে যাই? তাহলে কি আপনি খুশী হবেন?

বেখাপ্পা প্রশ্ন দুটো ঠাট্টা করে বলেছিলো মেহনূর, এই ঠাট্টাটা কারো বুকের মধ্যে সাহসের দূর্গম প্রাচীরটা কেমন ভিত্তিসহ নাড়িয়ে দিবে সেটা চোখে দেখা যায়নি তখন। আগ্নেয়গিরির ভয়াবহ উদগীরণের ভয়ে মেহনূর দিশেহারা হয়ে পরলে মাহতিম বুকের ধাক্কাটা সামলে নিয়ে ফের মাথা মুছতে থাকে। শান্ত ও সংযত গলায় যোগ্য জবাবদুটো ছুঁড়ে বলে,
– আমার সাথে যতখুশী ফাজলামি করো, আপত্তি নেই। শুধু এসব ব্যাপারগুলো এড়িয়ে বলার চেষ্টা করবে। আমি এমন কথাবার্তা পছন্দ করি না।

নিরব হুমকির বার্তা শুনে তটস্থ চোখে তাকালো মেহনূর, অনুতপ্ত সুরে গলা নামিয়ে বললো,
– বুঝতে পারিনি। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে।

কথাটায় সায় দিয়ে চুল মোছা শেষ করে বললো মাহতিম,
– এবারের জন্য মাফ। পরবর্তীতে এমন ভুল করলে ক্ষমা থাকবেনা। কথাটা মনে থাকে যেনো।

মাথাটা উপর-নিচ নাড়িয়ে সম্মতির ইঙ্গিতটা বুঝালো মেহনূর। বসা থেকে কেবল উঠে দাঁড়াতে নিচ্ছিলো মাহতিম, এদিকে ব্যান্ডেজ পালটানোর তাগাদা কিভাবে দিবে সেটা নিয়ে উশখুশ করতেই হঠাৎ গলাটা মিহি করে সাবধানী কন্ঠে বললো,

– আপনার ব্যান্ডেজটা একটু দেখতে পারি?

.

অস্থিরতার জন্য নিশ্বাসটা কোনোভাবেই স্বাভাবিক হচ্ছেনা। বারবার এপাশ-ওপাশ করেও ঘুমের লেশমাত্র ছোঁয়া নেই। বুকের ভেতর অদ্ভুত-উদ্ভট ভয় এসে দলা পাকিয়ে মনটাকে খেয়ে দিচ্ছে। দুঃস্বপ্নের ভেতর রাতগুলো পার করলেও আজ যেনো ভয়ের কারনে ঘুম নেই। মাহতিমকে তিনি বাড়ি ফেরার জন্য অনুরোধ করেছেন, স্পষ্ট করে বলেছেন তার মন কোনো অজানা ব্যাপার নিয়ে ভয় পাচ্ছে। শরীর-মন যেভাবে ছটফট করে শুরু করেছে তাতে স্বস্তিতে বুকে নিশ্বাসও নিতে পারছেন না। সত্যি-সত্যিই খারাপ কিছু হবে। মায়ের মন বিপদের গন্ধ যেনো দশ গজ আগে থেকে টের পায়, ধরতে পায় তার আশেপাশে অনিষ্ট কিছু হবে। এখনো মন যেনো চিৎকার করে বলছে, ‘ জঘন্য কিছু হবে, জঘন্য কিছু হবে। পালা। ‘ মারজা ভয়ে আবার শোয়া থেকে উঠে ঢকঢক করে দু’গ্লাস পানি খেলেন। কম্বল ফেলে, বালিশ উলটে তাড়াতাড়ি হাতের ফোনটা নিয়ে মাহতিমকে কল করলেন। এখান থেকে তিনি সন্তানদের নিয়ে নিরাপদে ফিরতে চান, বাড়িটাই উনার আসল জায়গা, ভরসার জায়গা। বাড়ি থেকে বেরুলেই বিপদ! কলটা নেটওয়ার্কের জন্য কেটে গেলো, মাহতিমের কাছে পৌঁছলো না। তিনি ফোন ফেলে পাগলের মতো রুমে পায়চারি শুরু করলেন, পায়ের গিঁটগুলো অবশ হয়ে এলেও পায়চারী থামালেন না। থাই জানালার বাইরে গুমোট আকাশের বর্ষণ দেখে ভীত মুখটা সেদিকে তাক করলেন, থুতনিটা মৃদ্যু-মৃদ্যু কাঁপতেই চোখ ফেটে অশ্রু বেরিয়ে এলো, তিনি বিড়বিড় করে আকাশের দিকে ব্যর্থ অন্তরের ব্যকুল ভারে বলতে লাগলেন,

– আমি আর সহ্য করতে পারি না গো মাবুদ। এ কি যন্ত্রণায় পরেছি! কেউ আমার কথা বিশ্বাস করবেনা, কেউ বুঝবে না আমি কেমন চিন্তায় ম-রে যাচ্ছি। এই প্রথম বাড়ি থেকে বের হয়ে স্বস্তি পাচ্ছি না, কি ভয়াবহ বিপদের ঠাহর হচ্ছে সেটা যদি কাউকে বলতে পারতাম।

ফিরোজা রঙের সাদা পেড়ে ওড়নায় চোখ মুছলেন মারজা। ফোনটা নিয়ে আবার তিনি মাহতিমের ফোনে কল দিলেন। ইচ্ছা ছিলো মেহনূরের সাথে কথা বলে মন হালকা করবেন, তার বিশ্বাস মেহনূর তার কথা হাওয়ায় উড়াবে না, শুনবে। একে-একে নিরর্থক কলগুলো দিলেন ঠিকই, কিন্তু নক্ষত্রবাড়ি রেসোর্টের সীমানায় সেগুলোর একটাও পৌঁছালো না।

.
বৈরি আবহাওয়ার সোল্লাস ধ্বনিটা শাঁ শাঁ করে শোনা যাচ্ছে। প্রবল বৃষ্টির ঝড়ো হাওয়া যেনো উদ্যমী হয়ে লম্বা-লম্বা গাছগুলোকে মাটিতে ঝুঁকাতে চাচ্ছে। এতোক্ষণ কেবল বৃষ্টির উত্তালটা বহাল ছিলো, এখন এর সঙ্গে দ্বিগুণ উৎসাহে যুক্ত হয়েছে ঝড়ো হাওয়াটা। মাহতিম চরম আশ্চর্য হয়ে মেহনূরের কথা মতোই বিছানায় উঠে বসলো, মুখোমুখি হয়ে বসতেই কোনোপ্রকার জড়তা ছাড়া মাহতিমের বাঁ হাতটা ধরলো মেহনূর, ফোলা পেশির শক্ত হাতটা ধরতেই নিশ্বাস ভারী হয়ে এলো। নিশ্বাসের অদম্য অবস্থাকে প্রকাশ না করে ভেজা গিঁটটা খুলে প্যাঁচানো কাপড় সরিয়ে আনলো মেহনূর , ক্ষতটা একপর্যায়ে দুচোখের সামনে উন্মুক্ত হলে তৎক্ষণাৎ চোখ খিঁচ মেরে আবার ধীরগতিতে চোখ খুললো। মাহতিম সবই চুপচাপ ভঙ্গিতে দেখে যাচ্ছিলো, ঠোঁটে সহজাত শান্ত হাসি ঝুলছে তার। রক্ত মাখা ভেজা তুলাগুলো তুলতে-তুলতেই বিহ্বল কন্ঠে বললো মেহনূর,
– খুব ব্যথা করছে?

মাহতিম মৃদ্যু হাসি দিয়ে মেহনূরকে একটু খোঁচা মেরে বললো,
– করলেও তো তোমার এতে যায় আসে না।

হাত থামতে গেলেও থামালো না মেহনূর, কিছু না শোনার ভঙ্গিতে কাজ সারতেই কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললো,
– যদি বলি যায় আসে?

চোখে বিষ্ময় ফুটিয়ে অবাক হলো মাহতিম, তৎক্ষণাৎ তর্জনী দিয়ে মেহনূরের থুতনি উঁচিয়ে ফেললো, সরল দৃষ্টির মাঝে তার অস্থির চাহনিটুকু মিলিয়ে দিয়ে চন্ঞ্চল সুরে বললো,
– কিসে যায় আসে তোমার? কিচ্ছুতে যায় আসে না! আমার শরীরের কাঁ’টাছেড়া দেখে কাঁদো-কাঁদো মুখে তাকাও, অথচ জায়গামতো ছুঁ’ড়ি তো তুমিই ঢুকিয়েছো।

থুতনিটা তাচ্ছিল্যের সাথে সরিয়ে দিয়ে কম্বল টেনে শুলো মাহতিম। বিছানার ডানদিকে ওপাশ ফিরে চোখ বন্ধ করে মেহনূরকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করলো। সমস্ত আয়োজন, সমস্ত চিন্তাভাবনা, সমস্ত জল্পনা নসাৎ করে দিলো ওর। হাতের মুঠোয় ভেজা ব্যান্ডেজের তুলোর দিকে দৃষ্টি দিলো মেহনূর, আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে মাহতিমের দিকে তাকালো। আজ এতোটাই অবজ্ঞার দুয়ারে ঠেলে দিলো যে, মাহতিম ওর দিকে পিঠ দিয়ে শুয়েছে। মেহনূর মুঠোভর্তি তুলাগুলো রুমের বিনে ফেলে লাইট নিভিয়ে বিছানায় ফিরলো। কম্বলটা গায়ে টানতেই মাহতিমের পিঠের দিকে মুখ করে শুলো। হাতটা একটু উর্ধ্ধে উঁচিয়ে জানালার একটা দ্বার কিন্ঞ্চিত ঠেলে দিলো, চাপ পেয়ে জানালাটা ক্যাচ করে খানিকটা খুলে গিয়ে সরু একফালি আলো ঢুকলো। আলোটা দুজনের মধ্যবর্তী দূরত্বের উপর তেরছা হয়ে পরেছে, ফাঁকা পেয়ে প্রকৃতির উদ্দাম হাওয়াও শান বাজিয়ে ঢুকছে। মেহনূর বালিশে গাল রেখে গালের নিচে বাঁহাতের তালু রেখে সুঠাম পিঠটার দিকে তাকালো, বিছানা ছুঁয়ে-ছুঁয়ে ডানহাতটা বাড়িয়ে দিতেই আবার পূর্বের জায়গায় ফিরিয়ে আনলো। সাহস হচ্ছে না বুকে, যদি মাহতিম ক্ষেপে উঠে? চোখ বন্ধ করে ডানহাতটা মুষ্টি করলো মেহনূর, ঘুমের জন্য বৃথা চেষ্টা সেরে ফের ডানহাতটা বাড়িয়ে দিলো। একবুক ভয়, একটু আশা, খানিকটা অনুশোচনা নিয়ে বিছানা থেকে শূন্য উঠিয়ে পিঠের উপর হাত রাখলো মেহনূর। আজ একটুও অস্বাভাবিক ভাবে হৃদকম্পন হচ্ছে না, দূর্বল লাগছেনা, কুণ্ঠা হচ্ছেনা, মেহনূর অদ্ভুত ভালো লাগায় পিঠ ছুঁয়ে হাতটা কাধে রাখলো। কম্বলটা সাথে-সাথে নড়েচড়ে উঠতেই অভিযোগী মুখটা কাধের কাছে এনে অপ্রসন্ন গলায় বললো,
– কি চাই?

মেহনূর ফিসফিস সুরে হাসি আঁটকাতে যেয়ে হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠলো। এদিকে হাসির দশা দেখে মাহতিমের রাগ যেনো আরো তুঙ্গে! কাধ থেকে মেহনূরের হাতটা ঝটকা মেরে ওর দিকে ফিরলো সে, ভ্রুঁ কুঁচকে রাগ দেখিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে বললো,
– পাগলের মতো হাসছো কেনো? কি চাই তোমার?

হাসিটা কোনোরকমে চেপে দুই বালিশের দূরত্বটুকু খতম করলো মেহনূর। নিজের বালিশটা বেখেয়ালে রেখে মাহতিমের দিকে এগুতেই বললো,
– ঘুমাতে চাই।

কথা শুনে ছোট-ছোট চোখে বাঁ ভ্রুটা উপরে তুললো মাহতিম। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ক্ষীণ মেজাজে বললো,
– ওপাশ ফিরো,

‘ ওপাশ ফিরো ‘ মানেই তুমি ওপাশ ফিরে শোও, আমি আমার শক্ত-সৌম্য-সুগঠিত বুকটা দিয়ে তোমার সুকোমল দেহটা আগলে দিচ্ছি। তোমার দেহের ভেতর আমার উষ্ণতার সাহস, আমার শক্ত চেতনার দৃঢ়তা, আমার জীবিত নিশ্বাস ছেড়ে দফায়-দফায় কাছে থাকার মূলক বুঝাচ্ছি। মেহনূর অম্লানবদনে হাসি উৎসর্গ করে ওপাশ না ফিরে ওই বুকটার কাছে মুখ লুকিয়ে নিলো। প্রশ্নাত্মক চোখদুটো পরম উষ্ণতার নিবেদন পেয়ে তৎক্ষণাৎ বন্ধ হলো, দুপাটি দাঁতের করাত থেকে শান্তির দমটা সশব্দে বেড়িয়ে এলো। এই প্রথম মাহতিম আনসারীর নির্দেশটা কেউ অমান্য করলো, কেউ তার হৃদ দূর্গের বক্ষস্থলটা আত্মসাৎ করে সেখানে ছড়িয়ে দিলো আনন্দের সুখ। ঝুমঝুম বৃষ্টির হিংস্রতায় শীতল হওয়া বুকটার ভেতর থেকে উত্তর এলো,

– আপনি আমার উপর যতখুশী রাগ করুন, আপত্তি নেই। শুধু এসব ব্যাপারগুলো এড়িয়ে চলবেন। আমি এমন দূরত্ব পছন্দ করি না।

মুখটা আশ্চর্যে হা হতেই হোহো করে হেসে উঠলো মাহতিম। বাহুজোড়ায় আষ্টেপৃষ্টে ধরে হাসতে-হাসতে বললো,

– কি কাণ্ড! আমার ডায়লগ আমার উপরেই ছুঁড়ে দিলে?

চলমান .

#FABIYAH_MOMO .

( #নোটবার্তা : দুঃখিত 💔 )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here