মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤ #পর্বসংখ্যা_৪৬. #ফাবিয়াহ্_মমো .

0
67

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৪৬.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

লাস্যময়ী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়েটা, অশ্লীল ভাবে বাঁকা দাঁতটা দিয়ে ঠোঁট কামড়াচ্ছে । তার ভাবভঙ্গি দেখে একটুও ঘাবড়ালো না মাহতিম, তার মস্তিষ্কের প্রতিটি নার্ভ খুব সচল, তার দৃষ্টিজোড়াও খুব কৌশলের সাথে মেয়েটার আচরণবিধি পরোখ করে যাচ্ছে। মেয়েটা অদ্ভুত একটা হাসি দিয়ে ভ্যানিটি ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে কিছু একটা বের করার ধান্দায় ছিলো, লিফটটাও তখন থার্ড ফ্লোরে এসে পৌঁছলো। একপলক রেড সাইনের ‘ 3 ‘ লেখাটা দেখলো মাহতিম, এক মূহুর্ত দেরি না করে এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটিয়ে ফেললো সে! এতোই দ্রুত ঘটলো যে মেয়েটা ভয়ে তটস্থ হয়ে লিফটের দেয়ালে দুম করে পিঠ ঠেকিয়ে চিৎকার দিলো, সামনের সুদর্শন চেহারার স্মার্ট ব্যক্তির দিকে ভীষণ ভয় নিয়ে তাকিয়ে আছে, অনবরত ঢোক গিলেই যাচ্ছে, চোখের কোটর ভয়ের চোটে বড়-বড়, নিশ্বাসের বেগে বুকটা উঠা-নামা করছে তার। লিফটটাও ‘ পজ ‘ হয়ে থমকে আছে, আর নিচে নামছেনা। কপালের ঠিক মাঝ বরাবর পিস্তল তাক করে ধরেছে মাহতিম, ট্রিগারের কাছে আঙ্গুল রাখা, যেকোনো মূহুর্ত্তেই মৃত্যুর কাছে ছিটকে পরতে বাধ্য মেয়েটা! মেয়েটা পিস্তলটার দিকে একপলক তাকিয়ে ভয়ার্ত কন্ঠে বললো,

– আ-আমাকে, আমাকে আপনি যেতে দিন। আমাকে মা-রবেন না মিস্টার। আমিতো কনড —

– ‘ চুপ ‘, খুবই ক্ষীণ কন্ঠে জোর দিয়ে বলে উঠলো মাহতিম। চোখটা সরু করে মেয়েটার ভয় জড়ানো চোখের দিকে সরাসরি তাকালো। মেয়েটা ফ্যালফ্যাল করে তাকাতেই ওই অনড় চোখের কাছে নত স্বীকার করলো। নিতান্তই দূরত্ব রেখে পিস্তল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু কড়া পারফিউমের সুঘ্রাণযুক্ত মোহটা কঠিনভাবে আসক্ত করে দিচ্ছে। এমন স্বচ্ছ পার্সোনালিটির পুরুষদের হাতে ভারী পিস্তলটা বড্ড বেমানান, তাদের হাতে দামী বিয়ারের বোতল থাকলে চমৎকার লাগতো। শান্ত অথচ সংযত ঠোঁটটায় একটা বেনসন চেপে রাখলে মন্দ হতো না। কালো গেন্ঞ্জিটার দিকে তাকালেই বুকটা কেমন কেঁপে উঠে! খাপে-খাপে ছয়টা ভাঁজের আদল স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, দুহাতে টিশার্টটা খুললেই ভয়ংকর কিছুর মুখোমুখি হবে নিশ্চিত! মাহতিমের ইচ্ছা করছে ঠাস করে মেয়েটার গালে চড় মারতে, পরিবার নিয়ে হোটেলে উঠেও এমন জঘন্য ঘটনার মুখোমুখি হবে সেটা চিন্তাও করতে পারেনি। এরা সংঘবদ্ধ দল হিসেবে বিভিন্ন হোটেলে-হোটেলে ঘুরে বেড়ায়, কোনো ধনী বা টাকা-পয়সাওয়ালা লোকদের কাছে স্বেচ্ছায় দেহ বিকিয়ে দেয়, রাত কাটিয়ে ওইসব লোকদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে ভোরের মধ্যেই পগারপার। মাহতিম দাঁত কিড়মিড় করে রাগ দেখিয়ে বললো,

– ট্রিগারটা চাপলে কি হবে জানো? ডিরেক্ট মৃত্যু। ব্যাগ থেকে যেই প্যাকেট বের করতে চাচ্ছিলে সেটা এক্ষুনি বাইরে গিয়ে ফেলে দিবে। এ ব্যবসায় কেনো নেমেছো? লজ্জা করে না এসব করতে?

মেয়েটা হুমকি খেয়ে গড়গড় করে সব বলে দিলো। মেয়েটার নাম বন্যা, সে প্রায় তিন বছর যাবৎ এ লাইনে কাজ করছে, অনাথ, আত্নীয় বলতে কেউ নেই। দারিদ্র্যতার জন্যই এ পেশায় নিয়োজিত এবং সে মাহতিমকে এখানে আসার পর থেকেই ফলো করছিলো, কিন্তু মাহতিম যে সাধারণ ব্যক্তির মতো নয় এবং ওইসব নারীপিপাসু চেতনাও নেই সেটা বুঝতে পেরেছে বন্যা। চুপচাপ পিস্তল নামিয়ে সেটা কোমরে গুঁজলো মাহতিম, মেয়েটার হাতে কিছু টাকা এবং একটা কার্ড ধরিয়ে বললো,

– কার্ডে একটা নাম্বার আছে। ওটায় কল দিয়ে আনসারী নামটা বললেই এনাফ। স্যালারি কত লাগবে সেটা ঠিকঠাক মতো ফাইনাল করে দিবে। আর যদি কখনো এ লাইনে থাকতে দেখি, পরেরবার নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পাবে না। চলে যাও।

মেয়েটা অপরাধী মুখে চোখ নামিয়ে রেখেছে, হাতে কার্ড ও টাকা পেয়ে কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর হালকা গলায় বললো,

– আপনি আমাকে সাহায্য করলেন কেনো? আমিতো আপনার ক্ষতিই করতে চেয়েছিলাম।

লিফটটা অন অপশনে চাপ দিতেই একপলক মেয়েটার দিকে তাকালো সে, শেষে চোখ ঘুরিয়ে স্বাভাবিক মেজাজে বললো,

– পাপমোচনের সুযোগ দিলাম। নিজেকে আর দূষিত না করে কলঙ্কের দাগ ঘুচাও। মেয়ে হিসেবে নিজের প্রেস্টিজ বিক্রি করে সংসার দেখবে এটা লজ্জার। কর্মে খাটো, শ্রম দাও, নিজ বুদ্ধিতে টাকা ইনকাম করো, এসব অনৈতিক পথে থাকার মানে হয় না। মরলেও তুমি শান্তি পাবে না বুঝেছো? চলে যাও।

মৃদ্যু আওয়াজে লিফটের দুই দ্বার খুলে যেতেই বন্যা মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেলো। দু’পা এগুতেই হঠাৎ কিছু একটা মনে পরার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে পরলো, মাহতিম সেদিকে কপাল কুঁচকে তাকাতেই বন্যা মাথাটা পিছু ঘুরিয়ে চোখে-চোখ রেখে অকপটে বললো,

– আপনার স্মার্টনেস মেয়েমানুষকে করুণভাবে ঘায়েল করার যোগ্যতা রাখে মিস্টার। পিস্তলের চাইতেও মারাত্মক!

কোনো বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না মাহতিম আনসারীর। সদাসর্বদার মতো গুমর মুখে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলো, লিফটের বাটন অপশনে ক্লিক করে পকেটে হাত গুঁজতেই দুদিক থেকে দুটো সিলভার দরজা আসতে লাগলো। হঠাৎ এবং এক সেকেন্ডের জন্য ঠোঁটের ডানকোণে বাঁকা হাসি ফুটলো মাহতিমের, হাসিটুকু মিলিয়ে দিয়ে লেগে গেলো লিফটের দরজা। ছোট-ছোট পায়ে হোটেল এরিয়া ত্যাগ করে কখন যে অন্যমনষ্ক ভঙ্গিতে বালুকা স্থানে চলে এলো খেয়াল নেই বন্যার। হাতে এখনো সাদা কার্ড এবং কচকচে পাঁচটা এক হাজার টাকার নোট। চোখ তুলে সামনে তাকালো বন্যা। বালুময় জায়গাটা সন্ধ্যার মায়াতে নির্জন হয়ে উঠেছে, ডুবো-ডুবো কমলালেবুর গোল অরুণের চাকাটা সমুদ্রের নিচে যেনো তলিয়ে যাচ্ছে। আস্তে-আস্তে জলন্তপিন্ডটা তেজ হারিয়ে সমুদ্রের প্রশস্ত বুকে গা ভাসাতে প্রস্তুত। বন্যা দেখলো প্রকৃতি যেনো আগুনের পিন্ডটাকে সমুদ্রের জলধারা দিয়ে আগলে নিলো, সমস্তু দাপট শোষণ করে নির্বিকার বানিয়ে দিলো সূর্যটাকে। ‘ পাপমোচন ‘ শব্দটা যেমন ছোট্ট, তেমনি এর ভাবার্থ যেনো বিশাল কিছু। কিছু টাকা কি অভুক্তদের মাঝে বিলিয়ে দিবে? দিলে ভালো হয়। তার পেটেও তো সকাল থেকে কিছু পরেনি।
.

আকাশে কোনো তারা নেই, চাঁদের আলো নেই, সবকিছু কেমন নিস্তব্ধ। কুয়াশা যেনো প্রবলভাবে ঘণীভূত হচ্ছে, দূর-দূরান্তের দৃশ্যপট এখন ধোয়ার চাদরে ঢাকা। ঠান্ডায় পায়ের তলা যেনো গরম হওয়ার নাম নেই, তার উপর সকাল থেকে নষ্ট ফোনটা নিয়ে কল করে যাচ্ছে শানাজ। গ্রাম্যভিটায় একমাত্র আদরের টুকরোটা যেনো মেহনূরই ছিলো, নিজের সহোদর বোন সাবার থেকেও প্রিয়। আদরের টুকরোটা যখন স্বামীর হাত ধরে শহরের দিকে ছুটলো, সে আর পিছু ফিরে আসেনি। শেফালীর হাতে কড়ায়-দন্ডায় মার খেয়ে যখন সব বোনেরা খিঁচিয়ে থাকতো, তখন ছোট্ট মেহনূর ঠোঁট ফুলিয়ে কান্না চোখে ‘ বুবু ‘ মানুষটাকে জাপটে ধরতো। মাঝে-মাঝে আকাশ ডেকে উঠলে দৌঁড়ে-পালিয়ে ছুটে আসতো শানাজের কাছে, দুহাতে শানাজকে জাপটে ধরে কতবার যে বাজের শব্দে চমকে উঠতো হিসাব নেই। কখনো মায়ের মতো, কখনো বোনের মতো মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো, আজ বুলিয়ে দেওয়ার মাথাটা কাছে নেই। মোটা লেপে গা ঢাকা দিয়ে শুয়ে আছে শানাজ, ঘড়িতে দশটা বাজলেও এখন গভীর নিশুতির মতো নিঃশব্দ হয়ে আছে। নষ্ট বাটন ফোনটা ছোটোখাটো ভাবে আছাড় দিতেই ফোনের স্ক্রিনটা জ্বলে উঠলো, সাথে-সাথে খুশি হয়ে গেলো শানাজ। তড়িঘড়ি করে মেহনূরের নাম্বারে কল দিলো, কিন্তু ফোনটা বন্ধ বললো। হতাশ শানাজ জানে তার নিজের ফোনটাও কিছুক্ষণের ভেতর বন্ধ হয়ে যাবে, যা করার চটজলদি করতে হবে। অনেক ভেবেচিন্তে শেষে মাহতিমের নাম্বারে ডায়াল করলো, আল্লাহ্-আল্লাহ্ জপতে-জপতে দুশ্চিন্তায় পরলো শানাজ। না-জানি মাহতিমের নাম্বারটাও বিজি দেখায়, এদিকে অভাবনীয় কায়দায় কলটা চট করে রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে গাঢ় গলায় বললো,

– আসসালামুয়ালাইকুম শ্যালিকা, কি খবর?

শানাজ প্রচণ্ড খুশিতে এক লাফ দিয়ে বসলো। লেপটা ফেলে জানালার কপাটটা খুলে খুশি হয়ে বললো,

– ওয়াআলাইকুমসসালাম ভাইয়া, আমার নাম্বার আপনি চিনেছেন? কি কপাল, কি কপাল! আমি ভালো আছি ভাইয়া। আপনার কি অবস্থা? আপনি তো আমাদের ভুলেই গেছেন, ভাইয়া মেহনূর কেমন আছে? ওকে একটু লাইনে দেওয়া যাবে? ওর তো ফোনটা বন্ধ, অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু পেলাম না।

চোখ বন্ধ করে জোরে নিশ্বাস ছাড়লো মাহতিম। কি উত্তর দিবে এখন? বলবে তোমার বোন জ্বরে কাতরাচ্ছে? আমার দোষেই এখন বাজেভাবে অসুস্থ? উত্তর না পেয়ে ওপাশ থেকে ‘ হ্যালো, হ্যালো ‘ করে উঠলো শানাজ। অস্থির কন্ঠের কাছে অধোমুখ করে মাহতিম সাড়া দিলো,

– মেহনূর ঘুমিয়ে পরেছে শানাজ। কাল সকালে যদি কথা বলিয়ে দেই সমস্যা হবে? আমি দুঃখিত, ওকে এখন জাগাতে পারছি না।

শানাজ দ্রুত মাহতিমকে আড়ষ্টতা থেকে রেহাই দিলো। স্বাভাবিক কন্ঠে হাসি দিয়ে বললো,
– না, ভাইয়া এভাবে বলতে হবে না। ও যেহেতু ঘুমাচ্ছে তাহলে ঘুমাক। আমার ফোনটা নষ্ট বলে এতোদিন ওকে কলটা দিতে পারিনি, ওকে আমার কথা বলে দিবেন।

নিজেকে চূড়ান্ত সীমায় স্বাভাবিক রেখে কথা সারলো মাহতিম, একটুও শানাজের মনে সঙ্কোচ বাড়তে দিলো না। বিশাল বড় জানালা দিয়ে বাইরের স্বল্প আলোটা রুমে ঢুকছে, রুমটা আজও লাইটহীন। সবাই যার-যার হোটেল রুমে ক্লান্তদেহে ঘুমাচ্ছে, অথচ তার চোখে ঘুম নামক কিছুই নেই। বিছানায় বসে ফ্লোরের দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে আছে, চোখদুটো নিজের হাতের উপর স্থির। গাড়ির মধ্যে যখন মেহনূর বেহুঁশ হয়ে গেলো, সে চিৎকার করে ডাকার পরও উঠলো না, তখন মাহতিম বুঝতে পেরেছিলো ‘ ভয় ‘ কি জিনিস। ভয়ের ব্যাখ্যাটা হাড়ে-হাড়ে টের পেয়েছে, কঠিনভাবে পেয়েছে। পুরোটা রাস্তা কেমন পাগল-পাগল অবস্থায় ড্রাইভ করেছে, সেটা বোধহয় এই ড্রাইভিং জীবনে প্রথম। কান্নার চোখদুটো তো সেই কবেই শুকিয়ে গেছে, তবুও শুষ্ক চোখদুটোয় যেনো বর্ষা নামতে চেয়েছিলো। ‘ যদি কিছু হতো? ‘ – এই প্রশ্নের কাছে ভেঙ্গেচুড়ে যায় মাহতিম, চূর্ণবিচূর্ণ কাঁচের মতো ভেঙ্গে যায়।

ড্রিম লাইটের মৃদ্যু আলোয় নিজেকে আবিষ্কার করলো মেহনূর। দেহের অসহন তাপমাত্রায় মাথার তালুটা ঝিমঝিম করছে, চোখ খুলে আশেপাশে তাকিয়ে কিছুক্ষণ থম মেরে রইলো। পরক্ষণে আস্তে-আস্তে বুঝতে পারলো সে এখন মারজার পাশে শুয়ে আছে। ঠিক ডানদিকটায় মারজা কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে, মুখটা মেহনূরের দিকে ঘুরানো হলেও মুখ বাদে সমস্ত শরীর কম্বলে আবৃত। মেহনূর খুব কষ্টে দূর্বল হাতটা নিজের কপালে উঠালো, হাতের উলটোপিঠে কপাল ছুঁয়ে বুঝলো তার জ্বরটা এখনো কমেনি। পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার ভাবে বুঝতে একটু সময় লাগলো ওর, সেই গাড়ির ঘটনা থেকে একে-একে সবটুকু ঘটনা মনে করতেই হঠাৎ মাহতিমের জন্য চিন্তিত হয়ে উঠলো। মাহতিম কোথায়? তারা কি বাড়িতে ফিরেছে? কিন্তু বাড়িতে ফিরলেও এই রুমটা একদম অচেনা। কোথায় আছে এখন? এই রুমটা ভুলেও আনসারী নিবাসের রুম হবে না। মারজাকে ডাকতে গিয়েও বিবেকে বাধা খেলো মেহনূর, অসুস্থ মারজা এমনেই ঘুমাতে পারেন না, আজ একটু ঘুমাচ্ছে, ঘুমোক। দুহাতে ভর দিয়ে যেই বিছানা থেকে উঠতে যাবে ওমনেই ধপ করে বিছানায় পরে গেলো মেহনূর, জ্বরে শরীরের হাড়গুলো যেনো ভঙ্গুর হয়ে মটমট করে উঠলো। চোখ খিঁচুনি দিয়ে বিছানায় পরে রইলো, উঠার জন্য কয়েকবার জোর খাটালো কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থ-বিফল। এই মূহুর্তে যদি মাহতিমকে না দেখে কিছুতেই শান্তি পাবে না, মাহতিমকে এখন চাই-ই চাই! অদ্ভুত জেদের বশে মেহনূর এবার উন্মাদের মতো উঠার চেষ্টা করতে লাগলো, কিন্তু সফল হলো না। জ্বরের মধ্যে থাকতে একটুও সহ্য হচ্ছে না, উঠতে পারছেনা, বসতে পারছেনা, দাঁড়াতে পারছেনা। মেহনূর রাগে-ক্ষোভে-জেদে দুহাতের মুঠোয় চাদর খামচে ধরে, ঠোঁট শক্ত করে ফেলে, চোখ থেকে টলটল করে গরম পানি ছাপিয়ে পরছে, অসাড়তায় শরীর যেনো চূড়ান্তরূপে টলছে। অসহ্য, সব অসহ্য লাগছে!

এমনই সময় চাপা নিস্তব্ধতার ভেতর ক্ষীণ একটা শব্দ হলো, শব্দটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কর্ণপথে ঢুকতেই মেহনূর চোখ খুলে দরজার দিকে তাকালো, আবছা অন্ধকারে কোনো কিছু দেখতে না পেলেও তার উদ্দীপ্ত ইন্দ্রীয় নিশ্চিত এই মূহুর্তে মাহতিম এসেছে। জ্বরের ঘোরে সবকিছু বিষাদ লাগলেও পারফিউমের গন্ধটা চিনতে কখনো ভুল করবে না। গতরাত যেই উন্মুক্ত বুকটার ভেতর মুখ লুকিয়ে ঘুমিয়েছিলো, তার রেশ ভোলা অসম্ভব কিছু। মোটা-মোটা অশ্রুগুলো জ্বরের সাথে দাঙ্গা করে ঝরঝর করে ঝরছে, চোখদুটোও কেমন ফোলা এবং ব্যথা অনুভব হচ্ছে। মেহনূর হাতের মুঠো স্বাভাবিক করে দূর্বল স্বরে বললো,

– আমি জানি, আপনি এসেছেন। রুমের লাইটটা জ্বালান। আপনাকে একটুও দেখতে পারছি না।

বলার কয়েক মিনিট পেরিয়ে গেলেও রুমের লাইট জ্বলার নাম-গন্ধ নেই। জ্বরের মধ্যে কোনোভাবেই শক্তি কুড়াতে পারছেনা মেহনূর, গলা উঁচাতে গেলেও স্বর যেনো বেরুতে চায় না, গলাতেই দুমড়ে-মুচড়ে আঁটকে যায়। আস্তে-আস্তে পদধ্বনির আওয়াজটা ক্ষীণ থেকে প্রকট হলো, হ্যাঁ এগিয়ে আসছে, তার দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে নিরব পায়ে আসছে। দূর্বল হাতজোড়া থরথর করে কাঁপা অবস্থায় তার দিকে বাড়িয়ে দিলো মেহনূর, ব্যকুল আবেদনে মাহতিমকে জাপটে ধরার ইচ্ছায় রুক্ষ গলায় কাশতে-কাশতে বললো,

– এদিকে আসুন, আপনাকে একটু ধরতে চাই। কাছে আসুন।

নির্বিকার ভঙ্গিতে বিছানার কাছে আসলো মাহতিম, পলকহীন দৃষ্টিতে মেহনূরের বাড়িয়ে কাঁপা-কাঁপা হাতের দিকে তাকালো, চোখ সয়ে যাওয়া আলোয় মেহনূরের চিকচিক চোখদুটোর অবস্থা দেখে ধপ করে হাঁটু ভেঙ্গে বসলো মাহতিম। মেহনূরের হাতদুটো উপেক্ষা করে কাতর মুখটার কাছে এগিয়ে গেলো, বাঁহাতটা দিয়ে গরম গালটা পূর্ণ আবেশে ধরতেই ঠোঁটে আলতো করে চুমু খেলো মাহতিম। চোখ বন্ধ করে মাহতিমের মাথায় কাঁপা হাতটা রাখলো মেহনূর, চুলের ভেতর নরম চামড়ায় উষ্ণ আঙ্গুলগুলো বুলিয়ে দিতেই মাহতিম চোখ খুলে তাকালো। দুজনের সরাসরি চোখাচোখি হতেই মেহনূরের দিকে ব্যথাতুর কন্ঠে বললো,

– গা পুড়ে যাচ্ছে মেহনূর। তুমি আমাকে কোন্ অপরাধের শাস্তি দিচ্ছো?

কথা শুনে খিলখিল করে হেসে উঠলো মেহনূর, দু’ফোঁটা মোটা অশ্রু তখন দু’কোল বেয়ে গড়িয়ে পরলো। ক্লিষ্ট ডানহাতটা দিয়ে মাহতিমের মাথা ও বাঁহাতটা পিঠের উপর সমানতালে ছুঁয়ে দিতে লাগলো। বুক ঠেলে গরম নিশ্বাসটা সশব্দে ছেড়ে দিতেই বললো,

– নিউমোনিয়া হলে কি করতেন? তখন তো আমার অক্সিজেন নেওয়া লাগতো, সূঁই ঢুকিয়ে হাত ঝাঁঝরা করে দিতো। ডাক্তার এসে বলতো রোগীর অবস্থা খারাপ, খুব খারাপ। যেকোনো সময় দম বেরিয়ে মরতে পারে।

ভ্রুঁ কুঁচকে কপট রাগ দেখিয়ে মাহতিম বললো,
– তুমি কি আমার সাথে মষ্কারা করছো?

রাগের আভাস পেয়ে হাসতে-হাসতে বললো মেহনূর,
– না, সত্য কথা বললাম। হতেও তো পারতো। হয়নি তো। হলে কি ভালো হতো না? আমার মতো একটা তুচ্ছ জীব পৃথিবী থেকে বিদায় নিতো। অন্তত এই সুযোগে আপনাকে কঠিন শাস্তি দিতে পারতো, তাই না?

দুই মিনিট একদম নিরব হয়ে রইলো। মেহনূর তো ভয়েই তটস্থ, জ্বরের ঘোরে বুঝি আবোলতাবোল মার্কা কথা বলে ক্ষেপিয়ে দিলো। মাহতিম যে চুপটি মেরে আছে এখন কি তুলে আছাড় মারবে? মেহনূর তাড়াতাড়ি হন্য হয়ে যেই কিছু বলতে যাবে, ওমনেই দু’হাঁটুর নিচে এক হাত ও ঘাড়ে তলায় অন্য হাত ঢুকিয়ে কোলে তুলে ফেললো মাহতিম। বসা থেকে উঠে দাঁড়াতেই বন্ধ দরজার দিকে আগাতে-আগাতে বললো,

– থাপ্পড় মারলেও কথা বের হয় না, আর এখন জ্বরের মধ্যে কথার খই খুটাচ্ছো। বলি কি, শ্বাশুড়ি আম্মা কি তোমাকে পেটে নিয়ে মৌনব্রত করেছিলো?

কথাটা বলতেই দরজা খুলে বাইরে বেরুলো মাহতিম। খোলা দরজাটা চাপিয়ে দিতেই নিজের রুমের দিকে যেতে-যেতে ফের বলে উঠলো,

– তোমার জন্য মা আমাকে খুব গালাগালি করেছে মেহনূর। ভাবতেও অবাক লাগে, বাবা যাওয়ার পর থেকে মা ওরকম শাসন কোনোদিন করেনি। একদিকে খুশিও ছিলাম, আরেকদিকে দুঃখও লাগছিলো। মেহনূর তোমাকে যত্ন করতে কি কমতি রেখেছিলাম? কেনো ওভাবে সেন্সলেস হয়ে গেলে?

মেহনূর ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো শুধু, কোনো কথা বলতে পারলো না। একে-একে সারিবদ্ধ রুমের দরজাগুলো পেরিয়ে যেতেই হঠাৎ মাঝের একটা দরজা যেনো ফাঁক দেখলো মাহতিম। সেই সরু ফাঁক দিয়ে কেউ যেনো তাদের দেখছে, মাহতিমের অবচেতন মন জানান দিলো মানুষটা কে হতে পারে, তবুও সেদিকে বিন্দুমাত্র ধ্যান না দিয়ে নিজের রুমে ঢুকলো সে। সরু ফাঁকটা এক লহমায় খুলে দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলো অনামিকা, সোনালী লাইটের আলোয় করিডোরে দাঁড়িয়ে সে মাহতিমের রুমটা দেখছে। রাগে দুহাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে নিজের রুমে ঢুকলো, ঠাস করে দরজাটা বন্ধ করতেই ফোন লাগালো। চোখ বন্ধ করে দেয়ালে দু’ঘাত ঘুষি মারতেই ওপাশ থেকে রিসিভ হলো,

– হ্যালো, ঘুমাচ্ছি না? এমন অসময়ে কল দেওয়ার মানে কি? কি হয়েছে অনা?

দপদপ রাগে চোখ বন্ধ করে দাঁত কিড়মিড় করে বললো অনামিকা,
– আনসারী ওর কচি মালকে নিয়ে লুকিয়ে-লুকিয়ে রাত কাটাচ্ছে জানো? জানো না। তুমিতো মুখে চুইংগাম দিয়ে বসে আছো, আমি কিন্তু সহ্য করতে পারছি না ফুপি। আমি যেকোনো সময় বাবাকে কল দিয়ে অঘটন ঘটিয়ে দেবো।

রজনী চোখ কচলে কপাল কুঁচকে বললো,

– তোমার মাথায় কি বুদ্ধি নেই? সবসময় তাড়াহুড়ো কেনো লাগাও? মাহতিম যদি লটরপটর করেই থাকে তাতে তো তোমার সমস্যা হবার কথা না। ও চাইলে আরো দশটাকে সামলানোর ক্ষমতা রাখে, তুমি জাস্ট চুপ থাকো। আমাকে আমার মতো চলতে দাও অনা। প্লিজ!

ক্ষান্ত হলো না অনা, রাগটা প্রশমন না করে গজগজ করে বললো,
– আর কতো চুপ ফুপি? তুমি কি ইচ্ছে করে এই কাণ্ডটা করছো না? আমি কিন্তু এব্রড ফিরতে চাই, শুধু ওই গেঁয়োর বাচ্চাটাকে জঘন্য শিক্ষা দিয়ে ফিরতে চাই। এমন শিক্ষা দিতে চাই যেনো মাহতিম আনসারী ধুকে-ধুকে ক্ষমা চাক্!

ঠোঁট গোল করে নিশ্বাস ছাড়লো রজনী। পুরোনো অতীতটা আরেকটু চাপা দিয়ে শান্ত কন্ঠে বললো,
– তুমি ঠান্ডা থাকো অনা। ভাইজানকে প্লিজ বিরক্ত করতে যাবে না। এমনেই ইলেকশানের জন্য প্রচুর ব্যস্ত হয়ে আছে। এবারের ভোটে যদি জিতে যায়, তাহলে মাহতিমকে নাকানি-চুবানি খাওয়াতে দেরি করবো না। আমি শুধু পাওয়ারটার জন্য অপেক্ষায় আছি, ওকে কোনোভাবেই প্রোফেশনালি হ্যান্ডেল করা যাবে না। তুমি এটা ভালো করেই জানো মাহতিম সবার আড়ালে খুবই ‘ ডেন্ঞ্জারাস পার্সন ‘ বলেই পরিচিত। ওকে টলানো কিন্তু ইজি না। একমাত্র পলিটিক্যাল পাওয়ারটাই ওর মতো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে টলাতে পারবে। আশা করছি তুমি আমার কথাটা বুঝেছো?

রজনীর যুক্তি শুনে শান্ত হলো অনা। সম্মতির সূচকে ফোনটা কেটে বিছানায় শুলো সে। টেবিল ল্যাম্পটা অফ করে চোখ বন্ধ করলো। ঘুমানো খুব প্রয়োজন, ঘুমটা না হলে শান্তি-স্বস্তি-স্বাভাবিক কোনোটাই হতে পারবে না।

.
গেমস খেলতে-খেলতে চোখ দিয়ে পানি পরছে মাহদির। ঘোলা চোখটা কচলাতে-কচলাতে বিছানা থেকে নামলো, ফোনটা ট্রাউজারের পকেটে ঢুকাতেই সোজা পা চালিয়ে মায়ের রুমের সামনে আসলো। দরজা খুলতেই হতভম্ব হয়ে বিরাট বড় হা করলো মাহদি, ঠাস করে হা করা মুখটা দুহাত ঢাকলো সে। ‘ ওমা, আমার বউ কোথায়? ‘ প্রশ্নটা মনে-মনে উচ্চারণ হতেই একদৌড়ে রুম থেকে বেরুলো মাহদি। হনহন করে দৌঁড়ে গিয়ে একদম কাট-কাট ভাবে মাহতিমের দরজায় থামলো, নাক দিয়ে ক্ষেপাটে ষাঁড়ের মতো নিশ্বাস ছাড়তেই দুহাতের থাবা উঁচিয়ে দরজায় বারি মারতে নিলো, দরজায় যেই ভয়ংকর আঘাতটা করবে ওমনেই পেছন থেকে কোমর জড়িয়ে শূন্যে তুলে ফেললো কেউ। মাহদি তাড়াতাড়ি মুখ ঘুরিয়ে দেখলো মানুষটা তৌফ। তৌফ চোখ-মুখ কুঁচকে ভীষণ রাগ নিয়ে ফুসফুস করছে। চার্জারের জন্য সামিকের রুমে যাওয়ার জন্য কেবল দরজা খুলেছিলো তৌফ, চোখের সামনে ফুলস্পীডে মাহদিকে দৌড়ে যেতে দেখে সেও পিছু-পিছু গিয়ে হাজির। মনে-মনে যা ভেবেছিলো, তাই ফলতে দেখে এখন ইচ্ছে করছে ধানের বস্তার মতো ছুঁড়ে আছড়াতে। তৌফের মুখে তাচ্ছিল্যের জায়গায় রাগ দেখে আজ ঠেলেঠুলে হাসি দিলো মাহদি, হিহি করে হাসতেই তোতলা সুরে বললো,

– ব-ব-বউ খুঁজতে এসেছিলাম।

তৌফ চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,

– ওটা তোর বউ? কষিয়ে লাগাবো।

তোতলাতে-তোতলাতে বললো মাহদি,
– ভাভাভা-ইয়ার মানে তো আমার। ভাইয়া বলেছিলো তার যা-যা কিছু আছে, তা-তা আমার।

তৌফ ক্রুদ্ধভাবে বললো,
– তোর বউগিরি কবে ছুটবে বলতো? অসহ্য লাগে না এসব বলতে?

মাহদি হো হো হাসি দিয়ে বললো,
– ম-রলে পরে যাবে তৌফ ভাই। আমি না ম-রা পযর্ন্ত ভাইয়ার কপালে আমার বউকে দেবো না। শী ইজ মাই ওয়াইফ।

হো-হো করে মুখে হাত চেপে হাসছিলো মাহদি। কথাটা শুনতেই কেনো যেনো তৌফের মনটা কামড়ে এলো, সে সমান তালে হাসতে পারলো না আজ।
সোল্লাস হাস্যে মাতোয়ারা মাহদির দিকে নির্লিপ্তে-নির্বিকারে শূন্য মুখে চেয়ে রইলো তৌফ। ধীরে-ধীরে হাত নিচু করে মাহদিকে নামিয়ে দিলো। বিকারহীন দৃষ্টিতে ভেতর থেকে বললো কেউ,

শেষ দেখাটা হলো যেনো,

ফিরবে না এই সময়।

হুট করে হারিয়ে যাবে,

দেখতে পাবো না তোমায়।

– চলমান .

#FABIYAH_MOMO .

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here