#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৪৭.
#ফাবিয়াহ্_মমো .
ভোরের দিকে সমুদ্রের কাছে যেতে অদ্ভুত ভয় পেলো সবাই। কেউ-কেউ সূর্যাদয়ের দৃশ্য দেখতে গিয়ে কাছে যেতে পারলো না, কেমন গা ছমছম শিহরনে পিছিয়ে গেলো তারা। ভোর সকালে ঘুম থেকে উঠেই কনকনে ঠান্ডার ভেতর গোসল সেরে বেরিয়ে পরেছে মাহতিম, সাদা টিশার্টটা পরে ‘ নাইক ‘ ব্র্যান্ডের ট্রাউজার পরে সমুদ্রের বালুকারাশির উপর হাঁটতে থাকে। মন আজ অন্যমনষ্ক নয়, কিন্তু ঘুম ভাঙ্গার পর থেকেই কেমন যেনো আড়ষ্ট বোধ করছে। ‘ কিছু একটা হবে ‘ এমন একটা চিন্তা-মনোভাব-উৎকন্ঠা তার মনের ভেতর ছোটোখাটো টর্নেডোর মতো ঘুরপাক খাচ্ছে। সাদা টিশার্টের উপর নেভি রঙের জ্যাকেট পরা, জ্যাকেটের বাঁদিকে ছোট-ছোট অক্ষরে ইংরেজি বর্ণমালায় সাদা রঙে লেখা ‘ N A V Y ‘. জ্যাকেটটা আজ পরার ইচ্ছা ছিলো না মোটেই, কিন্তু লাগেজ খুলে হাতের কাছে যেটা পেয়েছে সেটাই ছোবল মেরে গায়ে টেনে বেরিয়ে পরেছে। ঠান্ডা-শীতল-হিম বাতাসে তার জেলহীন চুলগুলো থেমে-থেমে উড়ছে, ডিউটিতে পুরোপুরিভাবে ঢুকে গেলে চুলগুলো ছেঁটে ছোট করে ফেলবে, অবশ্য এটাই নিয়ম। নিয়মটা একটু হেরফের হয়ে গেছে এবারের জন্য। হঠাৎ মনে পরলো সে আজ শেভ করতে গিয়েও চোয়ালের নিচটায় হালকা মতোন কেটে ফেলেছে, তবে সেই কাটাটা ছোট্ট ও চিকন ছিলো বলে রক্ত বেরুয়নি। এতটা ছটফট কেনো অনুভব করছে এই প্রশ্নের উত্তর কোনোভাবেই জানা নেই। শেভ করার দক্ষতাটা এতোই নিপুণ যে, দেদারসে বাঁহাত দিয়েও স্বল্প সময়ে ইলেকট্রিক রেজার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে টানতে পারে। দফায়-দফায় এতোগুলো ভুল যে কাকতলীয় ঠেকছেনা, অবচেতন মন যে কোনোকিছুর ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছে, যেটা মূলত ধরতে পারছে মাহতিম। ছয়টা একচল্লিশ বেজে তেত্রিশ সেকেন্ড অতিক্রম করলো এখন। সারারাত ঘুম হয়নি, ক্লান্তির রেশটা এখনো তাকে কাবু করতে পারেনি। মেহনূরকে নিজের রুমে এনে সারাটা রাত ধরে জ্বর নামানোর শুশ্রূষায় লিপ্ত ছিলো, জ্বরের ঘোরে মেহনূরের আবোলতাবোল কথা শুনে কতবার যে দমফাটা হাসি আঁটকাতে হয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সে জানে মেহনূর স্বাভাবিক ও সুস্থরূপে ফিরে এলে আর এভাবে কথা বলবে না, কিন্তু সে মন থেকে চায় মেহনূর নিজের শক্ত খোলসের জড়তাটা দয়াকরে ভেঙ্গে ফেলুক। ফোনটা নিয়ে কল করলো সে, ট্রাউজারের বাঁ পকেটে হাত গুঁজে সমুদ্রের দিকে দৃষ্টি ফেলে তাকালো। কলের বিপরীতে থাকা ব্যস্ত ব্যক্তিটা টাচস্ক্রিনে ‘ M. A. B. ‘ লেখাটা ফুলফর্মে ট্রান্সফার করতেই ‘ Mahtim Ansari Boss ‘ বলে দ্রুত কলটা রিসিভ করলো। সাথে-সাথে কোনো দেরি না করে এম.এ.বি. মানুষটা গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,
– আপডেট দিতে এতো দেরি লাগার কথা না নোমান। তুমি ভালো করেই জানো আমি দেরি জিনিসটা খুবই অপছন্দ করি। দেরিতে উঠেছো নিশ্চয়ই? ডেডবডি থেকে কি ইনফরমেশন পেলে জানাও।
কোনোরকম দ্বিধা ছাড়াই তার ডেষ্কের উপর ফটাফট রিপোর্টটা খুলে গড়গড় করে বলতে লাগলো নোমান। সবটুকু তথ্য শুনে মাহতিম যারপরনাই অবাক, তবুও অবাকের রেশটুকু ভেতরে চেপে নিজেকে স্বাভাবিক করে রাখলো। অজ্ঞাত সন্ত্রাসীর দলটা কোত্থেকে এসেছে এবং কোথা থেকে লিড পাচ্ছে সেসব তথ্য জানা জরুরী। এদের বিশাল নেটওয়ার্ক সম্পর্কে এখনো অনেক কিছু জানা যায়নি, পুরোপুরি একটা বিষয়ে না জানলে এদের সাথে ধাওয়া-পাল্টা খেলা সহজ হবেনা। নোমানের ভাষ্যমতে ট্রেক ডাউন করার পর কেউ একজন গাড়িগুলোতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়, সেই সাথে গুলিবিদ্ধ হওয়া মৃত সন্ত্রাসীদের সমস্ত আলামত সেখান থেকে সটকে দেয়। মাহতিমের স্পষ্ট মনে আছে সে কেবল চারটা গুলি ছুঁড়েছিলো, সেই চারটা গুলির টার্গেট ছিলো পেছন থেকে তিনটা গাড়ির গতিরোধ করা, অথচ আশ্চর্য্যের বিষয় হলো একটা গাড়ির বদলে তিনটা গাড়িই নাকি আগুনে ভষ্ম হয়েছে। তার মানে এটা পরিষ্কার যে, ওই যাত্রায় যারা বেঁচে গেছে, তারাই তাদের সঙ্গীদের আগুনে পুড়িয়ে নাম-নিশানা বিকৃত করে দিয়েছে। সমুদ্রের শো-শো হিমেল হাওয়ায় মাহতিমের চুলগুলো আবার কপাল ছুঁয়ে-ছুঁয়ে দুলছে, তার চোয়াল জোড়া রাগে শক্ত! ভ্রুঁর কাছে নীল রগগুলো ফুলে উঠেছে, পকেটে থাকা হাতটা পাঁচ আঙ্গুলে মুষ্টিবদ্ধ। সামনের যাত্রাটা খুব ভয়াবহ হবে, নির্ঘাত প্রাণে মারাটাই তাদের টার্গেট! কখন-কোথায়-কবে হামলা হবে তার জন্য একচুল অনুমান করা যাচ্ছে না। বিশাল বড় ঝুঁকিতে ঝুলতে যাচ্ছে মাহতিম, তার আগামীর দিনগুলো যে বীভৎস হবে তা নিয়ে সন্দেহ নেই। নিজের উপর যা ইচ্ছা তা আসুক, তারা চাইলে জানে মে’রেই ফেলুক! কোনো ভয় নেই মাহতিমের, শুধু নিজের পরিবার যেনো সহি-সলামত থাকে। সমুদ্রের কাছ থেকে সরে এসে হোটেলের দিকে যেতে লাগলো, নোমানের উদ্দেশ্যে কাট-কাট গলায় বললো,
– আমার জন্য ফোর্স পাঠাতে হবে না। আমি সেফ আছি। আমার জন্য কিচ্ছু দরকার নেই। আমি চাই হোটেল এরিয়ার চারপাশে স্পেশাল ফোর্স পাঠানো হোক। তাদের সিভিল ড্রেসে আসতে বলো, আমি বিকেল পাঁচটার মধ্যে জয়েন করছি। আমার এদিকের কাজ শেষ। নিরাপত্তার ব্যাপারে একটুখানি গাফিলতি দেখলে আমি কাউকে ছাড় দেবো না সোজাসাপ্টা বলে দিলাম!
কল কাটার সঙ্গে-সঙ্গেই নোমান ব্যস্ত হয়ে উঠলো। বসের আদেশ মতো অনেকগুলো কল করে লোকেশন মতো সিভিল টিমকে রেডি হতে বললো। আজই মাহতিম স্বশরীরে ডিপার্টমেন্টে ফিরবে বলে ভোররাতেই লাগেজ গুছিয়ে রেখেছে। মেহনূরের জ্বরটা মাঝরাতেই ছেড়ে দিয়েছে, এবার সে ইচ্ছে করেই হাইডোজের ঔষুধ খাইয়েছে ওকে। হোটেলে ঢুকে রুমের দিকে যেতেই পেছন থেকে মেয়েলি কন্ঠে ‘ এক মিনিট মাহতিম ‘ বলে উঠল কেউ। চমকে উঠলো না মাহতিম। শুধু চলন্ত পাদুটো থামিয়ে দাঁড়ালো, মাথা ঘুরিয়ে পিছনে তাকালো না সে। পেছনের আগন্তক মেয়েটা যে অনামিকা তাতে সন্দেহ জাগার প্রশ্ন উঠেনা। মুখোমুখি এসে হাজির হলো অনামিকা, একজোড়া দৃষ্টি সে মাহতিমের উপর ছুঁড়ে দিয়েছে। গায়ে ঢিলেঢালা অফ-হোয়াইট রঙের সিল্ক নাইটি, সেই নাইটির উপর কালো রঙের শাল জড়িয়ে নিয়েছে। গলাটা এতোই বড় যে, অশালীন কায়দায় বুকের ছোট্ট পোশাকটাও পরিদৃষ্ট। মাহতিম দৃষ্টি সংযত করে অন্যদিকে মুখ ঘুরালো, একচোট তুখোড় গালি ঢোকের সাথে গিলে হাতদুটো পকেটে গুঁজলো। অপ্রস্তুত ঢোক গিলাটা অন্যকিছু মনে করে মিটিমিটি হাসলো অনা, তার উদ্দেশ্যটা সফল হয়েছে ভেবে আস্তে করে মাহতিমের কাছে এসে দাঁড়ালো, আবেদনময়ীর মতো দৃষ্টি বিলিয়ে প্রসন্ন হাসিতে বললো,
– যদি তুমি চাও, দ্যান আই ক্যান এ্যাডোর ইউ মাহতিম।
ইঙ্গিতটা বুঝতেই রাগে চোখ বন্ধ করলো মাহতিম। অনামিকা এতে আরো খুশী, মনে-মনে বিশ্বজয়ীর মতো আনন্দ হতেই গতরাতের ব্যাপার টেনে বললো,
– ছেলেদের কষ্টটা আমি বুঝি আনসারী। তোমাদের সহ্য আর ধৈর্য্য জিনিসটা একেবারেই কম। সুযোগ পেলে আদরের জায়গায় বাঁদর হতে এক সেকেন্ড দেরি করো না। জানিতো আদর খোঁজো। তা তোমার বউ কি তোমাকে হ্যান্ডেল করতে পেরেছে? মানে ওইযে বুঝোই তো, তবে ওর সেন্স কি আছে?
মুচকি করে হেসে দিতেই হঠাৎ পূর্ণচোখে তাকালো অনা। মাহতিমের গাঢ় লালচের ঠোঁটদুটোর দিকে দৃষ্টি যেয়ে ঠেকলো। অতীতের পুরোনো লোভটা কেমন চনমন করে উঠলো আজ, নিশ্বাস-প্রশ্বাসের বেগটা যেনো ভারী হয়ে বুকটায় ধুকধুক করে ছুটছে। লালচে ঠোঁটদুটোকে নিজের অধরযুগলে পাওয়ার এক অদ্ভুত নেশা মনের ভেতর জেঁকে ধরেছে। লম্বা মানুষটার ঠোঁটদুটোর নাগাল পাওয়ার আশায় পা উঁচু করে বদ্ধচোখে এগুচ্ছিলো অনা, সুতীব্র আকাঙ্ক্ষায় মুখ বাড়িয়ে দিতেই সশব্দে ঠাস করে তাক লাগানো শব্দ হলো! বিদ্যুৎপৃষ্টের মতো মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো অনার, চোখে-মুখে সাথে-সাথে অন্ধকার দেখতে পেলো, ডান কান থেকে মৌমাছির মতো ভোঁ-ভোঁ-ভোঁ শব্দ শুনতেই কোথায় ছিটকে পরলো সেই হুঁশ নেই। চোখ ঝাপটাতে-ঝাপটাতে স্পষ্ট দেখার চেষ্টায় ছিলো অনা, কিছু বুঝে উঠার আগেই তার চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে এলো। শরীরটা নিস্তেজ হয়ে ভরহীন অবস্থায় ঠান্ডা ফ্লোরে পরতেই আধো-আধো দৃষ্টিতে দেখতে পেলো একজোড়া পদধ্বনি দাপটের সাথে তার কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে, অনেক দূরে, এরপর সব অন্ধকার।
.
মেঘলা আকাশের বিষণ্ণতা কাটিয়ে পূর্ব দিকে সূর্য উঠলো। সূর্যের গোলাকার অগ্নি চাকাটা চারিদিকে আলো ছড়িয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছিলো। সমুদ্রের বুকে নিজের জৌলুস ফেলে বেশ গরম করছিলো পরিবেশ। সমুদ্রতীরে ভিড় করেছে পর্যটকরা। কেউ পরিবারসহ এসেছে, কেউ এসেছে বন্ধুদল নিয়ে, আবার কিছু-কিছু এসেছে নব দম্পতির মতো হালাল ভ্রমনে। সকাল ন’টার দিকে ঘুমের তন্দ্রা কাটলো মেহনূরের, কঠিন জ্বরটা ছেড়ে গেলেও শরীর থেকে সব শক্তি যেনো টেনে নিয়েছে। ঘুম জড়ানো চোখদুটো আস্তে-আস্তে খুলতেই সোনালী আলোয় ঝলমল রুমটা দেখতে পেলো। ছোট্ট একটা হাই তুলে আশেপাশে কাউকে খুঁজতেই শোয়া থেকে উঠে বসলো। ডানদিকে জানালার উপস্থিতি দেখে দুহাতে পর্দা সরিয়ে দিলো, ওমনেই চোখ ধাঁধিয়ে সকালের সূর্যটা ছুঁয়ে দিলো ওকে। চোখ বন্ধ করে লম্বা নিশ্বাস নিয়ে নাক ও ঠোঁট দিয়ে শব্দ করে নিশ্বাসটা ছাড়লো। চোখ খুলতেই সুন্দর সকালকে মুচকি হাসি দিয়ে অভিবাদন জানাতেই বিছানা থেকে নামলো। সকাল-সকাল মাহতিমের দেখা না পেয়ে সুন্দর সকালটাও ফিকে লাগছে। জ্বরের জন্য ম্যাজম্যাজ ভাবটা কাটানোর জন্য গোসলের উদ্যোগ নিলো, কিন্তু পড়নের কাপড় যে মারজার রুমে সেটা সে জানে। সালোয়ার-কামিজে অভ্যস্থ নয়, খুব ছোট থেকেই মা-বড়মার নির্দেশে শাড়ি পরে বড় হয়েছে। এখন কামিজ পরেও কেমন যে খুঁতখুঁতে লাগছে, কতক্ষণে পালটাবে সেই চিন্তাই যেনো বড় কথা। ঘরের একদিকে বিশাল লম্বা বাদামী রঙের আলমারি দেখতে পেলো। সেখানে নিশ্চয়ই মাহতিমের পোশাক-আশাকের সাথে তোয়ালে রেখেছে! আপাতত ট্যাপের পানির নিচে মাথা ভেজাতে ইচ্ছে করছে ওর, সেই চিন্তাটা চেপে বসতেই আলামারি খুলে হাতের কাছে তোয়ালে পেয়ে গেলো। তোয়ালেটা দুহাতে নিয়ে নাকের কাছে আনতেই পরিচিত ঘ্রাণে ঠোঁটে হাসি ছলকে উঠলো। মাহতিমের ব্যক্তিগত জিনিসে হাত লাগালে অদ্ভুত শান্তি লাগে, মনটা আনন্দে নেচে উঠে! মনেহয় যেনো নিজের দেহের প্রতিটি ভাঁজে-ভাঁজে অস্তিত্বের সাথে মিশে আছে। তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকতেই হঠাৎ ক্লথ হ্যাঙ্কারে দৃষ্টি আঁটকে গেলো। একি! হ্যাঙ্কারে আগে থেকেই শাড়ি-ব্লাউজ-পেডিকোট ঝুলছে? আশ্চর্যে নাস্তানাবুদ হতেই ক্লথ হ্যাঙ্কারের শাড়িটা দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলো মেহনূর। মাহতিম আনসারীর দূর্ধর্ষ চিন্তা ও উপস্থিত বুদ্ধি দেখে একবুক ভালোবাসায় শিউরে উঠলো। হালকা বেগুনী রঙের সুতির শাড়ি, লাল টকটকে মোটা পাড়, শাড়ির পাশে মখমলের লাল ব্লাউজ দেখে মিচকি হাসিতে মাথাটা ডানে-বামে দুলালো মেহনূর। অসভ্য লোক তো দেখি সবই ব্যবস্থা করে গেছে।
.
নাস্তা খেতে বসে সবার মুখের অবস্থা করুণ। চিন্তায় কারোর গলা দিয়ে পানি পযর্ন্ত নামছেনা।কি হবে, না হবে সেটা নিয়ে চিন্তা করলেই মাথা কাজ করেনা। টান-টান উত্তেজনার ভেতর রুক্ষ মুখে বসে আছে সবাই, একটু আগে জানতে পরেছে অনাকে করিডোরের কাছ থেকে সেন্সলেস অবস্থায় পাওয়া গেছে। তার অবস্থা খুবই খারাপ, রীতিমতো হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গুরুতর দশা। কিভাবে ওই অবস্থা হয়েছে সেটা অবশ্য সৌভিকরা ছাড়া কেউ জানে না। হোটেলের দু’জন স্টাফ একই ফ্লোরের অন্য রুমে বেড-টি নেওয়ার সময় ঘটনাটা স্বচক্ষে দেখে ফেলে, তাদের কাছ থেকে টোপ ফেলে জেনে এসেছে সিয়াম। আপাতত ওই স্টাফদের টাকার জোরে মুখ বন্ধ করে এসেছে, ভুলেও এ খবর যেনো অন্য কারো কানে না যায় সেটাও পরিষ্কার ভাবে বলা শেষ। ভয় শুধু একটাই, নিরব বাঘিনী যেনো এ বিষয়ে না জানে। কোকের বোতলে ছোট্ট চুমুক দিয়ে বিমর্ষ কন্ঠে বললো তৌফ,
– মাহতিম যাই করুক আমার আপত্তি নাই। কিন্তু অনার ম্যাটার আইলে রে ভাই আমি বহুত টেনশনে থাকি।
তৌফের কথায় যোগ করে শান্ত কন্ঠে বললো সৌভিক,
– শুধু তুই না, আমরা সবাই থাকি। তোর কি মনে হয় বলতো, রজনী যে চুপ মে’রে আছে এই মহিলা কি কিছু প্ল্যান করে এসেছে?
সৌভিকের কথাটা চট করে টেনে নিলো নীতি। নিশ্চিত গলায় বললো,
– প্ল্যান করেই এসেছে। নাহলে আমাদের সাথে শুধু-শুধু তো সী-বিচ দেখতে আসতো না।
নীতির কথার পর চুপ রইলো সবাই। সবার মন যেখানে একীভূত হয়ে চিন্তায় ডুবে আছে, তখনই গেমস খেলায় ব্যস্ত মাহদি দাম্ভিকতার সুরে বললো,
– মাহতিম ভাইয়ার শার্প মাইন্ডের কাছে এইসব ফাউল প্ল্যান টিকে না।
সবাই চকিত ভঙ্গিতে চমকে উঠতেই সাথে-সাথে মাহদির দিকে তাকালো। যেই আত্মবিশ্বাস, যেই দৃঢ়তা, যেই প্রবল চেতনার সাথে মাহদি কঠিন কথাটা সত্যটা বলে উঠলো তাতে সবাই বেশ অবাক! খাপে-খাপ মাহতিমের মতো মাহতিমের ভাবসাবে কথাটুকু বললো সে, বিষ্ময়ের ঘোরে সবাই এখন মাহদির দিকে তাকিতে আছে। আড়চোখে সবার দৃষ্টি লক্ষ্য করে লজ্জা পেলো মাহদি, গেমটা পজ্ করে দুই ভ্রুঁ কঠিন করে কুঁচকে বিব্রত গলায় বললো,
– আমি কি লজ্জা পাই না? আমার দিকে এভাবে তাকাও কেনো? আমিতো একটু-আধটু ভাইয়াকে দেখে শিখি। ভাইয়া বুড়া হলে আমার তো মেহনূরকে বিয়ে করা লাগবে। এজন্য, এখন থেকে ট্রেনিং নিচ্ছি। বুঝছো সবাই?
মাহদির উটকো কথা শুনে কয়েক মিনিট শক্ত মুখে নিরব রইলো সবাই। সবার গম্ভীর মুখের অবস্থা দেখে মাহদি ইতস্তত ভঙ্গিতে চোখ নামালো, এক মূহুর্ত যেনো সুনশান! এরপর হো-হো হাসির কলরব ফেটে পরলো রুমের ভেতর । হাসতে-হাসতে সবাই তখন একই সুরে বলে উঠলো,
– চুপ কর বা’টপার!
.
ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়ালো মেহনূর, মাথা থেকে ভেজা তোয়ালেটা খুলে চুলগুলো ঝাড়া দিলো। টপটপ করে বৃষ্টিফোঁটার মতো বিন্দু কণা ফ্লোর জুড়ে পরলো। ওয়াশরুমে শাড়ি পরতে গেলে পানিতে শাড়িটা ভিজে যেতো, বাধ্য হয়ে শাড়ি হাতে রুমে আসতে হয়েছে। মাহতিম এখনো রুমে নেই, স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে আয়নার সামনে দাঁড়ালেও মনটা শান্তি পেলো না। কোথায় গেছে লোকটা? একবার কি বলে যাওয়া যেতো না? এখন যে একপলক দেখার জন্য অসহ্য রকম অস্থির লাগছে সেটা কি করে বোঝাবে? লাল পেডিকোটের ভাঁজে-ভাঁজে শাড়িটা গুঁজে নিতেই বুকের উপর আঁচলের কাপড়টা টেনে নিলো, মাথাটা একটু ঝুঁকিয়ে পেটের কাছে কুচির জন্য থামলো মেহনূর। দক্ষ হাতের আঙ্গুলে কুচির ভাঁজগুলো ঠিক করছিলো সে, একটা-দুটা-তিনটা করে ভাঁজযুক্ত কুচিগুলো ক্রমাগত আঙ্গুলে ধরছিলো, মাথা নত অবস্থায় ঠিক করা কুচিগুলো পেটের কাছে যেই গুঁজবে, ঠিক তখনই গা কাঁটা উঠলো ওর! পেছন থেকে একজোড়া হাত এসে চোখের পলকে পেটের উপর আষ্টেপৃষ্টে আঁকড়ে ধরলো। নিশ্বাস আঁটকে যেনো স্থির হয়ে আছে মেহনূর, হাত থেকে এক-এক করে সবগুলো কুচি ফস করে ফ্লোরে পরলো। পিঠের উপর সুঠাম বুকের সান্নিধ্য টের পেলো, কিছুক্ষণ পর অনুভব করলো পিঠের উপর চুলগুলো বামে সরে যাচ্ছে। নত দৃষ্টিটা চট করে বন্ধ করলো মেহনূর, নিশ্বাস আঁটকে রাখার কারণে প্রাণবায়ুটা বুকের ভেতর ফুরিয়ে আসছে। মেহনূরের নিশ্বাস না নেওয়ার পরিস্থিতিটা দেখে পেছনে থাকা মানুষটা মৃদ্যু শব্দে হাসলো। হাসি দিয়েই বললো,
– মুখটা তুলো মেহনূর। একটু তো লজ্জাখানা মুখটা দেখি।
মাহতিমের কথায় আরো কুঁকড়ে গিয়ে চোখ খিঁচে রইলো, ভুলেও মাথা তুললো না মেহনূর। লজ্জায়-কুণ্ঠায় মাথা নুইয়ে রাখলে ওর ডান কাধটায় থুতনি রাখলো মাহতিম। আদরে-আহ্লাদে চোখ বন্ধ করে মৃদ্যু স্বরে বললো,
– বিকেলে চলে যাচ্ছি। মন খারাপ কোরো না, পরেরবার অনেকদিনের জন্য আসবো।
চট করে চোখ খুললো মেহনূর, মাথাটা স্বাভাবিক ভাবে তুলতেই মুখটা ডান কাধের দিকে ফিরাতে নিলো, পারলো না। মাহতিমের গরম নিশ্বাসটা মেহনূরের গাল ছুঁয়ে থামিয়ে দিলো। উদ্বিগ্ন কন্ঠে মেহনূর এবার ঠিকই মুখ খুললো,
– চলে যাচ্ছেন মানে?
চোখ খুললো মাহতিম। আয়নায় এবার মেহনূরের পাশাপাশি সেও একদৃষ্টিতে তাকালো। পেটের উপর হাত বুলাতে-বুলাতে বললো,
– আমি থাকলে যে ‘ আব্বু-আম্মু ‘ ডাকার দলবল এসে পরবে।
এমন ভয়াবহ কথা শুনে কপট রাগ দেখাতে গিয়ে খিলখিল করে হেসে ফেললো মেহনূর। সেই হাসিতে কোনো জড়তা নেই, ভয় নেই, সঙ্কোচ নেই। হাসতে-হাসতে পেটের উপর মাহতিমের হাতের উপর নির্বিঘ্নে হাত রেখে দিলো মেহনূর, মুখটা ডানে ঘুরিয়ে মাহতিমের দিকে তীর্যক চাহনিতে বললো,
– আপনাকে আমি বাধা দেইনি। কালরাতেও মোক্ষম সুযোগ ছিলো। আপনিই সবসময়ের মতো দূরত্ব রেখে চলেছেন।
কথা শুনে কিছুক্ষণ নির্বাক রইলো মাহতিম। একদৃষ্টিতে মেহনূরের দিকে তাকিয়ে থাকতেই বোঝার চেষ্টা করলো কোনো কল্পনা করছে কিনা। মেহনূর ব্যাপারটা বুঝতে পেরে পেটের উপর থেকে হাত সরিয়ে মাহতিমের দিকে ফিরলো। কালো শার্টের ফোল্ডেড স্লিভের হাতদুটো টেনে এনে কোমরের দুপাশে রেখে দিলো। বিমূঢ় মাহতিম অবাকের রেশ না কাটাতেই আলতো সুরে ধীরে-ধীরে বললো,
– তুমি কি কালরাতে হুঁশে ছিলে?
মেহনূর ছোট্ট একটা নিশ্বাস ছেড়ে চোখে-চোখে রেখে বললো,
– আপনি যে আমার ঠোঁটে চুমু খেয়ে লাভ ইউ বলেছেন ততক্ষণ পযর্ন্ত ছিলাম।
আরেক দফা আশ্চর্য হয়ে হাসি-হাসি চোখে তাকালো মাহতিম। দুহাতে মেহনূরের গালদুটো ধরে নিচু স্বরে বললো,
– তুমি কি তাহলে একটুও বেঁহুশ ছিলে না?
মেহনূর একটুক্ষণ চুপ থেকে স্থির চোখে তাকিয়ে রইলো। মাহতিমের গভীর চাহনির অতল স্পর্শে নিজেকে সমর্পণ করে হালকা গলায় বললো,
– আপনার কোলে যখন মাথা রাখলাম, আপনিও চিৎকার করতে-করতে পানিপট্টি দিতে লাগলেন তখন আমার হুঁশ ছিলো না। অন্ধকার দেখছিলাম।
চোখ বন্ধ করলো মাহতিম। বুকভর্তি নিশ্বাস ছেড়ে আবার চোখ বন্ধ অবস্থায় বললো,
– একটু ভয় পেয়েছিলাম।
ফিক করে হাসলো মেহনূর। সরল গলায় বললো,
– একটু ভয় পেলে বুঝি ওভাবে পাগলের মতো চিৎকার করে?
চোখ খুলে প্রসন্ন চাহনিতে হাসলো মাহতিম, শান্ত কন্ঠে বললো,
– তোমাকে কাছে যে পুরো আমিটাই তুলে দিয়েছি। তোমার কিছু হলে এই আমিটা টিকবে? ভণ্ডুল হয়ে যাবে না? আমার উপর কতকিছুর চাপ যায় জানো? একটা ভুল করলে দেশের মধ্যে ধ্বং’সাত্মক অবস্থা হবে। খুব ভয় পেয়েছিলাম মেহনূর। ভয়ের ব্যাখ্যা কোনোদিনই ঠিকঠাক মতো বলতে পারবো না।
গালের উপর থেকে আস্তে করে দুহাত সরালো মেহনূর। এহেন কান্ডে একটু চমকালো মাহতিম। পরক্ষণে দেখতে পেলো মেহনূর উলটো তার গালদুটোই আদুরে হাতে ধরলো। আবদার সূচকে বললো,
– মুখটা একটু নিচে নামাবেন?
শীতল চাহনিতে তাকিয়ে থাকতেই মাথা নেড়ে সায় দিলো মাহতিম। মেহনূরের নাগাল বরাবর মুখটা নিচু করতেই দেরি করলো না মেহনূর, চোখ বন্ধ করে লালচে অধরযুগল নিজের ঠোঁটের ভাঁজে মিলিয়ে নিলো। ক্লিন শেভের ডানগাল থেকে হাত সরিয়ে ছোট করে ছাঁটা চুলের উপর রাখলো। দূরে যাওয়ার বিষণ্ণ সুর যেনো কাঁদিয়ে দিচ্ছিলো মেহনূরকে, নিজের চোখদুটোকে সংযত করতে গিয়ে ভুলবশত দাঁত শক্ত করলো ও। কিন্ঞ্চিৎ ব্যথায় মাহতিমের বন্ধ চোখদুটো খিঁচুনি দিয়ে পুনরায় স্বাভাবিক হয়ে গেলো। মাহতিম আজ বারবার-হাজারবার-দফায়-দফায় অবাক হলেও দারুণ খুশীতে-আনন্দে-আবেগে মেহনূরকে বুকের সাথে মিশিয়ে রাখলো। দুহাতের পাঁচটা আঙ্গুলে খামচে পিঠের মখমলের লাল ব্লাউজটা ধরলো। চোখ খুলে আজ দেখতে পেলো, কান্নায় লাল নাক ফুলে-ফুলে উঠছে, চোখের বড় বড় পাপড়ি চুয়ে পানি গড়িয়ে পরছে।
– চলমান .
#FABIYAH_MOMO
নোটবার্তা : ত্রুটিটা বিরাট ছিলো বলেই বাধ্য হয়ে এর আগের পর্বটা ডিলিট দিয়েছিলাম। বর্তমানে ঠিক করা হয়েছে। বিড়ম্বনার জন্য দুঃখিত। 💔